Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্বাধীনতা-উত্তর শেখ মুজিব ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ

শেখ মুজিবুর রহমান | রাজনীতিক

আহমাদ মাযহার

 



প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক, সম্পাদক

 

 

 

স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রের চার মূলনীতির একটি হিসেবে গ্রহণ করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। এই নীতির বাস্তবায়ন হিসেবে নিষিদ্ধ হয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। কিন্তু উনিশশো পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্টে তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে নেয় তারা রাষ্ট্রাচার থেকে বাতিল করে সেই নীতি, অর্থাৎ নির্বাসন ঘটায় স্বাধীনতা সংগ্রামের যে মূল্যবোধ গোটা দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল তার অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে শেখ মুজিব নামটিই ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। কয়েক বছর টানা সামরিক শাসনে থাকার পর সীমিত দলীয় রাজনীতি শুরু হলে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। আওয়ামী লীগের সূত্রে বা ইতিহাসের অনিবার্যতায় তাঁর নাম কোথাও উচ্চারণ এড়ানো অসম্ভব হলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা গণমাধ্যম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকার সূত্রে তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষে চলত একতরফা রাজনৈতিক ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে কেবল তাঁর নিন্দা; প্রকৃত অনেক তথ্য আড়াল করে ক্ষমতাসীনদের চাওয়া অনুসারে এমন সব উপাত্ত হাজির করা হত যাতে মানুষের মনে তাঁকে নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। সে সময় শেখ মুজিবের প্রতি সমর্থন ছিল কেবল সচেতন ও ওয়াকিবহাল মানুষের মনে। দেশের বিদ্বৎসমাজে তিনি যে একেবারে উচ্চার্য ছিলেন না তা নয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের বাধায় তাঁদের কথার ধ্বনি ছিল অনেকটাই ক্ষীণ। আওয়ামী লীগ ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী কিছু সীমিত সাংগঠনিক প্রয়াসীদের সক্রিয়তায় আয়োজিত উদ্যোগ ছাড়া তাঁর সম্পর্কে তেমন আলোচনা হত না। সকল পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মূল্যবোধ সম্পর্কে নানা ক্ষেত্রে উপস্থাপন করা হত ভিন্ন বয়ান। ১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তাদের সর্বাত্মক প্রয়াসে শেখ মুজিব সম্পর্কে প্রচুর বিভ্রান্তি ছড়ায়। এর প্রভাবে বেশ কিছুকাল তরুণ প্রজন্মের বিরাট সংখ্যক মানুষও ছিল তাঁর সম্পর্কে অনাগ্রহী। এই পটভূমিতেই গণতন্ত্র প্রত্যাশী দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ১৯৯০-এ তৎকালীন এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু ঐ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও এর ছাপ পড়ে;  নির্বাচিত হয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াতে ইসলামি ও অন্যান্য ইসলামি সাম্প্রদায়িক দলের সমন্বয়ে গঠিত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। সামরিক শাসনামলে সামরিক বাহিনির ছত্রছায়ায় প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ বিরোধী বিভিন্ন দলছুট ও সুবিধাবাদীদের সমন্বয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা পায়। ফলে অনুভব করা যায় যে, নির্বচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও দীর্ঘ সামরিক স্বৈরাচার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে ধরনের বয়ান চালু রেখেছিল তার কোনও পরিবর্তন হবে না। শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিরুদ্ধে যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনার পর তৎকালীন সরকার জারি করেছিল তা বাতিলের সম্ভাবনাও আর থাকে না। যদিও আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলে থাকায় এবং এই দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংসদ জাতীয় সংসদে থাকায় শেখ মুজিব প্রসঙ্গ কিছুটা আলোচিত হতে পারে। ফলে শেখ মুজিব সম্পর্কিত তথ্যপ্রবাহেরও কিছুটা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কিন্তু ইতিহাসের প্রয়োজনে শেখ মুজিব চর্চার চেয়ে শেখ মুজিব চর্চা হতে থাকে সমকালীন রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য মৃত শেখ মুজিবও থাকেন জীবিতের মতোই প্রাসঙ্গিক। এখনও পরিস্থিতি অনেকটা এমনই রয়েছে!

১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় আওয়ামী লীগ আবার জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়; শেখ মুজিবের নিহত হওয়ার ২২ বছর পরে সেবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেত্বত্বে সরকার গঠন করে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাঁর সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের একটি চরম অন্যায়ের প্রতিকারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার বিএনপি-জামায়াত জোট জয়লাভ করলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হওয়া সত্ত্বেও মুজিব হত্যার বিচারের কাজ অগ্রসর হয় না। বিএনপি-জামায়াত সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত আইনের সুবিধা নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। পরিস্থিতির সুযোগে সামরিক বাহিনির সমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরি অবস্থা জারি করে ৯০ দিনের স্থলে প্রায় দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করে। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থিত জোট। এর পর থেকে দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় মুজিব হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এইসব মামলার সূত্রে শেখ মুজিবের প্রকৃত কৃতি বহু মিথ্যা অপপ্রচার অতিক্রম করে সামনে আসতে থাকে। ফলে তরুণ প্রজন্ম আড়ালে থাকা অনেক কিছু জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিব সম্পর্কে। অন্তর্জালে তথ্যপ্রবাহের উন্নতি হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বহু সূত্র উন্মুক্ত হওয়ায়ও তাঁর সম্পর্কে অজানার আড়াল কাটিয়ে ক্রমশ ভাস্বর হয়ে উঠতে থাকেন তিনি। স্বাধীনতা-উত্তর কালের শেখ মুজিব গৃহীত পদক্ষেপগুলোও আলোচনায় আসে কিছুটা। এখন শেখ মুজিব সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সহজলভ্য; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর জীবনের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পর্ব যতটা আলোচিত হয় মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর পর্ব নিয়ে ততটা হয় না। অথচ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার জন্য শেখ মুজিবের রাষ্ট্র পরিচালনার কালও খুব গুরুত্বপূর্ণ!

শেখ মুজিবের জীবনের প্রথম পর্ব, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পর্ব পর্যালোচনা করতে গেলে লক্ষ করা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে শেখ মুজিবের আবির্ভাব এমন একটা সময়ে যখন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে সমাজের অধাসামন্ত বা ধনী অংশের প্রতিনিধিত্বের পর্ব অতিক্রম করে মধ্যবিত্ত অংশের প্রতিনিধিত্ব শুরু হয়ে গেছে। ততদিনে অখণ্ড বাংলার রাজনীতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি, আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ রাজনীতিবিদ। তরুণ রাজনীতিক হিসাবে শেখ মুজিব ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছেন এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি ও আবদুল হামিদ খান ভাসানীর। সুতরাং বলা চলে মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার বলয়ে তাঁর বিকাশ। কালক্রমে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, দূরদৃষ্টি, সাংগঠনিক যোগ্যতা, বাগ্মিতা, দুঃসাহস, অত্যাচার-নির্যাতনের মুখেও অনমনীয় থাকা ইত্যাদি গুণের সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এই রাজনীতির প্রধান নিয়ন্তা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক-মানুষ। কীভাবে তিনি এমন পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে উঠেছিলেন তার গভীরতর পরিচয় সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত তাঁর রচিত তিনটি বই থেকে পাওয়া যায়। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন শত্রুর কারাগারে বন্দি। তা সত্ত্বেও তিনিই ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালি জাতির নেতা। একটা সময় এমন হয়েছিল যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর ভাবমূর্তি এত উঁচুতে উঠেছিল যে, অধিকাংশ বাঙালি মনে করত তিনিই সকল মুশকিল আসান। সে সময় তাঁর প্রতি বর্ষিত হত কেবল স্তুতিবাক্য। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল ঘুর্ণাবর্তে পড়ে শেখ মুজিব সর্বার্থে সফল হতে পারেননি। মানুষের প্রত্যাশা যতটা দ্রুত চূড়ায় উঠেছিল হতাশাও পাতালে নেমে আসছিল ততটাই দ্রুত। কিন্তু অতিপ্রত্যাশা বা অতিহতাশা কোনওটাই প্রকৃত বাস্তবের অনুকূল নয়। সব ক্ষেত্রেই মহৎ মানুষেরা উত্তরকালে বিবেচিত হয়েছেন বাস্তবতার নিরিখে। শেখ মুজিবের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই।

১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি এবং এর কাছাকাছি সময়ে তাঁর ভাবমূর্তি ছিল সবচেয়ে উচ্চে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন তাঁকে হত্যা করা হয় তার কাছাকাছি সময়ে তাঁর ভাবমূর্তি নিচের দিকে নেমে এসেছিল। এর কারণ অনেকটাই ছিল জাতীয় রাজনীতির জটিলতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তখন প্রায় শূন্য কোষাগার নিয়ে লড়াই করছে। রাজনীতির জটিলতায় কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যর্থতা থাকা স্বাভাবিক। এর সঙ্গে পাকিস্তানপন্থী ও বামপন্থী উভয় ধারার বিরুদ্ধবাদী তৎপরতার যোগ ঘটে প্রবলভাবে। তাঁর হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত উত্তরকালে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী অধিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাদের দ্বারা সৃষ্ট গুজবের মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে তাদের একচেটিয়া বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় তাঁর মৃত্যূত্তর কালেও ভাবমূর্তির এই পতন অব্যাহত ছিল।

পরাধীন দেশে দূরদৃষ্টি ও সাফল্যজনক সাংগঠনিকতার ফলে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমশ স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। পরিণতিতে বাঙালি পেয়েছিল স্বাধীন দেশ। সে হিসাবে তাঁর জীবনের সাফল্যের প্রথম অধ্যায়কে বিজয়ের পর্ব হিসাবে অভিহিত করা যেতে পারে। স্বাধীনতা উত্তরকালে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর নেওয়া কৌশলগত ও সাংগঠনিক অধিকাংশ পদক্ষেপকে হয় পরিত্যাগ করা হয়েছে না হয় করা হয়েছে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত। সপরিবারে নিহত হওয়ায় তাঁর গৃহীত কর্ম পরিকল্পনা নিজের দ্বারা নির্দেশিত পথে যে চলতে পারেনি এটা তো তাঁরই পরাজয়জনিত ব্যর্থতা! সুতরাং তাঁর জীবনের এই পর্বকে ব্যর্থ পর্ব বা পরাজয়ের অধ্যায় বলে অভিহিত করা যায়। এই ব্যর্থতার ফলে তাঁর মৃত্যূত্তর বাংলাদেশ যে নতুন এক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। অবশ্য এ-কথাও ঠিক যে নতুন রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো উত্তরকালে তাঁর হাতে কতটা সাফল্য পেত বা কতটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হত তা বিচার করে দেখবার পর্যাপ্ত সুযোগ বাংলাদেশের মানুষ পায়নি।

মানতেই হবে যে শেখ মুজিবের সমগ্র রাজনৈতিক জীবনের দুটি পর্বই ছিল চরমভাবে সংগ্রামসঙ্কুল। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য তাঁর জীবনের বিজয়ী ও পরাজিত এই দুই সংগ্রামশীল পর্বকেই বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এই বিচারকে হতে হবে নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর জীবন যেমন অবিচ্ছেদ্য তেমনি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের স্বার্থের সঙ্গেও। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থে তাঁর জীবনকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না এই সত্য না মেনে উপায় নেই। সে কারণে তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক বই, ভবিষ্যতে আরও হবে। এই দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মিল রয়েছে। বাঙালির সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের অবদান যতটুকু তুলনায় বিশ্বব্যাপী বাঙালির জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবদান তারও চেয়ে বেশি। দীর্ঘকালব্যাপী নানা অপপ্রচার সত্ত্বেও সাম্প্রতিক কালে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান বিবিসির বিশ্বব্যাপী বাঙালিদের মধ্যে পরিচালিত জরিপেও তাঁর নাম শীর্ষদেশে থাকার মধ্য দিয়ে এই সত্যটিই যেন পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের আগের পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছর ধরে তাঁর রাজনীতিক সত্তার বিকাশ। তবে সমকালীন প্রবীণতর নেতাদের ছাড়িয়ে শেখ মুজিবের নাম শীর্ষে আসে ষাটের দশকে তাঁর নেতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুর পর থেকে। তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে সত্যিকারভাবে নাড়া দিতে পেরেছিলেন ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। সে সময় ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট’ (এনডিএফ) নামে স্বৈরাচারী আইয়ুববিরোধী ঘরোয়া রাজনীতি চলছিল। হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি ছিলেন এনডিএফের নেতা। ১৯৬৩ সালের দিকে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে। কিন্তু হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি, আতাউর রহমান খান, নুরুল আমিন প্রমুখ প্রবীণ নেতা রাজনৈতিক দলসমূহের পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না। তাঁদের যুক্তি ছিল ফ্রন্ট ভেঙে রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন ঘটলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষতি হবে। শেখ মুজিবের নেতা সোহরাওয়ার্দিও এই মত পোষণ করতেন। শেখ মুজিব তাঁকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা  করেন। এমনকী লন্ডনে চিকিৎসারত নেতাকে বোঝাবার জন্য তিনি লন্ডন পর্যন্ত যান। সোহরাওয়ার্দি রাজি না হলে তিনি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দি মৃত্যুবরণ করলে এনডিএফ-এর নেতৃত্বে সঙ্কট দেখা দেয়। তখন, ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের বাড়িতে অনুষ্ঠেয় সভায় আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। এখানে যে তিনি দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন তার প্রমাণ মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে মওলানা ভাসানী ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাঁদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপও পুনরুজ্জীবিত করা সঙ্গত করেন। আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় নেতা হিসাবে শেখ মুজিবের শীর্ষ অবস্থান সংহত হয়। দলের পুনরুজ্জীবন সমর্থন না করে আতাউর রহমান খান পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়ায় অংশ নেননি। তিনি শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেন। এর পর থেকে শেখ মুজিব সমগ্র বাংলাদেশ সফর করেন। দলকে সংগঠিত ও সংহত করেন। আনাচেকানাচে দেশের মানুষের মনোভাবের সঙ্গে স্বয়ং গভীরভাবে পরিচিত হন। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন নিজের ভাবনা দ্বারা। ইউনিয়ন পর্যায়ে, গ্রাম পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সকল মানুষকে তিনি স্মৃতিতে নিয়ে নেন। প্রকৃতপক্ষে সেই সময়ই তিনি পরিণত হয়ে উঠতে থাকেন জাতীয় নেতায়। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পটভূমিও তখনই গড়ে ওঠে। ছয় দফা ঘোষণা হয়ে গেলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে তা হজম করা ছিল অসম্ভব। ছয় দফা নিয়ে নানা অপপ্রচারের আশ্রয় নেয় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু শেখ মুজিব তো পিছপা হনই না উল্টো মানুষের কাছে ছয়দফার দাবিকে আরও পরিষ্কারভাবে ব্যখ্যা করতে থাকেন। বলা যায় এই ছয় দফাই তাঁকে অন্যান্য প্রবীণ জাতীয় নেতা থেকে, যথা মওলানা ভাসানী বা আতাউর রহমান খান প্রমুখের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়ে যায়। তার পরে তাঁর ওপর নেমে আসে আইয়ুবশাহী নির্যাতন। তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় ষড়যন্ত্রমূলক মামলায়। কিন্তু এতেও তাঁর ভাবমূর্তি কমে না বরং বাড়ে। জেলখানায় যে আত্মজীবনী লিখছিলেন তাতে তাঁর রাজনৈতিক সত্তার এই মনোভঙ্গিই প্রবহমান ছিল যে, তিনি বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান।

জীবনের প্রথম পর্বে অর্থাৎ ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি একের পর এক এমনভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে থাকেন যে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। ৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর তাঁর পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিপ্লবী ভাবনার অনেকেই মনে করেন ওইসময় তাঁর উচিত ছিল পালিয়ে যাওয়া ও সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া। যাঁরা এমনটি মনে করেন তাঁরা লক্ষ করেন না যে, যদি শেখ মুজিব ভারতে আশ্রয় নিতেন তাহলে বাধ্য হতেন ভারতীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে। মওলানা ভাসানী বা মণি সিংহ বা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো প্রায় বন্দিজীবন কাটাতে হত তাঁকেও, পাকিস্তানের সঙ্গে দরকষাকষি সম্ভব হত না বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। কিন্তু শত্রুর কারাগারে থাকায় তিনি পরিণত হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীকে। বিশ্বনেতাদের দৃষ্টিও ছিল তাঁর দিকে! ফলে আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে ভারত সরকারকে তাঁর মুক্তি দাবি করতেও সুবিধে হয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যেও জেগে উঠেছে অনমনীয় মুক্তির আকাঙ্খা। তাঁর মুক্তির দাবিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতি। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে একই সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত পরিপক্বতার পরিচয় পাওয়া যায়। যুদ্ধশেষে মুক্তির ঠিক আগে তাঁকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গোছের একটা সম্পর্ক বহাল রাখার জন্য। তখনও তাঁর স্পষ্টভাবে জানা ছিল না দেশ স্বাধীন হয়েছে কিনা। তিনি বলেছিলেন, জনগণের সঙ্গে কথা না বলে তিনি কোনও আলোচনায় যেতে রাজি নন। এই ক্ষেত্রেও তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় মেলে। মুক্ত মুজিবকে নিয়ে বিমান উড্ডীন হলে তিনি কোথায় যেতে চান জানতে চাওয়া হলে তিনি দিল্লি না গিয়ে তৃতীয় নিরপেক্ষ স্থান লন্ডনে যাওয়ার কথা বলেন। দেশে ফেরার পথে তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতিকালে ইন্দিরা গান্ধি তাঁকে উপহার হিসাবে কী পেলে তিনি খুশি হবেন জানতে চাইলে শেখ মুজিব বাংলাদেশ থেকে আবিলম্বে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার চান। এই ঘটনাটিকে শুধু দূরদর্শিতা বললে কম বলা হবে। কারণ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার এটিও ছিল একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব। ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর সংবিধান রচনায় বিলম্ব ঘটবার কারণে নানা সাংবিধানিক সঙ্কটে পড়েছিল পাকিস্তান। শেখ মুজিব সে-কথা ভোলেননি বলেই দ্রুত সংবিধান প্রণয়নে যত্নবান হন। ড. কামাল হোসেনকে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন তাঁর সংবিধান-বিশেষজ্ঞতার কারণে। তাঁর এইসব সিদ্ধান্তের মধ্যে একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কেরই পরিচয় পাওয়া যায়।

স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর নেওয়া অনেক সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট সময় তাঁকে দেওয়া হয়নি, কিন্তু ব্যর্থতার দায় চাপানো হয়েছে। তাঁর যে-সব পদক্ষেপ ভুল বলে অনেকের মনে হয় সে-সবের তিনি কী কী অদল-বদল বাস্তবতার নিরিখে করতেন তাও আজ আর কারও জানার উপায় নেই। এইসব কিছু বিবেচনার জন্যই তাঁর চিন্তা ও কর্মের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন জরুরি। তাঁর হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলেও, এখনও তাঁর মৃত্যুর অভিঘাত মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি; এখনও তাঁর মৃত্যুজনিত সুবিধাভোগীরা নানা বাস্তবতায় রাষ্ট্রক্ষমতার আশেপাশেই রয়ে গেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাষ্ট্র পরিচালনা সূত্রে শেখ মুজিব এখনও এতটাই প্রাসঙ্গিক যে তাঁর জীবনের রাজনীতিনিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন এখনও অনেক দুরূহ।

সপরিবারে নিহত হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে সরকার ব্যবস্থায় তিনি যে পরিবর্তন আনেন তা নিয়ে যে বিতর্ক আছে তাতেও রয়েছে রাজনৈতিক বাস্তবতা। বাকশাল ও একদলীয় ব্যবস্থাকে নিয়ে তাঁর মৃত্যূত্তর এত সমালোচনা হয়েছে যে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা সরকারে থাকলেও সরাসরি শেখ মুজিবের গৃহীত বাকশাল কর্মসূচি নিয়ে স্পষ্টভাবে এগিয়ে চলেননি রাজনৈতিক বাস্তবতার বিবেচনা থেকেই। অন্যদিকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে অন্যান্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পথ ধরেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। ফলে অবকাঠামো সহ বহু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য দৃশ্যমান হলেও সমাজে বৈষম্যও বেড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেও স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের সরকার পরিচালনা বা ভবিষ্যৎ অভিমুখিতা নিয়ে আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা হওয়া জরুরি। কারণ শেখ মুজিব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন সব সময়! তিনি মনে করতেন, ‘এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন মানুষের উপর মানুষের শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ [‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ.২৩৪]। রাষ্ট্রের মূলনীতির এক নীতি হিসেবে তাই তিনি সমাজতন্ত্রকেও গ্রহণ করেছিলেন। বাকশাল গঠনের পর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকেই তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি, সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোনও জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপোর্ট করে এনে কোনও ইজম চলে না। এ দেশে, কোনও দেশে, চলে না। আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।’ তিনি স্পষ্টই ইঙ্গিত করেছিলেন, তাঁর কল্পিত সমাজতন্ত্র সোভিয়েত বা চিনের সমাজতন্ত্র নয়, বাংলাদেশের পটভূমিতে নিজস্ব বাস্তবতার সমাজতন্ত্র। তাঁর চিন্তার মূলকে অর্থাৎ ‘বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে’ হাসি ফোটাতে চাওয়াকে বুঝতে হলে তাঁর জীবনের অসম্পূর্ণ পর্বকেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে!

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা কঠিন হলেও বিদ্বৎসমাজের পক্ষে অনেকটাই সম্ভব। স্বাধীনতা-উত্তরকালের বাস্তবতায় তাঁর সরকার যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে যেসব দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচি নিয়েছে তার কতটা সুফল বাংলাদেশের মানুষ পেত তা মূল্যায়নে এখন হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু তা হলেও তিনি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা থেকে যে মানবিক ও জনকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গির বা ভাবনার ইশারা পাওয়া যায় তা এখনও আমাদের পথ দেখাতে পারে। তাঁর সম্পর্কে বিদ্বৎসমাজের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন থেকে রাজনীতিকেরাও পেতে পারেন ভবিষ্যতের যাত্রাপথের নিশানা।