Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফিল্ম ট্রাইবুনালের মৃত্যুদণ্ড

চণ্ডী মুখোপাধ্যায়

 

লেখক সাংবাদিক, চলচ্চিত্রবেত্তা, বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন-এর সভামুখ্য

 

 

 

আবার কোপ ভারতের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে। আমাদের ফিল্ম সেন্সর বোর্ড বা সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন তথা ‘সিবিএফসি’-কে নিজের জালে আটকে রাখার চেষ্টা অনেক দিনের-যে সরকারই এসেছে তারা নিজের মতো করে এই সেন্সর বোর্ডকে।রাজনীতিকরণের চেষ্টাও হয়েছে। এই সেন্সর বোর্ডে কে থাকবে কে থাকবে না, সেটার মধ্যেও রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবার যে আঘাতটা এনেছে তা প্রায় ভারতীয় সেন্সর বোর্ডকে পঙ্গু করে দেবার আঘাত। তারা এবার ভারতীয় সেন্সর বোর্ড থেকে তুলে দিলেন ফিল্ম সার্টিফিকেশন অ্যাপিলেট ট্রাইবুনাল বা এফসিএটি। এবার শেষ কথা বলবে সিবিএফসি-ই। যেখানে থাকেন সরকারের পেটোয়া কিছু মানুষ। যাদের সঙ্গে বেশিরভাগ সময়েই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। চলচ্চিত্রবোধও তাই। বিট্রিশ আমলে ভারতে সিনেমা আসার বছর কুড়ির মধ্যেই সিনেমাকে বিধিকরণের মধ্যে আনার জন্যেই তৈরি হয় সেন্সর বোর্ড। সিনেমা সৃষ্টিতে কাঁচি চালাবার ব্যবস্থা। ব্রিটিশ শাসকদের এটা একান্তই দরকার ছিল। নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল তারা আগেভাগেই অলিখিতভাবে চালু করেছিল। এবার সিনেমা। নির্বাক যুগেই লেনিন বুঝেছিলেন যে সিনেমা ক্রমশ হয়ে উঠবে প্রতিবাদের এক শক্তিশালী মাধ্যম। রাশিয়া-তে আইজেনশটাইন নির্মাণ করেন ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’। যা আজও শুধু সিনেমা নয় প্রতিবাদের এক অস্ত্রও। আর ভিসুয়াল প্রতিবাদকে আটকে দেবার জন্যেই ভারতে তৈরি হল ফিল্ম সেন্সর বোর্ড। বেশিদিন নয় এই বোর্ড তৈরি হবার বছর তিনেকের মধ্যেই  সেন্সর বোর্ড ব্যান করল ‘ভক্ত বিদুর’ নামে এক ছবি। কোনও ধর্মীয় কারণে নয়, মুলত রাজনৈতিক কারণেই। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ছায়া ছিল নাকি এই ছবিতে। ভক্ত বিদুর-এর মধ্যে তৎকালীন সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা খুঁজে পেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর আদল। সেই প্রথম ভারতীয় সিনেমাকে রাজনীতির আওতায় আনা হল। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে প্রথম নিষিদ্ধ হওয়া ছবি ‘ভক্ত বিদুর’। কিন্তু ‘ভক্ত বিদুর’-কেও অ্যাপিল করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

সেন্সর বোর্ড স্বাধীনতার পর নতুন করে পুনঃগঠিত হয় ১৯৫২ সালে। নতুন নামকরণ ছাড়া নতুন করে  আর বিশেষ কিছু পরিবর্তন হল না ভারতীয় সিনেমা-সেন্সরের। আইনকানুন প্রায় একই রইল। তবে অ্যাপিল করার সুযোগ তাকে একটু প্রসারিত করা হল নেহেরু সময়ে। যার নাম হল ফিল্ম সার্টিফিকেশন অ্যাপিলেট ট্রাইবুনাল। সেন্সর বোর্ডে যথার্থ বিচার না পেলে এই ট্রাইবুনালে যেতে পারতেন চলচ্চিত্র নির্মাতারা। ভারতীয় সিনেমাটোগ্রাফ অ্যাক্ট-এর ৫সি ধারা অনুসারে এখানে সেন্সরের বিচারের বিরুদ্ধে এখানে অ্যাপিল করা যাবে। এই অ্যাপিল ট্রাইবুনালে থাকবেন একজন চেয়ায়পার্সন এবং চারজন কমিটি মেম্বার। এদের সাহায্য করার জন্যে একজন সচিব। এরা নতুন করে আবার ছবিটা দেখবেন। এবং ঠিক করবেন আগের সেন্সর সদস্যরা ঠিক বিচার করেছিলেন কি করেননি। সত্যি কথা বলতে কী, বহু ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক সেন্সর বোর্ডের রায়কে বাতিল করে দিয়েছে এই ট্রাইবুনাল।

চলচ্চিত্রকারেদের একটা পথ ছিল সেন্সর করা ছবিকে নতুন করে পুনর্বিচার করানোর। সেই পথটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিল কেন্দ্র সরকার। তাদের এক সাম্প্রতিক বৈঠকে এই আইনটিকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হল। ফিল্ম  সার্টিফিকেশন অ্যাপিলেট ট্রাইবুনাল বা এফসিএটি আইনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ৪ এপ্রিল ২০২১। শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষায় চলচ্চিত্রকারদের এখন একমাত্র পথ হাইকোর্ট।