মানস প্রতিম দাস
বিজ্ঞান-বিষয়ক নিবন্ধকার ও সম্প্রচারক
সেটা ২০০৭ সাল। ডক্টর অমিত চক্রবর্তী একটা প্রস্তাব দিলেন আমাকে। কয়েকটা বছর আকাশবাণী কলকাতার অধিকর্তা ছিলেন তিনি। আবার, বিজ্ঞান বিভাগের পথচলা শুরু তাঁর এবং সমবয়সি আরও কয়েকজনের হাত ধরে। অবসর নেওয়ার নির্ধারিত বয়সের আগেই চাকরি ছেড়ে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে যোগ দেন তিনি। একইসঙ্গে বিজ্ঞান প্রসারের ফেলো হয়েছিলেন। বিজ্ঞান প্রসার ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের অধীন স্বশাসিত সংস্থা। তারা চেয়েছিল অমিতদার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কিছু কাজ করতে। বেছে নেওয়া হল আকাশবাণীকে, অমিতদা জিজ্ঞাসা করলেন যে তেরোটা কল্পবিজ্ঞানের নাটকের একটা শৃঙ্খলা আমি প্রযোজনা করতে পারব কিনা! ভয় হল, আগে এমন কাজ কখনও করিনি। স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে অমিতদা বললেন, করলে তুমিই করতে পারবে আর নয়ত আমি বাতিল করি প্রোজেক্টটা। তখন আর ‘হ্যাঁ’ বলা ছাড়া আর উপায় কী! যাই হোক, প্রথমে বাছতে হবে তেরোটা গল্প। সেটা খুব সহজ কাজ নয়। বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রটা যে খুব বিশাল কিছু তা নয়। তবু অনেকেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন এই কাজে। তাঁদের মধ্যে তেরোজনকে বেছে নেওয়ার কাজটা কতটা সহজ হবে সেটাই ভাবছিলাম মনে-মনে। বিস্তারিত ব্যবস্থা নিয়ে, কমিটি গড়ে বাছার কাজ করতে গেলে সেটা সময়সাপেক্ষ হবে। তাছাড়া এভাবে সন্তোষজনক তালিকা পাওয়া যায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাই স্পনসর সংস্থা অর্থাৎ বিজ্ঞান প্রসারের ডক্টর সুবোধ মহান্তি, অমিতদা এবং আমি মিলেই নির্বাচন শেষ করলাম। কিছু গল্প খুব পছন্দ হলেও বাদ দিতে হল কারণ লেখক প্রয়াত এবং আকাশবাণীর নিয়ম অনুযায়ী যৎসামান্য রয়্যালটি তুলে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত উত্তরাধিকারী খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। গল্পের তালিকাতে আমরা রাখলাম অনীশ দেবের গল্প ‘বুদ্ধি যদি বৃদ্ধি পায়’। নিজের সম্পাদিত ‘সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান’-এ তিনি জায়গা দিয়েছিলেন এই গল্পকে। আমাদের ভালোলাগার সঙ্গে লেখকের নিজের পছন্দ যুক্ত হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনে সুবিধে হল।
এর আগে কয়েকবার আকাশবাণীর বিজ্ঞান বিভাগের জন্য কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখেছেন অনীশ দেব। কিন্তু এবার বিষয়টা আলাদা, তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে প্রকাশিত গল্প বেতার নাটকে রূপ দেওয়ার ব্যাপারে। আগে থেকে ফোনে কথা বলে নিয়ে গেলাম রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে। ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একতলায় তাঁর ল্যাবরেটরি। বিজ্ঞান কলেজের মধ্যেই ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছি বহু দিন ধরে। মিটিংয়ে যাতায়াতের পথে তাঁর বিভাগের সামনের খোলা জায়গাতে অনীশবাবুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি অনেকবার। কিন্তু কথা বলা হয়নি, কী প্রসঙ্গ দিয়ে আলোচনা শুরু করব এই সঙ্কোচে। এবার ঘরে ঢুকে কথা হল। কয়েক মিনিটের জন্য। সই দেওয়ার আগে আর একবার জিজ্ঞাসা করলেন যে কোন গল্পটা নিচ্ছি। দেখলাম, ফোনের বার্তালাপ স্মৃতিতে নেই। গল্পের নাম ফের বলাতে ‘ও আচ্ছা’ উচ্চারণ করলেন। আমি তাঁর কাজের ব্যাপারে একটু আলোচনা করতে চাইলাম, সেটাও বেশি দূর এগোল না। ভেবেছিলাম বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার কাজ করেন, হয়ত কথা বললে সাড়া পাব। সেটা হল না। অনেকেই অবশ্য মিতভাষী হন, এই ভেবে আর উদ্যোগ নিইনি বার্তালাপের।
আমাদের কল্পবিজ্ঞানের নাটকের শৃঙ্খলা বেশ ভালো হয়েছিল। তখন কম্পিউটারে এডিট করার চল এসে গিয়েছে, রেকর্ড করা জিনিসপত্র বাড়িতে এনে দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা করতাম যাতে কাজটা নিখুঁত হয়। কিশোরদের জন্য রচিত অনীশ দেবের অন্যান্য কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মতই এর মধ্যেও মজা ছিল বেশি, কিছু পরিভাষার উল্লেখ বাদে বিজ্ঞানের কোনও খুঁটিনাটির আলোচনা ছিল না। পরিবারের দুই ছেলের মধ্যে একজন অঙ্কে কাঁচা আর তাই নিয়ে তাদের বাবা খুব বিরক্ত এবং উদ্বিগ্ন। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা কাঁচা বুদ্ধির সন্তান বিকুনকে নিয়ে গেলেন বুদ্ধি বিকাশ কেন্দ্রে। সেখানে ডাক্তার অদ্ভুত সব কাজ করে বুদ্ধি বাড়ানোর প্রাথমিক সেটিং করে দিলেন মাথার মধ্যে। বাহাত্তর ঘন্টা পরে হবে চূড়ান্ত ‘ঢালাই’! যে ছেলে কবিতা আবৃত্তি করে, ছবি আঁকে আর অঙ্ক থেকে সরে থাকে সে ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়েই বিজ্ঞানের পরিভাষা আওড়াতে শুরু করল, সংক্ষেপে ব্যাখ্যাও দিল। রান্নাঘরে মাকে আর পড়ার ঘরে ভাইকে বিজ্ঞান সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। রেহাই নেই বাবারও। গোটা পরিবারের তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র অবস্থা। সবার অপেক্ষা যে কখন বাহাত্তর ঘণ্টা কেটে গিয়ে বিকুনের আগের কম-বুদ্ধির অবস্থা ফিরে আসে। তাই ঘটল এবং বাবা বিকুনকে আদর করে বললেন যে আর বুদ্ধি বাড়িয়ে কাজ নেই, তার এইরকম ছেলেই ভালো! সব মিলিয়ে আর বারোটা নাটকের মতই সমাদর পায় ‘বুদ্ধি যদি বৃদ্ধি পায়’। এর আগে অনীশ দেবের কোনও গল্প সম্ভবত বেতার নাটকের রূপ পায়নি।
এর পর সর্বজনীন সভায় অনীশবাবুর সঙ্গে আর কয়েকবার দেখা হলেও সেটা মনে রাখার মত কিছু নয়। উনি নিশ্চয়ই আমাকে মনে রাখেননি আর তাই আমার সম্ভাষণের উত্তরে হেসে দুটো কথা বলা ছাড়া আর কোনও বার্তা ছিল না ওঁর পক্ষ থেকে। ২০১৯ সালে আমি আকাশবাণীর শিলিগুড়ি কেন্দ্রে কর্মরত। ফোনে অনুরোধ পেলাম কল্পবিজ্ঞানের একটা বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার। পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুকস্টোরে নির্ধারিত দিনে উপস্থিত হয়ে দেখলাম যে অন্য দুই আলোচক, অধ্যাপক পুরুষোত্তম চক্রবর্তী এবং অধ্যাপক অনীশ দেব আগেই উপস্থিত। অনীশবাবু যথারীতি চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে, কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। আমি আগ বাড়িয়ে নিজের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তিনি এবারও ঠিক মনে করতে পারলেন না আমাকে। যাই হোক আলোচনা শুরু হল সেদিনের প্রকাশিতব্য বই ঘিরে এবং সবাই নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী বক্তব্য রাখলাম। আমি এবারও একটু প্রগলভ হলাম, বাংলা কল্পবিজ্ঞানে অনীশ দেবের অবদান সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ভাষায় কিছু বললাম। স্বাভাবিক সৌজন্যে নিজের বক্তব্যের সময় সেই উল্লেখকে স্বীকার করে অনীশবাবু বলেন যে তাঁর সম্পর্কে বেশি বলা হয়েছে। এত প্রশংসাবাক্যের যোগ্য নন তিনি। একটা জিনিস মনে হল যে উপস্থিত দর্শকরা অনীশ দেবের লেখালেখির সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নন। সেটা হলে তাঁকে ঘিরে ধরে আলাপ করার একটা আগ্রহ চোখে পড়ত। যাই হোক, এক সময় শেষ হল আলোচনা এবং গ্রন্থপ্রকাশ পর্ব। পা বাড়ালাম বাড়ির পথে। তার পরে হঠাৎ, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাঝে, ২৮শে এপ্রিল পেলাম তাঁর চলে যাওয়ার খবর। সত্তর বছরে জীবন শেষ হল তাঁর, একজন লেখকের পক্ষে বয়সটা নেহাৎই কম।
পাঠক হিসাবে আমি যে অনীশবাবুর সব লেখার ভক্ত তা নয়। সেটার কারণ নিয়ে অন্যত্র আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলা কল্পবিজ্ঞানের রচনায় তাঁর স্থান কেউ কোনওদিন অস্বীকার করতে পারবে না। প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪–১৯৮৮) গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা কল্পবিজ্ঞান কাহিনি রচনার ভিতটা। সেখানে সৌধ গড়লেন অদ্রীশ বর্ধন (১৯৩২–২০১৯), সঙ্গে পেলেন সত্যজিৎ রায়কে (১৯২১-১৯৯২)। মূল্যবান অবদান রেখেছিলেন আরও কয়েকজন যাঁদের মধ্যে ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, বিমলেন্দু মিত্র প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে কল্পবিজ্ঞান লেখার দায়িত্ব অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন অনীশ দেব (১৯৫১-২০২১)। অনেকেই নির্দেশ করতে পারেন যে দায়িত্ব পালন করার জন্য কেউ লেখক হন না, অনীশবাবু নিজেও তাই মনে করতেন। কিন্তু সময়ের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ‘দায়িত্বের’ উল্লেখ করলে সেটা দোষের হবে না। এই একই সময়ে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের বিস্তৃত ও লোকগ্রাহ্য ক্ষেত্রে পদচারণা করে খ্যাতিমান হয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যেও কেউ-কেউ কলম ধরেছেন কল্পবিজ্ঞানের জন্য। সেই সব প্রচেষ্টা কতটা রসোত্তীর্ণ হয়েছে তা বিতর্কের বিষয়। শক্তিশালী কবি ও গদ্যকার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কল্পবিজ্ঞানের বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন যা পরে সঙ্কলিত হয়েছে ‘কিশোর কল্পবিজ্ঞান সমগ্র’তে। ভূমিকায় তিনি যা লিখেছেন তার মধ্যে একটা অংশ বেশ নজর কাড়ার মত। বলছেন, ‘বাংলায় বয়স্ক পাঠকদের মত এখনও কোনও সার্থক বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস রচিত হয়নি। ছোটদের জন্য লিখেছেন কেউ-কেউ, তবে সেগুলি ঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা নয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে, কল্পবিজ্ঞান। অর্থাৎ বিজ্ঞানের একটু আভাসমাত্র আর অনেকখানিই কল্পনা। এই কল্পবিজ্ঞানই এ যুগের রূপকথা। আমিও ছোটদের জন্য সেরকম কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি অনেক লিখেছি। এসব কাহিনিতে ছোট ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান শেখাবার কোনও চেষ্টা নেই কিন্তু বিজ্ঞান সম্পর্কে তাদের কৌতূহল ও আগ্রহ জাগানোই আমার উদ্দেশ্য। কাহিনিগুলিকে আকর্ষণীয় করার জন্য আমি বিশ্বমামা কিংবা নীল মানুষের মতন চরিত্র সৃষ্টি করেছি।’ তা তেমন চরিত্র সবাই সৃষ্টি করেছেন বোধহয়। অদ্রীশ বর্ধন তৈরি করেছেন প্রফেসর নাটবল্টু চক্র আর অনীশ দেব এনেছেন যমজ দু ভাই চন্দ্রকান্ত আর ইন্দ্রকান্তর ছোটকাকে। এমন একজন সবজান্তা নায়ক আনার ক্ষেত্রে লেখক কতটা সচেতন তা বলা মুশকিল। তিনি হয়ত অজান্তে সায়েন্স কমিউনিকেশনের ডেফিসিট মডেল অনুসরণ করেন যেখানে ধরে নেওয়া হয় যে জনগণ বিজ্ঞান-মূর্খ আর তাদের অজ্ঞতা দূর করতে পারেন একজন বিজ্ঞানী, লিখে বা বলে। কিশোর গল্পের ছোটরা বা কিশোররা হল সেই জনগণের প্রতিনিধি। গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে এমন অভাব মেটানোর তাড়না নেই। সব পাঠক না হলেও অধিকাংশই লেখকের বলা মানবিক আবেগের বিষয়টা বুঝে যাবেন বলে মনে করা হয়। যাই হোক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্যের অন্য অংশটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সার্থক বিজ্ঞানভিত্তিক উপন্যাস রচিত না হওয়ার বিষয়টা নিয়ে আক্ষেপ বোধহয় খুব একটা অসঙ্গত নয়। কিন্তু ছোটদের জন্য লেখাতেও বিজ্ঞানের ভিত্তির অনুপস্থিতি নিয়ে তাঁর দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন কেউ-কেউ। আবার, এর ঠিক পরেই ‘আমিও করেছি’ বাক্যে কেমন যেন একটা সঙ্কটের ছায়া চোখে পড়ে। নিজের লেখার জন্য কি সুরক্ষার বর্ম তৈরি করলেন তিনি?
বস্তুতপক্ষে কল্পবিজ্ঞানের ময়দানে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানী আর সাহিত্যিক একে-অন্যের দিকে আঙুল তুলতে পারেন অনায়াসে। সাহিত্যিক আনবেন সাহিত্যরসের অভাবের অভিযোগ আর বিজ্ঞানী বলবেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধের অভাব সম্পর্কে। কিন্তু যেহেতু পাঠককে সন্তুষ্ট করা বা অনুপ্রাণিত করা দুজনেরই লক্ষ্য তাই ‘কল্পবিজ্ঞানের’ নামে একটা আপসের জায়গায় পৌঁছতে হয় দুজনকে। অনেক সময় দেখা যায় যে বিজ্ঞানীই ছেড়ে দিয়েছেন বিজ্ঞানের পথ, ভেসে গিয়েছেন কল্পনার দমকা হাওয়ায়। জগদীশচন্দ্রের ‘পলাতক তুফান’ তো এর এক বড় উদাহরণ। আবার প্রায়শই দেখা যায় যে চলতি ধারণার বশবর্তী হয়ে বিজ্ঞানী আর সাহিত্যিক দুজনেই বলছেন যে বাঁদর হল মানুষের পূর্বপুরুষ! তাহলে কি বিজ্ঞানী আর সাহিত্যিকের কল্পবিজ্ঞান রচনায় কোনও পার্থক্য নেই? দায়িত্ব নিয়ে হ্যাঁ বা না বলা কঠিন। তবে রচনার দীর্ঘ পরিসরে বিজ্ঞানী ছাপ রেখে যান নিজের রচিত কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে। অনীশ দেবও তাই করেছেন। তিনি লেখা শুরু করেছিলেন গত শতকের ষাটের দশকের প্রথম দিকে। শতাব্দী যখন শেষ হতে চলল তখন তাঁর পরিচয় কেবল কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা নয়। তিনি ভূতের গল্প এবং রহস্য উপন্যাসও লেখেন। ইউটিউবে ভেসে বেড়ানো অসম্পাদিত এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে গল্প কোথা থেকে কোথায় গিয়ে যে পৌঁছবে তা আগে থেকে ঠিক করতে পারেন না তিনি। কল্পবিজ্ঞান লিখতে লিখতে ভিড় করে এসে পড়ে ভূতের দল। ফলে পরিণাম আগে থেকে বলা কঠিন! শুনে বেশ বিস্ময় জাগে বৈকি! সাহিত্যিক আর বিজ্ঞানীর ভূমিকার গোলমালটা যাও বা সমাধান করা যায়, এটা যেন মানা যায় না। কিন্তু লেখককে নির্দিষ্ট কিছু পাঠকের সেন্টিমেন্ট বুঝেই চলতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি যদি জনপ্রিয়তা পান কল্পবিজ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু লিখে এবং সেটা যদি তাঁর ভালো লাগে তবে সেটাই হতে পারে স্বাভাবিক গতিপথ।
১৯৮৬ সালে কল্পবিজ্ঞান লেখক এবং পেশায় ইঞ্জিনিয়ার সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রকাশ করেছিলেন বাংলায় প্রথম কল্পবিজ্ঞান সংগ্রহ। সেখানেও তিনি উচ্চারণ করেছেন এক প্রচলিত আক্ষেপের কথা— ‘অনেকের ধারণা বাংলা সায়েন্স ফিক্শনের এখনও কিশোর দশা কাটেনি।…’ সেই ধারণায় সম্পাদকের সমর্থন ছিল কি না সেটা অবান্তর। ধারণাটা জোরদার এবং তথ্যভিত্তিক না হলে তিনি এটা উচ্চারণ করতেন না। এই সঙ্কলনে জায়গা পেয়েছিল অনীশ দেবের রচনা ‘নীলবর্ণ বিড়াল’। সম্পাদকের উচ্চারণ মানলে তিনিও অর্থাৎ অনীশবাবুও এই কৈশোর দশাকেই প্রসারিত করেছেন। এটা যদি সত্যি হয় তবে তা জাতি হিসাবে বাঙালির জন্য সত্যি, কোনও একজন লেখকের ত্রুটি নয়। বরং আমরা বলতে পারি যে অনীশ দেবের কলম সচল না থাকলে বাংলা কল্পবিজ্ঞানে একটা মারাত্মক শূন্যস্থানের সৃষ্টি হত। বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাইতেন তিনি আর তাই অনীশ দেব লিখেছেন পাই নিয়ে রূপকথা, রোমাঞ্চকর ধূমকেতু, সহজ কথায় রোবট, সহজ কথায় ইন্টারনেট ইত্যাদি বই। এর একটাও কল্পবিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের বাস্তব রূপ। কিন্তু বাস্তবের সীমা ছাড়িয়ে অনির্দিষ্ট সুদূরে বিজ্ঞানের যে প্রসার সেখানে পাঠককে নিয়ে যেতে তাঁর হাতিয়ার হয়েছে কল্পবিজ্ঞান। সেখানে তাঁর অবদান ভোলার নয়। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের শ্রদ্ধেয় কাহিনিকার হিসাবে চিরকাল স্মরণ করা হবে তাঁকে।