স্বপন ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যাপক
সম্প্রতি হরিয়ানার সোনেপতে অবস্থিত অশোকা ইউনিভার্সিটি খবরে এসেছে তাদের দুই হেভিওয়েট ফ্যাকালটির পদত্যাগের কারণে। মার্চের ১৬ তারিখে অধ্যাপনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে খবরে আসেন প্রতাপ ভানু মেহতা। এই প্রথমবার নয়, ২০১৯-এ এই অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ‘অ্যাকাডেমিক’ কারণে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু এখানে একটি মুক্তচিন্তার পরিসর নির্মাণের প্রয়াসকে মাঝপথে বিনির্মাণের ভাবনায় আমল দিতে চাননি বলে থেকে যেতে দ্বিধা করেননি, অন্তত এই মার্চ পর্যন্ত। অধ্যাপক মেহতা অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট, প্রিন্সটনের ডক্টরেট। অশোকাতে যোগ দেবার আগে অধ্যাপক মেহতা পড়িয়েছেন অক্সফোর্ডে, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি অফ ল-তে। সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের সভাপতিও ছিলেন তিনি। এর বাইরে অধ্যাপক মেহতার বড় পরিচয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর হিসাবে। তাঁর নিয়মিত কলামে সেখানে তিনি সরকারের বিভিন্ন পলিসি, বিশেষত নরেন্দ্র মোদি সরকারের সাম্প্রতিককালে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির পর্যালোচনা করে থাকেন এবং সমালোচনা করতে ছাড়েন না। ফিনান্সিয়াল টাইমস সহ একাধিক আন্তর্জাতিক জার্নালে তিনি লিখে থাকেন এবং আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভিউর তিনি অন্যতম সম্পাদক। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি লিবারেল আর্টসের অগ্রণী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ২০১৪-তে ‘অ্যাট পার উইথ বেস্ট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বপ্ন ফেরি করে, তা অ্যাকাডেমিক জগতের আরও বেশ কিছু পরিচিত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অধ্যাপক মেহতাকেও আকৃষ্ট করতে পেরেছিল সন্দেহ নেই। অধ্যাপক মেহতা পদত্যাগ করবার পরে পরেই অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন মোদি সরকারের ভুতপূর্ব চিফ ইকনোমিক অ্যাডভাইসর (২০১৪-১৮) অরবিন্দ সুব্রামানিয়ন। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিতে ভোলেননি যে প্রতাপ ভানু মেহতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন কেন না “Even Ashoka, with private status and backing by private capital can no longer provide a space for academic expression and freedom, is ominously disturbing,” (প্রাইভেট পুঁজি আর প্রাইভেট তকমার ভূষণ এমনকি অশোকার মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পড়াশুনো ও চিন্তার মুক্ত পরিসর তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে যা কেবল অশুভ ইঙ্গিত নয়, রীতিমতো হতাশাব্যঞ্জক।) আসলে ভারতে উচ্চশিক্ষায় পুঁজি যার নীতি তার। এই শিক্ষা-প্রোমোটাররা মুক্ত চিন্তার পরিসর বলতে যা বোঝেন তা কতটা বেড়ি আর কতটা ফাঁস তার একটা মডেল হয়ে রইল অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ যদি নমুনা হয় মুক্তচিন্তার পতাকা ওড়ানো প্রাইভেট ও অটোনোমাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, তাহলে এই নয়া শিক্ষানীতি কতটা জায়গা ছাড়বে স্বাধীন ভাবনার জন্য, আর কতটা জায়গাই বা সরকারকে পরোয়া না করে নিতে চাইবে তথাকথিত বিশ্বমান- তা নিয়ে সংশয় তৈরি হবেই। বস্তুত এটাই যে হবে তা করোনাকালে পরিবেশিত নয়া শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে আলোচনায় দেশের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থার যুক্ত মানুষজন অনুমান করেছেন, জোর গলায় বলেছেন। যেখানে সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি মুক্তচিন্তার বধ্যভূমি হয়ে উঠছে দিন কে দিন, সেখানে শিক্ষাব্যবসা থেকে যারা পয়সা করতে চায় তারা সাহসী হয়ে উঠবে এটা ভাবাই বাতুলতা। সরকার পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারের মন যুগিয়ে চলবার দায় যতটা কর্তৃপক্ষর থাকে ততটা ছাত্র-শিক্ষকদের থাকে না, কিন্তু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে প্রশাসন থেকে শিক্ষাদান সবই প্রোমোটারদের নজরের তলায় ফলে সেখানে মেধাও মুক্ত হবার সম্ভাবনা ক্রমক্ষীয়মাণ হয় আসবে এটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমের যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মডেলে এখানে প্রাইভেট ক্যাপিটাল উচ্চশিক্ষায় ঢোকার কথা তারা সরকারের কাছ থেকে যত বড় ফান্ডিংই পাক না কেন, সরকারের মন যুগিয়ে চলতে হবে এমন মুচলেকা দিয়ে তারা ক্যাম্পাস খুলবে না। আপাতভাবে কাগজে কলমে অন্তত মনে হতে পারে যে স্বশাসিত ইউনিভার্সিটিতে মুক্ত চিন্তার প্রসারে বাধা অনেক কম কেন না সরকার আরোপিত প্রতিবন্ধকতাগুলি সেখানে নেই। ২০১৬ তে মামিদালা জগদেশকুমারকে জেএনইউ-তে উপাচার্য করে আনার পর ছাত্র শিক্ষক নির্বিশেষে তাঁর সঙ্গে সংঘাত কম হয়নি, মাত্রাছাড়া তিক্ততা মুক্তচিন্তার পরিবেশকে বিষিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল, ভায়োলেন্স হয়েছে, রক্তপাত হয়েছে, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ, আইডেন্টিটি পলিটিক্স, আরবান নক্সাল কত রকম তকমায় চিহ্নিত করা হয়েছে ছাত্র থেকে ফ্যাকালটি সবাইকে কিন্তু কোনও শিক্ষককে চিন্তায় বিপজ্জনক বলে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা যায়নি, যেটা অশোকা’তে সম্ভব হল। বিশ্বভারতীর উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী যে এটারই অনুকরণ চাইছেন তা বোঝা যায়। কিন্তু সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিতে প্রোমোটারকে খুশি রাখার দায় অন্তত ছাত্র- শিক্ষকদের নেই, যেটা অশোকাতে আছে, অন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতেও থাকবে। মুক্তচিন্তাকে বন্ধক দিয়েই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিকে বাঁচতে হলে তাকে সব অর্থেই ব্যর্থ বলাই উচিত, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয় মডেল বলছে ভারতে অন্তত শিক্ষা-প্রোমোটারদের হাত ধরে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সাবালকত্ব অর্জন করতে পারার মত পরিস্থিতি এখনও নেই, তাঁদের ‘জনসেবা’র উদ্দেশ্য-বিধেয় না বদলালে ভবিষ্যতেও হবে এমন আশা নেই বললেই চলে।
জনসেবার কথাটা জেনে বুঝেই বললাম। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা একজন নয়, ফাউন্ডার রূপে সেখানে ৪৬ জনের নাম নথিভুক্ত। এঁরা নিজেরাই নিজেদের তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন কে কত দিয়েছেন তার উপর ভিত্তি করে যার মধ্যে ১০ কোটি বা বেশি দিয়েছেন তাদের নিয়ে তৈরি করা হল বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ এবং তাঁদের অবস্থান ও অংশীদারিত্ব যে পিরামিড শীর্ষে সর্বোচ্চ খাদকের মতই হবে তা এই ইকোসিস্টেমে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা যে কেউ অনুমান করতে পারবেন। এঁরা সকলে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন যে দর্শনে তা নিয়ে সংশয়ের জায়গা নেই— It was a philosophy of creating by giving, about answering to a greater calling, that had brought them there. নিজেদের ‘দান’-এর মাধ্যমে, বৃহত্তর দাবির ডাকে সাড়া দিয়ে কিছু ‘সৃষ্টি’ করার উদ্দেশ্যেই তাঁরা একত্রিত হয়েছিলেন। এই সৃষ্টিকার্যের পুরোধা ছিলেন ফাউন্ডার ট্রাস্টি বিনীত গুপ্তা যার উচ্চশিক্ষায় তখনও পর্যন্ত মহৎ অবদান ছিল জাম্বোরি এডুকেশন নামের একটি টেস্ট প্রিপারেশন মেটেরিয়াল তৈরির কোম্পানি তৈরি করা। তৎকালীন হরিয়ানা সরকারের কাছ থেকে সোনেপতের জমি ও অ্যাপ্রুভাল আনতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন ইনি এবং এঁর ভ্রাতা। শিক্ষানুরাগী শিল্পপতিদের এক ছাতার তলায় এনে ফান্ড তৈরির কাজটা নিলেন আশিস ধাওয়ান। আশিসের ব্যবসায় হাতেখড়ি ১৯৯৯ তে যখন তিনি ক্রাইস ক্যাপিটাল নামের একটা প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানিস্থাপন করেন। শিক্ষায় এলেন ২০১২ সালে সেন্ট্রাল স্কোয়ার ফাউন্ডেশন তৈরি করে। প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানিগুলির কাজ হল স্টার্ট আপ বা চালু ব্যবসার জন্য পুঁজি সংগ্রহ করা বা করার পথ দেখানো পরামর্শ দেওয়া। অশোকের আজকের এই অবস্থার এবং ভিশন-মিশনের অনেকটাই আশিসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কেন সে কথায় পরে আসছি তার আগে আশিসের জার্নিটা দেখে নেওয়া যাক। আশিস ধাওয়ান শিক্ষায় এলেন ২০১২ সালে সেন্ট্রাল স্কোয়ার ফাউন্ডেশন তৈরি করে। ওই একই সময় সেন্টার ফর সিভিল সোসাইটির বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ তার উপদেষ্টা পরিষদে চেয়ারম্যান রূপে বেছে নেয় তাঁকে। সিভিল সোসাইটি শব্দবন্ধ আমাদের বিভিন্ন আলোচনায় যে প্রসঙ্গে উত্থাপিত হয়ে থাকে তার সঙ্গে এটিকে মেলানো একটু কঠিন কেন তা এর স্টেকহোল্ডারদের পরিচয় জানলেই স্পষ্ট হবে। আশিসের আগে এটির চেয়ারম্যান ছিলেন লুই মিরান্ডা, যিনি আই ডি এফ সি ভেঞ্চার ক্যাপিট্যাল থেকে এসেছিলেন, ছিলেন অঙ্কুর শেঠ যিনি অ্যাকুমেন ফান্ড নামের একটি ইনভেস্টমেন্ট সংস্থার এডুকেশন পোর্টফোলিও ম্যানেজ করতেন, ছিলেন আনন্দ রথী ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের প্রবীন চক্রবর্তী ইত্যাদির মত দালাল স্ট্রীটের কেউকেটারা। ২০১৪ তে অশোকার পথ চলা শুরুর সময় তার প্রোমোটাররা আশিস ধাওয়ানকে নিয়ে এলেন এখান থেকে পুঁজি বাড়ানোর লক্ষে কেন না তার প্রাইভেট ইকুইটি ফার্মের অভিজ্ঞতা এই নতুন ইউনিভার্সিটির জন্য অর্থ সংগ্রহে কাজে লাগবে। অশোকা ইউনিভার্সিটি স্থাপিতই হয়েছিল এই রকম বিভিন্ন ব্যবসায়িক ইন্টারেস্টের লোকজনের মানবকল্যাণের ইচ্ছা জাগরূক হয়ে উঠবার ফলে। যাঁদের টাকায় গড়া এটি তাদের মধ্যে যেমন দালাল স্ট্রিটের মহারথী মোতিলাল অসওয়াল ছিলেন, তেমনই ছিলেন ফ্যান-লাইট-সুইচ- কেবল বানানোর কম্পানি হ্যাভেলস-এর জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর অনিল গুপ্তা, সান ফার্মার ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ সাংভি অথবা ডালমিয়া সিমেন্টের মালিক পুনীত ডালমিয়ার মত ব্যবসায়ীরা যাঁদের ঘোষিত উদ্দেশ্য আপনি পিঞ্চ অফ সল্ট লাগিয়ে হজম করতেই পারেন, কিন্তু তাঁরা নিজেরাই বলেছেন মহৎ- to create a superstructure that allows the university and its staff a degree of autonomy unprecedented in Indian higher education- ভারতের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অশ্রুতপুর্ব মাত্রার স্বশাসনের নজির স্থাপন করা। ভারতের বেশ কয়েকজন নামী শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীকেও আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এঁদের মধ্যে যেমন আন্দ্রে বেতে, রামচন্দ্র গুহ, মালবিকা সরকার আছেন তেমন আছেন রুদ্রাংশু মুখার্জি, প্রতাপ ভানু মেহতা বা অরবিন্দন সুব্রামানিয়ানের মত স্ব স্ব ক্ষেত্রে পরিচিত মানুষ । বলা দরকার বর্তমানে, অর্থাৎ যখন এই ঘটনা ঘটল তখন অশোকা’র আচার্যর পদে বৃত আছেন রুদ্রাংশু মুখার্জি এবং উপাচার্যের আসনে আছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন ভি সি মালবিকা সরকার। এঁদের কথায় আমাদের পরে আসতে হবে তবে তার আগে যেটা বলা দরকার তা হল, মুক্তচিন্তার দাম দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবার ঘটনা এই প্রথম নয়।
অশোকা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনা প্রথমবার সংবাদে আসে ২০১৬-তে। সে বছরের ৭ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ং ইন্ডিয়া ফেলোশিপ প্রোগ্রামের দু’জন সিনিয়র অ্যাডমিন্সট্রেটিভ অফিসার, যথাক্রমে আদিল মুস্তাক শাহ এবং সৌরভ গোস্বামী ‘ব্যক্তিগত’ কারণে পদত্যাগপত্র জমা দেন। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর রাজেন্দ্রন নারায়নন ওই একই কারন দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেবারেও জানিয়েছিল এঁদের কাউকেই কোনও চাপ দেওয়া হয়নি এবং তাঁরা স্বেচ্ছায় চলে গিয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল এই যে ওই বছরের জুলাই মাসে হিজবুল মুজাহিদিন কম্যান্ডার বুরহান ওয়ানি’র ‘এনকাউণ্টার কিলিং’-এর পরে কাশ্মিরে যে গণবিক্ষোভ এবং সেনা সক্রিয়তা শুরু হয় তাতে অশোকা’র ৮৮ জন একটি স্বাক্ষরিত পিটিশন জমা দেন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে, যাতে উপত্যকায় সরকারের অতি-সক্রিয়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। উল্লিখিত দুই শিক্ষা সহযোগী স্টাফ এবং দুজন মাত্র শিক্ষক— নারায়ণন এবং কুনাল জোশি ছিলেন (তখন অবশ্য তিনি প্রাক্তনী, পরে ফ্যাকাল্টি হয়ে যোগ দিয়েছেন এবং অবশ্যই তার আগে ভুল স্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছেন) স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে। আজকের আচার্য রুদ্রাংশু মুখার্জি তখন ছিলেন উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা বিনীত গুপ্তা ছিলেন সহ-উপাচার্য। এঁরা সাফাই দিয়ে জানিয়েছিলেন মুক্তচিন্তা কোথাও কম পড়ে নাই বটে তবে কিনা ইউনিভার্সিটির নাম প্রতিবাদপত্রে থাকা শোভনীয় নয়। চারজনের একটি কমিটি গঠন করা হল যার একজন ছিলেন মালবিকা সরকার এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে নারায়ণনকে পদত্যাগে বাধ্য করা হল যেভাবে তাকে পরিভাষায় বলা হয়— ‘আন্ডার ডিউরেস’ অর্থাৎ চাপে ফেলে।
পি বি মেহতার পদত্যাগ ভারতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তার ঢাকটিকে আর একবার ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল। তিনি যা পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন তা হল- অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তিনি ‘পলিটিক্যাল লায়াবিলিটি’– রাজনৈতিক দায়বিশেষ। পদত্যাগপত্রটিতে তিনি লিখেছেন সংবাদমাধ্যমে তাঁর লেখাগুলি যা সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা আহ্বান করে, সমস্ত মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে, স্বাধীনভাবে বাঁচবার অধিকার সুনিশ্চিত করবার কথা বলে, সেগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বিপজ্জনক বিবেচিত হচ্ছে কর্তৃপক্ষর চোখে। তিনি এও বলেছেন যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেটি লিবারেল অর্থাৎ মুক্ত চিন্তার ধারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় আশা করা অমূলক হবে না সেটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ভিন্ন ভিন্ন মতকে সম্মান করতে পারবে এবং সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারাটা অশোকার পক্ষেও অসম্ভব নয়। নীটসের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে চর্চিত হতাশার বাক্যটি স্মরন করেছেন তিনি– ‘no living for truth is possible in a university’- সত্যানুসন্ধানে বাঁচা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব নয়। প্রতাপভানু বলেছেন তাঁর ঐকান্তিক আশা আপ্তবাক্যটি যেন সত্য প্রমাণিত হতে ব্যর্থ হয়।
ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে মুক্ত চিন্তার পরিসর তৈরি হওয়া সম্ভব কিনা তা নির্ভর করছে তার স্টেকহোল্ডাররা কতটা মুক্তি প্রত্যাশা করেন তার উপরে। সিলেবাসের বাঁধনে বাঁধা উচ্চশিক্ষায় আজকের সরকারের কাছে যা অবশ্যপাঠ্য কালকে সরকার বদলালে তা পরিত্যাজ্য। বেসরকারি এবং স্বশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তো সে দায় নেই, তাহলে তার বেড়ি কোথায়? উদ্দেশ্যই যদি সরকারি অনুগ্রহ পাওয়া হয়, যদি কেবলমাত্র টাকা গোণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে প্রয়াসী হয় শেয়ার বাজারের প্রোমোটাররা তাহলে বেড়ি তার আনখশির, এখানে লিবারেল চিন্তা হল সোনার পাথরবাটি, অশোকা মডেল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। জানা যাচ্ছে পদত্যাগপত্রটি জমা পড়ার আগে ট্রাস্টি বোর্ডের পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান আশিস ধাওয়ান এবং প্রমথ রাজ সিনহা দেখা করেন পি বি মেহতার সঙ্গে এবং জানিয়ে দেন চলমান রাজনৈতিক বাতাবরণে তাঁর মার্গদর্শন এই অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ‘প্রোটেক্ট’ করা সম্ভব নয়। ফলে আগে কিবা কহ আর-এর অবকাশই দেননি মেহতা এবং তথাকথিত লিবারেল প্রতিষ্ঠানটি থেকে মুক্তি চেয়ে নিয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এ সম্পর্কে তাদের রিপোর্টে একটি জমিসংক্রান্ত গোলমেলে ডিলের কথাও উল্লেখ করেছেন যা ফয়সালায় আনতে মেহতার উপস্থিতি প্রোমোটারদের পক্ষে অসুবিধেজনক হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এহ বাহ্য, অশোকার হাতে থাকা শুধু জমির দামই বর্তমান বাজারে হাজার কোটি টাকার উপরে বলে সংবাদে মাধ্যমে অনুমিত হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় রূপ পরিগ্রহের পিছনে আশিস ধাওয়ানের টাকা জোগাড়ের দক্ষতা যে বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল সে কথা আগেই বলা হয়েছে। আশিসের শিক্ষায় বিনিয়োগ সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার পরিচয় মেলে তার প্রাইভেট ইকুইটি কোম্পানি সেন্ট্রাল স্কোয়ার ফাঊন্ডেশনের ভাষ্যে। সেখানে বেসরকারি স্কুল স্থাপনের নন-প্রফিট উদ্দেশ্যটিকেই পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে সহজ ঋণ পাবার সুবিধে ও কর্পোরেট প্রশাসন থাকার কথা। এবং চমৎকৃত হবার মত নিদান দেওয়া হচ্ছে বিদ্যালয়গুলিকেই বিগ, মিডিয়াম এবং স্মল স্কেল শিল্প হিসাবে বিভাজনের। এই হচ্ছে শিক্ষা-প্রোমোটারদের লিবারেল চিন্তার নমুনা। রাইট টু এডুকেশন আইনে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির পুর্বশর্ত হল সমাজের দুর্বলতর অংশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের জন্য ২৫ শতাংশ সংরক্ষণ যা বেসরকারি স্কুল সংগঠন মজ্জায় মজ্জায় বিরোধিতা করে আসছে। যারা অশোকা ইউনিভার্সিটিকে অভূতপূর্ব মুক্ত চিন্তার আঙিনা হিসাবে গড়তে চেয়েছেন তারা যদি শিক্ষাজগতের লোক হতেন তাহলেও অন্য রকম কিছু হত এটা ভাবার কারণ নেই, কেননা প্রতাপভানু মেহতা এবং অরবিন্দন সুব্রামানিয়ানের পদত্যাগ আচার্য রুদ্রাংশু মুখার্জি বা উপাচার্য মালবিকা সরকারকে বিচলিত করতে পেরেছে এমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পাওয়ার কথাও নয় কারণ এ এক ভিসাস সার্কেল। শিক্ষাবিদ এখানে আজ্ঞাবহ চাকুরিজীবীমাত্র সে যে নামেই ডাকা হোক না কেন তাকে। প্রোমোটাররা মালিক, কতটা বালি আর কতটা সিমেন্টে লিবারেল বুনিয়াদ তৈরি হয় সে ঠিক করবে তারা, আর সবার উপরে সরকার সত্য-তার অপছন্দের কোনও কিছুই লিবারেল গণ্য হওয়া অসম্ভব। অশোকা বিশ্বাবিদ্যালয় এই বেসরকারি বিশ্বমানের একটা মডেল, যা ক্রমশ দখল নিতে চলেছে এ দেশের মেধা ও মনন। এখন লাভের মুখ দেখাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে তাকে সফল না বলতে চাইলে বলতেই পারেন, কিন্তু বাজারসফল বলতে বাধা কোথায়?
তথ্যসূত্র
- https://economictimes.indiatimes.com/industry/services/education/ashoka-university-a-collective-effort-of-46-philanthropists/articleshow/44954336.cms?utm_source=contentofinterest&utm_medium=text&utm_campaign=cppst
- https://indianexpress.com/article/opinion/columns/what-ashoka-university-controversy-says-about-the-failures-of-private-institutions-7254945/
- https://indianexpress.com/article/india/firing-of-professor-will-hurt-ashoka-says-university-faculty-body-as-three-staff-exit-over-kashmir-petition-4548903/