স্বর্ণালী ইশাক
এটা কি আরও কেউ লক্ষ করছেন? নাকি আমারই মনের ভুল? অ্যাঁ? জানি না।
আমার গত কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে যেন পশুপাখি, গাছপালা, মাটি, জল, এমনকি হাওয়াও একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। টিয়াপাখির ঝাঁক দেখেছেন কেউ? চোখ দিয়ে ওদের পড়লে একটা জিনিস জানবেন, যে ওনারা স্ট্রেসড হলে নিজের গায়ের পালক টেনে টেনে ছেঁড়ে। এক্কেরে ন্যাড়া হয়ে যায়। এত জোরে টানে যে পালকের ফলিকল অব্ধি তুলে ফেলে। আমি গত কয়েকদিন ধরে টিয়াদের ঝাঁকে ন্যাড়া টিয়ার সংখ্যা বাড়তে দেখছি।
কাঠঠোকরারা অন্যমনস্ক। একটা গাছের কাণ্ড কিছুক্ষণ ঠুকরাচ্ছে, তারপর আর পোষাচ্ছে না ওদের। কেমন একটা “ন্যাঅ্যাঅ্যাহ্ নিগ্গা” আতিতিউদ দেখিয়ে অন্য গাছে চলে যাচ্ছে।
কাক আর কাঠবেড়ালি বেশী খাচ্ছে। কাক আর কাঠবেড়ালি বা ইঁদুর– এরা টেনশনে বেশি খায়। ইঁদুর তো প্রচণ্ড স্ট্রেসে এত বেশি খায় যে পেটের ব্লাডার ফেটে মরেও যায় কেউ কেউ। চেনা মানুষের চালের গুদাম থেকে এত্ত এত্ত খেতে খেতে মরে যাওয়া ইঁদুর বেরোবার পর লাস্ট কিছুদিন ধরে আমি চারিদিকে সচেতনভাবে চোখ রাখা শুরু করেছি। যা দেখছি, তা ভাল নয় কিন্তু। মাটির জীবগুলো সারফেস বদল করছে। পিঁপড়ে আর উইরা সময়ের আগেই বাসাবদল করছে। সাধারণত একেকটা জেনারেশন একটাই বাসা বানায়, প্রাসাদের মতো, আর তাতেই থাকে মৃত্যু অব্ধি। এতদিন যা দেখে এসেছি। ওই বাসা মানুষ নষ্ট না করে দিলে ওরা নতুন বাসার কথা ভাবে না। এখন ভাবছে। আমি নিজে চোখে দেখলাম। আর আশ্চর্যভাবে নতুন বাসাগুলো ওদের এতদিনের সনাতন বাসার থেকে আলাদা আর্কিটেকচারের হচ্ছে। ওরা ওদের সমান্তরাল করিডরগুলোর জায়গা কমিয়ে দিচ্ছে। এক্সট্রা এন্ট্রান্স রাখছে, যেটা অস্বাভাবিক। এতগুলো এন্ট্রান্স রাখে না ওরা। মাটির যত গভীরে ওরা থাকে, তার থেকে কম গভীরে রাখছে। আর চমকানোর ব্যাপার হল, খাবার রাখার যে ভাঁড়ার বা হলটা থাকে ওদের বাসার, সেটা বেশ ছোট করছে। মানে, ওরা যেকোনও মুহূর্তে, সদলবলে , হুড়মুড় করে (ওরা সাধারণত লাইন দিয়ে ভদ্রলোকের মতো ঢোকে বেরোয়) যাতে বেরিয়ে আসতে পারে, সেরকম ব্যবস্থা করছে। অদ্ভুত, তাই না? ওরা এরকম করে না একদমই। আমার খুব ভয় লাগছে।
আর্জিনা আর সাপেরা অতি সচেতন আর বিরক্ত হয়ে আছে। বর্ষার আগে এত আর্জিনার মাটির উপরে খুল্লমখুল্লা নেচে বেড়ানোটা দেখে আমার অশান্তি হচ্ছে খুব।
মাটিও একটু বেশি আলগা। শীত শেষে গরম পড়লে যে আলগা ভাবটা আসে, এটা সেরকম নয়। অন্যরকম আলগা। আলাদা রকম। হাত দিয়ে ধরে দু’আঙুলে ডললে বোঝা যায়। মাটির স্বাদ বদলে গেছে। শেষ ক’দিনে তিন-চাররকমের মাটি চেখে দেখেছি। স্বাদ বদলেছে। কোনও মিনারেল কমছে বাড়ছে কি? জানি না।
জলের ঢেউয়ের একটা প্যাটার্ন থাকে। জলাশয়ের গভীরতা আর দৈর্ঘ্যের ভিত্তিতে ঢেউয়ের প্যাটার্ন আলাদা হয়। বদ্ধ জলা আর স্রোতস্বিনী প্রবাহের ঢেউও আলাদা হবে– এটা তো কমন সেন্স। আমার বিশেষ পড়াশুনা নেই, তবে শুধু “দেখা”র ওপর ভিত্তি করে এটা বলতে পারি। প্যাটার্ন বদল সম্ভব যদি তাপ আর মাধ্যাকর্ষণের পরিবর্তন হয়। আরও কারণ থাকতে পারে হয়তো, তবে সেগুলো আমি জানি না।
এবার পূর্ণিমায় (12 এপ্রিল) জোয়ার আর ভাঁটাটা কেউ লক্ষ করেছেন? জলকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। অন্যরকম বিহেভ করছে। অচেনা লাগছে। I tell you people, জল খুব বিরক্ত হয়ে আছে।
চৈত্র মাসে আমের বোল এলে কত পোকা আসে। এবার পোকা কম। আর যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেক ওপর দিয়ে উড়ছেন। ঠিক হচ্ছে না। কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। কিছু একটা ভুল হয়েছে।
দখিনা হাওয়া এইসময় সোজাসুজি আসে। ক’দিন ধরেই রোজ সন্ধেয় বালি উড়িয়ে দেখছি, পুব ঘেঁষে সুইং করে আসছে। এর আগে তো এরকম আজব ব্যাপার দেখিনি। হাওয়ায় এই সময় একটা লবণাক্ত ভাব থাকেই, তবে এবার বেশি লাগছে। গ্যজ্জব ব্যাপারটা হল, মালভূমি অঞ্চলেও হাওয়ায় এই নোনা ব্যাপারটা আসছে দেখলাম।
কখনও লো ভোল্টেজের কারেন্ট খেয়ে দেখেছেন? এই যেমন ধরুন, ফোন চার্জ দেওয়ার চার্জারটা প্লাগে লাগিয়ে সুইচ অন করে চুষুন। দেখবেন, ওই ঝিনঝিনানির একটা প্যাটার্ন আছে। হাই ভোল্টেজের আবার আলাদা প্যাটার্ন (হাই ভোল্টেজের সবরকম কারেন্ট অবশ্য আমি টেস্ট করতে যাইনি। ওই ঘরের মেইন সুইচ অব্ধিই দৌড়, তার বেশি দম নেই আমার পেছনে)।
যাই হোক, লো ভোল্টেজটাই বলি, প্লাগে লাগিয়ে সুইচ অন করে মুখে ফোনের চার্জার নিন। চোখ বন্ধ করে ফুল ফোকাস করুন। zoom করে ফোকাস করুন। শুধু জিভে, শরীরের আর সব অঙ্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলুন। মনে করুন, আপনার শুধু জিভই আছে। Rather, আপনি নিজেই একটা জিভ। এবার ওই ঝিনঝিনানির প্যাটার্নটা টের পাবেন। যারা আগে এটা করেছেন, মানে যারা প্যাটার্নটা জানেন, তারাই এখন আবার এটা ট্রাই করলে বুঝবেন যে সেটা বদলে গেছে।
তাপও বদলে গেছে। লাস্ট ক’দিন ধরে ভাতের ফ্যান ঝরাবার সময় দেখলাম, ওই যে বাস্পটা বেরিয়ে হাতে যেটুকু ছ্যাঁকা কাইন্ড অফ লাগে, সেটা অন্যরকম। কীভাবে যে বোঝাই, খাড়ান, চেষ্টা করি… ধরুন, আপনার হাতে ছ্যাঁকা লাগল। ছ্যাঁকা অনেকরকমের হয়। উত্তপ্ত বস্তু (কঠিন, তরল, বায়বীয়) ত্বক থেকে কতটা দূরত্বে আছে, আর কতক্ষণ আপনার ত্বকের সংস্পর্শে থাকছে, আর তার উত্তাপ কতটা, তার ওপর নির্ভর করে ছ্যাঁকার প্যাটার্ন। ত্বকও অবশ্য আলাদা আলাদা রকম হয় শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। পরীক্ষা করার জন্য হাতের তালুটা নিন, গরম লোহার একটা শলাকা হাতে চেপে ধরুন। একদম সেই মুহূর্তটায় ফোকাস করুন, যখন ওটা হাতে জাস্ট ঠেকছে (আগে থেকে মন, মাথাটাকে প্রিপেয়ার করুন, একবার মিস হলে আবার অন্য হাতের তালুতে ছ্যাঁকা খেতে হবে না হলে। আর তাতেও বুঝবেন না, কারণ, এই হাতের ছ্যাঁকার ব্যথাটা ওই হাতের ছ্যাঁকাটাকে খাওয়ার আগেই ম্যানিপুলেট করে দেবে)। একদম শুধুমাত্র ওই মাইক্রো সেকেন্ডটাতেই ফোকাস করুন আর অনুভূতিটাকে মনে রাখুন। না পারলে লিখে রাখুন। ছবিও এঁকে রাখতে পারেন। তবে যদ্দিন না ঘা শুকোচ্ছে, তদ্দিন রোজ চোখ বন্ধ করে ওই মাইক্রো সেকেন্ডটাকে মনে করুন। Go through that pain everyday. মুখস্থ করে নিন।
এবার এই ঘা শুকোলে ওই হাতেই মুঠো করে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট চেপে ধরুন। দেখবেন, দুটো ছ্যাঁকা অন্যরকম। একদম অন্যরকম। এরকম যদি কেউ আগে করে থাকেন, তাহলে এখন আবার একবার করুন। পরিষ্কার বুঝবেন যে, তাপেরা বদলে গেছে। ছ্যাঁকার প্যাটার্নও।
কিভাবে যে এই বদলটা বিবৃত করব, জানি না। এইজন্য বাঁ আমি ভাষার ওপর ভরসা করি না। ভাবার ওপর বিশ্বাস করি। ভাবনা শুনতে পাওয়া যায়। এটা মানুষরা বিশ্বাস করে না, তাই শুনতে পায় না। কিন্তু মনোসংযোগে একটু zoom করলেই বা সামনের মানুষের গা ছুঁয়ে শিকড় ছড়িয়ে দিলেই কিন্তু ডাইরেক্ট #T_TO_T কথোপকথন সম্ভব (থট টু থট), মুখ খুলে আলবাল হ্যাজাতে হয় না। এত লোম্বা ছোম্বা লিখতেও হয় না। এনার্জি ও সময় বাঁচে অনেক।
আমার হেব্বি জোরসে একটা আশঙ্কা পাচ্ছে। আমার মনে হয়, কোনও পারমাণবিক পরিবর্তন ঘটছে। কারণ কী? জানি না। একটা ভয়ঙ্কর বড় কিন্তু খুব ধীরগতির ধারাবাহিক, কনসিসট্যান্ট আর ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক পরিবর্তন।
যাই হোক, এগুলো সবই হেকার মনে হওয়া। ভুলও হতে পারে। আমার বিদ্যেবুদ্ধি কম। কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে বললে পারব না। তবে যদি ভুল না হয়, তো আমার মনে হয়, আমাদেরও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি নেওয়া উচিত।
পতঙ্গ, পাখি আর গাছেরা কিন্তু ওদের সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজির ওপর কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমরা কবে করব?
নতুন ফোন, ক্যামেরা, গ্যাজেট, রেজার, টুথব্রাশ, কন্ডোমের ডট, সোডার ফট, এসব আবিষ্কার আর ডেভেলপমেন্টের কাজ ক’দিন দূরে ঠেলে এগুলো নিয়ে ভাবলে হয় না?