হারুণ রশিদ
রোহিঙ্গাদের ঘরছাড়া হবার ইতিহাস বেশ পুরোনো। সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায় ১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক সরকার ঘোষণা করল ১৮২৩ সালের পর থেকে যেসব মানুষ আরাকানে বাস করতে শুরু করেছে তাদের কাউকে বার্মার নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। তাদের কোনও ভোটাধিকার থাকবে না। শান্তির নোবেল পুরস্কার নিয়ে মানবতার প্রতীক বলে পরিচিত অং সান সু কি-র গণতান্ত্রিক সরকারও সেই সিদ্ধান্তেই অটল এই ২০১৭ সালেও। রোহিঙ্গা নামে পরিচিত সেই জনগোষ্ঠীর কোনও দেশ নেই, তাদের কোনও নাগরিকত্ব নেই। কয়েকশো বছর ধরে যারা ওই ভূখণ্ডে বাস করছে তাদের নাগরিকত্ব না থাকার কারণ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তারা বাঙালী।
বেছে বেছে শুধু কিছু নির্দিষ্ট জাতি একটা রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে, বাকীরা শত শত বছর ধরে ওই ভূখণ্ডে বাস করেও নাগরিকত্ব পাবে না, এই আধুনিক যুগে ভাবা যায়? কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে মগের মুল্লুক বলে পরিচিত ওই ভূখণ্ডে সেই বর্বর নিয়মই আইন। এখানে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অকার্যকর।
ঘটনার মূল খুঁজতে আরও কিছুদূর পেছনে যেতে হবে। মায়ানমারের রাখাইন নামের প্রদেশটি একদা আরাকান নামে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ১৭৮৪ সালে আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দলের সুযোগে বার্মা আরাকান দখল করার সুযোগ পায়। দখলীকৃত ভূখণ্ডের নাগরিকদের গলায় অপমানজনকভাবে তালপাতায় লিখে ঝুলিয়ে রাখতে হত-– “নিং থোয়া বারাং ক্যোঁয় ডো মো” নামের বাক্যবন্ধ, যার অর্থ উদীয়মান সূর্য বর্মী রাজার আমি দাসানুদাস। ১৭৯৮ সালে আরাকানীদের উপর বার্মার বোদপায়া রাজার নির্যাতন চরমে উঠলে নাগরিকরা পালিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশে। সেই আরাকানীদের মধ্যে ছিল বৌদ্ধ এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষ। ছিল বাঙালীরাও যারা আরাকানে বসবাস করছে শত শত বছর ধরে। সেই পালিয়ে আসা শরণার্থীদের অনেকে বাংলাদেশেই থেকে যায় স্থায়ীভাবে। যাদের কিছু অংশ কক্সবাজারে আর কিছু অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠাঁই নেয়। তখন থেকেই আরাকান নামক রাজ্যটির নাম মুছে যাওয়া শুরু হয়।
১৮২৫ সালে আরাকান বৃটিশ অধিকারে আসার পর অনেকে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ বাসভূমিতে। তাদের মধ্যে বাঙালী বৌদ্ধ হিন্দু মুসলমান সব জাতিধর্মের মানুষ ছিল। আরাকান বৃটিশ অধিকারে যতদিন ছিল ততদিন পর্যন্ত আরাকানে যাতায়াতে বাঙালীদের পথ ছিল অবারিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় জাপানী আক্রমণের আগ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল।
আরাকান ও চট্টগ্রাম অভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল বহুকাল ধরে। চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানেরই অংশ ছিল শত শত বছর ধরে। এমনকি হাজার বছর আগেও চট্টগ্রাম আরাকানের দখলে ছিল। সেই সূত্রে আরাকানে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের বিচরণ বহুকাল ধরে। এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় বসতি স্থাপন করাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। জাতিসত্তার পরিবর্তন না ঘটিয়েও মানুষ সারা পৃথিবীতে বসতি স্থাপন করে ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র এবং জাতিসত্তার পরিচয় সবসময় অভিন্ন হয় না। একটি রাষ্ট্রে বাস করে বহু জাতি ধর্মের মানুষ। ন্যূনতম সভ্য দেশে এটা মেনে নেয়াই রীতি। এমনকি অর্ধসভ্য মধ্যযুগেও সেই রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু বার্মার ক্ষমতাসীনেরা সেই রীতিকে কখনও সম্মান করেনি। দুশো বছর আগে যে কায়দায় আরাকানীদের শরণার্থী জীবন বরণ করতে হয়েছিল, আজও সেই শরণার্থী জীবনই বহন করতে হচ্ছে তাদের।
প্রায় দুশো বছর পর ১৯৭৭ সালে আবারও শুরু হয় উদ্বাস্তু সমস্যা। সেই সময়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়েছিল বার্মা থেকে। সরকারি হিসেবে সংখ্যাটি ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ও বার্মার সাথে যে চুক্তি হয় সে অনুযায়ী কিছু রোহিঙ্গা দেশে ফিরতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবারও দেখা দেয় একই সংকট। সেই দফায়ও লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরপর ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ প্রতিবছরই একেক দফায় রোহিঙ্গাদের ঠেলে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।
একটি অবোধ দুগ্ধপোষ্য রোহিঙ্গা শিশুর লাশ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সৈকতের কাদাজলে। শিশুটি যখন জীবিত ছিল তখনও সে জানত না তার জাত, ধর্ম কিংবা দেশ কোনটি। বোঝার বয়স হবার আগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় নৌকাডুবিতে জলে পড়ে যাবার আগে সে কেবল চিনত মায়ের কোল।
২০১৭ সালে এসে মাত্র দুই সপ্তাহে রোহিঙ্গা শরণার্থী এসেছে দেড় লাখের বেশী। এখনও প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু সংকটের একটি।
খুব স্পষ্ট করে একটি কথা জানানো দরকার যে এই সমস্যাটা মোটেও ধর্মীয় নয়। মুসলমান বলে রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে না। বার্মার বিভিন্ন প্রদেশে বহু মুসলমান আছে যাদের সাথে কোন সমস্যা নেই। এই সমস্যাটা মূলতঃ জাতিগত। রোহিঙ্গারা বাঙালী বংশোদ্ভূত বলেই তাদেরকে নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়মায়ানমার সরকার। শুধু সরকার নয়, সাধারণ বার্মিজদের দৃষ্টিভঙ্গীও অনেকটা সরকারের মতো। তারা রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা না বলে অভিবাসী বাঙালী হিসেবে দেখে আসছে চিরকাল। কিন্তু একজন অভিবাসীর কত শত বছর লাগে নাগরিক হয়ে উঠতে? আমেরিকার মতো দেশে মাত্র ৫ বছর বাস করেও নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু সাত পুরুষ বাস করেও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মেলেনি মায়ানমারে।
বর্তমান পৃথিবীর অন্ততঃ তিনটি মহাদেশের সমাজ গঠিত হয়েছে ভিনদেশী অভিবাসীদের হাতে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া। খুব বেশীদিন না। মাত্র ৩০০-৫০০ বছরের মধ্যে এই মহাদেশগুলোতে অভিবাসনের ঘটনা ঘটেছে। এখন হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি মেক্সিকো দখল করে স্পেনিশভাষীদের বলে ‘তোমরা তো এখানকার অভিবাসী মাত্র, নাগরিক নও, স্পেনে ফিরে যাও’– কেমন দাঁড়াবে ব্যাপারটা?
এবার একটু বিপরীত কথা বলা যাক। ২০১৭ সালে নতুন করে এই সমস্যার উদ্ভব নিয়ে বলতে গেলে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে দায়ী করতেই হয়। সাধারণ রোহিঙ্গারা হয়তো দায়ী নয়, কিন্তু নব্য গঠিত একটি জঙ্গী সংগঠনের নাম শোনা যাচ্ছে The Arakan Salvation Army (ARSA)। যে সংগঠন মায়ানমারে কয়েক দফা আক্রমণ চালিয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে। সর্বশেষ আক্রমণ মায়ানমারের ২৫টি পুলিশ চৌকির উপর। যার প্রতিক্রিয়াতে মায়ানমার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। এই জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেননা ওই জঙ্গীদের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গীদের যোগাযোগ থাকার ঘোরতর সম্ভাবনা রয়েছে। এই জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকগন এই সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে যদিও ধর্মের সাথে এর কোনও সম্পর্কই নেই।
আন্তর্জাতিকভাবে এই জঙ্গীদের কোনও রাষ্ট্র নেই, যে কোন রাষ্ট্রেই তাদের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘাড়ে চেপে যদি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যদি অস্থিতিশীল করে তোলে তাহলে সেটা হয়ে দাঁড়াবে গুরুতর আঞ্চলিক সমস্যা। যেখানে জড়িত হতে পারে ভারত বা থাইল্যাণ্ডের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো। সন্ত্রাসবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা থাক। মূল মানবিক সমস্যার দিকে চোখ ফেরানো যাক। সবার উপরে মানুষ যদি সত্য হয়ে থাকে, সেই মানুষের একটি ভূখণ্ডে বাস করার অধিকার আছে। যে ভূখণ্ডে পূর্বপুরুষেরা শত শত বছর ধরে বাস করে গেছে সেটাই আমার বাড়ি, সেটাই আমার দেশ। প্রতিটি মানুষের একটি দেশ থাকার অধিকার আছে। এটা প্রতিটি মানুষের সার্বজনীন অধিকার। সেই অধিকার প্রদানে মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। শুধু বাংলাদেশের উপর সমস্যা চাপিয়ে বসে থাকলে সমাধান আসবে না। রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক নাগরিক অধিকার না দিলে এমন বর্বর অমানবিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।