Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)

পবিত্র সরকার

 



বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

 

 

 

 

 

শঙ্খ ঘোষ, বাংলা কবিতার কালক্রমে অতি স্মরণীয় এক কবি, আবার যিনি আমাদের অনেকের কাছেই শঙ্খদাও বটে, নব্বই বছরে পা দিয়ে চলে গেলেন। বয়সটা জীবনকে প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে থাকার নয়। আমরা জানি, যেমন তিনি জানতেন, তাঁর শরীর জীর্ণ হয়ে এসেছিল, কথা অস্পষ্ট, কিন্তু মৃত্যু বা দুর্বলতাকে সমীহ করার কোনও মনোভাব তাঁর মধ্যে শেষ পর্যন্ত লক্ষ করা যায়নি। বরং আমি যখন শেষবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম তখন আমার একটা পুরোনো লেখার কপি আছে কি না জিজ্ঞেস করলেন। সে লেখা ১৯৭০-এর বছরগুলির শেষদিকে বেরিয়েছিল। আমি তাঁকে খুঁজে কপি দেব বলে কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি, এই একটা ক্ষোভ রয়ে গেল। হয়তো পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষকে নিয়ে কোনও একটা কাজ করছিলেন, কন্যারা বা তাঁর শেষ দিনগুলির সহায়ক স্নেহাশিস বলতে পারবে। এর আগেও মণীন্দ্রকুমারের চিঠির সূত্র ধরে আমার একটা লেখা প্রকাশের তারিখ জানতে চেয়েছিলেন, সেটা ঘটনাক্রমে দিতে পেরেছিলাম তাঁকে। অর্থাৎ কাজ থেকে বা জীবন থেকে ছুটি নেওয়ার কথা ভাবেননি, এই নব্বইয়ে পা দিয়েও। এখনও তাঁর বাড়ি গেলে সামনের ঘরে এসে বসেছেন, নড়বড়ে শরীরে, ঋজু হয়ে, কথা বলার চেষ্টা করেছেন, কখনও কখনও সে কথা বুঝতেও পারতাম আমরা, তাঁর সহায়ক স্নেহাশিসের ভাষ্য ছাড়াই। মজা হত যখন বিদায় নিতে যেতাম। ওই টলোমলো শরীরে উঠে আসবেনই দরজা পর্যন্ত, কারও বাধা শুনবেন না। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকবেন যতক্ষণ না আগন্তুক সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করছে।

যেভাবেই থাকুন, হয়তো কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনায়, তাঁর থাকাটাই ছিল একটা আশ্বাসের মতো, আশ্রয়ের মতো। তাঁকে প্রতিদিন দেখি আর না দেখি, অন্য কোনওভাবে তাঁর উপস্থিতি টের পাই আর না পাই, তিনি যে আছেন সেটাই আমাদের কাছে একটা বড় ভরসা ছিল। যখন আরও সমর্থ ছিলেন, কত লোক কত দাবি, সুখদুঃখ, সঙ্কট নিয়ে তাঁর কাছে গেছে, যেন তাঁর হাতেই সব নিদান আছে এই ভেবে। না, তিনি কখনও গুরুদেব হয়ে উঠতে চাননি। কিন্তু তাঁর কাছে যেত অজস্র মানুষ, জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠ পরিচিত অপরিচিত কাছের দূরের বন্ধু বা বন্ধু নয়— কোনও নির্বাচন ছিল না। খালি হাতে ফিরত খুব কম লোক। বস্তুর দিক থেকে নয়— যাওয়া মাত্র প্লেটে দুটি মিষ্টি আর চায়ের কথা আমি ধরছি না।

হ্যাঁ, কবি শঙ্খ ঘোষ। কবিরাও মানুষ, কিন্তু সব কবি এক ধরনের মানুষ হয়ে ওঠেন না। কেউ কবিত্বের দ্বারা নিজের সঙ্গে অন্যদের একটা দূরত্ব তৈরি করেন, কবিত্বে আচ্ছন্ন থাকেন। রবীন্দ্রনাথকে তো হিসেবের বাইরেই রাখি সব গণনায়, কিন্তু তাঁর পরের প্রজন্মের বাঙালি কবিদের কতজনকে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম ‘দাদা’ সম্ভাষণ করতে পারত আমার জানা নেই। বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, বা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পর্যন্ত? তাঁর শোক-যাপনের যত লেখা বেরিয়েছে তাতে তো সেই কথাটা আসবেই সকলের আগে। তাঁর অসংখ্য স্মরণীয় কবিতার ছত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হবে, আমরা সেই অমোঘ লাইনগুলির কাছে স্তব্ধ হয়ে থাকব। কারণ এই সময়ে খুব বেশি কবি এত বেশি স্মরণযোগ্য ছত্র লিখে গিয়েছেন কি না সন্দেহ। কবি তো বটেই: হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে অগ্রগণ্য এক কবি, অনেকের মতে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শ্রেষ্ঠ কবি। জানি না আর কার শ্রেষ্ঠ কবিতা পঞ্চাশ বছরে তেইশটি সংস্করণের মুখ দেখেছে? কবি কিন্তু মোটেই রোমান্টিক পদ্মভুক কবি নন, চারপাশের সমাজ, দেশ আর পৃথিবী থেকে দূরবর্তী বা বিচ্ছিন্ন নন। আর এই কবিতা শুধু নান্দনিক অভিজ্ঞতাকে নথিবদ্ধ করে না (কবিতার মুহূর্ত, বা কবির অভিপ্রায় পড়তে বলি), তা চারপাশের মানুষকে, সমাজকে, লড়াইকে, মৃত্যুকে ধরে। তার মুখ দুদিকেই। নিজেকে সে দেখে, বলে, ‘হাহাতপ্ত জ্বালাবাষ্প দিনের শিয়রে কাঁপে হৃদয় আমার।/ আকাশ, প্রসন্ন হও। রৌদ্রহর মেঘে মেঘে ঝঞ্ঝাকালো করো দিগঞ্চল— দীর্থ করো/ তামসগুণ্ঠন। আমাকে আবৃত করো ছায়াস্তৃত একখানি ধূসর-বাতাস—/ ঢালা অকরুণ আলোর মালায়,/ আমাকে গোপন করো তুমি।’ আবার নকশালবাড়ি পার হয়ে এই ছত্রগুলিও তাঁর কবিতায় দেখা দেয়— কথা বলছিল শাদা তিন বুড়ি/ সাবেককালের প্রথায়:/ সবদিকে এত চুপচাপ কেন?/ সেই ছেলেগুলি কোথায়?’ তাই সেই সঙ্গে চারপাশের মানুষকেও সে দেখে। মানুষের দুঃখ, তার বঞ্চনা, স্বাধীন দেশে তার কত কী পাওয়ার ছিল কিন্তু সে সব তার হাতের মুঠোয় এসে পৌঁছোয়নি, অনেক মৃত্যু অনেক রাষ্ট্রীয় হত্যা ঘটেছে— তাও শঙ্খ ঘোষকে স্বস্তি দেয়নি। কে ভুলতে পারে গত শতকের সত্তরের দশকে, জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁর সেই তীব্র ব্যঙ্গের পঙ্‌ক্তিমালা? কলকাতার রাজপথ কতবার যে তাঁর মিছিলে হাঁটার চিহ্ন ধারণ করেছে তার কি কোনও হিসেব আছে? আর কোন্ কবি এমন সাহস করে নিজের শ্রেষ্ঠ কবিতা-র ভূমিকায় বলতে পারেন, ‘সত্যি কথা বলা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই কবিতার।’ কবি তিনি ছিলেন, কিন্তু মানুষের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, পার্থিব— সব রকম অস্তিত্বের বিষয়ে গভীরভাবে আগ্রহী এক কবি।

কবি, আর সেই সঙ্গে কবিদের নির্মাতাও বটে। আমি জানি না, জীবনানন্দের পরে আর কোনও বাঙালি কবির কবিতা এত বেশি তরুণ কবিদের কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে কি না। সবাই হয়তো তাঁকে অনুকরণ করেনি, তাদের নিজেদের মতো করে লিখেছে, কিন্তু তারা যে নিজেদের মতো করে লিখতে পেরেছে, তার মূলেও শঙ্খ ঘোষ। কারণ তিনি তাঁদের সামনে, ভাষায়, ছন্দে, মিলে, স্তবকনির্মাণে, জীবনের প্রতি ভালোবাসার উচ্চারণে এমন এক উত্তমতার চ্যালঞ্জ তৈরি করে রেখেছেন যে, সকলে নিজের শিল্পকে অবহেলা করার কথা ভাবতেই পারেনি।  তিনি ছিলেন তরুণ কবিদের এক অবলম্বন আর আশ্রয়। সবাই জানে তাঁর বিদ্যাসাগর নিবাসের ফ্ল্যাটে প্রতি রবিবার তরুণ কবিদের একটি আড্ডা বসত সারা সকাল জুড়ে। এই আশ্রয কবিরা অন্য কোথাও পেত কি না সন্দেহ। এখান থেকে তারা কী রসদ নিয়ে ফিরত তা নিশ্চয়ই তারা নিজেরাই বলবে, আজ বা কাল। কেউ কেউ বলবার আগেই চলে গেছে— ভাস্কর চক্রবর্তী বা জয়দেব বসু যেমন।

কিন্তু শুধু কবিতার সঙ্গেই তাঁর সম্পর্ক ছিল তা একেবারেই নয়। গদ্যরচনা বোধহয় তাঁর কবিতার চেয়েও বেশি। তাঁর গদ্যের মধ্যেও একটা মায়া আছে। ছোটদের জন্যে লেখা উপন্যাস ‘সুপুরিবনের সারি’ বা নানা স্মৃতিচারণামূলক গদ্যে যেমন, তেমনই যখন তিনি গবেষণা বা মননবিস্তার করেন— সে ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’ হোক, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ হোক বা কাব্যতত্ত্বসন্ধান ‘কবির অভিপ্রায়’ হোক, তার একটা বিচিত্র আকর্ষণ তৈরি ‎হয় যার তুলনা খুব বিরল। সাধারণ গবেষণাগ্রন্থগুলিতে পাঠসুখের এই আমন্ত্রণ একেবারেই থাকে না, হয়তো তার বিপরীত কিছুই থাকে। কিন্তু শঙ্খ ঘোষের গদ্য, যে উপলক্ষ্যেই আসুক, তার স্বাদুতা যেমন হারায় না, তেমনই ব্যক্তি (রেজাউল করীম, ক্ষুদিরাম দাস, দেবীপদ ভট্টাচার্য— আরও বহু মানুষ), ঘটনা, সময় এবং বিষয়ের গভীরতা সমস্ত কিছুকে পাঠকের কাছে জীবন্ত করে তুলে ধরে। তখন তাঁকে আমাদের সময়ের এক শ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পী বলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

এত শান্ত, সামাজিকভাবে স্বল্পভাষী আর নিজেকে আড়াল করা মানুষ, আজীবন সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি/পাজামা পরা মানুষ। অথচ তাঁর নানা বিচ্ছুরণও দেখেছি কত। তাঁর অসামান্য অধ্যাপনার কথা তাঁর ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিচারণে পাওয়া য়াব। তাঁর রবীন্দ্রনাথ বা যা কিছু পড়ানো, তাঁর ছন্দ বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যক্তিগত পদ্ধতি, ছাত্রছাত্রী আর সহকর্মীদের সঙ্গে পিকনিকে বা দূরে কোথাও ‘শিক্ষমূলক’ ভ্রমণে, এই সেদিন পর্যন্ত নানা সভায় তাঁর বক্তৃতায় যে শঙ্খ ঘোষকে আমরা পেয়েছি, তাঁকে শুনতে আমরা বাধ্য হয়েছি। কণ্ঠস্বর নম্র কিন্তু বিশ্বাস ও সত্যে দৃঢ়বদ্ধ, কিন্তু তাঁকে শোনা এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। যেমন ছিল তাঁর কবিতার আবৃত্তি। কত বিচিত্র কাজ করেছেন তিনি।  গ্রামোফোন কম্পানির জন্য নানা সঙ্কলন, কলকাতা দূরদর্শনের জন্য রবীন্দ্রনাথের উপর নানা চিত্রনাট্য— সব কিছুর মধ্যেই ছিল রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর বোধের গভীরতার ছোঁওয়া।

মানুষটির মধ্যে এক ধরনের বৈপরীত্যও ছিল। স্বভাবত প্রচারবিমুখ, সচল সাংবাদিক ক্যামেরা বিশেষভাবে এড়িয়ে চলতেন। জ্ঞানপীঠের জন্য বাড়িতে গেছে দূরদর্শনের ক্যামেরা, তিনি তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি হবে, তিনি নিজে তাতে কোনও ভূমিকা নেবেন না, কথাও বলবেন না। কলকাতার রাস্তায় পায়ে হাঁটছেন শঙ্খ ঘোষ, সেই ধুতিপরা পায়ের চলনের ছবি তোলা হল এক অভিনেতাকে দিয়ে। সেই চিত্রে তাঁর একমাত্র সজীব, কিন্তু নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি ছিল একটিমাত্র দৃশ্য— তিনি তেতলার বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে বসে আছেন, ক্যামেরার দিকে পাশ-ফেরানো মুখ।

কিন্তু এই মানুষকে কতবার দেখা গেছে জনতার মিছিলে। শান্তির, সম্প্রীতির, রাজনৈতিক টীকাভাষ্যের বাইরে গিয়ে মানবিক কোনও সঙ্কটের প্রতিবাদে। তাঁর কবিতাও তো প্রতিবাদে দীর্ণ হয়েছে সেই প্রথম থেকে। গত শতাব্দীর চল্লিশের বছরগুলিতে কবিতায় মাথা তুলেছিল যে তুমুল বামপন্থা— সুভাষ মুখোপাধ্যায, সুকান্ত ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতির কবিতায়, সেই সঙ্গে তিরিশের দুর্বোধ্যতা কাটিয়ে মানুষের সহজ ভাষায় কবিতার সঞ্চার, আবার একই সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রেম, মানবসম্পর্ক, নিসর্গ ইত্যাদির বিচিত্র নিরীক্ষা— পঞ্চাশের কবিদের মধ্যে এক শঙ্খ ঘোষেই যেন সবগুলি ধারা এসে মিলিত হয়েছিল, অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি করে, হযতে আরও সার্থকভাবে। ফলে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকায় তাঁর সময়ের কবিদের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই বলতে দেখি, ‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই কবিতার’। এই এই একই কথা আমরা আরও অনেক পরে শুনি বিশ শতকের এক শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক নোয়াম চম্‌স্কির মুখে, যাঁর ‘দ রেস্পন্‌সিবিলিটি অব দি ইন্টেলেকচুয়াল’ প্রবন্ধে এই সত্য উচ্চারিত হয়— ‘দ রেস্পন‌সিবিলিটি অব দি ইন্টেলেকচুয়াল অলওয়েজ ইজ টু স্পিক দ ট্রুথ।’ সেই সত্যসন্ধ জীবনের সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু তা নিশ্চয় বহু বহু প্রজন্মকে উজ্জীবন দেবে ওই একই বিশ্বাসে।

শঙ্খদাকে আমি যাদবপুরে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম, তা এই জীবনের এক সমৃদ্ধ সম্বল হয়ে আছে। আমরা যখন যাদবপুরে ক্লাসের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ক্লাবে গিয়ে আড্ডায় বসতাম, শঙ্খদা, সৌরীন, নবনীতা, সুবীর রায়চৌধুরী, স্বপন মজুমদার, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় দেব, পিনাকেশ প্রভৃতি, সে ছিল আর-এক বিচ্ছুরণের জায়গা। এ ওকে পাল্লা দেয় উজ্জ্বল মন্তব্যে ও কটাক্ষে, আমাদের দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যেত।

আমার নিজের ভালো লাগত বাংলাভাষা সম্বন্ধে শঙ্খদার বিপুল আগ্রহ। হয়তো এটা পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন তিনি। ভাষা ও বানান সম্বন্ধে মণীন্দ্রকুমারের আগ্রহের স্পর্শ আমরা পেয়েছি। বাংলা আকাদেমির সঙ্গে তিনি একেবারে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন, পরে তো এর সহ সভাপতিও হয়েছিলেন। আমাদের পরিভাষা, বানান ও লিপি সংস্কার, অভিধান-নির্মাণ ইত্যাদি যাবতীয় কাজে তাঁর বিপুল সমর্থন আমরা পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১২৫ বছর উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ করে, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষই ছিলেন তার মূল স্থপতি। বিশেষ করে শেষ (ষোড়শ, ‘গ্রন্থপরিচয়’) খণ্ডটিতে গবেষক শঙ্খ ঘোষের রবীন্দ্র-সন্ধিৎসার অনবদ্য পরিচয় নথিবদ্ধ হয়ে আছে।

কিন্তু শঙ্খদার ভাষাবিষয়ে আগ্রহ পণ্ডিতের যেমন, তেমনই শিল্পীর। নইলে কবিতার অলঙ্কার বিষয়ে শব্দের খেলা-র মতো একটা বই কে আর লিখতে পারত, কে খেলার মজাটা ধরিয়ে দিত পারত ছোটদের? আর এই সামাজিক মানুষটি অসাধারণ কবি, সমালোচক, রবীন্দ্রতাত্ত্বিক, গদ্যশিল্পী, বন্ধু, আশ্রয়দাতা অগ্রজ হওয়া ছাড়াও কত কী অদ্ভুত কাজ করেছেন। সরস্বতী সম্মান না কী একটা পেয়েছেন পাঁচ লাখ টাকার, তার পুরোটাই তিনি দিয়ে দিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে। সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেক দিনের, সেই ভারত-কোষ-এরও আগে থেকে।  সাহিত্য পরিষদের দুর্গতি চলছে শুনে বাংলার কোনও শিল্পপতি এগিয়ে আসেনি। শঙ্খ ঘোষ তার লন্ডন-প্রবাসে বন্ধু নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের দান কয়েক কোটি টাকা পৌঁছে দিলেন তার ভাণ্ডারে। মানুষের জন্যও তাঁর হৃদয় এবং হস্ত এমনই দরাজ থাকত সব সময়।