পার্থজিৎ চন্দ
চারমাথার মোড়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল আলেকজান্ডার।
উদ্দেশ্যবিহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকাই কাজ তার, সকাল থেকে দুপুর-বিকেল-সন্ধে পর্যন্ত ঘুরেফিরে এই জায়গাটিতে আসে সে। সারাদিন সাম্রাজ্য চোখে চোখে রাখতে হয়, তার ফাঁকে মা শীতলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই অবসর তার।
এ সাম্রাজ্য তার, কিন্তু সে প্রজাবৎসল। তার চারপাশ দিয়ে হেঁটে যায় প্রজার দল। তাকিয়ে থাকে আলেকজান্ডার, মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তাদের। গাড়ির কালো কাচ নামানো থাকে সকালের দিকে অনেকের। দাড়ি কামানো ফর্সা ছেলেদের গালে এক নীল আভা, দেখলেই বোঝা যায় জিম করা শরীর। গন্ধ নাকে না-এলেও আলেকজান্ডার বোঝে দামি কোলন মেখেছে ওরা। এ সব দেখে মনে হয় তার সাম্রাজ্যে পুরুষেরা বেশ সুখেই আছে।
তার পাশ দিয়ে টাইট জিন্স, টপ, লেগিংস পরে হেঁটে যায় মেয়েদের দল। দিন দিন মেয়েরা বেশ প্লাম্প হয়ে উঠছে, তাদের শরীরে গমখেতের আভাস। এর মানে তার সাম্রাজ্যে মেয়েরাও বেশ সুখেই আছে।
শীতলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে নজরানা হিসাবে কাঁচাগোল্লা আর খাস্তা কচুরি না পেলে কিছু মনে করে না আলেকজান্ডার। কারণ প্রজারা মাঝেমধ্যে ভুল করতে পারে, সম্রাটকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। সে সোজা হাত ঢুকিয়ে দেয় প্লাস্টিকের ড্রামে। শালপাতায় মাঝে মাঝে মোড়া থাকে আধ-খাওয়া মিষ্টি। সেই রাজাই তো শ্রেষ্ঠ রাজা যে প্রজাদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসে ভোজন করতে পারে, এমন একটা কথা এক সময় শুনেছিল সে। প্রজারা তার সন্তান, সন্তানের এঁটো খেতে বাবার সঙ্কোচ করা উচিত নয়। অনুচিত কাজ একদম করে না আলেকজান্ডার।
রোজ বিকেলবেলায় নাম না-জানা এক লোক, লোকটাকে প্রায় চল্লিশ বছর দেখছে আলেকজান্ডার, একটা বিড়ি ধরিয়ে দেয় তার হাতে। এই দেওয়ার মধ্যে একটা শ্রদ্ধামিশ্রিত ভাব আছে। আলেকজান্ডারকে যে প্রজারা ভক্তিশ্রদ্ধা করে সে নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার।
পাড়ার বেশ কিছু ছেলে তার সামনে এসে বাইক থামায় মাঝে মাঝে। তার দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকায়, দশটাকার নোট ধরিয়ে দেয় হাতে। এই নোট ধরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সেই শ্রদ্ধামিশ্রিত ভাবটা থাকে না। আলেকজান্ডার বুঝতে পারে ছেলেগুলো তাকে নিয়ে বেশ হাসাহাসি করবে একটু পর। কিন্তু ছেলেগুলো বিশ্বাস করে বড় কোনও কাজে যাওয়ার আগে আলেকজান্ডারের মুখ দেখে গেলে কাজ সফল হয়।
আলেকজান্ডার টাকা নেয়, কারণ প্রজাদের একবার নজরানা দেবার অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেলে মুশকিল। সেটা গড়ে উঠতে বেশ সময় লাগে। কিন্তু সে মনে মনে একদম বরদাস্ত করে না ছেলেগুলোকে। এরা তার সাম্রাজ্যের বেশ দুষ্টূ-লোক হতে যাচ্ছে। এরা মানুষকে চমকাবে ধমকাবে, এমনকি খুনও করতে পারে।
কিন্তু তবু আলেকজান্ডার এখনও চুপ করে আছে, কতদূর বাড়তে পারে ওরা দেখতে চায় সে। খুব বেশি বাড়লে ডানা ছেঁটে দেওয়া যাবে সময়মতো।
ডানা-ছাঁটার কথা ভাবতেই উলটো দিকের পার্ল ম্যানসনের কথা মনে পড়ে যায় আলেকজান্ডারের। সেকেন্ড ফ্লোরের সামনের দিকে ফ্ল্যাটটির বারান্দায় একটি খাঁচার মধ্যে বসে থাকে টিয়া। সেটিরও ডানা-কাটা।
পার্ল ম্যানসন থেকে বারান্দায় বসে থাকা ডানা-কাটা টিয়া— এ সবই আলেকজান্ডারের সম্পত্তি। সম্রাটের সম্পত্তি কীভাবে বাড়ে তার একটা সরল ও সহজ অঙ্ক আছে। এ ক্ষেত্রে জলে জল বাড়ে কথাটার কোনও বিকল্প নেই। আলেকজান্ডারের অগাধ সম্পত্তির সঙ্গে প্রতিবছর যুক্ত হয়ে যায় আরও অগাধ সম্পত্তির ভার। মাঝে মাঝে এই ভার অসহ্য লাগে তার। কিন্তু কিছু করার নেই… তার অজান্তেই অনেক সময়ে সম্পত্তি বেড়ে যায়। যুক্ত হয়ে যায় মূলের সঙ্গে। যেমন কয়েক বছর আগেও তার সম্পত্তির হিসাবে এই ছায়ার কথা ধরা ছিল না।
তার সাম্রাজ্যের বেশ কয়েকজন ছায়ার কথা জানে আলেকজান্ডার, তারা সবাই কম কথা বলে ও উদাস।
কিন্তু কয়েক বছর আগে আসা এই ছায়া বেশ অন্যরকম, ব্লেডের দক্ষতায় সে কাটাকুটি খেলে রাস্তার উপর। ঘন্টায় ঘন্টায় বদলে যায় তার দিক ও বিস্তার। ফ্লাইওভারের ছায়াকে অনুসরণ করে আলেকজান্ডার। কংক্রিটের গন্ধ লেগে থাকে ছায়ায়। বিশেষ করে গরমকালে সে গন্ধ পাওয়া যায় বেশি।
আসলে রোদে তার কষ্ট হচ্ছে দেখে প্রজারা এই অতিকায় চাঁদোয়া তৈরি করে দিয়েছে। আলেকজান্ডারও তাদের অনুমতি দিয়েছে ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি চালিয়ে হুস করে চলে যাবার। কিন্তু মাঝে মাঝে বেশ দ্বন্দ্বে পড়ে যায় সে। তার রাজ্যে প্রজারা রাজভক্তির নিদর্শন রেখেছে ও সুখে-শান্তিতে আছে। রাজভক্তির কারণে সুখ, নাকি সুখের কারণেই রাজভক্তি তা এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি সে।
২
পুরুকে এখনও বিগ থ্রেট হিসাবে গণ্য করে না আলেকজান্ডার। পুরুকে দূর থেকে একটু চোখে চোখে রাখে সে। প্রতিদিন একটা দুটো করে লোক পুরুর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, খবর পায়। শহরের অটোওয়ালা আর চায়ের দোকানদারেরা বিশ্বস্ত গুপ্তচর। অটোতে ওঠে না আলেকজান্ডার। মাঝে মাঝে অটোস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের কথা শোনে। তাদের মুখে উঠে আসছে পুরুর কথা আজকাল।
কিন্তু তাকে বিগ থ্রেট হিসাবে গণ্য করছে না আলেকজান্ডার, এখনও। যদিও প্রতিদিন পুরুর সম্পর্কে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছিল সে। পুরুর কাজ-কারবারের মধ্যে একটা ইঁদুর ইঁদুর ভাব আছে। বিগ থ্রেট কখনও ইঁদুরের মতো হয় না, আলেকজান্ডারের বাপ-ঠাকুরদা এমনই বলত।
মানু-গুন্ডার সঙ্গে আলেকজান্ডারের বাবার খুন-খারাবির সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেটা প্রকাশ্য ছিল। বাবুডাঙার মাঠে দুজনের মোলাকাত হত। হেভি ঝাড়পিট হত, দিনের দিন ফয়সলা। কেউ হারত কেউ জিতত।
পুরুর কাজ-কারবার বেশ গোলমেলে, তার নিজস্ব স্ট্র্যাটেজিস্ট আছে। শোনা কথা, পুরু নাকি তার অ্যকশনের প্ল্যান অনেক আগে থেকে তৈরি করে রাখে। আর এটা শোনা মাত্র আলেকজান্ডারের মনে হয় পুরু একটা ইঁদুর। ঠিক সময়ে পুরুর ডানা ছেঁটে দেওয়া যাবে, যদিও কথাটা ভেবে একটু থমকে যায় সে। কারণ ইঁদুরের ডানা থাকে না।
পুরুর জগত নিয়ে একদিন সেলুকাসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তার। সেলুকাস একটা ছোট্ট-পাড়ার জমিদার গোছের মানুষ, ধারেভারে সে আলেজান্ডারের একশো মাইলের মধ্যেও আসে না।
সন্ধের আলো জ্বলে উঠছে ফ্লাইওভারের উপর। প্রজারা সারাদিনের শেষে বাড়ি ফিরছে। এই প্রজাদের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত প্রসন্নতায় ডুবে যায় আলেকজান্ডার,
–পুরুর সঙ্গে কত লোক আছে, সেলুকাস?
–প্রকাশ্যে যত মনে হয় তার থেকে ঢের বেশি লোক ওর দিকে…
–পুরুর দিকে দিনের পর দিন এত লোক ঢলে পড়বার কারণ কী?
–ভয়… মানে পুরুকে ভয় করার কিছুই নেই, কিন্তু তবু লোকে ওকে ভয় করে। এখানেই ওর সব থেকে বড় কায়দা।
–তা পুরু যখন শহরের বাইরের দিকে একটু একটু করে ঘাটি গেঁড়ে বসছিল তখন কি তোমরা ভাঙ খেয়ে বসে ছিলে?
–মাইরি বলছি, টের পর্যন্ত পাইনি আলেকজান্ডার। গাছের গোড়ায় যেমন উইপোকার ঢিবি কখন তৈরি হয় বোঝা যায় না এই কেসটা তেমনই।
–ঢিবি ভাঙার জন্য তোমাদের হাতে লোক নেই! আমাকে কি এই বয়সে এই সব ছুঁচো মারার কাজে হাত লাগাতে হবে?
–আছে, কিন্তু পুরু ইতিমধ্যে হাটেবাজারে রটিয়ে দিয়েছে উইঢিবির মধ্যে বিষধর সাপ থাকে… হাত ঢোকালেই মৃত্যু।
–আমাদের সাপুড়ে ব্রিগেডের লোকজন কি হাওয়া হয়ে গেছে?
–হাওয়াই হয়ে গেছে… প্রতিদিন এক-দুজন করে সাপুড়ে স্রেফ উবে গেছে। তারা যে কোথায় কেউ জানে না… শোনা কথা, পুরুই তাদের সাবাড় করে দিয়েছে।
প্রজাদের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ হয়ে যায় আলেকজান্ডার, পুরুর সঙ্গে তার দ্রুত একবার কথা বলা দরকার। মানে পুরুর বাড়বাড়ন্ত যে হারে বেড়েছে তাতে তার ডানা-ছাঁটা জরুরি, কিন্তু ডানা-ছাঁটার আগে পুরুকে আরও একবার ক্ষমা করে দিতে চায় সে।
গদিমোড়া এক বিরাট চেয়ারে বসে আছে পুরু। চেহারার মধ্যে সেই ইঁদুর ইঁদুর ছাপ। পুরুর নামে এদিকের রাস্তা-ঘাট হয়ে গেছে, আসতে আসতে লক্ষ করেছে আলেকজান্ডার। তলে তলে পুরু বেশ বেড়েছে। আলেজান্ডারের ফুলহাতা শার্টের একটা হাতা পতপত করে দুলছে।
কুরুক্ষেত্রের ধাঁচে এই অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে পুরুক্ষেত্র।
সোজাসুজি কথা শুরু করাই পছন্দ করে আলেকজান্ডার,
–তুমি আমার থেকে কেমন ব্যবহার আশা করো?
পুরু মোবাইল থেকে চোখ তুলে চায়, ‘তুমি আমার থেকে কেমন ব্যবহার আশা করো?’, পুরু পালটা প্রশ্ন করে।
–তুমি কেমন ব্যবহার করবে সেটা তোমার ব্যাপার, কিন্তু আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিতে এসেছি। কারণ সহনশীলতা ও ক্ষমা পরম ধর্ম…
‘পাইন মেরেছে তোর ক্ষমার…,’ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে পুরু। হাতের মোবাইলটাকে ছুড়ে ফেলে দেয়, তুইতোকারিতে চলে গেছে পুরু, ‘শোন, আমাদের ইতিহাসে ভুল পড়ানো হয়েছে এতদিন… পুরুকে আলেকজান্ডারের সামনে দড়ি বেঁধে কেউ আনতে পারেনি। সত্যিটা হল, আলেকজান্ডারকে ঘাড় ধরে পুরুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুরুর পাঞ্জা ছিল বিশাল, আলেকজান্ডারের থোবড়া বিলা করে দিয়েছিল সে…,’ রাগে গরগর করছিল পুরু।
এই মুহূর্তে চোখে চোখ রেখে কথা বলা দরকার, পালটা প্রশ্ন করা দরকার।
–সে বুঝলাম, কিন্তু তারপর তো পুরুর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না… এত বড় একজন রাজাকে হারালে তো তার ইতিহাসে থেকে যাওয়ার কথা…
–কেন! তোর সামনে যে বসে আছে সে কি তোর মায়ের প্রেমিক? আমিই সেই পুরুর অংশ…
৩
পুরুর দরবারে বসে আলেকজান্ডারের বিচার সম্পন্ন হচ্ছিল।
পুরুর দরবারে সব বিচারই ব্ল্যাসফেমি অ্যক্ট মোতাবেক হয়ে থাকে। অপরাধের মাত্রা অনুসারে অঙ্গ কেটে নেওয়ার বিধি রয়েছে। বিচারে আলেকজান্ডারের একটি হাত কেটে নেবার সুপারিশ করা হয়েছে।
আলেকজান্ডারের ফুলহাতা শার্টের বামহাতাটি পতপত করে উড়ছে। হাতার ভেতর হাত নেই, বহুদিন আগে মানু-গুন্ডার হাত থেকে বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে চপারের কোপ খেয়েছিল সে।
রায় ঘোষণার পর একবার আলেকজান্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখল পুরু। লোকটার বাম হাত বগলের কাছে থেকে প্রায় চেঁচে কেটে নিয়েছে কেউ। পতপত করে শার্টের হাতাটা হাওয়ায় উড়ছে।
হাতকাটা আলেকজান্ডারের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে পেল পুরু। দিনের পর দিন সে দেখেছে কীভাবে তাকে একটি মিথের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে; কিন্তু এই বেঁচে থাকাটা বেশ অশ্লীল ও ঘৃণ্য। একজন হেরো রাজা জিতে যাওয়া রাজার কাছে থেকে রাজার-সমান সম্মান দাবি করছে! দিনের পর দিন আলেকজান্ডারের ক্ষমার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়েছে তাকে।
অথচ বিষয়টি এমন ছিল না মোটেই। যুদ্ধে আলেকজান্ডারই হেরে যায়, পুরু তার অণ্ডকোষের কাছে একটা লাথি মেরে রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। অক্ষরে অক্ষরে আলেকজান্ডার সেই নির্দেশ মান্য করে। কিন্তু তারপর এই ভারতীয় রাজার গৌরবকে ফিকে করে দিয়ে গ্রিক মিথ তৈরি করা হয়।
মিথ ছাড়া কাহিনি বেশি দূর হেঁটে যেতে পারে না, আজ সুবর্ণ সুযোগ সেই মিথটিকে ভেঙে দিয়ে পালটা এক মিথ তৈরি করার।
পুরু আলেকজান্ডারের কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমায় শাস্তি দেব এবং তোমার বামহাত কেটে নেব…,’ পুরুর দরবারে সাইলেন্স। কিছুক্ষণ পর পুরু নিজেই সেই সাইলেন্স ভাঙে।
–আমি তোমার কাটা-হাত আরেকবার কেটে নেব… মানে তোমার ডানহাত কাটতে পারতাম, কিন্তু আমি তোমার বামহাতই কাটব…
পুরুর মাথার চারদিকে এক জ্যোতির্বলয় দেখা দিচ্ছে, আলেকজান্ডার মুখ তুলে চায়। তারও কিছু একটা বলার আছে,
–আমার কাছে বামহাতও যা ডানহাতও তাই… আমার বামহাত না-থেকেও আছে… কেউ বুঝতে পারে না… শুধু আমি বুঝতে পারি যে আমার বামহাত আছে…
–হেঁয়ালি ভাল লাগে না… খুলে বলো…
–মানু-গুন্ডার চপারের কোপে আমার হাতে গ্যাংগ্রিন হয়েছিল, কেটে বাদ দিতে হয়। কিন্তু কিছুদিন পর বুঝতে পারি আমার বামহাত কেটে বাদ দেওয়া হলেও সেটা রয়ে গেছে… প্রথম যেদিন বুঝতে পারি সেটা বেশ অদ্ভুত। আমার মা তখনও বেঁচে, একদিন রাত্রে হাতকাটা ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ মায়ের হাত আমার মুখের উপর পড়েছিল, আর আমার মনে হয়েছিল মা আমার বামহাতের বুড়ো-আঙুল ধরে রথের মেলায় নিয়ে যাচ্ছে… মায়ের ওই আঙুল ধরাটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম…
–ডাক্তার কী বলছে?
–ডাক্তার বলেছে, আমার হাত কাটা গেলেও হাতের কী যেন নার্ভ ঠিকঠাক রয়ে গেছে… আর ওই কারণেই আমার কাছে বামহাতটা এখনও আছে… মানে না-থেকেও আছে।
–কিন্তু সেটা হলেও আমি তোমার ডানহাত কাটব না; কারণ ডানহাত কেটে নেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তোমার কাটা-বামহাত আরেকবার কেটে নিয়ে আমি তোমাকে চিরদিনের মতো পরাজিত করে রেখে দেব…
–আমার বামহাত আর ডানহাতের অনুভূতি একই, মানে একবার অদৃশ্য বামহাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা লেগেছিল… পাক্কা তিনদিন আমার জ্বালা কমেনি…
–তবু আমি তোমার বামহাত কেটে নেব…
মজা-খালের ধারে একটা মাচার উপর আলেকজান্ডারের বামহাত রাখা হয়েছিল। বামহাত মানে ফুলহাতা শার্টের একটা হাতা। ভুরু-কাটা একটা লোকের হাতে ঝকঝক করে উঠেছিল ছুরি… অদৃশ্য বামহাতের কনুইয়ের একটু নীচে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই ছুরি।
এক বিন্দু রক্তপাত হয়নি, তবু চিৎকার করে উঠেছিল আলেকজান্ডার। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
জ্ঞান ফিরলে ডানহাত দিয়ে অদৃশ্য বামহাতের কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে সেই চারমাথার মোড় আর ওভারব্রিজের কাছে ফিরে এসেছিল আলেকজান্ডার।
চারমাথার মোড়ে চারদিক থেকে এত রাত্তিরেও ছুটে আসছে টোটো। ঘোষকের গলা ধরে গেছে মাইকিং করতে করতে, ‘পুরু আজ আলেকজান্ডারের ডানহাত থাকা সত্ত্বেও কাটা বাম-হাত কেটে প্রতীকী শাস্তি দিয়ে বিরল নজির গড়েছেন… পাঠ্যপুস্তকের বিশেষ অংশে এবার থেকে ‘আলেকজান্ডারের’ বদলে ‘পুরু’ পড়তে ও পড়াতে হবে…’
পার্ল ম্যানসনের ঘোলাটে কাচের জানলাগুলিতে রহস্যময় আলো খেলা করে সারারাত। সেকেন্ড ফ্লোরের বারান্দায় খাঁচার ভিতরে নিশ্চয় এত রাতে ডানা-ছাঁটা টিয়াপাখিটা ঝিমোচ্ছে।
কার কার ডানা সঠিক সময়ে ছেঁটে ফেলবার কথা ভেবেছিল মনে করার চেষ্টা করল আলেকজান্ডার। কয়েকটি অস্পষ্ট মুখ, কিন্তু তাদের ডানা ছাঁটা এখন আর সম্ভব নয় তার পক্ষে।
কারণ পুরু প্রথম সুযোগেই তার কাটা-বামহাত আরেকবার কেটে নিয়েছে।
আর সে কারণেই মাঝরাতে অজগরের মতো ওভারব্রিজ জটিল ধাঁধার মতো চারমাথার মোড় ছেড়ে, তার সাম্রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করল হাতকাটা আলেকজান্ডার।
ঘোস্ট লিম্ব সংক্রান্ত ঋণ: দ্য এমার্জিং মাইন্ড/ ভি রামচন্দ্রন