Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেয়েদের শ্রম ও মিম

মেয়েদের শ্রম ও মিম -- অনুরাধা কুন্ডা

অনুরাধা কুন্ডা

 

(একটি চলমান কাজের মুখবন্ধের কিছুটা ব্যবহার করলাম। যা কিছু বর্তমানে ঘটে, তার পিছনে কাজ করে সুদীর্ঘ ইতিহাস।)

এখন প্রায় সন্ধ্যাকাল। সূর্য ডুবে গেছে প্রায়। বনের ভিতরে এমনিতেই বেশ অন্ধকার। সূর্যাস্তের পর আরও বেশি কঠিন অন্ধকার। পুরুষ তিনজন ঝোপের পিছনে চুপ করে বসে আছে সকাল থেকে। তাদের হাতে বল্লম। কিন্তু আজ কপাল মন্দ। জলাশয়ের ধারেকাছে আজ কোনও পশুপাখি আসেনি। গত দুদিন প্রবল বৃষ্টি পড়েছে। তারা নিজেদের আস্তানার কাছাকাছি জলের সন্ধান পেয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ছোট ছোট নালা বা খানাখন্দ জলে ভরে যায়। অন্ধকার নেমে আসার পর প্রচণ্ড মশার উৎপাত। শিকারি পুরুষরা সকাল থেকে নির্বাক হয়ে বসেছিল শিকার সন্ধানে। তাদের পেটে খাবার যায়নি কিছু। এখন ক্ষুধাতে গা গুলাচ্ছে তাদের। তারা পুরুষ। খাদ্য সংগ্রহকারী বলশালী পুরুষ। হাতে লোহার বল্লম। আগুনে পুড়িয়ে বল্লমের মুখ তীক্ষ্ম করা হয়েছে। কিন্তু হায়!

সকলই বৃথা। একটিও শিকার পেল না তারা আজ। মুখ কালো করে, ক্রুদ্ধ, বিপন্ন ও বিষণ্ণ পুরুষত্রয় ফিরে চলল দলের অভিমুখে। তাদের পদক্ষেপের সঙ্গে দুলছিল তাদের দীর্ঘ চুল। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে খাদ্য ফুরিয়ে গেছে সব। দলের বাকি সবাই তাকিয়ে আছে তাদের শিকারের প্রত্যাশায়। দলের অন্যান্য পুরুষরাও আজ খালি হাতে ফিরছে। বৃষ্টির পর পশুপাখিরা বেরোয়নি তেমন। জলের প্রয়োজনও হয়নি।

বিস্তীর্ণ বনভূমির এক প্রান্তে দলটির বসবাস। ক্লান্ত, হতোদ্যম পুরুষরা প্রবল ক্ষুধা ও প্রকাণ্ড হতাশা নিয়ে ফিরছে আজ। সারাটা দিন তাদের বাসস্থান থেকে বহু বহু দূরে শিকার অন্বেষণে কেটে যায়। মাঝেমাঝেই এরকম বিপর্যয় ঘটে। সে হল হতাশার কালো দিন। গভীর বনের অধিকতর কালো। কিন্তু সেই অন্ধকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে একটুকরো আলোকচ্ছটা। আগুন। চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বেলেছে দলের মেয়েরা। তারা সারাদিন বাসস্থানেই থাকে। কাছাকাছি যায়। ছোট ছোট মুরগি, খরগোশ, ছাগল ধরে এনে পোষ মানায়। তারা তৈরি করেছে খননদণ্ড। তাই দিয়ে মাটি খুঁড়ে ধান আর আলু লাগায় তারা। কিছু শাকসবজি তৈরি করে।
হতোদ্যম শিকারিরা ফিরে এল। বড় বড় গাছের পাতায় নারীরা নিয়ে এল সিদ্ধ আলু, সিদ্ধ চাল, পোড়া মুরগির মাংস, শাক। শিকারের অভাব দলকে অভুক্ত থাকতে দেয় না। মেয়েরা তাদের মত করে খাদ্য সংগ্রহ করে। চাল, আলু রাখার জন্য কাছাকাছি বেতবন থেকে বেত সংগ্রহ করে ঝুড়িও বুনেছে তারা। চাল আর সবজি সেইসব ঝুড়িতে রাখা থাকে। অসময়ের জন্য। প্রখর তাপের দিনেও শিকার মেলে না। বা খুব শীতে। তখন মেয়েদের সংগ্রহ করা শাকসবজি সবার উদরপূর্তি করে। যেমন আজ।

ধ, খ এবং ঠ দেখল দলের অন্যান্য পুরুষরা অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য। অতি ক্ষুধার্ত মানুষগুলি আগুন ঘিরে খেতে বসেছে। নারী পুরুষ সবাই একসঙ্গে খাদ্য গ্রহণ করে তারা। শুধু শিশু আর বৃদ্ধরা আগে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

খাদ্যগ্রহণ অতি আনন্দের সঙ্গে হল। সবাই পর্যাপ্ত চাল সিদ্ধ পেয়েছে। আগে তারা সব পোড়া খেত। ইদানীং মেয়েরা আবিষ্কার করেছে চাল সিদ্ধ অতি উপাদেয়। মাটির পাত্র পুড়িয়ে তাতে চাল সিদ্ধ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে নারীরা খুব খুশি। এতে বেশ পেট ভরে। শিশু ও বৃদ্ধরাও খেতে পারে।

রাত গভীর হলে মেয়েরা বনের অন্য প্রান্তে জড়ো হল। পুরুষরা ঘুমিয়ে পড়েছে সারাদিনের হতাশ ক্লান্তিতে।

রা খুলে দিল তার দীর্ঘ চুল। নি সেই চুল নিয়ে খেলা শুরু করল। খেলতে খেলতে চুলগুলো তিন ভাগে বিভক্ত করে জড়াতে থাকল নি। চাঁদ উঠেছে আকাশে। সব চুল জড়ানো হলে ভারি সুন্দর লাগল তার। অন্যান্য নারীরা ছুটে এল। তারাও অমন করে চুল জড়াতে চায়। ভারি মজার খেলা যেন। এলোমেলো আলুথালু চুল হাত দিয়ে পরিষ্কার করে জড়ানো হচ্ছে। এক একটি নারীদেহ দুলে উঠছে। যেন মাটির নিচে যে গভীর গভীরতর খেলা চলে, সেই ছন্দে নেচে উঠছে সবাই। মা একটি লাল ফুল তুলে পরিয়ে দিল রা-র চুলে। হাত ধরে দৌড়াল। এই নারীরা কেউ দুর্বল নয়। এরা সুষম খাদ্য খায় বলেই খননদণ্ড ব্যবহার করে সবজি চাষ করতে পারে।
সবল, নির্ভয় দেহগুলি নেচে উঠল। আনন্দে। আবেগে। তারা ফসলমাতা। তাদের শরীর ঘিরে উৎসব। যেন কোনও ভয় নেই। দুর্ভাবনা নেই। ধা ধিনক ধিন ধা। একটি বিশেষ সুরে বলে উঠল পা। বাকিরা কণ্ঠ মিলিয়ে পা ফেলল। মাটির বুকে তৈরি হচ্ছে তাল। সুর। অচিরেই ঘুম ভেঙে ভ্রাতৃকুল যোগ দিল তাতে।

(অনুপ্রেরণা: ইভলিন রিড। নারীমুক্তির প্রশ্নে)

থরো থরো আবেগে অনেকগুলি দেহ নাচছিল। মাটির সুর এবং গন্ধ অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল তারা। কেউ কেউ আবেশে ক্লান্ত হয়ে ভূপতিত। শরীরে এক আশ্চর্য রসায়ন কাজ করছে। কয়েক হাজার বছর পরে কেউ তাদের নাম দেবে হরমোনস। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া। সেসব জটিলতা এরা কিছু বোঝে না।

যে নারী যে পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট বা যে পুরুষ যে নারীর প্রতি মুগ্ধ তারা কিছুটা আলাদা হয়ে যেতে লাগল দলগত নৃত্যের থেকে। এরা কোনও অজানা রহস্যবলে অরণ্যের এদিকে ওদিকে মিশে গেল অন্ধকারের সঙ্গে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়া সোঁদা মাটির গন্ধ, ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে মিশে গেল তাদের শীৎকার। এই অবাধ মিলনের ফলে যে শিশুরা জন্মাবে তাদের কোনও বিশেষ পিতা বা বিশেষ মাতা থাকে না। গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সমস্ত পুরুষ শিশুর পিতা আর সমস্ত নারী শিশুর মাতা। ফলে অতি আদরে নষ্ট হয়ে যাওয়া শিশু যেমন নেই, তেমনি নেই অবহেলিত, ক্ষুধার্ত অসহায় অনাথ শিশু। এখানে শিশুরা ব্যক্তিগত মালিকানাতে থাকে না। ঋতুকালে বা গর্ভাবস্থার শেষের দিকে মেয়েরা হয়তো সবসময় এই নাচে আসে না, তবু নি এসেছে। সে গর্ভবতী। ঋতুমতী হয়েও নেচে চলেছে জা। এখানে কেউ এইসব অবস্থা নিয়ে বিচলিত হয় না। সবই খুব স্বাভাবিক। সমষ্টিগতভাবে মাতাপিতার দায়িত্ব পালন করা হয় বলে শিশুরা সর্বদা খুশি থাকে। যেখানে শিশুরা খুশি থাকে, তার অধিক পবিত্র স্থান কি আছে! শীঘ্রই নি আরেকটি শিশুর জন্ম দেবে। সমস্ত গোষ্ঠী সেই আনন্দে চন্দ্রালোকিত বনভূমিতে এক আশ্চর্য নৃত্য করতে লাগল। আনন্দধ্বনির সঙ্গে মিশে গেল বুনোফুলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ, গভীর অরণ্যে মিলনরত নরনারীর আশ্লেষধ্বনি, অনাগত সন্তানের আবির্ভাবের দুগ্ধধবল উল্লাস।

ধী একজন মা। তার শিশুটি একবছরের। সে গোষ্ঠীর সমস্ত মাতৃজাতিকেই মা বলে। গোষ্ঠীর অন্যান্য সদ্যপ্রসূতিদের স্তন্যপান করে সে বড় হচ্ছে। ধী তাকে প্রসব করেছে। সে যখন ইচ্ছে শিশুকে আদর করে কিন্তু জানে যে এর উপর তার কোনও বিশেষ অধিকার নেই। প্রসবিনীকে এই সমাজ সন্তানের কোনও অধিকার দেয় না। শিশু আনন্দে আছে। তাই ধীও আনন্দে আছে। ধী এবং অন্যান্য মেয়েরা শিকারে যায় না। ঋ যায়। কিশোরীকাল থেকেই সে বরাহশিকারে পটু। অনেক সময় সে এবং আরও কিছু কিশোরী পুরুষদের সঙ্গে শিকারগমন করে। ধী জানে কীভাবে শিশুগাছকে রক্ষা করতে হয়। সে অন্যান্য মেয়েদের আগাছা তুলতে শিখিয়েছে। নারীরা প্রতিটি প্রজাতির গাছ ও শস্যের জন্য লাগসই চাষবাসের বিশেষ পদ্ধতি খুঁজে বার করেছে বলে গোষ্ঠী তাদের বিশেষ মর্যাদা দেয়। একটু বয়স্কা যারা, যেমন টি, বা, রু, এরা ঝাড়াই, মাড়াই, জমির কর্ষণ, ফসল তোলা ও মজুত রাখার কৌশলগুলি তৈরি করে অন্যান্যদের শেখায়। এখানে মেয়েদের কর্মজীবন খাদ্যসংগ্রহকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। কিন্তু মেয়েরা শুধু রান্নাঘর, আঁতুরঘর আর শিশুকেন্দ্রিক হয়ে বেঁচে নেই এখানে। গোটা শিল্পজীবন তাদের হাতে। কোন খাবার ঝলসানো হবে, কোন খাবার পোড়ানো হবে, কোনটা সেঁকা হবে বা ভাঁপানো, এসব নিয়ে তারা যেমন নিরীক্ষা করে, হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে, তেমনি পশু ধরার ফাঁদ, শস্যগোলা, মজুতঘর, বাসনকোসন তৈরি করে মেয়েরাই! পুরুষরা এত দূরে দূরে যায় যে এসব দেখার তাদের সময় কোথায়? ধী তার শস্যগোলাকে পাহারা দেওয়ার জন্য চারটে বনবেড়ালকে পোষ মানিয়েছে। নারকেলগাছ প্রচুর এখানে। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি বানানো মেয়েদের প্রিয় কাজ। একবার তো পা কাসাভা নামের বিষাক্ত উদ্ভিদ খেয়ে মরতে বসেছিল। বয়স্কা নারীরা অন্য একটি উদ্ভিদের রস খাইয়ে তাকে সুস্থ করে। মজার কথা এই যে টি এরপর ওই কাসাভাকে নিংড়ে বিষাক্ত উপাদান ফেলে, তাকে একটি প্রধান খাদ্যে পরিণত করেছে। উদ্ভিদজীবনে এদের গভীর জ্ঞান। সাপের বিষের টিকা ওরা বানিয়েছে বিষ থেকেই! সে এক দীর্ঘ কাহিনি। বেশ কয়েকজন সাপের কামড়ে মারা যায় অরণ্যের গভীরে। তারপর একদিন সরু বর্শার ডগাতেই দড়ির ফাঁস তৈরি করে একটি বিষধর সাপ ধরে ফেলে মেয়েরা। অসমসাহসী সু সেই সাপের বিষ বের করে নিয়েছিল অনেক নিরীক্ষার পর। যেসব পুরুষরা শিকারে যেতে পছন্দ করে না, তারা এইসব কাজে মেয়েদের সঙ্গে হাত লাগায়। এখানে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

প্রাত্যহিক জীবনের জ্বালানি কাঠ, জল, অন্যান্য জিনিস মেয়েরাই টানে। এমনকি ঘনঘন স্থান পরিবর্তন কালেও নারীরা কুটিরের সমস্ত জিনিস নিজেরা বহন করত। এই অঞ্চলে জল খুব দুষ্প্রাপ্য। সকালে উঠে শিকারি স বলল সে পাহাড়ের ঐ পিঠে এক চমৎকার জায়গা দেখেছে। সেখানে ঝর্ণা আছে। জল পাওয়া সহজ হবে। অনেক বড় চারণক্ষেত্রও আছে। কদিনের মধ্যেই এ তল্লাটের পাট উঠিয়ে ওরা চলে যাবে পাহাড়ের ওদিকে। সব বাঁধা ছাঁদা চলছে।

ব দৌড়ে এসে বলল, এই ভারি মাটির বাসনের বোঁচকাগুলো ভীষণ ভারি। পুরুষের বইবার মতো নয়।

মেয়েরা তখন চামড়া পাকা করছিল। এখান থেকে যাওয়ার সময় সমস্ত হরিণের চামড়া, গাইয়ের চামড়া নিয়ে যাবে পাকা করে। কে জানে ওদিকে রোদ কেমন হবে! শুনে ওরা হেসে গড়িয়ে পড়ল। ভারি জিনিস আবার পুরুষ কবে টেনেছে! সমস্ত ভারি জিনিস তো মেয়েরাই বহন করে! এ আর নতুন কথা কী হল! ব কি না ছেলেমানুষ, তাই!!!

আসলে এখানে সবাই স্বেচ্ছাশ্রম দেয়। মেয়েরা সবকিছু শিখেছে সাহস আর অটল চেষ্টা দিয়ে। তারা শিখেছে মাকড়সার কাছ থেকে কীভাবে ঘর তৈরি করতে হয়। ভারি জিনিসপত্র বহন করা মেয়েদের কাজ এ সবাই জানে। পুরুষ যায় বল্লম ও তিরধনুক নিয়ে আগে আগে। মেয়েদের পিঠে থাকে তৈজসপত্রের ভারি বোঝা, শিশু। হাতে সাত আট ফিট দীর্ঘ খননদণ্ড। শিকড়বাকড় খোঁড়ার জন্য তারা এই দণ্ড ব্যবহার করে যে তা শুধু নয়, আক্রমণ ও আত্মরক্ষার জন্যেও ব্যবহার করে। জ, সু, টি প্রভৃতিরা এ দিয়ে শেয়াল, ছোটখাটো বরাহ মেরে থাকে। ভারি বোঝা টানতে তাদের অসুবিধেও নেই, ভয়ও নেই!

(চ্যাপেল আর কুন বলেন, ওনা উপজাতিরা এখনও যখন শিবির পরিবর্তন করে, মেয়েরা একশো পাউন্ড পর্যন্ত বোঝা টেনে নিয়ে যায়। পূর্ব আফ্রিকার আকিক্যুস পুরুষরা ষাট পাউন্ডের বেশি বোঝা টানতে পারে না। তাদের মেয়েরা একশো পাউন্ডের বেশি বোঝা টানে।

মোটরগাড়ি আর জাহাজনির্মাণের সময় সবচেয়ে ভারি কলকব্জা টানতেন মেয়েরাই।)

মেয়েরা যে ছোটখাট পশু শিকার করে, তার জন্য যথেষ্ট কায়িক শ্রম প্রয়োজন হয়। গৃহকর্মের জন্যও। এমনিতে তাদের শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি। কেবল উপর্যুপরি সন্তানধারনের ফলে দুর্বল হয়ে যাওয়া মেয়েরা ভার বহন করে না। শিশুদের ছেড়ে তারা শিকারের খোঁজেও যেতে পারে না। অন্যথা শারীরিক শক্তি প্রয়োগ ও শ্রমমূলক কাজে নারীর অনীহা ছিল না। ইভলিন রিড বলছেন,

নারীর পিঠ থেকে মোটরগাড়ি এবং জাঁকালো জাহাজে যাওয়ার ইতিহাস হচ্ছে সব শিল্পের বড় শিল্প যা আমাদের প্রজাতিকে গোটা পৃথিবী অভিযানে পাঠিয়েছে। আমি বুঝতে পারি কেন জাহাজের ছুতার তার জাহাজের অগ্রভাগে নারীর মূর্তি খোদাই করত এবং কেন রেলগাড়িকে স্ত্রী সম্বোধন করা হয়।

শ্রম মেয়েদের পুরুষ শেখায়নি। শিখিয়েছিল মাকড়সা, দেখো এইভাবে বুনতে হয় জাল। শিখিয়েছিল কাদার পোকা। এইভাবে খাদ্য মজুত করে। শিখিয়েছিল উইপোকা। শ্রমের উদ্গাতা মাতা। রিডের মতে মেয়েরা তাদের প্রভূত শ্রম এত বিনয়ের সঙ্গে পেশ করে যে পুরুষের ইতিহাস তাকে কুটিরশিল্প বা হস্তশিল্প বলেছে শুধু। ক্রমে তারা ম্লান হয়ে গেছে যন্ত্রশিল্পের দানবিকতার কাছে।

মেয়ে শিখে নিল কৃষিকাজ।
মেয়ে পোষ মানাল পশুকে।
পুরুষও শিকার ছেড়ে তাই
ধীরে ধীরে কৃষিকাজ শেখে।

শুধু শিকার করে জীবন নির্বাহ হবে না, শিখে নিতে হবে কৃষি, নারীর হাত থেকে নিয়ে নিতে হবে কৃষির অধিকার— এই কথা যেদিন থেকে পুরুষ বুঝেছিল, সেদিন থেকে তৈরি হয়েছিল আধিপত্যের ইতিহাস। অবদমনের ইতিহাস। একটা সময় ছিল যখন প্রসাধনকে মনে করে হত রং মাখা। এও পুরুষের চোখে দেখা। রং মেখে পুরুষকে আকর্ষণ করে বেশ্যারা। তাই পুরুষ বধূ রূপে রংমাখা নারীকে নির্বাচন করত না। যে মুহূর্তে অর্থনীতি পুরুষের হাতে, সে মুহূর্তেই নির্বাচনের ভার তার হাতে। পুরুষ বিবাহ করে নারীকে ঘরে নিয়ে তোলে। তার বংশ চাই। তার চাই রাজত্ব বিস্তার। সে কৃষিজমি হোক বা শিল্প। পুরুষ মনোরঞ্জনের জন্য বেশ্যাবাড়ি যায়। অর্থাৎ বেশ্যার আকর্ষণকে সে অগ্রাহ্য করতেও পারে না। এই কথামুখ সামনে রেখে আজকের বিষয়ে আসি।

দশ কেন? পাঁচ বছর আগেও মিম কাকে বলে জানতাম না। কিন্ত তাতে কি কিছু আলাদা ছিল? যে মিমগুলি অনেকে দেখেছেন, অনেকে দেখেননি, সেগুলি ইচ্ছে হয়ে ছিল অনেকের মনের মাঝারে। এখন মিম হয়ে শতফুল বিকশিত হচ্ছে। সমাজ মেয়েদের যেভাবে দেখত, সেভাবেই দেখছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মিমওয়ালারা সেলিব্রিটি হচ্ছে। ঠিক যেমন করে টুম্পা গান ভাইরাল হয়।

মিম, ভাইরাল, ট্রোল… এই শব্দগুলি কতদিন হল শিখেছি আমরা? অর্কুটযুগে এরা ছিল না। ভার্চুয়াল এত শক্তিশালী গণমাধ্যম হয়নি তখনও। হঠাৎই ভাইরাসসম আবির্ভাব এই শব্দ এবং তার প্রয়োগের। অনেক সময়ই প্রধান লক্ষ্য রাজনৈতিক নেতা এবং মেয়েরা। কেন, এঁরা কি সফট টারগেট? অবশ্যই মেয়েরা সফট টার্গেট আর রাজনৈতিক নেতারা জানেন এইসব ট্রোল, মিম টিমে তাঁদের কিস্যু এসে যায় না।

তবে কি মেয়েদের এসে যায়? ক্রমাগত পিছনের দিকে চলেছি আমরা। গোটা সভ্যতার চেহারা দেখলে ভয় হয়। বেদনাতুর বসে থাকি নিজস্ব আঁধারঘরে। কিন্ত সে তো কোনও সমাধান নয়। আমরা সবাই জানি এই মিমগুলির বীজ প্রোথিত আছে সমাজের অন্তরে। পিতৃতন্ত্র যার ধারক, বাহক। মেয়েদের দুর্বল প্রতিপন্ন করা সহজ। এক হয় গ্যাসলাইটিং করে, না হয় তার দুর্বলতার পৃষ্ঠপোষক হয়ে। ফলে নারী শ্রম করেছে কিন্ত নিজেই তার শ্রমের মূল্য বোঝেনি। নিজে যদি নিজের শ্রমের মর্যাদা না বোঝা যায়, তাহলে অপরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

এই লেখায় একটিমাত্র রাজনীতি উঠে আসবে। লিঙ্গ রাজনীতি। সেটি সমাজ-রাজনীতি ও ক্ষমতার রাজনীতির অনেকটাই নির্ধারণ করে। হায়ারার্কির অদ্ভুত খেলা। যতদিন না সেই হায়ারার্কির নির্মম নিষ্ঠুর পদাধিকারবোধ মুছে ফেলে মানুষ কাজের নিরিখে নিজেদের দেখবে, ততদিন আরও অবনতি ঘটতেই থাকবে।

ঠিক যখন থেকে আমরা আপনারা দুপুর ঠাকুরপো বা দুপুর বৌদি নামক সিরিজগুলো বিজ্ঞাপিত হতে দেখেও না দেখার ভান করে স্ক্রোল করে গেছি ফোন, তখন থেকেই এই সেক্সি ননদ-বৌদি মিমের জন্ম। সে জন্ম-ইতিহাস আছে আরও অতীতে। যখন সাদা কালো স্কেচে বোরোলিনের বিজ্ঞাপনে আঁচল লুটানো বিভাজিকা প্রদর্শন করা গৃহবধূর ছবি প্রকাশিত হত পরিচিত পত্রিকার পাতায়। বিড়ি থেকে শুরু করে বাড়ি। সর্বত্র আওয়ার গ্লাস ফিগারের নারী। যার বর্ণ গৌর। চোখে লাস্য। যাদের একমাত্র কাজ প্রলুব্ধ করা। এই মিম কি নতুন কিছু নাকি?

সুচিত্রা সেন বা নার্গিসের স্টাইলে পাগল আমজনতা কোনওদিন কদর করেনি ভিন্ন মানের পর্দার ইমেজ। অনিতা কানোয়ার? কে? উত্তরা বাওকর? না। নাম শুনিনি। সুরেখা সিক্রি? না। জানি না। স্টাইল মানেই তো ছক। ছকে বাঁধা চুল। ত্বক। শরীর। হাসি। প্লাস্টিক সার্জারি করা ঠোঁট, নাক যোগ হয়েছে ইদানীং। আর কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই শরীর নিয়ে। পাউট করতে হয় সেলফি তুলতে গেলে। আড়াই বছরের শিশু পেলভিক টুইস্ট করে নাচে রিয়েলিটি শোতে। মুগ্ধ বাবা মা। খিলখিল হাসিতে সেলিব্রিটি। হাজার হাজার নেশাগ্রস্ত দর্শক।

প্রতিবাদী মিম তৈরি হয়ে যায় নিমেষে। তার বিশেষণ বড় কম ভয়ানক নয়। পিএনপিসি করা, কোনও কাজে না লাগা বৌদির কনসেপ্ট কি খুব দরকারি প্রতিপক্ষকে ডিফেন্ড করতে হলে? কিংবা টিকটক করা মামণির কনসেপ্ট? ঝিঙ্কু মামণি? মেয়েদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেওয়া কত সহজ এই কদর্য টার্মিনোলজি।

কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয় এই কদর্য মিম কালচারকে বর্ণনা করতে হলে। কোথায় লুকিয়ে ছিল এই কদর্য মানসিকতা? আজ ভার্চুয়াল স্পেস পেয়ে উথলে উঠেছে। কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি কোনও পক্ষপাত না রেখে এটুকু বলতেই হবে যে একজনকে আদরের মেয়ে বানানোর জন্য আইবুড়ো ননদের বাইনারি তৈরি করা অতীব কুশিক্ষা। তাতে আদরের মেয়েটির যেমন সম্মান বৃদ্ধি হয় না, তেমন আইবুড়ো শব্দটার বিশ্রী কনোটেশন ঘাড়ে চাপিয়ে সমস্ত ননদকুলকে অপমানিত করার স্পর্ধা, বিশেষ করে অবিবাহিত থাকার স্টেটকে সফট টার্গেট বানিয়ে ফেলা কী পরিমাণ রুচিহীনতার পরিচয়, তার কোনও পরিমাপ নেই।

অথচ এইসব মিম আসলে আমাদের আশেপাশেই ঘাপটি মেরে থাকে। এই হল হায়ারার্কির খেলা। আইবুড়োভাতের সচিত্র বিজ্ঞাপন ফেবুতে। আল্টিমেটলি আইবুড়ো শব্দটা একটা অবমাননার ইঙ্গিত বহন করে আনে। এটা তো নতুন কিছু না। চলচ্চিত্রে, শিল্পে, নাটকে, সাহিত্যে বাঙালি চিরকাল এই শব্দকে অপমান করে এসেছে। চোখে লাগছে যখন সঙ্গে যোগ হচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের ছবি। ছবির ক্ষমতা অনেক বেশি। দিনের পর দিন আমাদের সামনে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে নেশার বটিকা। টিভি সিরিয়াল। তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ওয়েব সিরিজ। এই সমস্ত সিরিয়াল বাইনারির ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। ‘প্রাক্তন’ ছবির সাফল্য এই সমস্ত মিমের সঙ্গে যুক্ত নয় কী? ভাতকাপড়। সিঁদুর। শাখাপলা। সংস্কার। এই কটি বস্তুর ওপর ভর করে সব সিরিয়াল চলছে। তার সঙ্গে আছে পারিবারিক পুজোঘর। যেখানে সবাই একসঙ্গে বসে গান গায়। লিড করেন সুকল্যাণী বধূ। মানে যিনি কদাপি চাকরি করেন না। বা করলেও মাল্টি টাস্কিং-এর পরাকাষ্ঠা দেখাতে সক্ষম। কুচুটে, ভিলেন বৌদি বা ননদ। সিরিয়ালের মশলা। এইসব দিনের পর দিন দেখেও সামান্য মিম নিয়ে মাতামাতি!

এবার আসি কাজের মাসির কথায়।

আগে বলা হত ঝি। সবসময় ঝি শব্দের অর্থ ছিল মেয়ে। মায়ে ঝিয়ে মিলে তখন সংসার গোছানোর দিন।

ক্রমে ঝি শব্দের কনোটেশন পাল্টে গেল। গৃহসেবিকা মাত্রেই ঝি অর্থাৎ বাড়িতে তাঁর কন্যার সম্মানটুকু পাওয়ার কথা। শ্রম বিভাজনের চক্করেই সে সম্মান গেল। কাজেই মেয়ে আর ঝি নয়। ঝি হল সে, যে পাঁচ বাড়ি কাজ করে পেট চালায়। নিজের এবং ছেলেপুলের। কালান্তরে ঝি হলেন কাজের মাসি।

মাসি শব্দটা বেশ্যালয়ে পপুলার। ব্রথেলকিপার যিনি তিনিই মাসি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি বলে বেশ্যালয়ের মধ্যবয়স্কা কর্ত্রী মাসি হয়ে মেয়েদের দেখভাল করতেন। দরদাম কষতেন। এখন তাঁরা ম্যাডাম। কিন্তু বাজারে আপনাকে মাসি বলে ডাকলে আপনি রেগে যান। মাসি একটা ডেরোগেটরি টার্ম। মায়ের বোন নয়। এমন কেউ যিনি অবজেক্টিফায়েড একজন আকর্ষণহীন মধ্যবয়সিনী হিসেবে।

এবার কাজের মাসি। কাজের দিদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাসি। দুটি অল্পবয়সী মেয়ে, যারা রাজনৈতিক জগতে পা রেখেছে, পর্যাপ্ত শিক্ষিত, তাদের সম্ভাষণ করা হল কাজের মাসি বলে। এতে যারা মিম করলেন তাঁদের রুচি বুদ্ধি তো বোঝা গেল বটেই, যারা গেল গেল করে উঠলেন তারাও খুব কিছু সুবিধে করতে পারলেন না।

আসলে শ্রম সম্পর্কে আমাদের বোধ বড় সীমিত। কূপমণ্ডুক প্রায়।

তাই বামপন্থীদের মিমে অফিসের কাজ করে এসে ঘর সামলানো দুর্গা দেখতে হলে হতাশ হতে হয় বৈকি।

কাজের মহিলারা সেই শ্রমজীবী নারী যাঁরা অন্তঃসত্তা অবস্থাতেও কাজ করে যান। চার বাড়ি। পাঁচ বাড়ি। তারপর সন্তান জন্ম দিয়ে টুক করে আবার কাজে ফিরে আসেন। এঁদের ঋতুকালীন ছুটি নেই। কোনও অসুবিধে বোঝাও যায় না। প্রবল বেগে হেঁটে যান এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে। রান কল্যাণী রান ছবিটি দেখবেন। স্যর, ইজ লাভ ইনাফ দেখা যেতে পারে। এঁদের অধিকাংশের বর এক হয় ছেড়ে গেছে, নয় মৃত, নিখোঁজ। নতুবা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিবাহ করে সংসার পেতেছে। তবু এরা সিঁদুরটি পরেন সেফটি মেজার হিসেবে। নিজের ডাঁটে চলেন। কারণ ভারতবর্ষে কাজ গেলে কাজ আছে বটে, গৃহশ্রমের ক্ষেত্রে। এঁদের একটা কমিউনিটি ফিলিং আছে। পরস্পরের পাশে দাঁড়ান। এ ওকে কাজ খুঁজে দেন। একসঙ্গে তীর্থে যান। সিনেমাও দেখেন। বেশ নিজের মতে, নিজের ঠাঁটেও চলেন অনেকেই।

মোটের ওপর শ্রমসূত্র সম্পর্কিত বোধ যেমন অস্পষ্ট তেমনি অবমাননার ছাপ সম্পর্কের গোড়াতে। এর নিশ্চিত সামাজিক কারণ আছে। জ্যেঠু, কাকু, পিসি, মাসি শব্দগুলো আর আদরের নেই। পুরুষ অবিবাহিত হলে তবু কিছু ছাড় পান, কিন্ত মেয়েদের সেই ছাড় নেই। অবিবাহিত মেয়ে মানেই খিটখিটে ফ্রাসট্রেটেড পিসি বা মাসি, এই কনসেপ্ট নিয়ে বাঙালি আঁতলামি জাহির করছে। এর অধিক কুয়োর ব্যাঙপনা আর কীই বা হতে পারে! যেটা বলার কথা মিমের পাল্টা মিম, ট্রোলের পাল্টা ট্রোল, টুম্পার পাল্টা টুম্পা দিয়ে আর কতকাল চলবে? মুখে দশ কেজি ময়দা মাখেন বলে ট্রোল করছেন যাঁদের, তাঁদের দেখতে তো দশ মাইল দৌড়ে যান আপনারাই। আপনারা আমরাই প্রোমোট করি চিকণ ত্বক। ফর্সা রং। সুন্দর ফিগার। টানা ভ্রূ। অন্যথা হলে সে আদার। অন্য কেউ। আমরা গৃহশ্রমের মর্যাদাও বুঝি না, রাজনীতির ময়দানের শ্রমও বুঝি না। কারণ সামনে অনেক পর্দা। হায়ারার্কি যা ঝুলিয়ে রেখেছে। যুগ যুগ ধরে। এও এক অদৃশ্য পর্দাপ্রথা। মিম দেখে হতবাক হওয়ার কিছু নেই। সবই গোকুলে বাড়ে। আমরাই লালন করেছি।