Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কর্পোরেট-পুঁজির দালালের দৃষ্টিকোণ থেকে করোনা নিয়ে দু-চার কথা

বিষাণ বসু

 


চিকিৎসক, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

করোনা নিয়ে দু-চার কথা লেখার পীড়াপীড়ি এল, তাই নেহাৎ বাধ্য হয়েই লিখতে বসা। না হলে লিখতাম না। কেননা ইদানীং মোটামুটি নিশ্চিত বুঝেছি, এসব নিয়ে লিখেটিখে কোনও লাভ নেই। এ অলমোস্ট দলীয় জনসভায় বক্তব্য রাখার মতো— যাঁরা শুনবেন, তাঁরা দলীয় সমর্থক, আপনার মুখ্য উপপাদ্য তাঁরা আগেই জানতেন, তাঁদের আলাদা করে আর না শুনলেও চলত; আর বিপরীত মতাবলম্বীদের মধ্যে যাঁদের কানে এসব কথা ঘুরপথে পৌঁছাবে, তাঁরা স্রেফ ছিদ্রান্বেষণের জন্যেই কথাগুলো শুনবেন, সদর্থক কোনও বার্তা বা নতুন করে ভেবে দেখার উপযুক্ত বক্তব্য হিসেবে শুনতে চাইবেন না।

আপাতত দেশে প্রতিদিন আক্রান্ত দু-আড়াই-লাখের বেশি, মারা যাচ্ছেন দেড় হাজারের বেশি— সংক্রামিত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হলে কলকাতা শহরের কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারা এবং ডিয়ার লটারিতে মোটা টাকা জেতার সম্ভাবনা বেশ কাছাকাছি। এগুলো নিছক তথ্য, যা মিডিয়াতে বা সরকারি ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবেন। অতএব অতিমারিই বলুন, বা কর্পোরেট প্ল্যানডেমিক, সেটি যে রীতিমতো জমকালো অবস্থায়, সে নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।

প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা যে অনেকগুণ বেশি, সে সন্দেহও অকারণ নয়। কেননা অনেক জায়গাতেই প্রবল নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার সঙ্গে শ্মশানে যে সংখ্যায় দাহ হচ্ছে, সরকারি হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা তার চাইতে ঢের কম বলে জানানো হচ্ছে। এসব কথা জানাজানি হয়ে যাওয়ার ফলে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি করার চেষ্টার পরিবর্তে শ্মশানের দেওয়াল উঁচু করে গোপনীয়তা বৃদ্ধির চেষ্টাটিও ভারি মর্মস্পর্শী। আবার সঠিক সংখ্যায় টেস্ট হলে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক গুণ বাড়ত, এ নিয়েও খুব একটা সংশয়ের অবকাশ নেই। বাড়ির কারও জ্বরজারি হলে কোভিডের RT-PCR পরীক্ষা করতে এবং তার রিপোর্ট আসতে ঠিক কীরকম সময় লাগছে, সে থেকে কিছুটা আন্দাজ পেতে পারেন।

নিজে যাচাই করে দেখার কথা বলছি বটে, কিন্তু সম্প্রতি এক জনপ্রিয় পত্রিকার উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে এমন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের (হিউরিস্টিক রিজনিং) প্রেক্ষিতে পুরোটা বুঝতে চাওয়ার সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিস্তারিত এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে— অর্থাৎ যে ব্যক্তির পরিচিত মহলে কেউই কোভিডে আক্রান্ত হননি বা হলেও ঘনিষ্ঠ আক্রান্তদের মধ্যে সকলেই বাড়ি বসে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তিনি কোভিডকে সর্দি-কাশির বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ হবেন; আবার, যিনি ঘনিষ্ঠজনকে কোভিডে হারিয়েছেন, তিনি এই অসুখকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে চাইবেন। দুটির কোনওটিই উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া নয়। প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে, তা খুবই ঠিক কথা— আমাদের সব প্রতিক্রিয়া যদি কেবল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ‘পরে নির্ভরশীল হতে চায়, সে এক মস্ত সমস্যা।

আবার আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি, সেই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে অবশ্য মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া এবং উপযুক্ত গুরুত্ব দানের অভাব— দুইয়ের অভিঘাত একই নয়। রজ্জুতে সর্পভ্রম বিরক্তিকর ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু বিষধর সর্পে রজ্জুভ্রম প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। সংক্রামক অতিমারির ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্তের অভিঘাত ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বিপদটা সমগ্রের।

ইদানীং অবশ্য সকলেই নিজের দেখাশোনার আলোকে সকলকে আলোকিত করতে অতি ব্যস্ত। ধরুন আপনি পুরীর সমুদ্রসৈকতে বসে মগে করে সমুদ্রের জল ছেঁচে ফেলার কাজটি করতে থাকলেন সকাল থেকে, এবং আপনার পাঁচ বন্ধুও এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে থাকলেন একাগ্রচিত্তে, শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, সমুদ্রে হাঙর নিয়ে যেসব বিপদের কথা শোনানো হয়, সে নিছকই বাড়াবাড়ি, কেননা আপনার বন্ধুদের মধ্যে কেউই হাঙর দেখতে পাননি। সবশেষে সোচ্চারে ঘোষণা করলেন, সমুদ্রে হাঙরের কথাটা খুব সম্ভবত গুজব— হাঙর যদিও বা থাকে, জলের গ্যালন পিছু হিসেবে বা ঘনমিটারের হিসেবে হাঙরের সংখ্যা নগণ্য এবং বিপদের আশঙ্কা অতিরঞ্জিত ইত্যাদি ইত্যাদি। হিউরিস্টিক রিজনিং দিয়ে ব্যক্তিগত ঝুঁকির হিসেব কষতে পারার চেষ্টাটা প্রায় এর কাছাকাছিই— কোভিড বিষয়ে অনেকের বক্তব্য প্রায় এরকম গোত্রের। (আবার, বাজার দোকান করতে গিয়ে আগের তুলনায় আপনার খরচা বেড়েছে কিনা, আয়ের বৃদ্ধির তুলনায় ব্যয় বেড়েছে কিনা, এসব দেখে আপনি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ব্যাপারটা নিজে নিজেই বুঝতে পারেন, সরকার বা মিডিয়া সত্যিমিথ্যে যা-ই বলুক না কেন। কাজেই, অন্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত সিদ্ধান্ত বা হিউরিস্টিক রিজনিং যে ফেলনা নয়, সে নিয়েও সন্দেহ নেই।)

এমনিতে আমাদের দেশে নাগরিক-সচেতনতার খুবই অভাব— শুধু সমাজের বাকি সকলের সুবিধে বা উপকার হবে বলে নিজের অসুবিধে কেউই করতে চান না, এমনকি নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের সামান্যতম ব্যাঘাতও ঘটাতে চান না। এখন বাড়তি সমস্যা হল, একদল তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষও আপাত বিজ্ঞানের ধুয়ো তুলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জটিলতা বাড়িয়ে চলেছেন। বিজ্ঞানের বড় অংশ আজকাল কর্পোরেট পুঁজি দ্বারা পুষ্ট ও কর্পোরেট স্বার্থ দ্বারা চালিত এবং কর্পোরেট সর্বদাই মুনাফার লক্ষ্যে চালিত এ নিয়ে সংশয়ের অবকাশ না থাকলেও, এখান থেকে কখনওই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে, বিজ্ঞান মাত্রেই মুনাফার উদ্দেশে ধান্দাবাজি। এবং এবম্বিধ “বিজ্ঞানমনস্ক”-দের মুশকিল হল, এঁরা প্রথমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তারপর তার সমর্থনে এদিক-ওদিক থেকে যুক্তি খাবলাতে থাকেন। যদিও বিজ্ঞানসম্মত অন্বেষণের রাস্তা ঠিক তার উলটো। উপরন্তু, বিজ্ঞানের আরেকটি মূল পূর্বসিদ্ধান্ত, ফলসিফায়েবিলিটি— অর্থাৎ বিজ্ঞান হল তা-ই, যাকে ভুল প্রমাণ করা যায়— এমন তথাকথিত বিজ্ঞানমনস্কদের অবস্থান তার থেকে বহুদূর।

যেমন ধরুন, এঁদের একজন বললেন, আমার ফ্যামিলির কেউ মাস্ক পরে না, তবু আমাদের কারও করোনা হয়নি, অতএব মাস্ক পরা অর্থহীন। দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা গেল, এঁর পরিবারের একজন, ধরুন বয়স্ক বাবা, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। আপনি ভদ্রতা বা চক্ষুলজ্জার তোয়াক্কা না করেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, এবার তাহলে দাদা কী বলবেন? উনি সঙ্গেসঙ্গেই বাবার অনেকবছরের হাঁপানি, কোভিড টেস্টের কত শতাংশ ফলস পজিটিভ, এই সিম্পটম গত দশবছর ধরে সিজনের এইসময়টাতেই বাবার হয়ে থাকে, এবছর তারই বাড়াবাড়ি, কোভিড নিয়ে ফালতু ইয়ে না করলে বাবার চিকিৎসা আরও তাড়াতাড়ি করানো যেত ইত্যাদি হাজার যুক্তি ফেঁদে বসবেন। মোদ্দা কথা, আপনি ওঁকে নিজের জায়গা থেকে নড়াতে পারবেন না।

আরেকদল “বিজ্ঞানমনস্ক” ভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে খুবই সরব। মুশকিল হল, বিরাট কোহলির টেকনিকের ত্রুটি নিয়ে বলার আগে সবাইকে টেস্ট খেলে আসতে হবে, এমন দাবি বাড়াবাড়ি হলেও, অন্তত ক্লাবস্তরের ক্রিকেটটুকু খেলার অভিজ্ঞতা জরুরি। ওষুধ বাজারে আনার আগে বা ভ্যাক্সিন বাজারে আনার আগে ট্রায়ালের এন্ডপয়েন্ট কী হওয়া উচিত, ওষুধ এবং ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালের মূলগত প্রভেদ কোথায়, দুটি ভিন্ন ধাঁচের ট্রায়ালের এন্ডপয়েন্ট কীভাবে নির্ধারিত হয়, সেই নির্ধারণের মুহূর্তে কী কী কনস্ট্রেইন্টস বা সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়া হয়, সেসব বোঝার জন্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মেথডলজি বিষয়ে ন্যূনতম ধ্যানধারণা জরুরি। সমস্যা হল, ৪০০-৫০০ শব্দের মধ্যে সেই জটিল বিষয়কে সহজপাচ্য তরলাকারে গিলিয়ে দিতে পারা দুঃসাধ্য। সাধারণ জ্ঞানের নামে একধরনের উপরচালাকি দিয়ে সংশয় তৈরি করে দেওয়া সহজ। সন্দেহ দূর করতে গেলে বিষয়ের গভীরে ঢুকতে হয়, সে কাজ কঠিন। বিষের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে, সেই প্রতিষেধক আগাম প্রয়োগ করার পর কয়েক হাজার সুস্থ মানুষকে বিষ খাইয়ে দেখলে প্রতিষেধক কতখানি কার্যকরী তার নিশ্চিত প্রমাণ মেলে বটে— কিন্তু, বৃহত্তর জনসমাজের মধ্যে তেমন পরীক্ষা এথিক্স-সম্মত নয়। তাহলে কী করণীয়? এই ক্ষেত্রে প্রতিষেধক কাজের নয় বা প্রতিষেধক নিয়ে অন্যায় দাবি চলছে, সুতরাং প্রতিষেধকটি পরিত্যাজ্য— এমন সিদ্ধান্তই যথাযথ? অবশ্যই এমন পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে সীমিত সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে বিপদহীনতা প্রমাণিত হলে কিছু ঘোরানো পথে প্রতিষেধকের কার্যকারিতা প্রমাণ করা যায়। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মেথডলজির ক্ষেত্রে সেগুলো মান্য পদ্ধতি, এবং তার কিছু সীমাবদ্ধতাও স্বীকৃত। এসব নিয়ে অবশ্যই সুস্থ বিতর্ক হতে পারে— যুক্তি এবং ট্রায়ালের মান্যতা স্বীকার করেই— কিন্তু, ওই যে বললাম, বিষয়টি নিয়ে ন্যূনতম পাঠ ছাড়া যাঁরা স্রেফ সাধারণ জ্ঞান দিয়ে কাজ চালাতে চান, তাঁদের কাছ থেকে এতটা আশা করা যায় না। বিশেষত যাঁরা আগেভাগেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে চোখকানের ঘাটতিটা মুখ দিয়ে পূরণ করবেন বলে ধরেই নিয়েছেন, তাঁদের তো এসব বোঝার অবকাশই নেই। অতএব, যে জার্নালের ব্লগসাইটের একটি লেখা থেকে তাঁরা ট্রায়ালের ঘাটতির খবর দিচ্ছেন, সেই জার্নালের একাধিক আর্টিকলের উল্লেখ এঁদের মুখে শুনবেন না, কেননা সেসব নিবন্ধের তথ্য এঁদের তত্ত্বের সহায়ক নয়। এমনকি একাধিক উন্নততর র‍্যাঙ্কিং-এর জার্নালে এর বিপরীত মত প্রকাশিত হলেও, এঁরা সেকথা শুনতে বা শোনাতে চাইবেন না। ভ্যাক্সিন নিয়ে অনিয়ম বা অনৈতিক বাণিজ্য হচ্ছে, একথায় কিঞ্চিৎ সত্যতা থাকলেও, তৎপরবর্তী সহজাত সিদ্ধান্ত বা অনুসিদ্ধান্ত যে এই হতে পারে না, যে, বহুজাতিক বাণিজ্যের জন্যই ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হয়েছে, অতএব ভ্যাক্সিনটিই পরিত্যাজ্য— এই সহজ কথাটা তাঁদের বোঝায় কে!!

দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান কোনও গুরুকথিত মতবাদ নয়, যা অপরিবর্তনীয়। এমত গভীর “বিজ্ঞানমনস্ক”-দের মতামত কিন্তু এক্কেবারে ধ্রুবসত্য। প্রয়োজন বুঝে গোলপোস্ট সরতে পারে, কিন্তু মতামত নয়। অর্থাৎ, কোভ্যাক্সিন প্রথম বাজারে আনা হল যথেষ্ট ট্রায়াল ছাড়াই— যেটি নিঃসন্দেহে অনুচিত এবং নিন্দার্হ। কিন্তু, এই মুহূর্তে কোভ্যাক্সিন যে যথেষ্ট নিরাপদ ও কার্যকরী, তার পক্ষে তথ্যের অভাব নেই। তাহলে এখনও কি কোভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে ওই একই যুক্তি প্রযোজ্য? অনেকে হয়ত বলবেন, ঠিকই, এখন না হয় দেখা যাচ্ছে কোভ্যাক্সিন ভালো, কিন্তু ধরুন যদি দেখা যেত কোভ্যাক্সিন কোনও কাজের নয়, তাহলে? হক কথা। মাসির আচমকা পুরুষ্টু গোঁফ গজালে তাঁকে মামা নাকি মেসোমশাই, ঠিক কী নামে ডাকা উচিত— সে নিয়ে অবসর সময়ে তর্ক জমানোই যায়— কিন্তু অতিমারির বিপদের দিন সে কূটতর্কের উপযুক্ত মুহূর্ত কি?

ভ্যাক্সিনের বা এরকম বড় সংখ্যার মানুষের ওপরে প্রযোজ্য কোনও চিকিৎসার কার্যকারিতা বা সীমাবদ্ধতার আসল প্রমাণ অনেকক্ষেত্রেই মেলে ভ্যাক্সিন বাজারে আসার পর। এখনও অব্দি যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে মোটামুটি স্পষ্ট— যাঁদের দুটি ডোজ টিকা নেওয়া হয়ে গিয়েছে, তাঁদের মধ্যে গুরুতর কোভিড বা কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা অরক্ষিত জনগণের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এমনকি, যাঁরা একটি ডোজের পর দু সপ্তাহ পার করেছেন, গুরুতর কোভিড থেকে তাঁরাও সুরক্ষা পাচ্ছেন। এই তথ্য আরও গুরুত্বপূর্ণ একারণে, এতদিন অব্দি টিকা পেয়েছেন মূলত বয়স্করা। পঁয়তাল্লিশ-ঊর্ধ্ব-কিন্তু-ষাটের-কম গ্রুপের মধ্যে যাঁরা টিকা পেয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই দুটি ডোজ সম্পূর্ণ হয়নি। বিজ্ঞানমনস্করা কি মানছেন? নাহ, তাঁরা গোলপোস্ট সরিয়ে নিয়েছেন। সেদিনই দেখলাম এক দিগগজ জানিয়েছেন, টিকা নিলে যেমন আদপেই জলাতঙ্ক হয় না, এক্ষেত্রে তেমনটি হচ্ছে কি? এর উত্তরে অনেক কথা বলা-ই যেত— যেমন, জলাতঙ্কের টিকা আর পাঁচটা অসুখের টিকার চাইতে আলাদা, সেটি প্রযুক্ত হয় এক্সপোজারের পরে, দুটির বিজ্ঞান আলাদা, সব টিকা একশো শতাংশ সুরক্ষা দেয় না, চিকেন পক্সের টিকা নেওয়ার পরেও ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, সেসব আলোচনা নিরর্থক। কেননা গোলপোস্ট সরানো যাঁদের স্বভাব, তাঁদের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই।

অতএব, এই বিজ্ঞানমনস্কতার ধ্বজাধারীরা কেন এক বিজ্ঞানীর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের বক্তব্যের অংশবিশেষ নিজেদের ভ্যাক্সিন-বিরোধিতার সমর্থনে ব্যবহার করে চলেছেন, যেখানে সেই একই বিজ্ঞানী গত তিনমাস ধরে কোভিডের বিরুদ্ধে সার্বিক টিকাকরণের গুরুত্বের কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে ফেলছেন— সে প্রশ্ন অবান্তর। এঁদের পলিসিই এই, যখন যেখানে যাঁর কথার যেটুকু নিজেদের পূর্বসিদ্ধান্তের সপক্ষে কাজে আসবে, সেটুকুই নেবেন। প্রায় পরমহংস-সুলভ ব্যাপারস্যাপার, দুধটুকুর বাইরে রুচি নেই। আর টিকার মাধ্যমে মোদিজি সব নাগরিকের শরীরে কোয়ান্টাম চিপ ঢুকিয়ে দিয়ে সবার গতিবিধি ট্র‍্যাক করতে চাইছেন— এঁদের একটি আলোচনাচক্রে তো এই দিব্যজ্ঞান লাভের সুযোগও হল— সুতরাং…

হ্যাঁ, সুতরাং, যুক্তি-প্রতিযুক্তির আর মানে হয় না। যাঁরা নিজেরা মানছেন, বা কপালগুণে যাঁদের বাড়ির কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন (এবং যাঁরা বুঝেছেন, প্রিয়জনের মৃত্যুটা শুধুই চিকিৎসকের গাফিলতিতে নয়), তাঁরা এমনিতেই নিয়ম মানছেন। তাঁদের আর নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। আর যাঁরা বুঝে গেছেন কোভিড একটি বহুজাতিক চক্রান্ত, তাঁদের অন্যরকম বোঝানো আমার এলেমের বাইরে।

সরকারকেও দোষ দিই না আর। অ্যাদ্দিন ধরে সরকারের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে সরকারি সদিচ্ছে জিনিসটা যে রসায়ন বইয়ে পড়া আদর্শ গ্যাসের ধর্ম বিষয়ে আলোচনার তুল্য, এটুকু কাণ্ডজ্ঞান লাভ করতে পেরেছি। অতএব, কুম্ভমেলা চলা উচিত কিনা, বা নির্বাচনী প্রচারে মাস্কহীন জনতার ভিড় কতখানি বিপজ্জনক, সে নিয়ে কথা বাড়াচ্ছি না। যে সরকার অপরিকল্পিত লকডাউন করে সমাজের বৃহত্তর অংশকে ঘোর বিপদে ফেললেন, এবং তার ফলে সমাজের সংবেদনশীল মানুষদের বড় অংশের চোখে কোভিড-নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে গরীব মানুষের পেটে লাথিকে সমার্থক করে তুললেন, তাঁদের কাছ থেকে সদর্থক পদক্ষেপের আশা করা বাতুলতা মাত্র। কিন্তু, সপ্তাহান্তে যাঁরা শপিং মলে জমায়েত হয়ে হুল্লোড় করছেন, কিম্বা যাঁরা চৈত্র সেল হালখাতায় হইহই করে ভিড় জমাচ্ছেন— তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্যেও কি সরকারকে দায়ী করা চলে? অথবা মেট্রোয় যিনি থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে মোবাইলে টাইপ করতে করতে মাস্ক যথাস্থানে তোলার অনুরোধে ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিলেন— “আপনি পরেছেন তো, তাহলেই হবে, আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না”— কে বলতে পারে, তিনি হয়তো সরকারি অপদার্থতা ও অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধে কোনও ঝাঁঝালো বয়ান লিখতে ব্যস্ত ছিলেন সেই মুহূর্তে!!!

কাজেই কথা বাড়ানোর আর মানে হয় না। একটা কথাই শেষে বলার আছে। যাঁরা সুরক্ষাবিধি যথাসাধ্য মেনে চলছেন, তাঁদের মধ্যে একটা কনফিউশান তৈরি হয়েছে সদ্য। বিশ্ববিশ্রুত মেডিকেল জার্নাল ল্যান্সেটে সদ্য জানানো হয়েছে, কোভিড নাকি বায়ুবাহিত— তাহলে কি…? বিজ্ঞান-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে আমাদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকারী সাংবাদিকরা নিত্যনতুন দিগন্ত উন্মোচন করে চলেছেন। বিষয়ের গভীরে না গিয়ে বা এপ্রসঙ্গে সাপ-ব্যাঙ কিছু না জেনেই হাতেগরম ফুটেজের লোভে আলটপকা মন্তব্যকারী কিছু চিকিৎসকও তথৈবচ (যাঁদের অনেকেই আবার স্বনামধন্য)। ল্যান্সেটের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যবেক্ষণের গরু বাংলা কাগজ ও চিকিৎসকদের মতামতের চোটে গাছে উঠে গিয়েছে। বায়ুবাহিত হওয়ার কারণে সুরক্ষাবিধিই নাকি বিলকুল বদলে যেতে চলেছে, এবার থেকে চব্বিশ ঘণ্টা এমনকি রাত্তিরে ঘুমোনোর সময়েও মাস্ক পরতে হবে ইত্যাদি প্রভৃতি…

যাঁরা সুরক্ষাবিধি মেনে চলতে চান, তাঁদের আশ্বস্ত করি— বায়ুবাহিত হোক বা না হোক, ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানো বন্ধ হয়নি। বায়ুবাহিত হওয়ার অর্থ ড্রপলেটের মাপটি পূর্বানুমানের তুলনায় আরও ছোট, বাতাসে সেই ড্রপলেট মিশবেও সহজে, সংক্রামিতের হাঁচি-কাশি না হলেও মিশতে পারে, সাধারণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মুহূর্তেও ভাইরাস পারিপার্শ্বিকে মিশে যেতে পারে, পার্টিকল বাতাসে থাকবেও দীর্ঘক্ষণ। কাজেই মাস্ক পরুন, পুরোপুরি না হলেও অনেকখানি সুরক্ষা মিলবে। বায়ুবাহিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে জানলা খোলা রাখলে দক্ষিণের বাতাস এসে আপনাকে কোভিড দিয়ে যাবে। কিম্বা সন্ধেবেলার মশার মতো করে জানলা দিয়ে করোনাভাইরাস উড়ে আসবে। বদ্ধ জায়গায়, এসি ঘরে বেশি লোক জড়ো হলে বিপদ। খোলামেলা জায়গায় তুলনামূলক কম। গাদাগাদি ভিড় হলে বিপদ বেশি। বায়ুবাহিত হলে, সেন্ট্রালি এসি বিল্ডিং-এ একটি ঘরে কোভিড-পজিটিভ কেউ থাকলে তাঁর থেকে অন্য ঘরে বসা মানুষও আক্রান্ত হতে পারেন (প্রাণীদের উপর পরীক্ষা করে তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে)। মাস্ক ছাড়া সুরক্ষার আশা নেই। বায়ুবাহিত ক্ষেত্রে পার্টিকল-এর সাইজ আরও ছোট— মাস্ক পরার ব্যাপারে আরও সচেতন ও নিখুঁত হতে হবে— বাতাসে পার্টিকলের ঘনত্ব দূরত্বের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক হারে কমবে, অতএব দূরত্ব বজায় রাখা, আঁটোসাটো মাস্ক পরা, বন্ধ বাতানুকূল ঘরে একত্রে হইহই এড়ানো, অরক্ষিত হাত বারবার নাকে-মুখে না দেওয়া, এগুলো মেনে চলতেই হবে।

আর হ্যাঁ, সুযোগ থাকলে ভ্যাক্সিনটা নিয়ে ফেলুন। পুরো সুরক্ষা কেউই দিতে পারে না— তবে জটিল পরিস্থিতি থেকে অনেকখানি সুরক্ষা পাবেন। ভ্যাক্সিনের নিত্যনতুন স্ট্রেইন এসে ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা কতখানি দীর্ঘমেয়াদি হবে, বলা মুশকিল— কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চয়তার কথা ভেবে আপাতত যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তাকে অগ্রাহ্য করা কাজের কথা নয়। যেকোনও মেডিকেল ইন্টারভেনশনের মতোই টিকারও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে, থাকবেই। কিন্তু অসুখটি তার চাইতে বহুগুণে বিপজ্জনক। আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার বা সম্ভাবনা আপনি যা ভাবছেন, তার চাইতে অনেক অনেএএক কম।

এর বেশি আর কিছুই বলার নেই।

একটু ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখি। উপরোক্ত কথাগুলো বিজ্ঞানের দিক থেকেই লেখা— অন্তত বিজ্ঞান বলতে আমি যেটুকু বুঝি, সেই দৃষ্টি থেকে লেখা। নতুন তথ্য নতুন গবেষণালব্ধ নতুন পর্যবেক্ষণের প্রেক্ষিতে কথাগুলো বদলেও যেতে পারে।

এর বিপরীতেও অনেক বক্তব্য পাবেন। সেসবও নাকি বিজ্ঞানেরই কথা। যাঁরা সেসব বলেন, তাঁরা নাকি বিজ্ঞানকে সঠিক আলোয় দেখার দিক থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অন্তত তাঁদের নিজেদের দাবী তেমনই। আপনি চাইলে তাঁদের কথাও শুনতে পারেন। তাঁদের কথার একটি মস্ত সুবিধে আছে। তাঁদের কথা কক্ষনও বদলায় না। আগাম সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে নতুন পাওয়া তথ্য না মিললে তথ্যটিকেই মিথ্যা বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। আর দৈবাৎ মিলে গেলে— দেকেচ তো, আগেই বলেছিলাম…