Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সিন্ধুর টিপ ও একটি অশ্বত্থগাছ

শিবাংশু দে

 

….এই সে লঙ্কা, হৈমবতী পুরী,
শোভে তব বক্ষস্থলে, হে নীলাম্বুস্বামি,
কৌস্তুভরতন যথা মাধবউরসে…

(মেঘনাদবধ কাব্য)

আজকের ইতিহাসে রাবণ বা তাঁর স্বর্ণলঙ্কার কোনও উল্লেখ নেই। রাবণ বা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী অযোধ্যার রাজপুত্র বেঁচে আছেন শুধু কিংবদন্তি, কবিকল্পনায় আর কিছু শিকড়হীন স্বার্থান্বেষীর গুপ্ত ষড়যন্ত্রে। কিন্তু তাই বলে হৈমবতী লঙ্কার দীর্ঘ গৌরবগাথা ম্লান হয়ে যায় না। তার ইতিহাস শুরু হয় একজন ভাগ্যান্বেষী রাজপুত্রের অভিযানের গল্প দিয়ে। আমাদের বাঙালি কবি লিখেছিলেন,

ওই    শৈশব তার রাক্ষস আর যক্ষের বশ, হায়,
আর    যৌবন তার ‘সিংহের’ বশ, সিংহের নাম যায়
এই    বঙ্গের বীজ ন্যগ্রোধ প্রায় প্রান্তর তার ছায়
আজো    বঙ্গের বীর ‘সিংহের’ নাম অন্তর তার গায়।

(সিংহল— সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

***

 

বৌদ্ধ ইতিহাসের দুটি আদি আকর গ্রন্থের নাম মহাবংশ আর দ্বীপবংশ। বস্তুত এগুলি ইতিহাস নয়, কিংবদন্তি বা লোককথামাত্র। কিন্তু মূল ভারতভূখণ্ড থেকে যখন বৌদ্ধ ঐতিহ্য একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল তখন ইওরোপীয় পণ্ডিতেরা ভারতীয় ইতিহাসে বৌদ্ধ অধ্যায়টি উদ্ধার করার জন্য লঙ্কাদেশ থেকে আহৃত ঐ দুটি গ্রন্থের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করেছিলেন। তাঁরা জানতেন, গ্রন্থ দুটি ভারতীয় পুরাণের মতো কাল্পনিক কিংবদন্তির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু সমস্ত অলঙ্কৃত কল্পনার আড়ালে কোথাও কোথাও সতর্ক হলে তথ্যের কঙ্কালও আবিষ্কার করা যায়। যদিও জেমস প্রিন্সেপ ও আলেকজান্ডার কানিংহাম সাহেব মূলত নির্ভর করতেন বিভিন্ন শিলালিপির প্রামাণ্য দলিলে। কিন্তু বহুযুগ ধরে স্বীকৃত লঙ্কাদ্বীপের এই আকর গ্রন্থগুলিকেও একেবারে অস্বীকার করা যেত না। কারণ লঙ্কাদ্বীপেই বৌদ্ধধর্ম ও ঐতিহ্যের দীর্ঘতম ও অবিরাম অনুপালন করা হয়েছিল। এই সব সূত্র থেকে তথ্যসম্মত প্রমাণ খুঁজতে গেলে থেরবাদী সিংহলি বৌদ্ধযান ও তিব্বত-নেপালভিত্তিক মহাযানী বৌদ্ধঐতিহ্য, দুটিই গবেষকদের কাছে প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে।

***

 

সিংহলের ইতিহাস খুঁজতে গেলে মহাবংশ ও দ্বীপবংশ-র সাহায্য নেওয়া এখনও জরুরি। মহাবংশ অনুযায়ী সিংহলের ইতিহাস শুরু হয় বিজয় সিংহের সিংহল আগমনের সময় থেকে। ভারতের মূল ভূখণ্ডে মহাকাব্যভিত্তিক যে লঙ্কাসন্ধান দেখতে পাওয়া যায়, তার কোনও রকম ঐতিহাসিক প্রামাণ্যতা নেই। তাই রাবণ বা রাম-সীতার উপাখ্যানের কেন্দ্র হিসেবে লঙ্কাকে নির্বিবাদে গ্রহণ করাটা ইতিহাসসম্মত হবে না। অবশ্য সেভাবে ভাবতে গেলে মহাবংশের উপাখ্যানটিও নিতান্তভাবে গল্পকথা। যার সঙ্গে কিংবদন্তি, লোককথা আর কবির মনের মাধুরী ওতপ্রোত মিশে আছে, সেখানে একটি কাহিনি পাওয়া যায়। একদা বঙ্গদেশের রাজার মহীষী, যিনি জন্মসূত্রে ছিলেন কলিঙ্গের রাজকন্যা, এক কন্যার জন্ম দেন। নবজাতিকা পরম রূপসী কন্যাটি সম্বন্ধে রাজজ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তিনি একদিন সিংহের ভার্যা হবেন। কন্যা ছিলেন অত্যন্ত প্রগলভ এবং স্বাধীনচেতা। রাজবাড়ির বন্ধন ত্যাগ করে তিনি স্বেচ্ছামতে জীবনযাপন করা শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে এক পশুরাজ সিংহের প্রণয়সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। এর সূত্রে তাঁর দুটি যমজ সন্তান জন্মলাভ করে। একটি পুত্র, নাম সিহবাহু (সিংহবাহু)। যাঁর বাহুদুটি ছিল সিংহের মতো প্রখর ও নখরযুক্ত। অপর সন্তানটি কন্যা, নাম সিহসিবলী (সিংহসিবলী)। সন্তানদ্বয় বড় হলে তারা মাকে নিয়ে পিতার অরণ্য আবাস ছেড়ে লোকালয়ে ফিরে আসেন। বঙ্গদেশের তৎকালীন রাজসেনাপতি সিংহমহীষী, দেশত্যাগিনী রাজকন্যাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। সম্পর্কে এই রাজকন্যা সেনাপতির খুড়তুতো ভগ্নী ছিলেন। এই খবর পাওয়ার পর ক্রুদ্ধ পশুরাজ সিংহ বঙ্গদেশ আক্রমণ করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেন। পর্যুদস্ত রাজ্যবাসীদের অনুরোধে সিহবাহু সেই পশুরাজকে (তাঁর জন্মদাতা পিতা) নিধন করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। কৃতজ্ঞ প্রজারা সিহবাহুকে রাজা হিসেবে বরণ করেন। কিন্তু সিহবাহু তাঁর মাতার ‘স্বামী’কে রাজ্যের অধিকার দিয়ে নিজে তাঁর  জন্মস্থান অরণ্যপ্রদেশে ফিরে যান। অরণ্যপ্রদেশটি ছিলো লাঢ়প্রদেশে (রাঢ়)। সেখানে সিহবাহু সিংহপুর (সিঙ্গুর) নামে তাঁর রাজ্য স্থাপনা করলেন। তারপর সিহবাহু, ভগ্নী সিহসিবলীকে বিবাহ করে ষোলোবার যমজ সন্তানের জন্ম দেন। বত্রিশটি সন্তানদের মধ্যে বিজয় সিংহ ছিলেন জ্যেষ্ঠতম। তাঁর স্বভাব ছিল একান্তভাবে রূঢ় ও অনুশাসনহীন। বিজয় সিংহ ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রজারা রাজার কাছে দরবার করেন। রাজা সিহবাহু, বিজয় ও তাঁর সাতশো অনুচরের কেশ অর্ধমুণ্ডিত করে তাঁদের সপরিবারে সমুদ্রযাত্রায় নির্বাসন দেন। বহু ঘাট ঘুরে বিজয় সিংহ সদলে যেদিন সিংহলের উত্তর-পশ্চিম তটে তাম্বপন্নি (তাম্রপর্ণী) বন্দরে  এসে নোঙর করেন সেদিন সুদূর কুশীনগরের আম্রকাননে দুটি শালবৃক্ষের মাঝখানে শায়িত হয়ে তথাগত বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। সেই উপলক্ষ্যে সমবেত দেবতাদের উদ্দেশ্য করে তথাগত বললেন, আজ রাঢ়দেশের বিজয়সিংহ সাতশো অনুচরসহ লঙ্কাদ্বীপে অবতরণ করেছেন। আপনারা তাঁকে সাহায্য করবেন, কারণ তিনিই সেখানে ভবিষ্যতে সদ্ধর্মের প্রচার করবেন।

***

 

বিজয়সিংহ নামে আদৌ কেউ ছিলেন কি না তার কোনও প্রমাণ নেই। বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে মনে হয় ‘বিজয়’ শব্দটি আর্য ক্ষত্রিয়দের এই দ্বীপে বিজয়-অভিযানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সময়কাল মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক। এই সব কিংবদন্তির পাঁজিপুথি মেলাতে গেলে পণ্ডিতেরা পাগল হবেন। তাই শ্রীলঙ্কার এই ‘ইতিহাস’কে কিঞ্চিৎ লবণ-লঙ্কাসহ সেবনই বিহিত। এটা অধিগম্য যে, পূর্ব-ভারতের তিনটি অঞ্চল, যেমন মগধ, বঙ্গ বা কলিঙ্গ, থেকে আর্য ভাগ্যান্বেষীরা দক্ষিণযাত্রা করে লঙ্কাদ্বীপ অধিকার করেন। যদিও অনুমানসাপেক্ষ, ‘বিজয়সিংহ’ নামক কিংবদন্তিটি পূর্ব রাঢ়, অর্থাৎ বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর অঞ্চল থেকেই সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন। হয়তো তৎকালীন তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে। এই অঞ্চলটি সেকালে ছিল কলিঙ্গরাজ্যের অংশ। তাই ‘বিজয়সিংহে’র উপর বঙ্গ ও কলিঙ্গ, উভয়েই  দাবি জানিয়ে যায়। পরবর্তীকালে এর সমান্তরাল দাবি দেখা যায় সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়েও। এর সঙ্গে আবার একটি অন্যরকম রাজনৈতিক মাত্রাও আবিষ্কার হয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতে ২০১৩ সালে ভারতে শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার প্রসাদ কারিয়বাসম দাবি করেন, শ্রীলঙ্কার সিংহলী জনগোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে বঙ্গ ও কলিঙ্গদেশীয় পূর্বপুরুষের বংশজাত। তারা আর্যমূলের মানুষ। তাই শ্রীলঙ্কার জাতিগত সংঘাত আসলে আর্য ও দ্রাবিড় আধিপত্যের লড়াই। তাঁর এই উক্তি নিয়ে তামিলনাড়ুর রাজনীতিকরা প্রবল কলকোলাহল ও প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁদের কাছে এ ছিল উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রয়াস। এই উক্তিটি করার অল্পদিন আগেই আমি বেশ কয়েকদিন শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণসূত্রে নানা মানুষের সান্নিধ্যে এসেছিলুম। হাইকমিশনারের উক্তিটি অতিসরলীকরণ হলেও তার মধ্যে কিছু সত্য আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

***

 

জন্ম ও কর্মসূত্রে আমি রাঢ়, মগধ ও কলিঙ্গের সঙ্গে ওতপ্রোত যুক্ত রয়েছি দীর্ঘকাল। উপরন্তু বৌদ্ধ ইতিহাস ও দর্শন আমার প্রিয় চর্চা। তাই শ্রীলঙ্কা আমার ভ্রমণতালিকায় দীর্ঘকাল ধরেই শীর্ষে ছিল। কিন্তু তিন দশক জোড়া তুমুল হিংস্রতা, রক্তপাত ও বিপর্যয়পর্বে শ্রীলঙ্কা কোনও পর্যটকের প্রাথমিকতা থেকে ছিল বহুদূর। যাঁরা যেতেন, তাঁরা মূলত কলম্বো ও তার দক্ষিণে বেনটোটা, হিক্কাডুয়া, গল, মাটারা বা দক্ষিণপূর্বে তিস্সমহারামা, ইয়ালা ন্যাশনাল পার্কের বাইরে আর যেতেন না। আমার শ্রীলঙ্কা মানে অনুরাধাপুরা, পোলান্নারুয়া, ডাম্বুলা, সিগিরিয়া। বাকিগুলো মোটামুটিভাবে আবার পর্যটকের তালিকায় ঢুকতে পারলেও অনুরাধাপুরা, পোলান্নারুয়া বেশ কিছুদিন ধরেই অচ্ছুত। অনুরাধাপুরা থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে সেইসব রোমহর্ষক স্থাননামগুলি ঘিরে আছে। ত্রিঙ্কোমালি, ভাভুনিয়া, মন্নার। মুল্লইতিভু বা কিলিন্নোচিও খুব একটা দূরে নয়। সবই একশো কিমির মধ্যে। খোদ জাফনাই তো অনুরাধাপুরা থেকে মাত্র একশো নব্বই কিমি। তাই যে সংস্থাটি আমার ভ্রমণসারণীটি তৈরি করেছিল তাদের অসুবিধেটি আমি বুঝতে পেরেছিলুম। তার উপর আমি একটু আয়েসি পর্যটক। যেখানে ভালো লাগবে সেখানে সময়ের হিসেবে চলব না। আবার যেখানে সবাই ভিড় করে সেসব জায়গাও ঠিক পোষায় না। অতএব সফরনামা মেরা মর্জি এবং নো কম্প্রোমাইজ।

***

 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এই দ্বীপটির মূল বাসিন্দা ছিলেন যক্ষ ও নাগজাতির মানুষেরা। পৃথিবীর আদি ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আর্যদের অভিধান ও মননে ‘অনার্য’দের সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সম্মানবোধ ছিল না। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে সাগরপারের বণিকদের যোগাযোগ ছিল মুক্তো ও মূল্যবান রত্নব্যবসায়ের সূত্রে। কিন্তু তখনও কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। রামায়ণ মহাকাব্য বর্ণিত অতি সম্পন্ন সভ্যতার ন্যূনতম ইঙ্গিতও এই দ্বীপদেশটির ভূভাগে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই, কবি ‘তব মনোভূমি’ রাম ও রাবণ, উভয়েরই জনমস্থান। অযোধ্যা বা স্বর্ণলঙ্কা কাব্যভূমি হিসেবেই স্বীকৃত হওয়া সমীচীন।

সেই অনুযায়ী ‘বিজয়সিংহ’ই এই দ্বীপরাজ্যের প্রথম ক্ষত্রিয় বংশজ আর্য নৃপতি। তিনি ও তাঁর অনুসারী সাতশো সঙ্গী, স্থানীয় আদিবাসী যক্ষ ও নাগদের বশীভূত করে এদেশে আর্য সিংহলি সভ্যতা গড়ে তোলেন। আর্যদের পরীক্ষিত পথে বিজয়সিংহ স্থানীয় যক্ষরাজের কন্যা কুবেণীর পাণিগ্রহণ করেন। এই সম্পর্কস্থাপন করার ফলে যক্ষরা সহজেই আর্যদের শাসন স্বীকার করে নেয়। যদিও নিজেদের প্রভাব দৃঢ়মূল করার পর বিজয়সিংহ মধুরানগরের (মাদুরাই) দ্রাবিড় পণ্ডিয়ন রাজবংশের কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁর সমস্ত সহযোগীরাও রাজাকে অনুসরণ করতে বিলম্ব করেননি।

তাম্বপন্নি থেকে বিজয়সিংহ নিজের সাম্রাজ্যবিস্তার করতে থাকেন দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে মালওয়তু নদী (মাল্যবতী) ও কলানদীর তীরভূমি বরাবর। আটত্রিশ বছর রাজত্ব করে নিষ্পুত্র রাজা বিজয়সিংহ ভ্রাতুষ্পুত্র সিহপুরের রাজ-উত্তরাধিকারী পাণ্ডু বাসুদেবের হাতে রাজত্বের ভার দিয়ে গত হলেন। পাণ্ডু বাসুদেবের পর রাজ্যের অধিকার পেলেন তস্য পুত্র অভয়, তার পর তস্য ভাগিনেয় পাণ্ডুক অভয়। পাণ্ডুক অভয় ছিলেন পরাক্রমী রাজা। তিনিই প্রথম অনুরাধাপুরা নগরটির পত্তন করেন রাজধানী হিসেবে। তাঁর সত্তর বছরের ও তাঁর পুত্র মুতাশিবের ষাট বছরের রাজত্বকালে সিংহল সভ্যতা নিজস্ব ধরনের আর্য উপনিবেশ হিসেবে সংহত হয়ে ওঠে। মুতাশিব রাজার দ্বিতীয় পুত্রই ছিলেন তিষ্য। যাঁর উপাধি ছিল দেবানমপিয় (দেবপ্রিয়) এবং সম্ভবত সিংহলের খ্যাততম নৃপতি। তিনি সিংহাসনে বসেন খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে। বিজয়সিংহের রাজ্যগ্রহণের ঠিক ২৩৬ বছর পরে। রাজা তিষ্যের রাজত্বের মেরুদণ্ড ছিল ছ-সাতটি নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা উর্বর ভূমিতে কৃষি-অর্থনীতি। তিনি সযত্নে অনুরাধাপুরাকে কেন্দ্র করে সফল আর্থ-শাসনব্যবস্থা প্রয়োগ করেন।

***

 

তখন আমি ভুবনেশ্বরে। সন্ধের দিকে একটু শিরশির করে। কিন্তু শীত পড়েনি। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে একদিন দুপুরে চেন্নাইয়ের জন্য হাওয়াই জাহাজে সওয়ার হলুম দারাকন্যাসহ। রাতের বেলা থাকতে হবে চেন্নাইতে। সকালবেলা উড়ান কলম্বোর উদ্দেশ্যে। হোটেলটি আলন্দুর পাড়ায়, নুঙ্গবক্কমের কাছে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হল। যদিও সাড়ে নটায় উড়ান, কিন্তু কলম্বো হলেও ‘বিদেশ’ বলে কথা। দু ঘণ্টা আগে রিপোর্টিঙের আদেশ ছিল। উড়ান সময় এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। হায়দরাবাদ থেকে ভুবনেশ্বর, অতটাই সময় লাগে। তবু কাকস্য পরিবেদনা। পনেরো-কুড়িদিনের সফর। সঙ্গে দুজন মহিলা। চলার পথের ঐহিক সম্বল পঁয়তাল্লিশ কিলোর মধ্যে ধরে রাখতে অনেক গার্হস্থ্য সংগ্রাম করতে হয়েছে। চড়নদারের উপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি সত্ত্বেও সে আপস করেনি, অতএব হাতের ঝোলাতেও সাত কিলোর দাবি। অর্জুন মণ্ডলের সিন্দুকের মতো গোটা কয় বোঝা টানতে টানতে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে পৌঁছাই। সেখানে জানতে পারা যায় মাথাপিছু তিরিশ কিলোর অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তখন আর বোঝা বাড়ানোর কোনও সুযোগ আবিষ্কার করা গেল না। তবে খানিকক্ষণ পরে বোঝা গেল ভাগ্যবানের বোঝা কীভাবে বওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

***

 

খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সনে সিংহলে ছিল ভূতপ্রেতের রাজত্ব। মানে ঐ দ্বীপের পূজনীয় বিগ্রহ ছিল বিভিন্ন যক্ষ ও যক্ষীর রূপ। তাদের নাম কালভেলা, চিত্তরাজা, বেস্সবন, বলভামুখি, ব্যাধদেব, পচ্ছিমরাজিনি ইত্যাদি। রাজা তিষ্যের পিতামহ পান্ডুক অভয় পর্যন্ত এই সব যক্ষযক্ষীর পুজোআচ্চা করার জন্য মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও প্রেতালয় হিসেবে স্বীকৃত বটগাছ, তালগাছকেও পুজো করা হত তাঁদের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য। আসলে এখন মনে করা হয় এই সমস্ত যক্ষ-প্রেত ইত্যাদি ছিল পূজকদের পরলোকগত আত্মীয়স্বজনেরা। লোকধর্মে এই প্রবণতাটি এখনও প্রচলিত আছে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে বিভিন্ন জৈন নির্গ্রন্থ যেমন গিরি, জটিয়া, কুম্ভাণ্ডদের দেখা পাওয়া যেত। ছিলেন আজীবিক, রমতা যোগী এবং বিশেষ করে ব্রাহ্মণেরা। কিছু শৈব লোকজনও ছিলেন আর ছিলেন বেশ কিছু নাস্তিবাদী মানুষ। কোনও বিশেষ বিশ্বাসের প্রাধান্য ছিল না সারা দেশে। ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের মতো-ই বিবিধ মতানুসারী জনতা ছড়িয়ে ছিল দ্বীপময়। যদিও মহাবংশ বলছে তথাগত বুদ্ধ তিনবার এসেছিলেন সিংহল দ্বীপে, কিন্তু তার কোনও ঐতিহাসিক সাক্ষী নেই। তবে তাঁর আত্মীয় ভদ্দকাচ্চন বত্রিশজন ভিক্ষুণীকে নিয়ে পান্ডুক অভয়ের রাজত্বের সময়ই এসে পৌঁছেছিলেন তার উল্লেখ আছে কয়েকটি ইতিবৃত্তে।

***

 

চেন্নাই থেকে শ্রীলঙ্কার যাত্রীদের প্রকৃতি, বেশবাস, আচরণ একেবারে দমদমে আগরতলার যাত্রীদের মতো। অথবা আদ্রা লাইনে বলরামপুরের যাত্রী। ঝোলাঝুলি, বাক্সোপ্যাঁটরা, চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি, সব আছে। একেবারে মাছের বাজার। সিকিউরিটিতে লাইন আছে, আবার নেইও। কাজটা হচ্ছে একটা ঘরের মধ্যে, খোলা জায়গায় নয়। যে পারছে এদিক ওদিক থেকে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমরা একটু সরে দাঁড়ালুম। অনেক সময় আছে। ঢুঁসাঢুঁসি কইরতে লারবো।

যুদ্ধ থেমেছে, কিন্তু চাপা টেনশন তো বেশ রয়েছে। তামিলভাষীদের সিকিউরিটি চেক ভালোভাবেই করা হচ্ছে। হঠাৎ একজন পুলিশের চোখ পড়ল আমাদের উপর। এগিয়ে এসে পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। তারপর ভিড়ের পাশ কাটিয়ে চেকটেক করে স্ট্যাম্পো লাগিয়ে দিলেন বোর্ডিং পাসে। আমরা আরাম করে ডিপার্চার লাউঞ্জের দিকে এগোই। বাঁক ঘুরতেই দূর থেকে দেখি ইংরিজি ইশকুলের ফর্ম তোলার মতো শতশত উদগ্রীব জনতার হুটোপাটি। কাছে গিয়ে দেখি তা হল ডিউটি-ফ্রি সুরার বিপণী। অগণিত রাবণরাজার অনুচর সেখানে কোলাহল করে চলেছেন। যাত্রীদের বসার জায়গার আশেপাশেই এই মোচ্ছব বরকরার। আমারও প্রাণ টানছিল, কিন্তু যেকোনও বঙ্গবীরের মতো ব্রাহ্মণীর অনিচ্ছার সামনে অসহায় প্রাণী হয়ে থাকার ভবিতব্য নিয়েই জন্মেছি। অতএব শুধু দেখেই যাই। ক্রমে দেখতে থাকি পাঁজা পাঁজা সুচারু প্যাকিঙে বন্দি আসব-মঞ্জুষা সহ চারপাশে জনতা সোল্লাস কাকলিতে মুখর হয়ে উঠছে। সামনে বড়দিন, নববর্ষ। অল্পক্ষণের মধ্যেই সেই নিছক উল্লাস-কাকলি কর্ণবিদারী হয়ে উঠতে লাগল। টক ‘শো’ করতে আসা রাজনীতিকদের পাশব স্বরযন্ত্র ব্যবহারের মতো। সেও যেন কল্পতরুর আশীর্বাদধন্য ভক্তদল। উঠে দেখতে যাই। ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছে ততক্ষণে। তা গিয়ে দেখি, সেখানে নানা আলমারিতে প্রবাদপ্রতিম যাবতীয় বিলায়তি সুরাসম্ভার রীতিমতো ‘উচিত’ মূল্যে সাধকের কারণপাত্রে বিতরিত হতে অপেক্ষা করছে। আমাদের মতো হাভাতেও এক আধটা উঠিয়ে নেওয়ার এলেম রাখে। কিন্তু আমাদের সামনে তখন দীর্ঘ পথযাত্রা। বোঝা বাড়ানো সম্ভব নয়। শ্রীলঙ্কা বিমানে মাথাপিছু তিরিশ কিলো নিতে দেয়, কিন্তু ঘরে ফিরে আসার পর তা অর্ধেক হয়ে যাবে। অতএব সাধু উদ্দেশ্য বিফল হল।

***

 

খ্রিস্টপূর্ব আড়াইশো অব্দে লঙ্কাদ্বীপে বিজয়সিংহের আগমনের ঠিক দুশো ছত্রিশ বছর পর রাজা পান্ডুক অভয়ের পৌত্র তিষ্য দেবানামপিয় অনুরাধাপুরার সিংহাসনে বসলেন। এই দুশো ছত্রিশ বছর ছিল লঙ্কাদ্বীপে আর্যজাতির নিজস্ব উপনিবেশ ও শাসনকে মজবুত করে তোলার পর্ব। এই সময়ের মধ্যে তারা বিভিন্ন নদী অববাহিকার উর্বর জমিতে নিজস্ব কৃষিসভ্যতার পত্তন করল। মূল অধিবাসীদের কিছু অংশ আর্যজীবনের অঙ্গ হয়ে গেল। বাকিরা নিল মধ্য সিংহলের পর্বতপ্রদেশ মলয়দেশে স্বেচ্ছানির্বাসন। রাজা তিষ্য তাঁর যাবতীয় শক্তি, কল্পনা ও সামর্থ্য ব্যবহার করে অনুরাধাপুরা নগরীকে এক বিশাল, সুরম্য জনপদ হিসেবে গড়ে তুললেন।

ঠিক এরকম সময়েই, কিংবদন্তি অনুসারে মগধের মৌর্যসম্রাট অশোক কথিতভাবে কলিঙ্গযুদ্ধের মর্মান্তিক পরিণতি দেখে নিগ্রোধ নামে এক তরুণ বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে সদ্ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তার পর তাঁর জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠলো সদ্ধর্মের প্রচার, প্রসার। তাঁর বিপুল রাজত্বে প্রায় চুরাশি হাজার স্তূপ নির্মাণ করলেন তিনি। বিংশতিবর্ষীয় পুত্র মহেন্দ্র (মাহিন্দা) এবং অষ্টাদশী কন্যা সঙ্ঘমিত্রাকেও অনুমতি দিলেন সদ্ধর্মের শরণ নিয়ে ভিক্ষুজীবন গ্রহণ করতে।

পিয়দস্সি অশোকের প্রভাবে ও প্রয়াসে অল্পদিনের মধ্যেই বিপুল সংখ্যক মানুষ সদ্ধর্মের শরণ নিলেন। যেহেতু এতদিন বৌদ্ধধর্ম নিতান্ত মননপ্রধান চর্চা ছিল, তাই সেভাবে তার কোনও লৌকিক আচারসংহিতা অর্থাৎ স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হয়নি। ফলত এই সদ্যোদীক্ষিত বিপুল জনসমষ্টিকে আধ্যাত্মিক বাঁধনে অনুশাসিত করার জন্য অশোক রাজগৃহে তৃতীয় মহাসঙ্গীতির আয়োজন করলেন। আচার্য মোগ্গলিপুত্ত তিষ্যের নেতৃত্বে এক হাজার থের-এর (স্থবির, অর্থাৎ জ্ঞানী সাধু) দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর সদ্ধর্মের আচারসংহিতা, যাকে বলা হয় ‘শাসন’, রচিত হল। পালিভাষার এই গ্রন্থটিই থেরবাদী দর্শন ও ধর্মবিশ্বাসের আকর ও প্রামাণ্য সঙ্কলন। এই মহাসঙ্গীতিতেই স্থির করা হল কোন কোন থের বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সদ্ধর্মের প্রচারপ্রসারে নিযুক্ত হবেন। থের মাহিন্দ ভার পেলেন সিংহলের, তাঁর সঙ্গে থের ইত্থীয়, উত্তীয়, সম্বল এবং ভদ্দসালও সহকারী হিসেবে যাবেন।

থের মাহিন্দ যখন এই ভার পেলেন তখন তাঁর বয়স বত্রিশ বছর। কুড়ি বছর বয়স থেকে তিনি সদ্ধর্ম ও দর্শনের বিশদ অধ্যয়ন তথা অভ্যাস করে অরহৎত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে রাজা তিষ্য দেবানামপিয়কে সম্রাট পিয়দস্সি বার্তা পাঠালেন,

অহম বুদ্ধম চ, ধম্মম চ, সংঘম চ শরাণাগতো উপাসকত্তম বেদেশিম সাক্যপুত্তস্য সাসনে ত্বমপি মানি রতনানি উত্তমনি নরুত্তম চিত্তম পসা দায়িত্বন সাধ্যয়া শরণম ভজ।

অস্যার্থ,

‘আমি বুদ্ধের দর্শন ও ধর্মের শরণ নিয়েছি। হে শ্রেষ্ঠ সুজন, আপনিও শাক্যসিংহের শরণ নিয়ে সেইরূপ উত্তম মননের মণিমুক্তা লাভ করুন।’

বৈশাখ মাসের একদিন তিষ্যের প্রধান অমাত্য সম্রাট অশোকের সেই বার্তা তাঁর কাছে এনে দিলেন। সেই জ্যৈষ্ঠ মাসেই সদলে থের মাহিন্দ সিংহলে এসে দেবানামপিয় তিষ্যের রাজত্বে পদার্পণ করলেন।

***

 

শ্রীলঙ্কা সফরসূচি নিয়ে এদেশে ও ওদেশের পর্যটন সংস্থাগুলির সঙ্গে বেশ কিছু বার্তাবিনিময় হয়েছিল আমার। তাঁরা আমাকে অনুরাধাপুরা যাত্রা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেটা আমার জন্য গ্রহণযোগ্য ছিল না একেবারে। কারণ ঐ স্থানটিই আমার প্রথম গন্তব্য। শেষ পর্যন্ত তাঁরা হার মানলেন। জানালেন, ভারতীয়দের জন্য কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু ছাড় পাওয়া যায়। সাহেব পর্যটকদের জন্য একেবারে মানা। অনুরোধ করলেন, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যেন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কোনও কথা না বলি।

১৯৮৫ সালের ১৪ মে তামিল গেরিলারা অনুরাধাপুরায় একটি বাস ছিনতাই করেছিল। ছিনতাই করার সময় ঐ বাস স্টেশনে তারা অপেক্ষমান বহু যাত্রীকে বেপরোয়া গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তার পর তারা বাসটি নিয়ে মহাবোধি মন্দিরে ঢুকে যায়। সেখানে প্রার্থনারত সব ভিক্ষু, ভিক্ষুণী আর সাধারণ নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করার পর কাছেই ভিলপট্টু জাতীয় অরণ্যে আঠেরোজন বনকর্মীকে হত্যা করেছিল। সেদিন সন্ত্রাসবাদীদের হাতে শিকার হয়েছিলেন একশো ছেচল্লিশজন নিরীহ মানুষ। লোকে এই ঘটনাটিকে ‘অনুরাধাপুরা গণহত্যা’ নাম দিয়েছিল।

প্রতিশোধ হিসেবে শ্রীলঙ্কা সামরিক বাহিনির হাতে পরের দুদিনে শিকার হন পঁচাত্তরজন সাধারণ তামিল নাগরিক। ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সালে প্রভাকরণের মৃত্যু পর্যন্ত ছাব্বিশ বছরে শ্রীলঙ্কার জাতিদাঙ্গায় আশি হাজারের উপর মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। আমি যখন গিয়েছিলুম তখনও ক্ষত নিরাময় হয়নি।

***

 

কলম্বো থেকে অনুরাধাপুরা ঠিক দুশো কিমি। সোজা উত্তর দিক মেপে যেতে হয়। ঘন্টা চারেক লাগে। বিমানবন্দরের কাজকর্ম সেরে বাইরে এসে দেখি আমাদের বাহনচালক ভদ্রলোক, নাম রেক্স, অপেক্ষা করছেন। আমাদের তিনজনের জন্য যে গাড়িটি পাঠানো হয়েছে তাতে অনায়াসে জনা দশেক যাত্রী এঁটে যাবেন। ভালো লাগল। হাত-পা ছড়িয়ে বেড়াতে বেশ ভালো লাগে।

কলম্বো থেকে জাতীয় সড়ক ধরে আম্বেপুসা, কুরুনেগলা, ডাম্বুলা হয়ে অনুরাধাপুরা। শ্রীলঙ্কার ভূপ্রকৃতির সঙ্গে কেরলের নিবিড় সাদৃশ্য রয়েছে। আম্বেপুসা পর্যন্ত পথটি কেরলের মতোই সবুজে সবুজ আর নীলিমায় নীল। দিগন্তে নীচু, সবুজ পাহাড়। পথের দুধারে তুমুল সবুজ শস্যক্ষেত। মাঝে মাঝেই সারি সারি নারকেলবীথি, কদলীবীথি আর ঢালু টালিছাতের গ্রামীণ বাড়িঘর। রাস্তা অপরিসর। যানবাহনের মধ্যে টাটার ছোট মাপের ট্রাক-বাস, বাজাজের অটো আর টোয়োটার যাত্রীগাড়ি। অত্যন্ত অনুশাসিত যানবাহন ব্যবস্থা। ভারতীয় উপমহাদেশের বিচারে অভাবনীয়। ডাম্বুলা বাইপাসের পর থেকে ডবল রাস্তা। তাও বিশেষ চওড়া নয়। কিন্তু অনুশাসিত ট্র্যাফিকের জন্য যাত্রা মসৃণ। আমি ক্যামেরাসহ সব সময় চালকের পাশেই বসি। তাঁর গদাই-লস্করি গাড়িচালন দেখে হাত নিশপিশ করে স্টিয়ারিঙে বসতে। মাঝে মাঝেই রাস্তা কেটে জোড়া রেললাইন চলে গেছে। সরু ন্যারো গেজ লাইন। টুক টুক করতে করতে রেলগাড়ি চলে। এত ছোট্ট একটা দেশ। উত্তর থেকে দক্ষিণ মাত্র সাড়ে চারশো কিমি। আর পূর্ব-পশ্চিম তার অর্ধেক, সোয়া দুশো। ভারতীয় হিসেবে একটু বাৎসল্য ভাব জমে মনের মধ্যে।

গাড়ি চালক রেক্স শ্রীলঙ্কার দুর্দিনের গল্প করেন। তিনি ধর্মে খ্রিস্টিয় হলেও বৌদ্ধ সমর্থক। প্রায় তিন দশকের গৃহযুদ্ধে সে দেশের সাধারণ নির্ধন মানুষের কী দুরবস্থা হয়েছিল, তার গল্প বলেন। কলম্বোর কাছে একটি কারখানায় মোটামুটি স্বচ্ছন্দ শ্রমিকের জীবন ছিল তাঁর। তিনটি সন্তান। কবে সে জীবন ফিরে পাবেন, ঠিক নেই। ভারত সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই। আত্মগতভাবে ‘দাদাগিরি’র বিরুদ্ধে স্বর জাগে। যদিও তিনি জানান সাধারণভাবে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভারতের কাছে ‘কৃতজ্ঞ’। ভারত না চাইলে নাকি প্রভাকরণকে নিকেশ করা যেত না। তামিল লবির চাপ অস্বীকার করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কার উপকার করেছেন। যুদ্ধপরবর্তী কালে ভারত নানাভাবে তাঁদের সাহায্য করছে। এটুকু জানেন, মনমোহন সিং একজন ভালো নেতা। কৃতজ্ঞতা বশেই নাকি কুমার সঙ্গকারা ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে ম্যাচটা ছেড়ে দিয়েছিলেন।

গোধূলির আলো ম্লান হবার আগেই রেক্সবাবু আমাদের একটা রিসর্টে এনে পৌঁছে দিলেন। অনুরাধাপুরা সম্বন্ধে যে রকম শুনে এসেছি তাতে খুব একটা ভালো ঠেক আশা করিনি। কিন্তু সেখানে এসে দেখি বিশাল একটা তপোবন গোছের সাজানো, কিন্তু ভেবেচিন্তে তৈরি করা বন্যতার ল্যান্ডস্কেপ। তার মধ্যে ছড়িয়ে আছে কটেজগুলি। সেগুন কাঠের ফ্রেমে বন্দি বিরাট মাপের সব দরজা জানালা। প্রশস্ত ঘর আর মনোরম সজ্জা। একটি বিরাট পুল আর ছোট ছোট অসজ্জিত জলাশয়, গাছের ফাঁকে ফাঁকে। দেশবিদেশে অনেক সরাইখানায় থেকেছি। কিন্তু এই ঠেকটি মনে রয়ে গেছে। মালিকানা মনে হয় কোনও তামিল ধনাঢ্য ব্যক্তির। কারণ ফয়্যারটিতে চমৎকারভাবে সাজানো গণেশ, লক্ষ্মী, রাম, হনুমান ও বাসুকী নাগরাজের মূর্তি। কিন্তু ঐ বিশাল নির্মাণটিতে লোকজন বিশেষ চোখে পড়ল না। গা ছমছমে আলো-আঁধারিময় বিস্তৃত বনবাংলোর মতো মায়াবী পরিবেশ সেখানে।

শ্রীলঙ্কায় শুধু দুটি ঋতু আছে। শুষ্ক ও সিক্ত। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাইরে তুমুল রোদ। রীতিমতো গ্রীষ্মকালীন তাপ। নিরক্ষরেখার কাছাকাছি থাকার জন্য সূর্যদেবের অকৃপণ আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে চরাচরে। সেখানে সারাদিন খালি পায়ে তপ্ত পাথরের পথে হেঁটে বেড়ানো। টান লাগে।

এদেশে আমরা ছোটবেলা থেকে মহেন্দ্র-সঙ্ঘমিত্রার গল্প পড়েছি। পালি ভাষায় ‘মাহিন্দা-সঙ্ঘমিত্তা’। সে সময় দেশের রাষ্ট্রপতিও একজন ‘মাহিন্দা’, মাহিন্দা রাজপক্ষে। দেশের লোক জানে তিনি একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই বিধ্বস্ত দেশের মানুষ একজন সেরকম নেতার প্রতিই অনুগত থাকতে চান। অন্যদিকে মাহিন্দার ভারতের প্রতি বিশেষ আনুগত্য নেই। তিনি বাজি ধরেন ভারতের উত্তর প্রান্তের প্রতিবেশীর সমর্থনে। হাম্বানটোটায় চিনের নেতৃত্বে বিশাল বন্দর বানানোর কাজ নিয়ে তখন আন্তর্জাতিক দুনিয়া সরগরম।

খ্রিস্টপূর্ব তিনের শতকে পিয়দস্সি অশোকের বড় মেয়ে সঙ্ঘমিত্তা সিংহলে আসেন। সেখানে তখন রাজা তিষ্যের শাসন। বোধগয়ায় পবিত্র বোধিবৃক্ষ থেকে চয়ন করা একটি অঙ্কুর নিয়ে এসেছিলেন তিনি। অনুরাধাপুরায়, মাটি থেকে প্রায় একুশ ফুট উঁচু মহামেওনাওয়া নামের একটি টিলার উপর রাজা তিষ্য ২৮৮ সাল খ্রিস্টপূর্বে অঙ্কুরটি রোপন করেন। এই বৃক্ষটি বিশ্বের প্রাচীনতম নথিভুক্ত জীবিত উদ্ভিদ। তখন থেকে শুরু করে প্রায় দু হাজার বছর ধরে সিংহলের সমস্ত রাজা, যেমন বাসব (প্রথম শতক), বোহরিকা তিষ্য (তৃতীয় শতক), মহানাগ (ষষ্ঠ শতক), সেনা (নবম শতক) থেকে কীর্তিশ্রী রাজসিংহ (আঠেরো শতক) পর্যন্ত বৃক্ষটিকে নিরাপদ ও ফুল্ল রাখার জন্য নানারকম ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। বোধগয়ার বর্তমান বোধিবৃক্ষটি ম্রিয়মান হয়ে যেতে সেখানে অনুরাধাপুরা থেকে আনীত বোধিবৃক্ষের অঙ্কুর রোপিত হয়েছিল উনিশ শতকে। বোধিবৃক্ষকে শাক্যমুনি নিজের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। সারা বিশ্বের বৌদ্ধ অনুগামীদের কাছে এটি এক পবিত্রতম তীর্থ। শ্রীলঙ্কাকে চিনতে এজন্য আমি অনুরাধাপুরার ‘জয় শ্রী মহাবোধি’ দর্শন থেকেই যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলুম।

 

মহাবোধির কাছেই রয়েছে জেতবনবিহারের ধ্বংসাবশেষ। কিংবদন্তি অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রাজা দূতগমনু প্রথম এখানে একটি স্তূপের পত্তন করেন। তৃতীয় শতকে রাজা মহাসেন এই জায়গায় তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম স্তূপটি নির্মাণ করতে ব্রতী হন। তাঁর পুত্র প্রথম মেঘবর্ণ নির্মাণটি সম্পূর্ণ করেন। তখন সেটি  প্রায় চারশো ফুট উঁচু ছিল। মিশরের পিরামিড ছাড়া তখন এত উঁচু নির্মাণ আর কোথাও ছিল না। বুদ্ধের উত্তরীয়ের অংশ নিহিত ছিল এর ভিতরে। সঙ্ঘমিত্তার জীবৎকালেই এই স্তূপটি কেন্দ্র করে সিংহলে মহাযানী ও থেরবাদী অনুগামীদের মধ্যে বিরোধ দানা বেঁধে উঠেছিল। দুই গোষ্ঠীর পরস্পর সংঘর্ষে জেতবনবিহার ধ্বংস হয়ে যায়। এগারো-বারো শতকে অনুরাধাপুরা থেকে রাজধানী অপসারিত হয়ে যাওয়ার জন্য সমগ্র এলাকাটি ঘন অরণ্যে ঢেকে গিয়েছিল। বারো শতকে রাজা পরাক্রমবাহু স্তূপটির নতুন করে সংস্কার ও নির্মাণ করেন। তখন এর উচ্চতা আগেকার চারশো ফুট থেকে কমে তিনশো আটত্রিশ ফুট হয়ে যায়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এর সামগ্রিক সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হয়েছিল। ১৯৪০ সাল নাগাদ সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়। উচ্চতা কমে গেলেও এটিই এখনও বিশ্বের বৃহত্তম বৌদ্ধ স্তূপ। এর নানা নামের মধ্যে আছে মহাথুপ (মহাস্তূপ), স্বর্ণমল্লী চৈত্য, সুবর্ণমল্লী মহাচেতি (মহাচৈত্য) বা রত্নমল্লী দগোবা। এখন এর নাম ‘রুওয়ানা ওয়েলিসায়া’।

বর্তমান অনুরাধাপুরা জনপদে দর্শনযোগ্য বহু প্রাচীন নির্মাণ ও ইতিহাস স্থাপত্যের দেখা পাওয়া যায়। শুধু বৌদ্ধ ঐতিহ্য নয়, আর্যসভ্যতার প্রথম উপনিবেশ হিসেবে অনুরাধাপুরা, যা সিংহলের প্রাচীনতম রাজধানী এবং রাজধর্মের কেন্দ্র। শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধপ্রধান দেশ। সংবিধান অনুযায়ী সে দেশে কোনও অবৌদ্ধ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে পারেন না। কিন্তু বুদ্ধের অহিংসার বাণী ভারতবর্ষের মতোই সেখানেও নীরবে নিভৃতে কাঁদে। যদিও বৌদ্ধপ্রধান বর্মা দেশের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করেনি শ্রীলঙ্কা। চূড়ান্ত সঙ্কটের মুহূর্তেও নির্বাচিত সরকারের উপর ভরসা রেখেছেন সেখানকার নাগরিকরা। অবশ্য ‘নির্বাচনে’র সংস্কৃতিও ভারতবর্ষের থেকে ভিন্ন নয়।

ভারত-সভ্যতায় জাতিগত, ধর্মগত, ভাষাগত অন্তর্কলহের পরম্পরা চিরকালই অন্তহীনভাবে প্রসারিত হয়েছে। ধর্মগতভাবে বহু প্রচারিত হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব ছাড়াও হিন্দু-হিন্দু, হিন্দু-বৌদ্ধ, হিন্দু-জৈন, হিন্দু-খ্রিস্টান, হিন্দু-শিখ, মুসলিম-মুসলিম, মুসলিম-বৌদ্ধ, মুসলিম-শিখ ইত্যাদি সংঘর্ষের শোনিতসিক্ত ইতিহাস আমাদের পরম্পরাকে ঘৃণামলিন করে রাখে। এইতো সেদিন, ২০১৯-এর ইস্টারের দিন কলম্বোর কাছেই সেন্ট অ্যান্থনি গির্জা ও তিনটি পাঁচতারা হোটেলে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে দুশো সাতষট্টিজন নিরীহ মানুষের প্রাণ বিসর্জিত হয়েছে। গত তিন-চার দশকে যত মানুষ সেখানে হিংস্র হানাহানির বলি হয়েছেন, দেশটির মাপ মনে রাখলে তার সংখ্যা শিহরিত করে।

অনুরাধাপুরা জনপদের পথে পথে ঘুরে বেড়ালে ইতিহাসের চতুর্থ মাত্রাটি টের পাওয়া যায়। সিংহল দ্বীপের প্রাচীনতম বৌদ্ধ বিহার, থুপরামা স্তূপ ও বিহার (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক), অভয়গিরি স্তূপ বিহার (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক), লঙ্কারামা স্তূপ (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক), ইসুরুমুনিয়া বিহার (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক), রনমাসু উয়ান (উদ্যান) (অষ্টম শতক), লোভমহাপায়া প্রাসাদ অবশেষ (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক), অনুরাধাপুরা রাজধানী অবশেষ, যেদিকে তাকানো যায়, বৃহত্তর ভারতসভ্যতার একটা বিশ্বস্ত মুদ্রা চোখে পড়ে যাবে। মাপের দিক দিয়ে অবশ্যই ভারতবর্ষের ইতিহাস চিহ্নগুলির তুলনায় তাদের লঘু লাগতে পারে। কিন্তু মাহাত্ম্যের বিচারে তাদের সম্মান কোনও মতেই ন্যূন নয়।

শ্রীমহাবোধি সংলগ্ন মন্দির, বিহার, উদ্যান অথবা রুয়ান ওয়েলিসায়া স্তূপমূলে সারি সারি আজানু প্রণত কাষায়, গৈরিক বস্ত্রশোভিত শ্রমণ, ভিক্ষু-ভিক্ষুণীর অন্তহীন সমাবেশ, শ্বেতবস্ত্র পরিহিত আবালবৃদ্ধবনিতা ভক্তজনের নানা ভঙ্গিতে উপাসনার স্থিরচিত্র স্মরণ করিয়ে দেয় শাক্যমুনির ছায়ালালিত এক শান্তিকল্যাণের আবহ।

অথচ নিষ্ঠুর বাস্তবের রূঢ় কশাঘাত আমাদের রক্তাক্ত বর্তমানকে এক বারের জন্যও ভুলতে দেয় না। জগৎ নিয়ন্তার শুভবোধের প্রতি আমাদের অফুরান প্রশ্ন থেকেই যায়। হে মহাবোধি, তবে কি কোনই পরিত্রাণ নেই? আশ্বাস নেই? করবীফুলের মতো লাল খ্রিস্টের রক্ত নিরর্থক বয়ে যাবে আরও বহু মন্বন্তর পেরিয়ে, অন্ধ ইতিহাসের পথে…

…এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে
পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্নকাল:
প্রতিটি রেশম থেকে সীতা আর অগ্নিপরীক্ষায়—
অথবা খ্রিষ্টের রক্ত করবীফুলের মতো লাল।

(সাবলীল— জীবনানন্দ)