Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তথাগতর চরণচিহ্ন: আম্রপালীর দেশে

অম্লান চক্রবর্ত্তী

 

হাজীপুর-লালগঞ্জ রোড থেকে উত্তর-পশ্চিমমুখী বৈশালী-বাখরা রোডে চলতেই সামনে দেখা হল তাঁর সঙ্গে। বয়স চল্লিশের বেশি হলেও বিগতযৌবনা নন, বরং রবি ঠাকুরের ভাষায় বলা চলে, “নগরীর নটী চলে অভিসারে যৌবনমদে মত্তা।” দীর্ঘাঙ্গী, তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা, উন্নত পীন এবং গম্ভীর নিতম্বের মধ্যবর্তী কটিদেশ যেন ক্ষীণস্রোতা নদীর ন্যায় আপন খেয়ালে বাঁক নিয়েছে। মদির টানা চোখ, বর্তুল দুই ঠোঁট। লাবণ্যকোমলতা সর্বাঙ্গে প্রতীয়মান। মনে হল কোনও কালচক্রের ঘূর্ণনে আমি আগত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। আমার সম্মুখে এই নারীই আম্রপালী। বৈশালীর নগরশোভিনী। চলেছেন তথাগতর শরণাগত হবার সদিচ্ছায়। তথাগতকে নিজগৃহে আহার হেতু নিমন্ত্রণ জানাতে। পার্শ্ববর্তী নীপশাখে সহসা এক কপোতযুগলের আদরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন তিনি। চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসলেন।

আমার ভ্রম ভাঙল। তথাগতর পথে চলার যে সংকল্প আমি নিয়েছিলাম, সেই হেতু আমি পৌঁছেছি বৈশালীতে। আগের দিন রাজগীর থেকে বাসে বখতিয়ারপুর হয়ে ট্রেনে পৌঁছেছি পাটনা। পাটনা থেকে বাসে পৌঁছেছি বৈশালী।

আম্রপালীর ভানুমতীতে প্রত্যাবর্তনের আগে একটু বৈশালীর ইতিহাস বলে নেওয়া অবশ্য কর্তব্য। বৈশালী নগরীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে একাধিক গল্প। এই নগরী ভারতীয় সভ্যতার এক সম্পদ। নগরীর পত্তন ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এই নগরীতেই ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম প্রজাতন্ত্র স্থাপন ঘটে লিচ্ছবি বংশের হাতে। বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বিশালের গড় থেকেই বৈশালী নামের উৎপত্তি। বিশাল রাজার সেই গড় আজ কালের গর্ভে। সামান্য কিছু ইষ্ট-প্রস্তরের কাঠামো শুধুমাত্র আজ অবশিষ্ট আছে। তার পার্শ্ববর্তী উন্মুক্ত ময়দানে আছে বহু উঁচু ঢিবি। বিশাল রাজার গড়ের বহু কারুকার্য্য আজও সেখানে বিদ্যমান বলে আমার ধারণা। ইটের পাঁজরের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এখানেই হয়তো জমায়েত হতেন রাজ্যের গণরাজাগন। নির্ধারিত হত নিয়মাবলি, শাস্তি হত অপরাধীর। আবার হয়ত সন্ধ্যায় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমাহার ঘটত। পরিবেশিত হত নৃত্যগীতি।

আম্রপালীর জন্ম এই নগরীতেই। শৈশবেই মাতৃ-পিতৃহারা হন তিনি। বড় হন মহানামভদ্রের গৃহে। অপার্থিব সৌন্দর্য্য এবং উপচে পড়া যৌবনের অধীশ্বরী আম্রপালীর বয়ঃপ্রাপ্তির পর রূপের ছটা এমন ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রথম দর্শনেই প্রেমে পরে যেতেন রাজা, রাজপুত্র, শ্রেষ্ঠী, নট, বীট। পাণিপ্রার্থীদের আগমন এবং প্রণয় প্রস্তাবে রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়েন মহানামভদ্র। বৈশালীর অবস্থা হয় গৃহযুদ্ধের ন্যায়। মহানামভদ্র নিজের দুশ্চিন্তার কথা নিবেদন করেন সংস্থাগারে। কামাতুর গণরাজাগণ এমনই সুযোগের সন্ধানে ছিলেন। রায় দিলেন, আম্রপালী নগরশোভিনী হওয়ার যোগ্য। “বহু পুরুষের অঙ্কশায়িনী” হওয়াই তাঁর নিয়তি। নিজের বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে ওঠেন মহানামভদ্র। আম্রপালী প্রথমে এই খবর শ্রুত হবার পর প্রস্তরমূর্তির ন্যায় স্থবির হয়ে যান। পরে প্রজাতন্ত্রের নিয়ম মেনে রাজি হলেও কিছু শর্ত আরোপ করেন। আগত পুরুষকে আপ্যায়নের সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের। সম্মত হন গণরাজাগণ। এবং তাঁদের উদ্দেশ্য অনেকাংশেই বিফল হয়। ক্রমে ক্রমে নৃত্য-গীত শিক্ষায় আম্রপালীর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। অন্যান্য রাজারাও আম্রপালীকে নিজ রাজ্যে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু অসফল হন। আম্রপালী ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্না। আর নারীর মনের নাগাল পেতে পুরুষেরা যুগে যুগে ব্যর্থ হয়েছে। মগধের রাজা বিম্বিসার নিজেও হন প্রত্যাখ্যাত। পরবর্তীতে তথাগতের মৃত্যুর পর অজাতশত্রু আম্রপালীর জন্যই বিশাল রাজ্য আক্রমণ করেন। এবং পতন ঘটে ভারতের প্রথম প্রজাতন্ত্রের।

বিশাল রাজার গড় ছেড়ে আমি অগ্রসর হলাম আরও উত্তরে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৈশালীতে জন্ম হয় চতুর্বিংশ তীর্থঙ্করের। আমরা যাঁকে চিনি মহাবীর জৈন নামে। বর্তমানে সেখানে একটি বিশালাকার জৈন মন্দির।

আমার পরবর্তী গন্তব্য বৈশালী স্তূপ। এই সেই ভূমি, যার জন্য আমার এখানে আসা। তথাগতর নিবাস ছিল যেই স্তূপের পাশে। এবং কুশীনগরে তাঁর মৃত্যুর পর দাহকার্য নির্গত ছাইয়ের কিয়দংশ এই মাটিতে রাখা হয়। তার উপর পরবর্তীকালে সম্রাট অশোকের হাতে নির্মীত হয় স্তূপ এবং সম্মুখে অশোকস্তম্ভ।

এই পথে অগ্রসর হয়েই স্থানীয় এক নারীকে আমি আম্রপালী ভেবে ভুল করেছিলাম। আমি চললাম স্তূপের সামনে। টিকিট কিনে স্তূপ কমপ্লেক্সের ভিতর প্রবেশ করলাম। বিশাল অর্ধগোলাকার এক স্তুপ। ইটনির্মিত। সম্মুখে বহু শ্রমণের সমাধি। আর এক পাশে সম্রাট অশোকের স্তম্ভ। স্তুপের পশ্চিমে স্বস্তিক চিহ্ন সদৃশ একটি বৌদ্ধ মঠের ভগ্নাবশেষ। বর্তমানে শুধু বাইরের সীমানাই অবশিষ্ট আছে। আর স্তূপের উত্তরে আছে সেই কক্ষ যেখানে অবস্থান করতেন ভগবান বুদ্ধ। জীবনের শেষ বছর তিনি এসেছিলেন বৈশালীতে। সে বছর বুদ্ধের শরীর ও মন ভালো নেই। তিনি বুঝতে পারছিলেন, সময় শেষ হয়ে আসছে। বহু নিমন্ত্রণ তিনি রক্ষা করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় আম্রপালী স্থির করলেন ভগবান তথাগতকে তাঁর গৃহে মধ্যাহ্নভোজের নিমন্ত্রণ জানাবেন এবং দর্শন লাভ করবেন। সম্মুখে এল বহু বাধা। তাঁর যৌবনের আগুনে পুড়তে আগত সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ নিষেধ জানালেন। খবর পৌছল রাজদরবারে। রাজা আদেশ দিলেন, আম্রপালী যেন বুদ্ধের সম্মুখে পৌঁছতে না পারেন। একদা যিনি ছিলেন, নগরের নয়নমণি, তাঁকে গণিকা হিসাবেই তিরস্কার করা হল। কিন্তু তিনি আম্রপালী। যাঁর রূপ, দেহবল্লরী, নৃত্যগীত এবং ব্যক্তিত্ব রচনা করে এক বিভোর বিভা। যা বহু বাধাকে জয় করতে জানে। অবশেষে আম্রপালী পৌঁছলেন বুদ্ধের কুটিরে।

অন্দরে প্রবেশের পর সম্মুখে জ্যোতির্ময় তথাগতকে দেখে স্থির হয়ে গেলেন আম্রপালী। সম্মুখে যেন দেবাঙ্গনের দিব্য পলাশ। প্রাজ্ঞ। প্রাজ্ঞ বলেই স্নিগ্ধ। কী অপার করুণাময় তাঁর চোখ। কে বলে পুরুষ পরুষ? রুক্ষ? অমার্জিত? কর্কশ? রিরংসায় উদ্যত? আসল পুরুষ তো সম্মুখে। এই পুরুষের জন্যই তো তোমার অপেক্ষা আম্রপালী। এই পুরুষের জন্যই তো জন্মজন্মান্তরের প্রতীক্ষা নারীর। বলিষ্ঠ কিন্তু কর্কশ নয়। ব্যক্তিত্বে লাবণ্য কিন্তু সঙ্গে দার্ঢ্যের মিশেল। চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন আম্রপালী।

সম্বিৎ ফিরতেই তথাগতের শ্রীচরণে নতজানু হয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালেন মধ্যাহ্নভোজের। সচকিত ভিক্ষুকগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল মৃদুগুঞ্জন। কারও চোখে ভর্ৎসনা, কারও বা তাচ্ছিল্য। শান্ত স্বরে শ্রমণ গৌতম নিমন্ত্রণ রক্ষা করার সম্মতি জানালেন। এবং আম্রপালীর সংঘে যোগদানেও তিনি সম্মত হলেন। একদা যে বুদ্ধ থেরীগণের সংঘে যোগদানে অসম্মত ছিলেন, আজ তিনি রাজি হয়েছেন।

বিজয়িনী আম্রপালী চললেন নিজ কুটিরে। আজ সত্যি তিনি জয়ী। বহু শ্রেষ্ঠী, রাজকর্মচারীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে অপারগ হয়েছেন তথাগত, কিন্তু আম্রপালীর অনুরোধ তিনি রক্ষা করতে সম্মত হয়েছেন। তাঁকে বরণ করেছেন সংঘে। এ তো আম্রপালীর সারা জীবনের জয়। তবু তাঁর মুখায়বয়বে উল্লাস নেই, স্পর্ধা নেই, পরিবর্তে ভোরের আকাশে প্রথম আলোর সংরাগ। ভগবান তথাগতর সেই কুটিরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমি যেন প্রত্যক্ষ করলাম সেই দৃশ্য। কতক্ষণ সেখানে ছিলাম মনে নেই। হয়ত অনন্তকাল। সম্বিৎ ফিরল, যখন পাহারাদার বললেন, “আভি দরওয়াজা বন্ধ হোগা”।


*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা