Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কয়েকটি অসমিয়া কবিতা

বাসুদেব দাস

 

(মূল অসমিয়া থেকে অনূদিত)

 

নষ্ট রাতের কবিতা

প্রাঞ্জল কুমার খাউণ্ড

রাত হলে
বিনা নিমন্ত্রণের অতিথির মতো
তারা একটি প্রবেশ করে
খোলা জানালা দিয়ে

বুকের বোতাম খুলে
শীর্ণকায় এক লতা জড়িয়ে
গোপনে গোপনে বিবস্ত্রা হয়ে
ফিসফিস করে কানে কানে কী কথা বলে

সর্পিল গতিতে অবাধ্য হয়ে
নেড়েচেড়ে বিদীর্ণ করে
গোপন প্রমের মগ্নতা

প্রস্তর মূর্তি একটার মতো
এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকি

মাঠের অন্য প্রান্তে
চাঁদ একটা দাড়িয়ে থেকে
খিলখিল হেসে দেখতে
থাকে দুজনকে

তীক্ষ্ন একটা যন্ত্রণা নিয়ে
সারা রাত উষ্ণ হতে থাকি
দিগন্তের নীলার আড়ালে।।

 

আমি সেখান থেকেই বলছি

রাজেশ কুমার তাঁতী

ক্ষুধা যেখানে বিলাসিতা,
সেখান থেকেই আমি বলছি

শত সহস্র অন্ধকার কেটে
আলোর সন্ধানে ব্যাকুল সেই দিনগুলি থেকেই

শিশুর অর্ধস্ফুট কথা থেকেই আমি বলছি
আমি নিরন্তর বলে চলেছি

কেন দুর্ভিক্ষ আসে
মাটি ভেদ করে বের হয় দুঃখের অঙ্কুর
দ্রুত বেড়ে চলে, ছড়িয়ে যায় বুকে
জ্বলজ্বল, জ্বলজ্বল-প্রাণবন্ত

মহামারিতে আক্রান্ত মানুষগুলি
খাদ্যের অভাবে মৃত্যমুখী শিশুগুলি
মৃতপ্রায় সময় এবং পতিত আত্মাগুলি
এসে আমাকে প্রতিবাদ করে
আমি দুহাত যুক্ত করি
প্রার্থনায় অসন্তোষ আমার ঈশ্বর
তবু আমি বলে থাকি একটা সম্ভাবনার কথা
সেখান থেকেই

এখানে সমস্ত উৎসবই দুঃখের উৎসব,
প্রতিটি দিনই যন্ত্রণার দিন আর
প্রতিটি রাত এক একটি দীর্ঘশ্বাস

কারণ এখানে নগ্নতাই বস্ত্র আর
শূন্যতাই জীবন

 

মহারণের শেষে

রশ্মিরেখা বরা

এখন শেষ হল সমস্ত ঘৃণা আর অবিশ্বাসের ক্ষত
সমস্ত অহঙ্কা্র আর প্রতিজ্ঞা পূরণের স্বপ্ন
শেষ হল সমস্ত অপ্রাপ্তি আর দুঃখের যাতনা

কিন্তু পূর্ণতার এই মহাক্ষণে শূন্যতার এই অসহ্য চিৎকার কেন বাসুদেব

আমার কেশদামের তীব্র তৃষ্ণা শেষ হল অন্ত পড়ল সহস্র অপমান
কিন্তু হঠাৎ চেতনার এই অতল থেকে মাথা তুলে উঠছে অন্য এক কাতর ধ্বনি
আর আমার শরীর জুড়ে জ্বলছে একটা প্রাচীন আগুন

কী নাম এই অনন্ত জ্বালার বাসুদেব

পরিত্যক্ত প্রাসাদে গজিয়ে উঠছে অসংখ্য বিহঢেঁকীয়া মেঝেতে জমাট বাঁধা চোখের জল
আমার সামনে ব্যথার এক বিহ্বল সমুদ্র
আমার শূন্য আঁচলে এখন মৃতদের চিৎকার
আর জীবিতদের দীর্ঘশ্বাস

মহারণের শেষে এটাই কি প্রাপ্তি বাসুদেব

প্রতিনিয়ত এই যুদ্ধ এই ভাঙাগড়া এই মরা এই বেঁচে ওঠা
প্রাপ্তির সুউচ্চ শিখরে ক্রমশ কেঁপে ওঠা একটা ঠান্ডা নিশ্বাস

মধ্যরাতে যখন নিজের সঙ্গে মুখোমুখি একান্ত নির্জনে
যখন নিজের সঙ্গে কথা বলা
আর নিজের কাছেই অচিন হয়ে যাওয়া
সেই একান্ত গোপনে

সমস্ত পূর্ণতাই কি একদিন শেষ হয় শূন্যতার বিশাল অন্ধকারে

বাসুদেব

 

ভালোবাসায়

বিজয় শঙ্কর বর্মন

তুমি কিছু ভাবছ
অথচ
আমাকে জিজ্ঞেস করছ—
‘কী ভাবছ?’

আমি কিছু ভাবছি
আর
তোমাকে জিজ্ঞেস করছি—
‘কী ভাবছ?’

অতল এই কয়লার খাদে
হারিয়ে রইলাম আমরা

অচিন অন্ধকারে
ঢেঁকিয়ার ফুল কাঁপে

তুমি চোখের জল ফেল
আমিও
প্রসারিত আঙুলগুলির দিকে তাকিয়ে
আমরা নিজেকে জিজ্ঞেস করি—

‘চোখের জলে আবেগ থাকে।
বল হে আত্মা,
আবেগ থাকে কি

চোখের জল
মুছে দেওয়ায়?’

 

একটি সহজ কথার কবিতা

প্রজ্ঞানজ্যোতি

পথে ঘাটে আবার ঘন ঘন টায়ার জ্বলছে, ঝন ঝন তরোয়াল বাজছে, পাথর বর্ষিত হচ্ছে
আমরা নিরীহ মানুষদের পেটের ভেতর হাত পা লুকিয়েছে। কী একটা ভয়ে বুকটা
কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে টায়ারের আগুন নিভে যাবে সত্য। তবে ভয় হচ্ছে
বাতাসে ছড়িয়ে পড়া কালো ধোঁয়াগুলি বহুদিন অস্থির করে রাখবে মানুষকে

টায়ারের দাউদাউ আগুনের চেয়ে মাটির প্রদীপের ক্ষীণ শিখাটি ভালো। আসলে এই
সহজ কথাটি ভুলে যাবার জন্যই টায়ারের ধোঁয়া কলজে কালো করছে
পথের দুব্বোয় রক্ত পড়েছে, শিলের পাহাড় খসেছে এবং
ঝিঁঝিপোকার আওয়াজ জিলির আওয়াজকে ছাপিয়ে দেওধনি[i] রাতগুলিতে
বিষাদের রাগ জুড়েছে

তাই সহজ কথাটা এখন আমার আরও সহজভাবে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে
ভাইয়েরা—
কিছুক্ষণ পরে আমাদের সবাইকে একই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু
নাতিদের ফুলের মতো কোমল পায়ের জন্য রেখে যাব যে পথ
জ্বালিয়ে যাব কি সেখানে
টায়ারের আগুন…
রেখে যাব শিলের পাহাড়
ধারালো তরোয়াল…।

 

শূন্যতা

কৃষ্ণকায় মাঝি

একদিন আমি শূন্যতার সাঁকো দিয়ে বেয়ে বেয়ে
শূন্যতা দিয়ে একটি ঘর বানালাম
আমার ঝুলিটাও ছিল শূন্য
পকেটও ছিল শূন্য
আমার অজ্ঞাতসারে শূন্যতার ঘরে প্রবেশ করল
একটু আলো
আলো জিজ্ঞেস করল
তোমার চোখে এত শূন্যতা কেন
রোদ আমাদের শূন্য ঘরের চালে উঠে জিজ্ঞেস করল
তোমার হৃদয়ের শূন্যতা কে পূর্ণ করবে
আমি খুঁজে খুঁজে আকাশকে আনলাম
শূন্য ঘরের চালে শূন্য একটা আকাশ চাই
শূন্যতার বাক্সে বৃষ্টি এত রং মাখে
আমি বুঝেও বুঝতে পারলাম না শূন্যতা পূরণ করার জন্য
এক কাঠা এক বিঘা মাটি কেন লাগে
কেবল মাটি আর জলেই
শূন্যতার সম্পূরণ অথবা সমাধি তৈরি করতে পারি
শূন্যতার হাতে ধরে
আমি আবার একটা শূন্য শহরে উপস্থিত হলাম
শূন্যতার চিৎকারে শূন্য হয়ে পড়ে আল্লা-ঈশ্বর
কেবল শূন্যতাই ঘিরে রাখে চারপাশের ফুঁপিয়ে কান্না
আমার হাত ঘড়িতে এখন সময় শূন্য
ধীরে ধীরে শূন্য হয়ে আসা একটি নদী
খুঁড়ে খুঁড়ে জলের খোঁজ করলাম
বাতাসে শূন্যতার একটা ভায়োলিন বাজাতে বাজাতে
সমস্ত কিছু শূন্য করে দিল
এবার শূন্যতার ক্ষয়ীভবন টুকরো টুকরো করে খসিয়ে
শূন্যতায় আমাকে পুঁততে থাকে
আমার শূন্য হয়ে আসা রক্ত-মাংস-জল
শূন্যের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল
প্রকৃতপক্ষে আমিও শূন্যই
বিশ্বাসহীনতার
অসীম শূন্যতায় ছিটকে পড়া
নামহীন একটা শূন্য তারা…

 

মানুষ, জীবন এবং বৃষ্টি

নন্দসিং বরকলা

আকাশ এবং মাটির প্রেমের কথা বাতাস ফিসফিস করে নদীকে বলল
এক দুরন্ত আকাঙ্খায় মেঘের মাটি স্পর্শে রজস্বলা ঋতু
আর সবুজ সন্তানের সঙ্গে মাছের রঙিন চোখে আকাশ নাচছে
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চকচকে হয়ে উঠা চোখে মাটি এবং আকাশ হওয়ার আশা

বৃষ্টি এবং মাটির মতো হওয়ার জন্য রং মাখা মাঠে জেগে উঠেছে কৃ্ষকের কণ্ঠস্বর

গাছের ডালে চোখের জলের দাগ, এই দাগে সাঁচিপাতের পৃথিবী একটার বিলাপ
বিলাপ কেবল বৃষ্টির, বৃষ্টিতেই জীবনের যাত্রা…

এই যাত্রায় আকাশের চাঁদ,
সকালের পাখির শোভাযাত্রা,
কৃ্ষকের কোলাহলে বর্ষা আরও যেন
পিতামহ, প্রপিতামহ পোত খাওয়া কলং, কপিলী, হারিয়া, বুড়িদিহিঙের
প্রাচীন কণ্ঠস্বরে হাতে ধরি একটা যুদ্ধের ইতিহাস

একদিন আলোর আস্তরণে ভেজা দুহাত মেলে ধরেছিলাম একটা মাঠ
এক সুরের সমলয়ে আকাশের অভিসার মাটির সঙ্গে
রং ঢালা… ফাগুনে গাছের উদাসী মন
যেন আলো-ছায়ার খেলা… লুকোচুরি

রত্নাকর না দধীচির দিন… সাঁচিপাত কোথায় (?)
খোঁজে হৃদয়মুলুক বন্ধক রেখে
আকাশের সঙ্গে বাতাসের গায়ে এই প্রেম…

বৃষ্টিতে নেমে আসুক মানুষের গান
ভেতরে-বাইরে রং আর প্রেমে ভিজুক মানুষ
নদীর সঙ্গে মানুষ আর বৃষ্টি যেন জীবনের বসন্ত

 

সান্ধ্যভ্রমণ

হরেন গগৈ

সান্ধ্যভ্রমণে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল

বড়পুকুর তীরের বন্য পাখির কলরবে
তিরবির করে উঠছে একটা ঝলমলে সন্ধ্যা

উজ্জ্বল পদ্মের পাপড়িগুলিতে
লেগে থাকে মাঝির ভাটিয়ালি রাগ
ঝিরঝিরে বাতাসে আঁচল উড়িয়ে নিয়ে
থমকে রয়েছে বিষাদের গান

দুজনের ঠোঁটে ঝুলে আছে
দুটো প্রেমের সংলাপ
একচিলতে সাদা মেঘ এঁকে দিয়েছে
মৌনতার ছবি

সান্ধ্যভ্রমণে তোমার বুকে উথলে উঠেছে
একটা সাতরঙের সাগর

 

কবি পরিচিতি

প্রাঞ্জল কুমার খাউণ্ড

১৯৭৯ সনে অসমের জোরহাটে কবি প্রাঞ্জল কুমার খাউণ্ডের জন্ম হয়। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘শিলকপৌ’। সদৌ অসম কবি সম্মেলনের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।

রাজেশ কুমার তাঁতী

১৯৭৩ সনে অসমের জোরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সেউজীয়া উপত্যকাত সূর্য নামিব’। নুমলীগড় রিফাইনারিতে কর্মরত।

বিজয় শঙ্কর বর্মন

১৯৮১ সনে জন্ম। ‘ডেও’ এবং ‘অশোকাষ্টমী’ দুটি কাব্যগ্রন্থ. ২০০৭ সনে মুনিন বরকটকী পুরস্কার এবং ২০১২ সনে সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কার লাভ করেন।

কৃ্ষ্ণকায় মাঝি

১৯৬০ সনে কবি কৃ্ষ্ণকায় মাঝির শিবসাগরে জন্ম হয়। ২০১১ সনে কবির একমাত্র কাব্য সঙ্কলন ‘সুহৃদের হাত’ প্রকাশিত হয়।

নন্দসিং বরকলা

১৯৬৯ সনে কবি নন্দসিং বরকলার জন্ম হয়। ‘সুন্দর সময়র আহবান’, ‘ক’রবাত জোনাকর সমদল’ নিয়ে মোট আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিবর্ণ পান্থশালা এবং অন্যান্য’ নামে একটি কাব্য উপন্যাস, দুটি গল্প সঙ্কলন এবং ভূপেন হাজরিকার জীবন নিয়ে লেখা ‘গরিমা এবং প্রতিমা’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

হরেন গগৈ

১৯৭০ সনে কবি হরেন গগৈর জন্ম হয়। প্রকাশিত কাব্য সঙ্কলন ‘জোনাকতে জোরণ’, ‘বকুল তলর গান’, ‘দুপর টেঙা পাতর দরে’। ‘জীবন আরু কিছু বিক্ষিপ্ত’ নামে একটি গদ্য সঙ্কলনও রয়েছে।

রশ্মিরেখা বরা

১৯৭৫ সনে রশ্মিরেখা বরার জন্ম হয়। ২০১১ সনে ‘শিঙরাজানর রূপকথা’ নামে গল্প সঙ্কলনের জন্য মুনিন বরকটকী পুরস্বকার লাভ করেন। ভারত সরকারের জুনিয়র ফেলোশিপ লাভ করেন।

প্রজ্ঞানজ্যোতি

১৯৮৪ সনে জন্ম। ‘নরা পেঁপার মাত’ কাব্যগ্রন্থ।


[i] দেওধনি— অপদেবতা ভর করা মহিলা