প্রবুদ্ধ বাগচী
প্রাবন্ধিক, সমাজভাবুক
গত শতকের নব্বই দশকের গোড়ার দিকে যখন দেশে নব্য আর্থিক নীতির জোয়ার আসে ঠিক সেই সময়েই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয় বাংলাভাষার বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত কবির। নিজের কবিতাচর্চা সেকরার ঠুকঠাক হলেও সত্যি সত্যি কবিতায় কামারের এক ঘা কতদূর পর্যন্ত অভিঘাত নিয়ে আসে তা বুঝতে পারছিলাম এইসব কবিদের কবিতা পড়তে পড়তে। আর তাই সে বিমোহিত অনুভূতির মধ্যবর্তিতায় সাধ হয় কবিসঙ্গের। আর তার সুযোগ ঘটে যায় ষাটের দশকের খ্যাত কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের সহৃদয় বদান্যাতায়। তাঁর পোদ্দার কোর্টের অফিসচেম্বার কার্যত তখন কবি বা কবিযশোপ্রার্থীদের সদর দফতর। গুটি গুটি পায়ে সেখানে পৌঁছে যেতে আস্তে আস্তে আলাপ হয়ে যেতে থাকে কবিদের সঙ্গে। অবশ্য এখানে প্রভাত চৌধুরীর ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার নামও ইতিহাসগতভাবে উল্লেখ করা দরকার। তাঁর অধিনায়কত্বে নবীন প্রবীণ একদল কবি জড়ো হয়েছিল ওই পত্রিকার ছাতার তলায়। কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার জুড়ে যাওয়া এইসব সূত্রেই। প্রাথমিক পরিচয়ে একটা দূরত্ব ছিল, কিন্তু সেই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর আপন স্বভাবে। বলা ভালো, নিতান্ত মফস্বলে স্কুলজীবন কাটানোয় কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় বা তাঁর খ্যাত ‘কবিপত্র’ পত্রিকার কথা আমি এর আগে শুনিনি। ফলে তাঁর সাহচর্যে যখন সেইসব পুরোনো গল্প শুনতাম তা ছিল আমার কাছে হাঁ করে গিলবার বিষয়। আমার ধারণা ছিল না অত বিখ্যাত একজন কবি আমার মতো তরুণকে এতদূর পাত্তা দেবেন। কিন্তু ঘটেছিল তার উল্টোটাই। শনিবার একটায় অফিস ছুটির পরে মেট্রো রেলে চেপে তাঁর প্রতাপাদিত্য রোডের বাসায় আমার যাওয়া ছিল প্রায় নিয়মিত। তাঁর পাশে বসে শুনেছি তাঁর কবিতা নিয়ে আর ‘কবিপত্র’ নিয়ে বেঁচে থাকার আর লড়াইয়ের গল্প। যাঁর খাওয়ার ঠিক ছিল না, যাঁর মাথার ওপর ছাদ ছিল অনিশ্চিত, জীবিকা ঘোর সঙ্কটে সেই তিনিই ক্রমশ আঁকড়ে ধরছেন কবিতাকে এটা খুব হেলাফেলা করার মতো ঘটনা নয়। আকাশে মুষ্টিবদ্ধ হাত মানেই লড়াই নয়, আরও অনেক রকম অগোচর লড়াই আছে। সেই লড়াই আর কবি পবিত্র মূখোপাধ্যায় সমার্থক। দীর্ঘ দিনের প্রকাশিত ‘কবিপত্র” পত্রিকার কিছু বিশেষ সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখেছি সেই সময়। একেবারে বাণিজ্যিক স্রোতের বাইরে দাঁড়িয়ে কী চমৎকার সব সংকলন ছোট গল্প নিয়ে, ছবি নিয়ে। কার্যত এই পত্রিকা কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল একটা লেখকগোষ্ঠী। আর তাঁর মধ্যমণি পবিত্রদা। যিনি শুধু সম্পাদক নন, একই সঙ্গে নিয়মিত লেখক। আজ আর তাঁর কবিতা নিয়ে বাড়তি কিছু বলার নেই। সুযোগ এসেছিল তাঁর লেখালিখি নিয়ে বিস্তারিত লেখার, “কবিকৃতি” পত্রিকার সম্পাদক সুজিত সরকার সেইসব সযত্নে ছেপেছেন। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর রবিবারের পাতায় রবিশংকর বল আমায় বলেছিলেন পবিত্রদাকে নিয়ে ফিচার করতে, সেই লেখাও প্রকাশ করেছেন তাঁরা, অনেকদিন আগে। মনোজ চাকলাদার নামের এক গবেষক পবিত্রদার কবিতা নিয়ে গবেষণামূলক বই লিখেছেন। আজ সেই কেন্দ্রের মানুষটা প্রয়াত। মানুষের মৃত্যুর পরে তবুও মানব থেকে যায়। ‘কবিপত্র’ পত্রিকার চল্লিশ বছর পূর্তিতে ‘ইস্ক্রা’ পত্রিকা পবিত্র মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি বিশেষ স্মারক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। সেই উপলক্ষে একটি নিবন্ধ লিখবার সুযোগ তাঁরা আমায় দিয়েছিলেন। পবিত্রদার স্নেহভাজন হিসেবে আপাতত সেই লেখাটি পুনঃপ্রকাশের মাধ্যমে আমি তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলাম।
চল্লিশ বছরের স্পর্ধা
যার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের তুমুল দিনগুলি সম্বন্ধে কিছুই জানি না হঠাৎ করে তার বিষয়ে কোনও মন্তব্য করে যাওয়াটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়, নৈতিকও নয়। তবু শৈশব-কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে যখন একটি পত্রিকা, সীমিত অর্থে নিছকই এক ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত কবিতাপত্র, এমন এক সময়ের সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছায়, তখন শুধু এই সময়ের পেরিয়ে আসা বাঁকগুলোকে খুঁজে নেওয়ার তাগিদেই কিছু বলার লোভ সংযত রাখা কঠিন। বিশেষ করে, তা যদি হয়, ‘কবিপত্র’র মতো এক প্রকাশনা! আমি ‘কবিপত্র’র থেকে দশ বছরের ছোট, কিন্তু আমি নিশ্চিতই জানি, সেই শুরুর থেকে আজ পর্যন্ত ‘কবিপত্র’ মানে এক তুলকালাম স্পর্ধা। হ্যাঁ, শতকরা একশোভাগই স্পর্ধা— মাথা উঁচু রাখার স্পর্ধা, নতুন কোনও ভাবনাকে আলোয় আলোকময় করে দেওয়ার স্পর্ধা।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আজ থেকে সতেরো বছর আগে, সমর সেনকে উদ্দেশ্য করে একটা ছোট্ট কবিতা লিখেছিলেন। তাতে তিনি একটু মজা করেই বলেছিলেন:
সবাই যখন রাজবাড়িতে
বেচতে গেলেন দাঁতের মাজন
একা তিনি চৌরাস্তায়
দাঁড়িয়ে শোনেন শিবের গাজন।
আমার কেমন যেন মনে হয়, ‘কবিপত্র’ পত্রিকা এবং তার স্থপতি পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে কথাগুলো বেশ সুপ্রযুক্ত। আজ থেকে চার দশক আগে যখন এই পত্রিকা প্রকাশ করার ভাবনা নিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ, তখন ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হয়ে অনায়াসেই তিনি এগিয়ে যেতে পারতেন। এবং আমার বিশ্বাস, ‘রাজবাড়িতে’ ‘দাঁতের মাজন’ বেচতে গেলে তিনি খুব একটা ব্যর্থও হতেন না, কারণ নিজের মাধ্যমটায় তাঁর ক্ষমতা কিছু কম ছিল না। মনে রাখা প্রয়োজন, পঞ্চাশের দশকের ওই সময়টায়, এই আজকের মতো, পত্রিকাপ্রকাশ, সম্পাদকের কেরিয়েরের পাকা বুনিয়াদ তৈরি বা বড়-ছোট-মাঝারি সাহিত্য মহলে নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার কোনও অব্যর্থ হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। একইভাবে, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ঠিক এক দশক পরে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের একতরফা চাপ এবং তার থেকে চুঁইয়ে পড়া বিচ্ছিন্নতার মনোদর্শনে এক পার্টি ভেঙে দুটি বা তিনটি পার্টি, এক পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্তর্কলহে একাধিক গোষ্ঠীর হতচকিত উদ্ভব, এই প্রবণতাগুলো সেভাবে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি বা সাহিত্যের শরীরে দেখা দিতে আরম্ভ করেনি। সেই বিগত সময়ের সবই স্বর্ণালী রঙে আলোকিত ছিল— এমন একমুখী আবেগের বেষ্টনী থেকে বেরিয়েই বলছি, সেই সময়ে এইরকম কোনও স্বতন্ত্র চরিত্রের বিকল্প পত্রিকার প্রকাশভাবনা ছিল যথেষ্টই স্পর্ধার। তার ওপর বেশ রকমারি বিষয় সংবাদ-ফিচার-তদন্ত সবমিলিয়ে জমজমাট তেমন কোনও সাড়ে বত্রিশ ভাজা হলেও বা কথা ছিল— নেহাতই এক ‘দুর্বোধ্য’, ‘অপঠিত’ বিষয় নিয়ে পত্রিকা?
কিন্তু এরই পাশাপাশি, আমি বলতে চাই, এই অভাবনীয় স্পর্ধা প্রকাশ করার অবজেক্টিভ শর্তগুলোও কিন্তু সেদিন জীবন্ত ছিল। ভুলে গেলে চলবে না, এই পঞ্চাশের দশকেরই মাঝামাঝি সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র হাত ধরে বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্র এক রুচিশীল আধুনিকতার মুখ দেখেছে। একই সময়ে ঋত্বিক ঘটক শেষ করে ফেলেছেন তার ‘নাগরিক’-এর মতো ছবি, শম্ভু মিত্র মঞ্চস্থ করেছেন ‘রক্তকরবী’র এক প্রজ্ঞাস্নাত সংস্করণ, বাংলা গানে সলিল চৌধুরী তুলে আনছেন অনবদ্য সব সুরের ঐশ্বর্য, পঞ্চাশের কালাপাহাড়ী কবিরা তখন কবিতাকে নতুন করে শাসন করার চেষ্টা করছেন প্রতিদিন। এই সবকিছুর মাঝখানেই কিন্তু ‘কবিপত্র’র মতো ভাবনার জন্ম ও বিকাশ। সেদিনের সেই সম্পন্ন সময়ের চেতন বা অচেতন প্রভাব কি কোনওভাবেই অনুভব করেননি সম্পাদক ও স্থপতি পবিত্র মুখোপাধ্যায়? এইরকম একটা পরিবেশে মাঝখানে ‘একা চৌরাস্তায়’ দাঁড়িয়ে ‘গাজনের’ শোভাযাত্রা দেখতে দেখতেই কি তার মনে হয়নি নতুন কোনও রাস্তার অভিযাত্রায় তাঁকে বেরিয়ে পড়তে হবে, অস্তিত্বের ভিন্ন একটা মানেও খুঁজে নিতে হবে পাশাপাশি, যে তাগিদ থেকেই একদিন ‘ফ্রন্টিয়ার’ প্রকাশ করার কথা ভেবেছিলেন সমর সেন! চরিত্রের দিক দিয়ে ‘কবিপত্র’ আর ‘ফ্রন্টিয়ার’ আলাদা, কিন্তু ওই দায়টা, ওই তাগিদটা— বোধহয় তা অভিন্ন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘কবিপত্র’ পত্রিকা চল্লিশ বছর পেরিয়ে আসার সূত্রে কেন তার সম্পাদকের কথা বারবার এসে পড়ছে? যাঁরা এই ধরনের প্রশ্ন তুলবেন তাঁদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পবিত্র মুখোপাধ্যায় যখন ‘কবিপত্র’ পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করেন তখন তিনি আঠারো বছরের এক তরতাজা কিশোর; ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় এসে পড়া, সংসারের দৈনন্দিন ঘা-খাওয়া, স্বল্প আয়ের সংস্থানে হিমসিম খাওয়া তাঁর পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল বিশাল মেট্রোপলিসে কোনওভাবে ফাঁকফোজর খুঁজে পেটের ধান্দায় নেমে পড়া। সেসময়ের গড়পড়তা আঠারো বছরের এই ছিল পরিণতি। অথবা রুটিরুজির লড়াইয়ের স্বার্থে সেসময়ের কমিউনিস্ট পার্টির দর্শনে-প্রকরণে আপাদমস্তক আস্থা রেখে আস্তে আস্তে বড় মাপের কোনও নেতা হয়ে ওঠা— সমাজবিপ্লবের স্বপ্নে নিজে মজা, অন্যকে মজানো। ভাগ্যের চাকা নয়, আমার মনে হয়, ইচ্ছের চাকার ঘূর্ণনেই এ দুয়ের কোনওটাই তার ক্ষেত্রে ঘটেনি, তিনি ঘটতে দেননি। তাই ‘কবিপত্র’। কিন্তু আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি কিশোররা কতটা পরিণতমনস্ক ছিলেন? সাহিত্য-শিল্প-সমাজ-সংস্কৃতি সম্বন্ধে কতটা সচেতন থাকা সম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে?
তাই আমার মনে হয়, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-শম্ভু মিত্র-সলিল চৌধুরী বা বিষ্ণু দে-বুদ্ধদেবের পরিবেশে দাঁড়িয়ে ‘কবিপত্র’ ছিল পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের নিজের পথচলার একটা যোগ্য অবলম্বন। স্বভাবত, গত চল্লিশ বছরের ‘কবিপত্র’ পত্রিকার ইতিহাস এক হিসেবে তো পবিত্র মুখোপাধ্যায়েরও জীবনযাপনেরই ইতিহাস, তাঁর কবিজীবনের বিবর্তনের দলিল। প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’, বুদ্ধদেবের ‘কবিতা’ বা অন্যান্য খ্যাত পত্রিকার থেকে এখানেই ‘কবিপত্র’ একেবারে আলাদা। ওগুলো সবই ছিল পরিণত বয়সের প্রয়াস। স্থপতি সম্পাদকের মননের বিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নয়। ‘কবিপত্র’র আঠারো বছর বয়সী সম্পাদকের কোনও কবিপরিচিতি সমকালে ছিল না। কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায় একটু একটু করে হয়ে উঠেছেন, পাশাপাশি বিকশিত হয়েছে ‘কবিপত্র’। তাই এই দুয়ের মধ্যে সত্যিই কোনও বিভাজনের আরোপ নেই। কারণ যেভাবে ‘কবিপত্র’ শিরোনামের বর্ণগুলিকে একটু সাজিয়ে ধরলে উঠে আসে ‘পবিত্র’ নামটি, বাস্তবেও ব্যাপারটা তাই।
সম-মানসিকতার বন্ধুবান্ধবরা যে একেবারে তার পাশে এসে জড়ো হননি তা নয়। অনেকেই এসেছেন। ‘কবিপত্র’ তাঁদেরও ধ্যান-জ্ঞান-চর্চা হয়ে উঠেছে মাঝের কিছুটা প্রক্ষিপ্ত সময়ে। আবার তারা কেউ কেউ সরেও গেছেন। তবু ‘কবিপত্র’ প্রকাশ হয়েছে। পবিত্র মুখোপাধ্যায় একটু একটু করে খ্যাতির বা পরিচিতির বৃত্তে এসে দাঁড়িয়েছেন। পবিত্র মুখোপাধ্যায় সংসার পেতেছেন। ‘কবিপত্র’ও তাঁর সংসারের প্রয়োজনীয় আসবাবের মত থেকে গেছে তাঁর সঙ্গে। পবিত্র মুখোপাধ্যায় প্রেমিক থেকে পিতা হয়েছেন। তাঁর কন্যাসন্তানের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ হয়েছে ‘কবিপত্র’। এভাবেই চল্লিশ বছর কখন যেন গড়িয়ে চলে গেছে। আমরা যে টের পাইনি তা নয়। একেক সময়ের বাঁকে হঠাৎ কোনও কবিতা-দর্শনের উদগাতা হিসেবে সামনে এসে গেছে ‘কবিপত্র’, নতুন কোনও সাহিত্য আন্দোলনের বিভঙ্গ নিজের শরীরে ধারণ করে রেখেছে এই প্রবাহমান পত্রিকা আর তার অবিমিশ্র স্পর্ধা। নতুন ধারণায় বিশেষ কোনও সংখ্যা প্রকাশ করে সকলকে চমকেও দিয়েছে কখনও কখনও। শুধুমাত্র ছোট পত্রিকার সংক্ষিপ্ত ও ভুলভাবে-আত্মতৃপ্ত বৃত্ত থেকে বেরিয়ে ‘কবিপত্র’ কখন যেন একটা বড় আকাশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বোধহয় এতটা ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্তে পুষ্ট নয়, তাই আষাঢ়ে-জন্ম-শ্রাবণে-মৃত্যু গোছের অজস্র পত্রিকার পাশে এই একটা বাড়াবাড়ি গোছের উদাহরণে আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্তের অবচেতন ঈর্ষাবোধ যে কখনও মাথাচাড়া দেয়নি এটা কি আমরা বুকে হাত রেখে বলতে পারব? তাই আড়ালে-আবডালে আমরা এ নিয়ে গুজগুজ-ফুসফুসও যে করিনি তা নয়, তবু ‘কবিপত্র’র প্রকাশ বন্ধ হয়নি। সাময়িক হয়তো থমকে গেছে ব্যক্তি-উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা মেনেই, কিন্তু ব্যক্তি-উদ্যোগের দিন-আনি-দিন-খাই পেরিয়েও আন্তরিকতা নিঃস্ব হয়ে যায়নি। এমনকি মলিন হয়ে যায়নি সেই পুরনো স্পর্ধার আঁচ!
তাই আজও ‘কবিপত্র’। গত চারটে দশক বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ কীভাবে হাড়েমজ্জায় পালটে গেছে আমি, আপনি সকলেই জানি এবং টের পাই। সাহিত্যের কাছাখোলা বাণিজ্যায়ন, মিডিয়া-লালিত জীবনধারার ছাপ যেভাবে আমাদের উত্তরপ্রজন্মের চেতনাকে আখের গোছানোর দুর্নিবার অভিমুখে টান দিয়ে চলেছে, উদার অর্থনীতির খোলা হাওয়া পালে লাগিয়ে যেভাবে আমরা ‘ডুবতে রাজি আছি’ এই প্রতীতিতে ভর করে দাঁড়াতে শিখছি সেখানে একেবারে নিজস্ব প্রয়াসে পরিচ্ছন্ন সুদিশারী কোনও পত্রিকা বার করা ক্রমশ একটা অট্টহাসির উপকরণেই হয়তো পর্যবসিত হবে বলে আশঙ্কা হয়। তবুও আপাতত সে আশঙ্কার মুখে ছাই দিয়ে ‘কবিপত্র’ প্রকাশিত হয়ে চলেছে। হয়তো আগামী আর কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতির চোরাস্রোতের টানে আমাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আরও লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। হয়তো আগ্রাসী হিন্দু-হিন্দি মৌলবাদের চোখরাঙানির দাপটে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলা নির্বিবাদে ভুলে যাব এবং এই বিস্মরণ নিয়ে আমরা বেশ নির্লিপ্ত দিন কাটাব। হয়তো পিছিয়ে যাওয়ার অগ্রগতিতে আমরা আধুনিকতা থেকে আবার পুরাণের যুগেই ফিরে যাব। সেদিন ‘কবিপত্র’ প্রকাশ হবে কিনা আমি জানি না! জানি না, ঠিক কোন রকমের আক্রমণের মুখে কীভাবে তাকে প্রতিহত করতে পারবে ‘কবিপত্র’!
তবু যদি সেদিন ‘কবিপত্র’ তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে কিছুমাত্র সক্ষম হয়, তবে সে যেন তার চরিত্রস্খলিত না হয়। চল্লিশ বছর বয়সটা বড় বিপজ্জনক। ‘আজকে যে প্রতিবাদী কণ্ঠ/ সর্বংসহা হবে কাল সে/ চল্লিশ পেরোলেই চালসে’— না, ‘কবিপত্র’র স্পর্ধায় যেন কখনও চালসে না ধরে।