Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্ধিক্ষণে কৃষক আন্দোলন

সন্দীপ পাণ্ড্যে এবং রাহুল সিং রানা

 

লেখকদ্বয় সমাজকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী

বিগত কয়েক মাস ধরে কৃষকদের আন্দোলন চলছে। পঞ্জাব আর হরিয়ানার মানুষেরা ব্যারিকেড ভেঙে ভারতের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হয়ে এই বিক্ষোভগুলির সূত্রপাত করেন। প্রত্যাশামতোই বিক্ষোভরত কৃষকদের আটকাতে নানা জায়গায় বাধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাবতীয় প্রতিরোধ সত্ত্বেও কৃষকেরা দিল্লির সীমান্তগুলিতে পৌঁছাতে পারেন। যদিও তাঁরা বোট ক্লাবে এসে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন, অনিচ্ছুক এবং অনাগ্রহী সরকার দিল্লি পুলিসকে আদেশ দেয় হরিয়ানা আর দিল্লির মধ্যে সীমানা হিসেবে চিহ্নিত সিংঘু বর্ডারে কৃষকদের আটকে দেওয়া হোক। তখন সরকার নিশ্চয়ই ভেবেছিল কয়েকটি রাজনৈতিক দলের উসকানিতে ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে হাতেগোনা বিক্ষুব্ধ কৃষকরা পথে নেমেছেন। অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক কৃষকের মনোবল কতটা দৃঢ়, তা সরকারপক্ষ টেরও পায়নি। এবং সেই থেকে আন্দোলন শুধু বাড়েইনি, বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

সমগ্র আন্দোলনটিকে বেআইনি প্রমাণ করবার জন্যে নানান কল্পকথার মাধ্যমে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল ‘খলিস্তানি’, ‘দেশবিরোধী’ ইত্যাদি বলে। কিন্তু তাতে আন্দোলন আরও মজবুত হয়। পাঞ্জাবি আর হরিয়ানভিদের আমাদের দেশ চেনে ভারতীয় সৈন্যবাহিনিতে তাঁদের বিপুল অংশগ্রহণের জন্যে, মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাঁরা। তাঁদেরকে এভাবে অপমান করাটাকে মেনে নিতে না পেরে দলে দলে মানুষ আন্দোলনে শরিক হয়ে এই ধারণাটি ভেঙে দেন যে তাঁরা বিভ্রান্ত নন এবং কোনও বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের উসকানিতে তাঁরা আন্দোলনে যোগ দেননি। আন্দোলনটি তাই সিংঘু বর্ডারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এক রাতের মধ্যেই তা টিকরি বর্ডার এবং গাজিপুর বর্ডারে ছড়িয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ থেকে কৃষকেরা দলে দলে এসে এই প্রতিবাদে সামিল হন।

এই আন্দোলনগুলিকে ঠেকাতে সরকারের যে ব্যর্থতা, তা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা যেতে পারে। তিনটি কৃষি আইন জারি করবার নেপথ্যে কোন উদ্দেশ্য ছিল, তা বোঝাতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে মোদি সরকার। অধিবেশন না চলা সত্ত্বেও একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে এই আইনগুলিকে সংসদে পাশ করানো হয়। তদুপরি, রাজ্যসভায় যে উপায়ে এই আইনগুলিকে পাশ করানো হয়, তাতে সন্দেহের অবকাশ যথেষ্টই। যাদের স্বার্থ রক্ষা করবে বলে প্রমাণিত হবে বলে মোদি সরকার দাবি করছে, সেই কৃষকদের কোনও প্রতিনিধিই এই আইনগুলি রচনার পর্বে অংশগ্রহণ করেননি। প্রথমেই ভুল পদক্ষেপ নিয়ে পরে মিথ্যা আখ্যান গড়াটা সরকারের অভ্যাস হয়ে গেছে, অথবা অভ্যাস হয়ে গেছে অতীতে ওই ভুল পদক্ষেপটি নেওয়ার ফলে যে দুর্দশা হয় তা অবজ্ঞা করা। নোটবন্দি পর্বটি এর যথার্থ নিদর্শন। ব্যাঙ্কে অবৈধ টাকা বিষয়ে কোনও রিপোর্ট না পৌঁছানোর কারণ দেখিয়ে কালো টাকা বার করে এনে, আতঙ্কবাদ থামিয়ে সরকারের অর্থব্যবস্থা চাঙ্গা করবার কথা বলা হয়েছিল। নোটবন্দি করবার পদক্ষেপটি নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর স্পিডব্রেকার ব্যবহার করা হল যে দেশের অর্থনীতিই ধুঁকতে শুরু করল, তারপর করোনাভাইরাস সংক্রমণ হেতু এমন ধাক্কা খেল যে তার অবিমিশ্র ফল আমরা এখনও ভোগ করছি।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের দুর্দশা। ভারতবর্ষের কৃষকেরা বহু দশক ধরেই তাঁদের ফসলের উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। একটি হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে ১৯৭০ থেকে ২০১৫ সাল অবধি একজন স্কুল শিক্ষকের বেতন ২৮০ থেকে ৩২০ বার বেড়েছে। একই সময়সীমায় একজন কৃষকের রোজগার বেড়েছে মাত্র ১৯ বার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে আখচাষিদের মূল্য পেতে বিলম্ব হওয়াটা এখনও এক গভীর সমস্যা। এতগুলি দশক ধরে একের পর এক সমস্যা জমেছে। মোদি সরকার তাতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার ফলে তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে গেল। এই তিনটি আইন কৃষকদের এই বিশ্বাসকে আরও পাকা করে দিল যে ফসলের ক্রমশ কমতে থাকা মূল্য এবার আরও নেমে গিয়ে তাঁদেরকে খোলা বাজারের মর্জি অনুযায়ী বাঁচতে বাধ্য করবে।

খোলা বাজার ব্যবস্থা চালু হবার পরে সারা বিশ্বে একটি কৃষকেরও কোনও উপকার হয়নি। কৃষিকাজে বরাবরই ঝুঁকি ছিল। কারণ, এমন অনেক কিছুর প্রতি তা নির্ভরশীল যার কোনওটাই আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে কৃষকের হাতে মাথাপিছু দুই হেক্টরও জমি নেই, সেখানে খোলা বাজারের মর্জি অনুযায়ী তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার অর্থ হল অতিরিক্ত সরবরাহের ফলে ফসলের মূল্য ক্রমশ কমবে। কোল্ড স্টোরেজের অভাব আছে, যানবাহনের খরচও অত্যন্ত বেশি। সীমিত সম্পদ নিয়ে একজন কৃষক কোন সাহসে নিজের জমিতে বিভিন্ন ফসল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে দূরদূরান্তে তা বেচতে যাবে? তার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো কোথায়? সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, এই আইনগুলির থেকে যাবতীয় ফায়দা বেসরকারি সংস্থাগুলিরই হবে। সরকার কেন কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের ফসলের জন্যে ন্যূনতম ক্রয়মূল্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছে না? এতে কি কৃষকদের নানান রকম ফসল উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হয় না? মোদি সরকার যদি নিশ্চিত থাকে যে বেসরকারি সংস্থাগুলি থেকে কৃষকেরা মান্ডিগুলির থেকেও বেশি মূল্য পাবেন, তাহলে কেন যে কোনও ফসলের জন্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকেই আইনসম্মত খরিদমূল্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন না? এর যুক্তি দিতে সরকার নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেও আইনগুলিকে সম্পূর্ণ রদ করে ন্যূনতম সহায়ক মুল্যকে আইনি মর্যাদা দিতে অসমর্থ হওয়ার ব্যাপারে গোঁয়ার্তুমি চালিয়ে যাচ্ছে।

ক্রমবর্ধমান আন্দোলনই বুঝিয়ে দিচ্ছে মোদি সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। একজন সাধারণ মানুষও টের পাচ্ছেন এই সরকার কেমনভাবে বিভেদমূলক রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এবং আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শের অভাবকে এই রাষ্ট্র যে নীরবে মেনে নেবে না, তা বুঝতেও কারও বাকি নেই। বিক্ষোভ এখন বিকেন্দ্রিত। সারা ভারত জুড়ে তা ‘কিসান মহাপঞ্চায়েত’-এর রূপ নিয়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়রা দেশের প্রতিটি কোণে পৌঁছে গেছেন, এমনকি, যে রাজ্যগুলিতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে বা চলছে সেখানেও। এতগুলি দশক ধরে কৃষকদের প্রতি যে অবিচার হয়েছে, সেই বিষয়ে ওনারা সবাইকে সচেতন করে বোঝাতে চাইছেন এই তিনটি আইন কার্যকর হলে ভারতের কৃষিব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হবে। মহাপঞ্চায়েতে অসংখ্য মানুষ এসে কৃষক ইউনিয়ন ও তার নেতৃস্থানীয়রা সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ শানাচ্ছে, তার প্রতি নিজেদের সংহতিকে নথিবদ্ধ করছেন। পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এবং উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিণামে মহাপঞ্চায়েত যদি কিছুটা প্রভাবও ফেলতে পারে, তাহলে তা মোদি সরকারের অন্তিম পর্যায়ের সূচনা করবে। এই আন্দোলনের কারণে যে রাজনৈতিক লাভ হবে তা কৃষক ইউনিয়নগুলির পক্ষে সরকারকে নিজেদের দাবিগুলি মানতে বাধ্য করবার এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে।