Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুসাফির এ মন

লাহোর-ইসলামাবাদ মোটোরওয়ে

নীলাঞ্জন হাজরা

 

পূর্ব প্রকাশিতে পর

শেষ পর্ব

সবুজে সবুজ পাতায় শুকায় ঘোলাটে হলুদ দ্বিপ্রহর
একাকিত্বের বিষাক্ত জিভ চাটছে দেওয়াল পরের পর
দূর দিগন্তে এগিয়ে পিছিয়ে উঠছে পড়ছে নিরন্তর
কুয়াশা-জমাট ব্যথার ঢেউ ম্যাড়মেড়ে আর নোংরা ধূসর
সেই কুয়াশার পিছনে ওই বসত করে আলোর শহর
ও আলোর শহর…”

—ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় (মন্টগোমারি জেল৷ মার্চ/এপ্রিল ১৯৫৪)

এই কবিতা এক আশ্চর্য পরিস্থিতিতে রচিত হওয়ার ৬০ বছর পরে এক বিকেলে আমরা কলকাতা থেকে আগত অপয়া ১৩ সংখ্যক সাংবাদিক লাহোরের বাসে উঠে বসলাম৷ আমরা যেতে পারতাম জিটি রোড, হ্যাঁ এই কলকাতা অবধি এসে পৌঁছেছে যে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড সেই জিটি রোড ধরে— গুজ্জর খান, ঝিলম, গুজরানাওয়ালা হয়ে৷ কিন্তু তা হল না৷ আমাদের নিয়ে যাওয়া হল পাকিস্তানের উন্নয়নের হাতে-গরম প্রমাণ লাহোর-ইসলামাবাদ এক্সপ্রেস মোটরওয়ে দিয়ে৷ ঝাঁ চকচকে, ক্যারমের ম্যাচ-বোর্ডের মতো সেই রাস্তায় কিছুই পড়ে না৷ তার দুপাশে ইস্পাতের বেড়া৷ আর তার দুপাশে এগিয়ে পিছিয়ে ওঠা পড়া ধুধু নোংরা ধূসর ঢেউ৷ আর কাঁটা ঝোপ৷ তাতে পাঁচ ঘণ্টার সফর চার ঘণ্টায় পার করে আমাদের জীবনের অমূল্য এক ঘণ্টা বাঁচিয়ে দেওয়া যাবে!

তখনও আমি সেই উন্নত পথের ঘেরাটোপ চেহারা দেখিনি— যেখানে কোনও গ্রাম-গঞ্জ-শহর কিচ্ছু নেই, যে গমগমে সভ্যতার, রঙের, রসের আশীর্বাদ আমাদের এই উপমহাদেশের আনাচে কানাচে, তার চিহ্নমাত্র নেই৷ পথে যে কখন পেরিয়ে গেলাম চন্দ্রভাগা আর ঝিলমের স্রোত, মালুমই চলল না৷ শুধু হুহু করে ছুটে চলা একটা— পশ্চিমী উন্নয়নের গতির বাঁদুরে নকল৷ ইসলামাবাদে বাসে চড়ার সময় মনে হয়েছিল, যাক, এক ঘণ্টা যদি বাঁচে, তা-ই ভাল৷ এমনই অধীর আমি তখন লাহোরে পা রাখতে৷

কেন এমন অধীর? কারণ লাহোরের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত যে বহুকাল আগের৷ আর সে পরিচয় অ্যাসফল্ট রাস্তার মতো কয়েক ইঞ্চি পুরু আর পিচ্ছিল নয়৷ সে পরিচয় একটা জীবন ডুবিয়ে দেওয়ার মতো গভীর৷ আর সে পরিচয়ের সূত্রপাতের একাংশ আমরা অপয়া ১৩ ইসলামাবাদ ছেড়ে লাহোরের পথে রওনা হলাম তার ঠিক ৬০ বছর আগে, আর একাংশ তার ঠিক ৫০ বছর আগে!!

গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে বাদ-এ-নও-বাহার চলে
চলে ভি আও কে গুলশন কা কারোবার চলে৷
কফস উদাস হ্যায় ইয়ারোঁ সবাসে কুছ তো কহো
কহিঁ তো বহর-এ-খুদা আজ জিক্র্-এ-ইয়ার চলে৷…

ফুলে ফুলে রং ভরে যাক, নবীন বসন্তের বাতাস উঠুক
এসো, এসো চারিপাশে আজ তবে বাগান সাজুক৷
বিষণ্ণ এই পিঞ্জর, কে আছ বন্ধু আজ ভোরের হাওয়ার সাথে কিছু না কিছু তো কথা বল
ঈশ্বর! প্রিয়ার বিষয়ে আজ কোথাও তো কেউ আজ দু কথা বলুক৷…

–ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় (মন্টগোমারি জেল, ২৯ জানুয়ারি, ১৯৫৪)

জেলের অন্ধকার কুঠরিতে এ কবিতা রচিত হওয়ার ঠিক ১০ বছর পরে, ১৯৬৪-তে পাকিস্তানে একটি ফিল্ম রিলিজ হল, যার নাম ‘ফরঙ্গি’৷ সেই ছবিতে এক নবীন গায়কের গলায় শোনা গেল এই গানটিই৷ সুপার ডুপার হিট৷ তার পরে আর কোনওদিন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি শাহেনশাহ-এ-গজল মেহদি হাসানকে৷

ফয়েজ়-মেহদি, এই যুগান্তকারী যুগলবন্দি তৈরি হওয়ার ১২ বছর পরে তার তরঙ্গ এসে পৌঁছে গেল পশ্চিমবঙ্গের টিমটিমে মফস্বল শহর বিষ্ণুপুরের এক অতি মধ্যবিত্ত পরিবারে৷ সেটা ১৯৭৬৷ বাবা বাড়িতে নিয়ে এলেন একটা ক্যাসেট৷ যার রং সবুজ, আর যার ওপরে গালে গালপাট্টা আর ব্রণ বা বসন্তের দাগওয়ালা একটা গম্ভীর লোকের ছবি৷ যার ওপরে লেখা “The Best of Mehdi Hassan”৷ এই ক্যাসেটের প্রথম গান ছিল ‘গুলোঁ মে রঙ্গ্ ভরে…’৷ যার পাশে ইংরেজিতে লেখা ছিল— “Lyrics Faiz Ahmed Faiz”৷ কিন্তু তখন স্বপ্নের পায়ের-পাতা-ভিজানো জল৷ বাড়িতে একটা ধ্রুপদী সঙ্গীতের রেওয়াজ ছিলই৷ মা সেতার শিখতেন। গানবাজনাও হত, রবীন্দ্রসঙ্গীত বা খাস হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিকাল৷ কাজেই ‘গুলোঁ মে রঙ্গ্ ভরে’-র জাদুতে সম্মোহিত হতে সময় লাগল না৷ এ এক আশ্চর্য গজল৷ যা অন্তত দুজনের জীবন বদলে দিয়েছে বলে আমি জানি— বলা হয়ে থাকে মেহদি হাসানের, আর নিঃসন্দেহে আমার!!

কাজেই আমি লাহোর নিয়ে কথা বলতে বসলে শুরু করতেই হবে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়এবং মেহদি হাসানের অলীক প্রতিভার মেলবন্ধনে তৈরি এই গজলটির কথা দিয়েই৷ মেহদি হাসান নিজে কখনও ক্লান্ত হতেন না এই গানটির কথা বলতে৷ আমৃত্যু অনুষ্ঠান করতে করতে গান থামিয়ে, হারমোনিয়াম প্যাঁপ্যাঁ করতে করতে বলতে শুরু করতেন এই গানের কথা৷ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রেকর্ড, ক্যাসেট, ইউটিউব-এর এই গানটিরই বিভিন্ন রেকর্ডিং থেকে আমি বহু বছর ধরে এই ‘গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে’-র একটা অদ্ভুত ইতিহাস তৈরি করতে পেরেছি৷ এটা মোটামুটি নথিবদ্ধই যে, মন্টগোমারি জেলখানায় বন্দি থাকার সময় ফয়েজ় ১৯৫৪-র ২৯ জানুয়ারি এই গজলটি লেখেন৷ পরে সেটা দস্ত-ই-সবা (ভোরের হাওয়ার হাত) নামের বইয়ে সংকলিত হয়৷ সম্ভবত মেহদি হাসান প্রথমে পাকিস্তান রেডিওতে এই গানটি রেকর্ড করেন৷ লাহোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক The Friday Times-এর ২০১১-র, ২১-২৭ সংখ্যায় উস্তাদ গুলাম হায়দার খান জানাচ্ছেন, মেহদি হাসান ১৯৫৯-এ রাজস্থানি মান্দ আঙ্গিকে ‘গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে’ প্রথম রেকর্ড করেন পাকিস্তান রেডিওর জন্য৷

তার পরের ঘটনা একটি লাইভ কনসার্টে জানিয়েছেন মেহদি নিজেই— ‘ফরঙ্গি’ বলে ছবির প্লে-ব্যাক রেকর্ডিং হচ্ছে৷ কোনও এক মহিলা গায়িকাকে দিয়ে ‘গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে’ রেকর্ড করানো হয়েছে৷ এরই মধ্যে রেকর্ডিস্ট আখতার সাহাব (মেহদি ওই নামটাই বলেছেন) একদিন ফয়েজ়কে ডাকলেন মেহদি হাসানের রেকর্ড করা তিন চারটি গান শোনানোর জন্য৷ ‘গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে’ শুনে ফয়েজ় অবাক৷ আরে, এ তো আমার লেখা গজল৷ হ্যাঁ, স্যার আপনারই লেখা৷ (মেহদি হাসান ঠিক এইভাবেই কথাগুলো বলেছেন) তো এই ছেলেটি কে? কে গাইছে গানটা? আখতার সাহাব বলেন, মেহদি হাসান৷ ফয়েজ় বলেন, স্টুডিওয় যে রেকর্ড হয়েছে সেটা ক্যানসেল৷ এটাই ব্যবহার করতে হবে৷ সেটা ১৯৬৪৷ এখানে অবশ্য আমার একটা প্রশ্ন আছে, ‘ফরঙ্গি’ ছবিতে এই গানের দৃশ্য দেখলে দেখা যাবে এক চাপ দাড়িওয়ালা দরবেশ গানটি গাইতে গাইতে চলেছেন৷ এখন কথা হল, তবে কি ফয়েজ় মেহদি হাসানকে বাছার পর, ফিল্মের স্ক্রিপ্টটিও বদলানো হয়েছিল? নিশ্চয়ই তাই, নইলে ওই দরবেশের গলায় তো কোনও মহিলা প্লে-ব্যাক করতে পারেন না!

মেহদি হাসান

এর বহু পরে লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল অ্যালবার্ট হলের একটি অনুষ্ঠানে মেহদি হাসান বলছেন— ‘রাগরূপের প্রচার আমাদের করা কর্তব্য৷ কী হিন্দুস্তান, কী পাকিস্তান হাজার হাজার বছর পুরনো আমাদের সঙ্গীত৷ কোথায় আপনাদের বিটল্‌স, যারা তুফানের মতো এসে আঁধির মতো চলে গেল৷ কিন্তু আমাদের রাগরূপ তো কখনও পুরনো হয় না। কেন? যেমন ধরুন ‘গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে’৷ এত বছর হয়ে গেল এই গান ছাড়া আজও আমার কোনও মেহফিল শেষ হয় না৷ যদি আমি নিজে নাও গাই, কেউ না-কেউ ফরমাইশ করবেনই…।”

সেই ১৯৭৬-এ, ন বছর বয়সে এই গুলোঁ মে রঙ্গ ভরে দিয়েই আমি প্রথম শুনেছিলাম সেই মানুষটার নাম, যে আমার জীবন দর্শনটাই বদলে দিয়ে গেছে— ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়৷ ‘আলোর শহর’ লাহোরে যার বাড়ি৷ যে লাহোরের পথে চলেছি আমরা, সেই রাস্তা দিয়ে যাতে আগু পিছু ছুটন্ত গাড়ির আলো ছাড়া আর কিচ্ছু দেখার নেই৷

ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়

উল্লিখিত দুটি কবিতাই লিখিত মন্টগোমারি জেলখানায়৷ ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়কে কেউ কখনও গলা তুলতে শোনেনি৷ জীবনে কখনও ভালোবাসার কবিতা ছাড়া অন্য কোনও কবিতা লেখেননি৷ অথচ এই ভদ্রলোকটিকে ১৯৫১ সাল থেকে বারংবার কারাবাস করতে হয়েছে, গ্রেফতার হতে হয়েছে এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে৷ যার মধ্যে একবার, ১৯৫১-তে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল৷ কেন? কারণ তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন৷ ভাবতে অবাক লাগে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ একটা সামরিক রাষ্ট্র একজন কবিকে কী ভয় পেতে পারে!

কখন কী পরিস্থিতিতে ফয়েজ়কে গ্রেফতার হতে হয়েছে, কেমন তাঁর কবিতা— এ সব নিয়ে আমি দীর্ঘ আলোচনা করেছি অন্যত্র, বিশেষ করে আমার অনূদিত বই— ‘কেড়ে নেওয়া ইতিহাস: আফজাল আহমেদ সৈয়দের কবিতা’-র দীর্ঘ ভূমিকায়৷ তাই পাকিস্তানে মুসাফিরির এই বৃত্তান্তে তা বাদই থাক৷ শুধু এইটুকু যে, আমার জীবনের অন্যতম স্বপ্ন সেদিনও ছিল, আজও আছে— লাহোরে গিয়ে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর স্মৃতিসৌধে একগোছা সাদা গোলাপ রেখে আসি৷

ধুধু ধূসর মাঠ আর ছোটছোট পাথুরে পাহাড় ভেদ করে সমস্ত জনপদ এড়িয়ে ইসলামাবাদ-লাহোর মোটরওয়ে দিয়ে ধেয়ে চলেছি সেই স্বপ্নের দিকে৷ লাহোর যখন পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি হয়ে গিয়েছে৷ কিছুই তেমন ঠাহর হল না৷ আমাদের নিয়ে তোলা হল মাঝারি মানের একটা হোটেলে৷ এদিকে আমি মনে মনে অস্থির হচ্ছি, সেই প্রশ্ন কেবলই খোঁচাচ্ছে— আগে ‘জি’ না আগে ‘এফ’? শেষ ফেব্রুয়ারির ফুরফুরে হাওয়ায় করাচি পৌঁছনোর আগেই আতি-পাতি করে নেট ঘেঁটে বার করে ফেলেছি সঠিক ঠিকানা৷ আর সেই থেকে মনের মধ্যে চলেছে অহর্নিশি দ্বন্দ্ব— আগে জি না আগে এফ৷ লাহোর পৌঁছেই মডেল টাউন তো অবশ্যই ছুটব, কিন্তু আগে জি ব্লকে যাব, না কি আগে এফ ব্লকে৷ ছবিও দেখে রেখেছি নেটে৷ জি ব্লকের কবরখানায় কালচে রঙের পাথরে মোড়া অতি সাদামাঠা কবির অন্তিম শয়ানের সৌধ৷ পাশে ঠিক তেমনই পাথরের নীচে শুয়ে বেগম অ্যালিস কলসুম ফয়েজ়৷ আর ১২৬/এফ মডেল টাউনে কবির শেষ বেশ কয়েকবছরের বাসা৷ এখন ফয়েজ়-এর স্মৃতিতে মিউজিয়াম ‘ফয়েজ়ঘর’৷

এ দিকে আমরা তো বন্দি হয়ে রয়েছি আতিথেয়তার নাগপাশে৷ আমাদের লাক্সারি কোচের সামনে-পিছনে হুটার কোঁকানো পুলিশের গাড়ি৷ গাড়িভর্তি অটোমেটিক মেশিনগান ঝলসানো কম্যান্ডো৷ আর প্রতি মুহূর্তে সঙ্গে সদা হাস্যমুখ প্রোটোকল অফিসার জাফর কুরেশি৷ বেশ গভীর রাতে ডিনারের পর গুডনাইট বলতে এলেন তিনি৷ একান্তে জানতে চাই— ‘এখান থেকে মডেল টাউন কত দূর মশাই?’

‘পাশেই তো৷ কেন?’
‘বহুত বড়িয়া৷ কাল ভোর ভোর উঠেই তাহলে ছুটব, বুঝলেন৷’
‘সে কী? কোথায়?’
‘মডেল টাউনের জি ব্লকের কবরখানায়৷ ফয়েজ়-এর কবরে একটু ফুল চড়াতে চাই৷ এখানে খুব সকালে কোনও ফ্লোরিস্ট খোলা মেলে?’

ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ় ও তাঁর স্ত্রী অ্যালিস কুলসুম ফয়েজ়ের সমাধি

কুরেশি সাহেবের হাস্যমুখ এক নিমেষের জন্য পাথর হয়ে যায়৷ এক পলকের জন্যই৷ ফের সেই ভুবন ভোলানো অট্টহাসি— ‘নো, নো, নো৷ দ্যাট ইজ নট ইন আওয়ার প্রায়রিটি লিস্ট৷ প্লিজ ফলো দি প্রোগ্রাম শেডিউল!’

না, দুর্লভ পাকিস্তানি ভিসা পেয়েও, লাহোরের মডেল টাউনেরই একপাশের একটা হোটেলে থাকা সত্ত্বেও, আমার যাওয়া হয়নি ফয়েজ়-এর সমাধিতে বা বাড়িতে৷ কারণ, পাকিস্তান সরকার আমাদের ঘোরনোর জন্য লাহোরের দর্শনীয় স্থানের যে তালিকা তৈরি করেছিল তার ‘প্রায়রিটি লিস্টে’ তা ছিল না৷

লাহোরে এসে, আর শুধু লাহোরে এসেই নয়— মডেল টাউনের এক পাশে থেকেও যে ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়-এর সমাধিতে আমি যেতে পারব না, এই সত্যটা মনটাকে এমন বিষিয়ে তুলেছিল যে, রাতে ঘুমই হল না ভাল করে৷ তা একেবারে চিড়বিড়িয়ে উঠল, যখন পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর আমাদের সদাহাস্যমুখ প্রোটোকল অফিসার কুরেশি সাহেব কান এঁটো করা হাসি নিয়ে বললেন— আজ আমরা প্রথমেই শুরু করব একটা দারুণ জিনিস দিয়ে— পাকিস্তানে প্রথম চালু হওয়া ট্রলি বাস!

আমরা সকলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করি, এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম শহর, আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে চিনা পরিব্রাজক হিউ এন সাংয়ের (৬৩০ সাধারণাব্দ) জমকালো বর্ণনার শহর, গজনি সাম্রাজ্যের রাজধানী শহর, দিল্লি সুলতানতের খিলজিদের শহর, তুঘলকদের শহর, লোধিদের শহর, ইতিহাসের এক বিরল শাসক আকবর বাদশার শহর, রঞ্জিত সিংয়ের শহর, অল্লামা ইকবালের শহর, ফয়েজে়র শহর, সাদাত হাসান মান্টোর শহর, ভগত সিংয়ের ফাঁসির শহরে দাঁড়িয়ে রয়েছি এক বিরল সুযোগে, আর এই ভদ্রলোক বলছেন আমাদের অতি সীমিত সময়ের প্রথম দর্শনীয় নতুন চালু হওয়া ট্রলি বাস? সত্যিই মনে হল লোকটাকে মারি৷ চ্যাংড়ামো হচ্ছে?

সত্যিই আমাদের লাহোর সফরের অনেকটাই এই চ্যাংড়ামোয় ভরা ছিল৷ তেমনই এক মহাচ্যাংড়ামোর কথা দিয়েই শেষ করব এ পাকিস্তানে মুসাফিরি৷ আপাতত চললাম ট্রলি বাস দেখতে, যেমনটা ইউরোপে হুদো হুদো দেখা যায়৷ মায় কাঠমান্ডুতেও চিনারা করে দিয়েছে সে পরিবহণ ব্যবস্থা৷ ভাবলাম যাকগে, নিশ্চয়ই মিনিট পনেরোর মধ্যে উন্নয়ন দেখানোর এই তামাশাটা শেষ হবে, তারপর আমরা ইতিহাসের লাহোরে ঢুকে পড়তে পারব৷ কাকস্য পরিবেদনা৷ আমাদের কনভয় এসে থামে এক ঝাঁ চকচকে বহুতলের সামনে? ঢুকে পড়ি৷ কী ব্যাপার? এখান থেকেই পরিচালিত হয় লাহোরের আধুনিকতম ট্র্যাফিক ব্যবস্থা, যা নাকি যানজট ব্যাপারটাকেই প্রাচীন ইতিহাস করে দিয়েছে৷ অজস্র সিসি টিভি লাগানো নানা কামরা পার করে এক সুসজ্জিত কনফারেন্স রুমে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের৷ এবার আমাদের লাহোরের সেই ট্র্যাফিক ব্যবস্থার প্রধান এক ঘণ্টা ধরে বোঝাবেন কীভাবে পরিচালিত হয় সেই ব্যবস্থা৷ পর্দায় পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড দেখিয়ে দেখিয়ে৷ শুরু হয় প্রেজেন্টেশন— ‘জেন্টলমেন (আমাদের ১৩ অপয়ার প্রত্যেকে পুরুষ!)…’

“নীলু, ওঠ্‌ রে! এবার যেতে হবে…” আমার কলেজ জীবনের বন্ধু অধুনা সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠেলায় ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখি পাওয়ার পয়েন্ট শেষ৷ অঞ্জনদা মৃদু ভর্ৎসনা করে, ‘একেবারে প্রোজেক্টারের সামনে বসে অঘোরে ঘুমোলি মাইরি!!’

যাই হোক এর পর কুরেশি সাহেবের কাছে জানতে চাই, এই নতুন চালু হওয়া পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য ট্রলি বাসটি ছাড়া আর কী কী দেখব আমরা এই দিন দুয়েকে? তালিকাটা খারাপ না— লাহোর দুর্গ, বাদশাহি মসজিদ, লাহোর জাদুঘর ইত্যাদি৷ সবই দেখেছিলাম৷ যেমন দেখে টুরিস্টের দল৷ যেমন দেখানো হয় টুরিস্টের দলকে৷ আর তার পরেই হল সেই মহাচ্যাংড়ামোটি৷

চ্যাংড়ামো হলেও তার গুরুত্ব অপরিসীম৷ কারণ তা থেকেই বোঝা যায় ৫০০০ বছর একসঙ্গে থাকার পর মাত্র মাত্র ৭০ বছরে আমরা একে অপরের থেকে কতটা দূরে চলে গিয়েছি৷ কী সাংঘাতিক এক অজানার পাঁচিল তৈরি হয়ে গিয়েছে আমাদের মধ্যে৷

অনেক বেলা করে সন্ধ্যা হল৷ হঠাৎ আমরা জানতে পারি, লাহোরের বিশ্ববন্দিত ফুড স্ট্রিট নয়, আমাদের রাতের খানার আয়োজন কোনও অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁয়৷ আমাদের মধ্যে অনেকেই আঁতকে উঠি৷ লাহোরের ফুড স্ট্রিটকে বলা হয়ে থাকে সারা দুনিয়ার মধ্যে খাদ্যরসিকদের অন্যতম স্বর্গ৷ তা ছাড়া, আমি দলছুট হয়ে প্রায় সমান মানের (খাদ্যের দিক থেকে, দৃশ্যের দিক থেকে নয়) করাচির বোট বেসিন ফুড স্ট্রিটে গিয়ে মাঝরাতে নেহারি, কাবাব মেরে এসেছি বটে, কিন্তু আমার সহকর্মীদের বাকিদের কারও সে সুযোগ হয়নি৷ বাঙালি তার প্রিয় কাজে লেগে পড়ে— প্রতিবাদ৷ সমস্বরে প্রতিবাদ ওঠে৷

বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে বুঝে শেষ মুহূর্তে ব্যবস্থা হয় ফুড স্ট্রিটেই৷ আলোকিত লাহোর দুর্গ৷ উল্টো দিকে টুকরো টুকরো রামধনু আলো ঠিকরানো কোনও এক জমানার বাইজি-পাড়া হিরা মান্ডির ঐতিহাসিক বহুতল, এখন সারি সারি ছোট ছোট রেস্তোরাঁ৷ সে দৃশ্য অপার্থিব৷ কিন্তু শুধু দৃশ্যই নয়, করাচির বোট বেসিনে যে সুগন্ধের সিম্ফনি শুরু হয়েছিল, এ পাড়ায় উপচে পড়ে তার অ্যালেগ্রো ভিভাস৷

লাহোরের ফুড স্ট্রিট

আর এই মায়াবি রাতেই বুকে বেঁধে এ সফরের সব থেকে ধারালো স্টিরিওটাইপের নিষ্ঠুর চ্যাংড়ামোর ছোরা৷ বিলিতি ভাষায় যাকে অনায়াসে বলা যায়— Mother of all stereotypes৷ আমরা গিয়ে বসি একটি বহুতল বাড়ির একেবারে উপরিতলে৷ তার জানালা দিয়ে দেখা যায় সেই গোটা এলাকার দৃশ্য৷ খানা আসা শুরু হয়৷ হাতা গুটিয়ে নিই, কারণ জানি কনুই ছাড়িয়ে বগল অবধি ডুবিয়ে দিতে হবে এ খানায়৷ আসতে থাকে একে একে৷ পালক পনির৷ বাঃ বেশ৷ নান৷ বাঃ নরম৷ ডাল মাখনি৷ বাঃ দিব্যি৷ গোবি আলু৷ চলবে… মিনিট দশেক এ রকম চলার পরে একটু বিরক্ত হয়েই বলে ফেলি, ‘জনাব, গোশ্ত, মুর্গা বগয়রা ভি তো লাইয়ে৷ মেরে লিয়ে গোশ্ত নেহারি৷’

ওয়েটারদের দল সহসা যেন স্থানু হয়ে যান৷ সেই ছোটবেলায় খেলতাম— গো-স্ট্যাচু-র মতো৷ কী ব্যাপার? ‘স্যার, আপলোগোঁ কে লিয়ে তো ভেজিটেরিয়ান খানা অর্ডার কিয়া গয়া হ্যায়৷’ প্রথমে মনে হল, লোকটার গলা টিপে ধরে মেরেই ফেলি৷ লাহোরের ফুড স্ট্রিটে এসে গোবি-ডাল খেয়ে ফিরে যেতে হবে৷ চ্যাংড়ামো হচ্ছে?

তারপরেই অপয়া তেরো স্বরের সম্মিলিত আর্তনাদ শোনা গেল৷ এ কী করেছেন কুরেশি সাহেব৷ কাঁচুমাচু হয়ে তাঁর করুণ যুক্তি— আসলে আপনারা হিন্দুস্তান থেকে আসছেন জেনে এঁরা এই শুদ্ধ শাকাহারি বন্দোবস্ত করেছেন! খাস নেহারি-কাবাব তো দূর-অস্ত্, লাহোরের ফুড স্ট্রিটে এসে সামান্য চিকেনের দাবিতেও শেষে প্রায় সর্বভুক বঙ্গসন্তানদের গলা তুলে স্লোগান দিতে হয়েছিল৷ কাকে আর দোষ দিই? কপাল চাপড়াই৷ যে কপালের ওপর দিয়ে চলে গেছে চির-অপরিচয়ের বিভাজন রেখা সেই ১৯৪৭-এ৷

 

শেষ