অশোক মুখোপাধ্যায়
প্রাবন্ধিক, সেস্টাস-এর সাধারণ সম্পাদক
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় (১৯৭০-৭৪) ক্যান্টিনে বা পোর্টিকোর আড্ডায় আমাদের নকশালপন্থী বন্ধুদের মুখে একটা ছড়া খুব শুনতাম—
ভোট এসেছে ভোট এসেছে, ভোটের লগ্ন আটটা,
সময়ে ভোট না যদি দাও, মাথায় পড়বে গাট্টা।
দুটো টীকা প্রয়োজন। এক, সেই সত্তরের দশক অবধি নির্বাচন শুরু হত সকাল আটটা থেকেই। চলত বিকেল চারটে পর্যন্ত। দুই, এই ছড়াটি ব্যবহৃত হত আমাদের মতো সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী দলের ছাত্র কমরেডদের উদ্দেশে।
তবে ছড়া বর্ষণের বাইরে আর কিছু করার সামর্থ্য ১৯৭২ উত্তরকালে আমাদের সেই বন্ধুদের আর ছিল না। বরং সেই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জমানায় রামমোহন সরণির সত্যিকারের মূর্তিমান ফাটা কেষ্ট-র গুন্ডৃত্বে ছাত্র পরিষদের ছাত্র সংসদ দখল ও কলেজকে বাম তথা লাল রাজনীতি মুক্ত করার সশস্ত্র প্রয়াসের বিরুদ্ধে আমরা তখন ক্রমাগত এক সঙ্গে জোটাজুটি করে কাজ করতে শিখে ফেলছিলাম। গালাগালির তুলনায় গলাগলির আনুপাতিক প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছিল বছর বছর। সেই দিন থেকে বহু কাল পর্যন্ত— যখন আমি বা আমার সমকালিক ব্যাচমেট বিভিন্ন র্যাডিক্যাল কমরেডরা আর কলেজ স্ট্রিটে নেই— প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদে প্রেকছাপ জায়গা করতে পারেনি। সিদ্ধার্থ রায়ের কালো দিনগুলিতে আমাদের পাশের পাশের লাল বাড়ি মেডিক্যাল কলেজেও ছাত্র সংসদের দখল ছিল নানা মতের সম্মিলিত বামপন্থীদের হাতেই।
কথাগুলো মনে পড়ল এই সেদিন। যখন ফ্যাসিস্ট বিজেপি-র বিরুদ্ধে বাম দলগুলি এক জোট হতে পারল না। সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের নেতা কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্যর ঐক্যবদ্ধ বামপন্থী চুনোতি তুলে ধরার আন্তরিক যুক্তিঋদ্ধ আবেদন ও প্রয়াস বাংলার মাটিতে কার্যত ব্যর্থ হয়ে গেল।
[২]
২০২১-এর এই একটা বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছেও বটে।
সিপিআই(এম) নেতারা যখন দিদি = মোদি সমীকরণে বিশ্বাস ও প্রচার করে এবং কিছু ভ্রান্ত কৌশল অবলম্বন করে, হয়ত না বুঝেই, পদ্ম দলের বাংলা দখলের কঠিন রাস্তা কিঞ্চিৎ মসৃণ করে দিচ্ছেন, তখন মোদি স্বয়ং এই সমীকরণে আস্থা রাখতে না পেরে ১৮ বার রাজ্যে ভাষণবাজি করতে ঘুরে গেছেন। একচল্লিশ জন ওজনে-ভারি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও নেতা— তাঁদের মধ্যে আবার প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও আছেন— পশ্চিমবাংলার মাটি কামড়ে পোস্তভাতে পড়ে আছেন। তাঁরা বাংলা জানেন না, বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই কারও, মোদি মাস ছয়েক ধরে পার্লারে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্টাইলে একটা দাড়িছাঁট বানিয়েছেন বটে। কিন্তু অসমে রবীন্দ্রজয়ন্তী বন্ধ করে বাংলায় আর কতটা রবিপ্রেমিক সাজা যায়?
আসলে সঙ্ঘ পরিবারের বংশধর বিজেপি-র পক্ষে বহুবিধ কারণে এই পশ্চিমবাংলার মাটিকে চেনা শক্ত। সমস্ত মৌলবাদী শক্তির মতোই সত্যকারের ইতিহাস পাঠে ওদের ঘোর অনাসক্তির দরুন। নীচের দু-এক পশলা বিবরণ হয়ত বিষয়টা কিঞ্চিৎ সাফ করতে পারে।
অবিভক্ত বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে বরাবর মৌলবাদী কট্টরবাদী মতাদর্শের সাঙ্ঘর্ষিক সম্পর্ক। এটা অন্তত পাকিস্তান খুব ভালো টের পেয়েছিল ধর্মের নামে রাষ্ট্র গঠন করার দু-তিন বছরের মধ্যেই। পূর্ব পাকিস্তানে যে ধর্মের আবেদনের তুলনায় মাতৃভাষা ও সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলা প্রচলনের দাবি অনেক বড় হয়ে উঠেছিল, এর সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক শেকড়ের খবর আজও পাকিস্তানের শাসককুল পেয়েছে কিনা সন্দেহ। তারা আজও হয়ত ভারত সরকারের সামরিক সহযোগিতার প্রশ্নকে বড় করে তুলেই সান্ত্বনা খোঁজে পূর্বাঙ্গ হারানোর শোকে। লালন শাহের বাংলায় যে একটা বিশেষ ধর্মের নামে অধিকাংশ ধর্মভীরু মানুষকে এক সূত্রে বেশি দিন বাঁধা যেত না, এটা বুঝবার জন্য লেন্সের ফোকাস যে মাপে বানানো দরকার, ক্ষমতার দম্ভে শাসককুলের চশমার কাচ তার নাগাল না পেয়ে মাইওপিয়া নিয়ে দিন পার করে।
এই কথাটা বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবাংলার মাঠে ময়দানে বিজেপি নেতাদের দৌড়ঝাঁপ দেখে আরও বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে। কেন পর পর খড়্গপুর ঝাড়গ্রাম বলরামপুরের সভায় লোক হল না, একটার পর সভা বাতিল করতে হল, কেন বিভিন্ন ভাড়াটে টিভি চ্যানেলের সাজানো রিপোর্ট আর ছবির কারুমিথ্যা দিয়ে কুর্সি আর গরুর জমায়েত আড়াল করে মানুষ দেখাতে হচ্ছে, হেলিকপ্টারগুলো কেন ঠিক সভার দিনেই বিগড়ে যাচ্ছে, ক্ষমতা বিস্তারের দাম্ভিক গাঁজায় তাঁরা হয়ত বুঝতে পারছেন না। এখানকার জমিতে ধর্মের নামে হুঙ্কার, সাম্প্রদায়িকতার আবেশে ঘৃণার চাষ, মৌলবাদী লক্ষ্য নিয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের রাজনীতি বেশি দিন ধরে চালানো ভারি অসুবিধাজনক। ওদের দ্বেষপ্রেমের বিরুদ্ধে এখানকার মানুষ কেমন যেন স্বভাবত দ্বেষদ্রোহী।
অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও এই মাটিতে আগে-পরের নানারকম মতবাদিক তোলপাড়কে সংহত করে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করেন। আইনটা বেন্টিঙ্কের হলেও আন্দোলনটা রামমোহনের। আর আসলে সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রচার করতে গিয়ে রামমোহনকে সনাতন ধর্মের পরাকাষ্ঠাকেই চুনোতি জানাতে হয়েছিল। যে দলের নেতাকর্মীরা আজও— এই ২০২১-এও— জহরব্রত রূপকথায় বিশ্বাস করে, সতীকাণ্ডে মদত দেয় এবং পদ্মাবত সিনেমা বন্ধ করতে ঝাঁপায়, তাদের পক্ষে রামমোহনস্নাত বাংলার মাটিকে চিনে ওঠা মুশকিলই। রামায়ণ যাত্রাপালায় জনপ্রিয়তা পেলেও রাম এবং হনুমান কেন বাংলার জমিতে দেব চরিত্র হিসাবে ঠাঁই পেল না, এর রহস্য তারা বুঝতে ব্যর্থ হবেই। ধর্মবিশ্বাসে এখানে শ্যামা এবং শ্যামের প্রভাব রামের চাইতে বহুগুণ বেশি বলেই নজরুলের হাজারের উপর ভক্তিগীতিতে মহম্মদ শ্যাম এবং শ্যামা থাকলেও রাম কই? নামে ভক্তিগীতি হলেও নজরুলের সেই সব গীতে মহম্মদও মানবসন্তান হয়ে ওঠেন, ননীচোর কৃষ্ণকেও দেশগাঁয়ের লোক আপন রাখালবাগাল বলে চিনতে পারে, মা কালীও ভক্ত সন্তানের উদ্যানে বাঁশের বেড়া বাঁধায় এসে হাত লাগায় বলে বিশ্বাস। উত্তরভারতে রামের এইরকম লোকদেবতায় উত্তরণ (বা অবতরণ) ঘটেছে নাকি?
এই উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল নানা মাত্রার পিছুটান সত্ত্বেও এক রেনেশাঁসের অভিঘাতে। যাকে আবার অনেক বুদ্ধিমান পণ্ডিত “তথাকথিত” বলে দেগে দেন। যে আন্দোলন মানুষের মনের দুয়ারে এসে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। প্রাচীন প্রথা, আচারবিচারের শাস্ত্রমান্য অন্ধতাকে অগ্রগতির বাধা হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন প্রচেষ্টা সাধারণভাবে ব্যর্থ হলেও নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক প্রশ্ন তুলে দিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত রাম চরিত্রকে দৈবী জ্যোতি মুক্ত করে মানুষের যাচকাঠিতে ফেলে বিচার করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন এক রাম কাপুরুষকে, যে আড়াল থেকে বালী বধ করে, যে ছলচাতুরি করে ইন্দ্রজিৎ ও রাবণকে যুদ্ধে পরাস্ত করে, যে লোকলজ্জার নামে গর্ভবতী স্ত্রীকে মিথ্যে কথা বলে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল্যবোধকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দত্তকবি বীর বলে বরণ করেন তাকেই যে বীরের মতো অছল যুদ্ধ করে। আর সেই কবিকে তার সমস্ত চপলতা উচ্ছৃঙ্খলা সত্ত্বেও সাহায্য করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঝুঁকি নেন বিদ্যাসাগর। তিনি নিজেও আবার রামের বনবাসে নয়, কাঁদেন সীতার বনবাসে। সেই সীতার আখ্যান নিয়েই “সীতা থেকে শুরু” প্রবন্ধ লেখেন নবনীতা দেব সেন, রামায়ণের ধারণাকে ছিন্ন করে “সীতায়ন” উপন্যাস রচনা করেন মল্লিকা সেনগুপ্ত। সেই বাংলায় ঢুকতে হলে, জমিতে পা ফেলতে হলে, প্রাক রেনেশাঁস অনেক কিছু পুরনো মধ্যযুগীয় জঞ্জাল মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আসতে হবে।
সাহিত্যের আঙিনায় রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, রোকেয়া, নজরুল, এই মাটিতেই জন্ম নেন— একের পর এক। যোগ দেন তারাশঙ্কর, মানিক, নারায়ণ গাঙ্গুলী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুশীলরঞ্জন জানা, সুলেখা সান্যাল। ওপারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ুন আজাদ ও অন্যান্য। শিক্ষাঙ্গনে মাথা তোলেন আশুতোষ মুখার্জী, দীনেশচন্দ্র সেন, শহীদুল্লাহ, কাজী আবদুল ওদুদ, প্রমুখ। বিজ্ঞানের মঞ্চে আসেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তার পরে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশ, এবং সেই ধারাতেই এই সেদিনের সুশীল মুখোপাধ্যায়, বিনায়ক দত্তরায়। যুক্তিবাদের হাতিয়ার হাতে উঠে দাঁড়ান এক স্বশিক্ষিত আরজ আলী মাতুব্বর। সাহিত্যে বিজ্ঞানে সঙ্গীতে আলোচনায় তাঁরা যে সমস্ত বর্ণমালা উচ্চারণ করেন, তাতে প্রাচীন বলেই প্রাচীনের আর গরিমা থাকে না। বেদ উপনিষদ গীতা কোরান— বিচারকের আসন ছেড়ে সমস্তই যুক্তিতর্ক বিচারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলার বুকে যে গল্প উপন্যাস নাটক জন্ম নিতে শুরু করে তার মর্মবস্তু চরিত্র চিত্রণ সংলাপ ভক্তিবাদ থেকে সরে যেতে থাকে। যে সংবাদপত্র কাজ শুরু করে তাতেও ইংরেজ শাসক আর গ্রাম বাংলার জমিদারের অপশাসনের কাহিনি কম বেশি উদ্ঘাটিত হতে থাকে। যুক্তি, সত্য, মানবিকতা বড় হয়ে দাঁড়ায়। তার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনের চরিত্ররা দলে দলে এই মাটিতে উঠে আসে। সমাজে রাজনীতিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ বাংলার স্বাভাবিক পলাশ শিমূল শিউলি কেতকী।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বঙ্কিম বিবেকানন্দ অরবিন্দ হয়ে তাতে আবার কিছু ফুটোফাটাও হয়েছে। বিজেপি-র ঢুকবার জন্য সেই সব ফুটোগুলিই হয়ত ভরসা। কিন্তু তারও চারপাশে এমন সব আয়োজন যে ধর্মীয় বিদ্বেষ চেপে যদি বা রাখা যায়, প্রকটিত হওয়া মুশকিল।
একা রবীন্দ্রনাথ যে নাচগানের চর্চা শুরু করেন, পয়লা বৈশাখে এবং পৌষে যে উৎসবের আয়োজন করেন, আর যে সমস্ত নৃত্যনাট্যে বাঙালি মেতে ওঠে— বাল্মীকি প্রতিভা, চণ্ডালিকা, শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, ইত্যাদি— তাতে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক বাণীর স্পর্শদোষ থাকলেও কিছুতেই মুসলিম বা দলিতের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে দেয় না, বরং ঘৃণা বিদ্বেষের প্রতিষেধ তৈরি করে দেওয়াল তুলে দাঁড়ায়। নজরুলের “মৃত্যুক্ষুধা” আর “কুহেলিকা” সরাসরি হিন্দুমুসলমানের যুক্ত প্রয়াস হিসাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারণা তুলে ধরে। কাঁটাতারের বেড়ার দুই পারের বাঙালিই তাতে উজ্জীবিত এবং উদ্দীপ্ত হয়। রফিক জব্বাররা পাঁচ জন ওপারে আর এপারে কমলারা উনিশজন বাংলা ভাষায় গান গাইবে বলে রক্ত দিয়ে বাঙালিকে ঋণগ্রস্ত করে রাখে বছরের পর বছর। নেশাগ্রস্তও। সঙ্ঘ পরিবারের সাধ্য কী এইসব দেওয়াল ভেঙে বাঙালির মনে বিভাজনের কাওয়ালি শোনায়।
[৩]
মাটির সঙ্গে সংযোগবিহীন বলেই বিজেপি-র পক্ষে “সোনার বাংলা” গড়ার জন্য একশো প্রার্থী দিতেই নাজেহাল অবস্থা। তাও আবার টিএমসি এবং সিপিএম থেকে শখানেক নেতা কিনেও। আদি এবং কিনে আনা নেতাদের মধ্যে কাদের টিকিট দেওয়া হবে, তা নিয়েও এক ধুন্ধুমার কাণ্ড পদ্মের দপ্তরে দপ্তরে। চেয়ার টেবিল জানালার কাচ ভাঙার সে এক এলাহি গেরুয়া রামভক্তিযুদ্ধ! জনসেবার জন্য চেয়ার না পেলে প্লাস্টিকের চেয়ারের উপর সে কী বিষম ক্রোধ বর্ষণ! বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙায় হাত পাকিয়ে দলের অফিসে ঢুকে ভাঙচুর করায়ও সে কী ভয়ানক উৎসাহ!! সুশৃঙ্খল সঙ্ঘকর্মীরা তখন নিজেদের দলের নেতাদের উপর দিয়ে চিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রণরঙ্গের রিহার্সাল করে নিচ্ছে বলে সংবাদে প্রকাশ।
তার মধ্যেই আবার রাজ্যে পদ্মফুলের নেতা হয়েছেন দিলীপ ঘোষ। যিনি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মুখে একটা আস্ত নর্দমা নিয়ে ঘোরেন এবং তার জন্য খুব গর্ব বোধও করেন। বিজেপি-র ভেতরের সংস্কৃতির অন্তর্লীন চেহারাটা বাইরে মেলে ধরতে তাঁর সত্যিই জুড়ি নেই। সারা দেশে, কিংবা অসম, ত্রিপুরা এবং উত্তরপ্রদেশে তাঁর দল যা যা জনস্বার্থ-বিধ্বংসী কাজ করে যাচ্ছে, পশ্চিমবাংলায় ভোটের ইস্তাহারে তার একেবারে উলটো প্রতিশ্রুতি দিতে তাঁদের আটকাচ্ছে না। আর তাঁরা ভাবছেন, তাঁদের এই দিবালোকিত মিথ্যাচার কেউ বুঝবে না।
হয়ত একটা জিনিসই তাঁদের পরম ভরসা। নির্বাচন কমিশন তাঁদের প্রায় পকেট বন্দি সংস্থা হিসাবে কাজ করছে। যেমন সুপ্রিম কোর্ট, ইডি, সিবিআই, এনআইএ, ইত্যাদিও তাঁদের দলের প্রায় শাখা কমিটিতে পর্যবসিত। প্রধান বিচারপতি বোবদে সাহেব এক বিজেপি এমপি-র বাইকে হেলমেট ছাড়া চেপে নাগপুরের সঙ্ঘ দপ্তর ঘুরে এসে এটা হয়ত স্পষ্ট করে দেশবাসীকে জানিয়ে দিতে চেয়েছেন। ইসি-র আচরণও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সামান্য উত্তেজক বক্তব্য রাখলেই তাঁরা অন্য দলের প্রার্থীদের কাছে শমন পাঠাচ্ছেন, কিন্তু বিজেপি-র রাজ্য ও কেন্দ্রীয় নেতারা দুবেলা উঠতে বসতে সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক বয়ান দিলেও ইসি-র কান আছে বলে মনেই হচ্ছে না।
বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতাদের ঘুরে ঘুরে ভোটের কাজ তদারকিতে সুবিধা হবে বলে নির্বাচন হচ্ছে ৮ দফায়— যার মধ্যে এ পর্যন্ত ৫ দফা শেষ হয়েছে। বুথে বুথে রাজ্য পুলিশকে কার্যত সরিয়ে দিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনির হাতেই সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত যে কতটা অমানবিক ও অন্যায় তা বোঝা গেল ১০ এপ্রিল ভোটের দিনে কুচবিহার জেলার শীতলকুচিতে এক ভোটকেন্দ্রে পাঁচজনকে গুলি করে মেরে ফেলার ধিক্কৃত ঘটনায়। বহু লোক নাকি জড়ো হয়ে টাঙ্গি হাতে আক্রমণ করেছে বলে অভিযোগ তোলা হল, সিআরপিএফ জওয়ানরা গুলি করে সিধে পাঁচ জন ভোটারকে মেরে ফেলল, অথচ, কেন, কী সেই গণ্ডগোল যা তারা অন্যভাবে, লাঠিচার্জ করে, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে থামাতে পারেনি, কারা এই “ভয়ানক” ঝামেলা করল—কোনও কিছুর কোনও ছবি নেই, ভিডিও নেই, ইসি কিছুই দেখাতে পারছে না, এরকম হল কী করে? আরও অদ্ভুত, গুলিতে মরল যারা সকলেই মুসলিম সম্প্রদায়ের। আবার পরশু দিন থেকেই নরেন মোদী অমিত শাহ দিলীপ ঘোষ এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কিছু বলা বা দুঃখপ্রকাশ করা তো দূরের কথা, হম্বিতম্বি করে বলেই চলেছেন, খুব ভালো কাজ হয়েছে, এরকম গুলি নাকি আরও চলবে, ইত্যাদি। তাঁদের কথা থেকেই পরিষ্কার, কোথাও একটা পরিকল্পনা করেই পদ্মের সুবিধার্থেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। যদি মুসলমান ভোটারদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে পদ্ম বিরোধী ভোটের কিছু অংশও কমিয়ে দেওয়া যায়। রাজ্য প্রশাসনকেও কেন কাজই করতে দেওয়া হচ্ছে না, ইসি-র এই বদাচরণে তাও স্পষ্ট।
ভিডিও হয়ত ডকুমেন্টারি হিসাবে দেশের অন্যত্র কোথাও তৈরি হচ্ছে। উপযুক্ত সংখ্যায় টাঙ্গির যোগান পেতে দেরি হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বাঙ্গালিদের মতো দেখতে অভিনেতা লোকজনও জড়ো করা দরকার। সব কিছু মিলিয়ে হাতে এসে গেলেই দালাল মিডিয়া এই সেই গোলমালের ছবি বলে এক চলচ্চিত্র দেখাতে শুরু করে দেবে। মুশকিল হচ্ছে, এই সব ছক এখন সকলেরই জানা হয়ে গেছে। “নিউটন” নামক হিন্দি এক সিনেমার কথাও অনেকেই স্মরণ করতে পারবে।
কিন্তু এত কাণ্ড করেও শেষ পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, তাঁদের কপালে একশো-র বেশি আসনের শিকে ছিঁড়ছে বলে কেউ বিশ্বাস করছে না। সংখ্যাটা ষাটে নেমে এলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ইভিএম ম্যাজিক নিয়ে অবশ্য চার দিকেই একটা গুঞ্জন চলছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের বহু দেশেই ইলেকট্রনিক ভোট যন্ত্র এখন প্রশ্নের মুখে। এই সন্দেহ মোচনের স্বার্থেই উন্নত অনেক দেশই আজকাল আবার পুরনো কাগজের ব্যালটে ফিরে যাচ্ছে।
এই ব্যাপারে একটা তাত্ত্বিক কথা সকলের মনে রাখা ভালো। ইভিএম সন্দেহ যদি বাস্তব হয়ও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সাধারণ পরীক্ষা করে ধরা পড়বে না। কেন না, কারিকুরি যদি কিছু করা হয়ে থাকেও, তা বেশিরভাগ যন্ত্রেই থাকবে না। বেশিরভাগ যন্ত্রই বাস্তবে ভালো ও ত্রুটিহীন হিসাবেই কাজ করবে। সামান্য কিছু মেশিনে হয়ত কিছু গণ্ডগোল থাকবে, যাকে রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় পোয়াসঁ ডিস্ট্রিবিউশন (Poisson Distribution) বলে সেই অঙ্ক অনুসারে। এবং তা কেবলমাত্র কেন্দ্র বিশেষে ও বুথ বিশেষে এমনভাবে ছড়ানো থাকবে যাতে ধরা পড়লেও অত্যন্ত অগ্রাহ্যকর ত্রুটি হিসাবেই মনে হয়। নির্বাচনী আধিকারিক থেকে শুরু করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের খুব অল্পসংখ্যক লোকই এই পোয়াসঁ ডিস্ট্রিবিউশনের খবর রাখেন। ফলে সেই সামান্য ত্রুটিকে সুবিন্যস্ত বা পরিকল্পিত ত্রুটি হিসাবে মনেই হবে না! কিন্তু সাজানো প্রোগ্রামটা তার কাজ সেরে রাখবে। এটা একটা সম্ভাবনা মাত্র— সুনিশ্চিত তথ্যের অভাবে আমাদের পক্ষে আশঙ্কামূলক অনুমান করার বাইরে আর কিছু বলার সাধ্য নেই।
[৪]
আশঙ্কাই বা করছি কেন?
করছি, কেন না, এমন একটা দল এখন কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায় যারা জনস্বার্থের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলেছে শখানেক কর্পোরেট পরিবারের বাণিজ্যিক স্বার্থকে দেখার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। যারা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ঘোষিত ও সম্ভ্রমিত সাংবিধানিক স্তম্ভগুলিকে অনায়াসে পদদলিত করে আইনসভা সহ সমস্ত আর্থিক, প্রশাসনিক, বিচারসম্বন্ধীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে দলদাসে পরিণত করছে, প্রতিবাদী মুখগুলিকে বিনা বিচারে জেলে পচিয়ে মারার ব্যবস্থা করছে।
করছি, কেন না, বিজেপি এই মুহূর্তে ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে তিনটি ফ্রন্টে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে: কৃষকদের বিরুদ্ধে কৃষি আইন; শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শ্রম কোড; এবং আপামর গরিব জনসাধারণের বিরুদ্ধে এনআরআইসি পরিকল্পনা। এই কালা আইনগুলির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের সম্ভাবনাকে রুখবার জন্য তারা করোনা প্রটোকলকে ব্যবহার করে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে রেখে শিক্ষাপ্রক্রিয়া এবং পঠনপাঠন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করে দিচ্ছে। বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক আশঙ্কার কথা যে পাঁচ রাজ্যে ভোটপর্ব মিটে গেলেই আবার লকডাউন চাপিয়ে দেওয়া হবে দেশের মানুষের উপর। সাধারণ মানুষের পেটের দিকে ধেয়ে আসবে আর একবার চাকরি ছাঁটাই, বেকারি, বেতনহীনতা, অর্ধবেতন, অনাহার, অর্ধাহার, আর তারা অপেক্ষা করে থাকবে রাষ্ট্রের করুণা ভিক্ষার উপর।
করছি, কেন না, এই কেন্দ্রীয় সরকার চুরিডাকাতি দুর্নীতিতে অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। এবং অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে সেই নতুন রেকর্ডগুলিকে বুক বাজিয়ে প্রদর্শন করে যাচ্ছে।
ফ্যাসিবাদ আমরা ইতিহাস বইতে পড়েছি। জার্মানি ইতালির ঘটনাবলির বিবরণে। আমরা আমেরিকায় ম্যাকার্থি যুগে মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বীভৎস সব কাণ্ডকারখানার কথাও জেনেছি বইপত্র পড়ে। চমৎকার ছবি পেয়েছি হাওয়ার্ড ফাস্টের মার্ক্সবাদী থাকাকালীন সাইলাস টিম্বারম্যান এবং পিকস্কিল উপন্যাসদ্বয়ে, আর মার্ক্সবাদ বর্জনের পর দ্য প্লেজ উপন্যাস পাঠ করে। আমরা সেই ফ্যাসিস্ট প্রকরণের কিছু ঝলকানো প্রয়োগ দেখেছি ইন্দিরা গান্ধির শাসনকালের দেড় দশকে— ভায়া ইমার্জেন্সি, আগে ও পরে।
কিন্তু এখন সেই বইতে পড়া ধারণা যেন দ্রুত ধুসর হয়ে যাচ্ছে বিজেপি-র কার্যকলাপ দেখে দেখে। মুসলিম বিদ্বেষ, ঘৃণার চাষ, গোমাংস নিয়ে বাড়াবাড়ি, ভিন্ন ধর্মে বিয়ে করার উপরে আইনি নিষেধাজ্ঞা, সাম্প্রদায়িক খুনখারাপিতে প্রকাশ্য প্ররোচনা ও যোগদান, দেশেরই একদল অধিবাসীকে রাজনৈতিক দেশভাগের অপকর্মের দায় চাপিয়ে অনাগরিক করে দেওয়ার চক্রান্ত— হিটলার মুসোলিনির পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলিকে যেন চোখের উপর এনে ফেলছে। তাই আমরা সাবধান হতে চাইছি। অন্যদের হুঁশিয়ারি দিতে চাইছি।
ফ্যাসিবাদ রুখবার দায় নিতে হবে বামপন্থীদেরই। টিএমসির পক্ষে এই কাজ সম্ভব নয়। তারা সংসদীয় স্বার্থে আজ হয়ত বিজেপি-র বিরোধী, কোনও মতাদর্শগত কারণে নয়। ক্ষমতার জন্য তাদের মধ্যে এক কালে যেমন সখ্যতা ছিল, এখন তেমনই দ্বন্দ্ব আছে। এই দ্বন্দ্বের উপর খুব বেশি ভরসা করা যায় না, আবার এই দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করাও কোনও বুদ্ধিদীপ্ত কাজের কথা নয়।
টিএমসি-র কাছে বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারিয়েছে বলে এখন বিজেপি এসে ওদের হঠিয়ে দিলে মন্দ হয় না— এই ভাবনার সঙ্গে টিএমসি-র রাজনৈতিক অবস্থানের খুব কিছু ফারাক নেই। একে আর যাই হোক বামপন্থা বলা যায় না। বামপন্থীদের নিতে হবে দৃঢ় মতাদর্শগত অবস্থান— সাহসের সঙ্গে যে কোনও মূল্যে বিজেপি-কে রুখবার মতো রাজনৈতিক লাইন। একথা সত্য যে নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে এলেও ফ্যাসিবাদকে স্রেফ ভোটে হারিয়ে পরাস্ত যায় না। তার জন্য চাই রাস্তায় নেমে সক্রিয় প্রতিরোধ, যেমনটা দিল্লির বুকে এই মুহূর্তে উত্তরভারতের লক্ষ লক্ষ চাষি করে দেখাচ্ছেন। আবার একথার মানে এও নয় যে রাস্তায় পরাস্ত করব বলে ভোটে হারানোর সুযোগ এলেও তাকে ব্যবহার করব না। এরকম দুটো চিন্তাই একমুখী ও একপেশে। ঘরে বাইরে রাস্তায় বাসে ট্রেনে চায়ের দোকানে বাজারে পার্কে ফ্যাসিবাদকে যেখানেই কাজ করতে দেখতে এবং শুনতে পাবেন, আঘাত করতে হবে। এই তালিকায় বুথগুলিকেও রাখতে হবে।
লড়াই জারি থাকুক!