Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যে যাবে অনেক দূর তাকে বলি ধীর পায়ে হাঁটো

সৌমিত বসু

 



কবি

 

 

 

 

পবিত্রদাকে প্রথম কবে দেখেছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। তবে কুড়ি বছরের এক তরুণকে কবিতার পথ ধরে সস্নেহে চৌকাঠ থেকে ঘরে তুলে এনেছিলেন, এক অভিভাবকসুলভ সম্পর্ক দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে রচনা করেছিলেন যে যোগসূত্র এতদিন পর প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে আসার পর আজও তা অমলিন, আজও সেই সম্পর্কসুতো সমান উজ্জ্বল।

শিষ্য বলতে যদি আমরা কিছু বুঝে থাকি তাহলে সেই বয়সেই আমরা তা গ্রহণ করেছিলাম তাঁর কাছ থেকে এবং তা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র পবিত্রদার চরিত্রের আশ্চর্য গুণ আমাদের কাছে আমাদের মত করে নেমে আসার মধ্য দিয়ে। আমার সামান্য জীবনে কত এলসিএম কত সভাপতিকে দেখলাম বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছুড়ে ফেলে মাটির ওপর দিয়ে হাঁটতে, কত রাজনৈতিক সহযোদ্ধাকে দেখেছি মন্ত্রী হয়ে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াতে। অথচ রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন মানুষকে গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে একই ভাষায় কথা বলতে পারি, একই অশালীন হাসিঠাট্টার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কখনও হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় না।

পবিত্রদা মানে পবিত্রদা। সমস্ত প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্রুসজল আদ্যন্ত কবি, যিনি বাইশবার পড়ে গিয়েও তেইশবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। পবিত্রদা যদি আমায় সস্নেহে গ্রহণ না করতেন, যদি বীজমন্ত্রের মতো কবিতাকথনের ভেতর আমার দশটি বছর বয়ে না নিয়ে যেতেন, তাহলে মাথা উঁচু করে কবিতা লেখার প্রবণতা আমরা কবেই হারিয়ে ফেলতাম। পবিত্রদা বলতেন, যে যাবে অনেক দূর তাকে বলি ধীর পায়ে হাঁটো। এই যে এভাবে সেই প্রথম জীবনেই যে অহংবোধ ও মর্যাদাবোধ পবিত্রদা আমাদের আটের দশকের কয়েকজন বন্ধুর ভেতর চারিত করেছিলেন তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা আজও কবিতাকে নিয়ে মরণবাঁচন সংগ্রামে বেঁচে আছি, বেঁচে আছি কোনও কিছুকে পরোয়া না করেই।

সে সময় প্রতিদিন সকাল পাঁচটায় আমাকে ঘুম থেকে তুলে হাঁটতে বেরোতেন। আমাদের কালী লেনের গলি থেকে শুরু করে লেকের রাস্তা দিয়ে ঘুরে সে হাঁটা শেষ হত প্রতাপাদিত্য রোডে। পথে একবার জিলিপি খাওয়া আর অজস্র কবিতাকথন। নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করতে চেষ্টা, কবিতায় ধ্রুবপদ রচনা করা ইত্যাদি বিভিন্ন চেতনা যা আমি চিরটাকাল বুকে বয়ে বেড়িয়েছি তা পবিত্রদার কাছ থেকে শেখা। পবিত্রদার প্রভাবে জীবনের অসংখ্য দিন আমাদের কেটেছে যেখানে সারাদিন কবিতা ছাড়া কোনও কথা আমরা উচ্চারণ করিনি। গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা আমি ও আমার ভাই (সৌমেন বসু)-এর কাছে পবিত্রদাই ছিলেন অভিভাবক। পবিত্রদাই আমাকে হাত ধরে কবিতা পড়াতে নিয়ে গিয়েছেন আকাশবাণীতে, প্রতিক্ষণে, অমিতাভ দাশগুপ্তের পরিচয় অফিসে। আমাকে নিয়ে অন্তত কুড়িটি গদ্য লিখেছেন, কানের কাছে নিরন্তর সাহস জুগিয়ে বলে এসেছেন ‘তোমার হচ্ছে’। ভরসা করে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন “কবিপত্র” সম্পাদনার ভার। এ প্রশ্রয় ষাটের অন্য কবিদের কাছ থেকে পাওয়া আমাদের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। এক মঞ্জুষদা ছাড়া।

জীবনানন্দ পরবর্তী কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং দরদী কবি নিঃসন্দেহে পবিত্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর কবিতায় যেমন সময়ের চাকায় চূর্ণ মানবজাতির অসহায় আর্তস্বর শুনতে পাই আবার অন্যদিকে পাই অনন্ত আশার আশ্বাস। শবযাত্রা, ইবলিশের আত্মদর্শন কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়কে একজন প্রকৃত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলেও ব্যক্তিগতভাবে আমি তার সনেটের অত্যন্ত ভক্ত। অসীমার প্রতি সনেটগুচ্ছ একটা সময় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। কবিতার অজস্র খুঁটিনাটি ব্যাকরণ আমি ও আমার বন্ধুরা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি। মেধা ও মননকে কীভাবে ঋদ্ধ করতে হয় সেই পাঠ তাঁর কাছ থেকেই নেওয়া। দীর্ঘজীবন পেরোতে পেরোতে জেনেছি কিছু কিছু ঋণ যা চেষ্টা করেও শোধ করা উচিত নয়। তেমনি পবিত্রদার মত কিছু মানুষ যাঁর কাছে আমার আমৃত্যু ঋণ থাকার মধ্যে এক অলৌকিক আনন্দ রয়েছে। আমি এই আনন্দের রেশটুকু নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।

পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের মহাকবিতা এক অনন্য সৃষ্টি। মাইকেল মধুসূদনের পর এই অন্যতম নতুন লিখনভঙ্গিমা বাংলা সাহিত্যে স্বকীয়তার দাবি রাখে। ইতিহাস, পুরাণ ও মিথের সার্থক ব্যবহার সমসময়ের ভেতর দিয়ে চালিত করার দক্ষতা অনির্বচনীয়। পবিত্রদার রচনা, আঙ্গিক এবং আবহনির্মাণ অত্যন্ত অনুভূতিগ্রাহ্য এবং পরস্পরের পরিপূরক। অস্তিত্বহীনতার ওপর দাঁড়িয়ে তিনি কখনও ছায়া নির্মাণ করেননি বরং দর্শনের বিমূর্ততাকে তিনি কাব্যে মূর্ত করে তুলেছেন। দর্শনের জ্ঞানগর্ভতা তার কাব্যে কখনওই প্রধান হয়ে ওঠেনি।

পরিণত বয়সে তাই আগুনসন্ন্যাসী এই মানুষটি প্রসন্ন কৌতুকে গ্রহণ করতে পারেন জীবনের সকল সফলতা ও স্খলন।

তিনি বলেন—

কবির বার্ধক্য নেই, জীর্ণ তাকে করে না সময়,
বয়স ক্রমশ প্রাজ্ঞ করে তোলে, স্বচ্ছ ও নির্ভার
হতে থাকে দৃষ্টি ও শরীর তার, অর্থহীন জয় পরাজয়
বুঝে নিয়ে, ভারমুক্ত জ্বলন্ত আত্মার
আলোয় সে পথ করে নেয়, যেতে হবে বহুদূর।

আজ তিনি চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারি কত মানুষ প্রতীক্ষা করেছিল তাঁর কবিতায়, তাঁকে তো পৌঁছতেই হবে মগ্ন পথিকের সেই অভিযাত্রায়। আমাদের মতো রেখে যাওয়া অসংখ্য গুণমুগ্ধরা সেই অভিযাত্রার দিকে সানন্দে চেয়ে থাকব বাকিজীবন।

আজও যখন শনিবার রাতে কফিহাউজ থেকে সেন্ট্রাল স্টেশনের পথে কিংবা রোববার সকালে সাদার্ন অ্যাভেনিউতে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে থাকি তখন নিরন্তর মাথার মধ্যে বেজে ওঠে তাঁর গভীরতর সমস্ত কবিতাকথা যা নিরন্তর নিজের বোধবিন্দুকে আলোড়িত করে এবং বাড়িতে ফিরে গিয়ে লেখার টেবিলের সামনে এনে দাঁড় করায়। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই এমন একজন মানুষকে আমার জীবনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্য।