শুভদীপ চক্রবর্তী
মোরা ভোরের বেলায় ফুল তুলেছি…
এত তীব্র দহন, সারাদিন ভিজিয়ে যায় স্বেদ নির্ঝর। ধুলো শরীরে হাঁটতে হাঁটতে শ্রাবণ প্রার্থনা করা হয়ে যায় সহনাগরিকদের সঙ্গে। বিরক্তি আসে না তবু। সকালের প্রার্থনার পর প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথা মনে আসে: শীত ভাল, গ্রীষ্ম ভাল, বর্ষা ভাল। কঠিনের মধ্যেও ভাল খুঁজে নেওয়ার শিক্ষাই বড় সব থেকে। আর কিছু সেভাবে শেখানোর আগেই অবসরে গিয়েছিলেন যিনি, মনের মধ্যে গেঁথে দিয়ে একটা সহজ সহনশীলতার বীজ।
সেই বীজ থেকে শস্য সবুজ বা সোনালি হবে, এমন আশা করতে করতেই তারপর বেড়ে গেছে পিঠের ব্যাগের ওজন। দহন দিনের পর এখন ভীষণ হাওয়া দিলে বাইরে, সারা শরীর শিরশির করে ওঠে আচমকা ভোর রাতে। একবার হঠাৎ ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছা হয় জলঙ্গি নামের নদী। ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছা হয় হাওয়াদের ফিসফিসে শোনা পরশপুর চর; গ্রামের স্কুল। সকালের প্রার্থনা ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছা হয়।
ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছা হয়, কারণ রোজ মনে হয় পিঠে ঝাঁকা-মুটে বেঁধে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে সব বাঁশিওলাদের দল। তাদের ভিড়ে বোঝাই লোকাল ট্রেনের ভেন্ডর কামরা। যেমন আজকাল বিকালের বাস থেকে মুখ বাড়ালেই দেখতে পাই, সোঁদা দেওয়ালের থেকে উঠে আসছে স্থবির জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকার মতো খিদিরপুর। জল জমে ছলছল হয়ে আছে চক্ররেলের প্ল্যাটফর্ম। যেন কাউকে দূর গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার ট্রেন ছাড়বে এখান থেকেই। নীচে ধুলো ওড়া রাস্তার খানাখন্দেও জল জমে আছে গত দুপুরের বৃষ্টির, যেদিন বাইশে শ্রাবণ। আচমকা সেই গর্তে বাসের চাকা ছুঁয়ে গেলে, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকার স্মৃতির মতো কাদা জল এসে লাগে গায়ে। ঘোর কেটে যায় খানিক। বুঝতে পারি, ইয়ারফোনের গানে গানে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তা; অথচ কোথায় যে তার ঘর কে জানে! পিছনের সিট থেকে টিনেজ প্রেমিক-প্রেমিকা নেমে গেছে কখন যেন। এদিকে নামব-নামব করেও কখন থেকে, আমাদের নামাই হচ্ছে না আর। এদিক-ওদিক চঞ্চল ঘোরাফেরার মধ্যে, প্রতিটা ব্যর্থ ইন্টারভিউয়ের পর, কাজের কাজ বলতে হচ্ছে শুধু মেয়ের বিয়ের জন্য যোগাড়যন্ত্র করতে ঘুরে বেড়ানো অন্ধ মানুষকে ধরিয়ে দেওয়া নিউটাউন-আন্দুলের বাস। তারপর দাঁড়িয়ে থাকা, লবণহ্রদের হাওয়া গায়ে মেখে নিয়ে।
এসব দাড়িয়ে থাকার মধ্যে পার হয়ে যাওয়া আছে একটা যুগ। একটা যুগাবসান আছে। পিচ থেকে ছোঁয়ানো হাত মাথায় ঠেকিয়ে ফিরে আসা আছে সচিন তেন্ডুলকারের। হু হু কান্না বন্ধুর সবুজ টি-য়ের পিঠে চেপে যুবভারতী ফেরত হাহাকার বিকেলে থামিয়ে দেওয়া আছে হো হো উল্লাসের ম্যাটাডোর। দু টাকার বিস্কুট চায়ে ডোবানোর আগেই ভেঙে নামিয়ে দেওয়া আছে সাদাকালো পথকুকুরের মুখে। তারপর একটা বসে থাকা আছে অবিরাম। বসে বসে ভাবতে থাকা আছে মেঘদূত। বিরহী যক্ষিণী। চাকার মতো পিষে যাওয়া দিনের অভিমুখে কি অপেক্ষায় বসে আছে সেও, আচমকা কোনও সুসংবাদের আশায়?
মনের ভিতর বাষ্প পাকিয়ে উঠলে, দুপুরের মেঘও তার ভাগ নেয় খানিকটা। খানিক চঞ্চলতা মিশে যায় সামনের চলনে। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পাই, ওপারে বৃষ্টি নামে খুব। এপারে এগোতে এগোতে লবণহ্রদের মাঝামাঝি এসে থেমে যায় আবার। আমিও মোমিনপুর-খিদিরপুরের কথা ভাবতে ভাবতে ছেড়ে দিই একের পর এক যাদবপুরের বাস। বুঝতে পারি আজীবন শুধু পাহাড় জঙ্গল আর নীরবতা ভালবাসা ছেলেটা, এই মুহূর্তে সমুদ্রে যেতে চাইছে খুব। ছুঁয়ে দেখতে চাইছে অনর্গল ঢেউয়ের শব্দে ভেঙে যাওয়া বাতিঘরের নীরব ঔদাসীন্য। সেই ঔদাসীন্য মেখেই সন্ধের আলো নিয়ে নেমে পড়ি যাদবপুর থানা। সামনের ফুটপাথে বসে সিগারেট ধরাই। দেখি ক্রসিং পার করে চলে যাওয়া অজস্র গাড়ি হলুদ ট্যাক্সি খয়েরি প্যান্ট পরা পা। আমার সঙ্গেই চুপ করে বসে থাকে সারাদিন ধুলো আর কার্বন খাওয়া প্রাচীন অশ্বত্থ, বৃষ্টি ছাড়া যাকে এই শহরে আর স্নান করিয়ে দেওয়ার কেউ নেই।
অথচ ভক্তিবাদের কমতি নেই একটুও। অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় কেউ রেখে গেছে বেল ফুল কলকে ফুল হলদে গাঁদা। একদম কাছে মুখ নিয়ে গিয়েও সেই ফুলেদের থেকে গন্ধ পাওয়া যায় না কোনও। শুধু সেই গাছের গায়ে পোঁতা, জ্বলতে জ্বলতে ছোট হয়ে আসা দুটো ধুপকাঠির সুবাস ক্রমশ ঘিরে ফেলতে থাকে আমাকে। ভোর রাতের স্বপ্নের স্থবির জাহাজটাকে দেখতে পাই আবার। দেখতে পাই আর মনে করি, সিগারেট ধরালেই পুরনো বন্ধুদের কথা মনে করা আসলে, বয়স বেড়ে যাওয়ারই নামান্তর।
বসে বসে বুঝতে পারি, মাথার মধ্যে রেডিও টিউন করতে থাকে কেউ। বাজতে থাকে বাইশে শ্রাবণ। সেই মুহূর্তে সব ভুলে কোনও এক ঠাকুরকে বন্ধু মনে হয় খুব নিজের। মনে হয় ঘুরে বেড়াচ্ছি দুজনে সুদূর স্কটল্যান্ডের কোনও মাঠ-ঘাট-ভেল্ড। আর কোনও গাছের আড়াল থেকে ভেসে আসা একটা গানের সুর আমাদের উদাস করে দিচ্ছে ভীষণ। ভালবেসে আমাদের খুব খুব ইচ্ছা করছে নতুন করে সেজে উঠতে; তোমাদের সামনে দঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছা করছে—
অ্যান্ড সিওরলি ইউ’ল বি ইয়োর পিন্ট-স্টুপ
অ্যান্ড সিওরলি আইউ’ল বি মাইন!
অ্যান্ড উই’ল টক আ কাপ অব কাইন্ডনেস ইয়েট
ফর অল্ড ল্যাঙ্গ সাইন!