Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সেই সব ছেঁড়া পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাওয়াই চটি পরা পাগলগুলি এখন কোথায়?

শৈলেন সরকার

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

বোমা-বারুদ বা ট্যাঙ্কের ব্যবহার বাদে হয়েছে সবকিছুই। মানুষ খরিদের জন্য কোটি কোটি টাকা, যার কাছে বিচার চাইতে যাবেন সেই নির্বাচন কমিশনকে বগলদাবা করে রাজ্য জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সঙ্গে হাজার-হাজার সেপাই-সান্ত্রী, গুচ্ছ গুচ্ছ মুখ্যমন্ত্রী। হেলিকপ্টার আর সাড়ে ষোলশো কোটির প্লেনে দিল্লি থেকে বাংলা ডেলি প্যাসেঞ্জারি। আর রবীন্দ্রনাথ সাজা সাদা দাড়ি নিয়ে মিচকে চোখে বুক কাঁপানো ডাক, দিদি… ও দিদি—। যুদ্ধ দু মাসের, প্রস্তুতি ছিল অন্তত দু বছরের। বা তা-ই বা কেন, আসলে উত্তরভারতের গো-বলয়ের বাংলা দখলের সাধ বহু দিনের। হ্যাঁ, যুদ্ধের ডাক ছিল গো-বলয়ের, উদ্দেশ্য বাংলা দখল। সমান্তরালে সামাজিক মাধ্যমে তুমুল প্রচার। উদ্দেশ্য বাংলায় থাকা মীরজাফরদের হাতে নিয়ে যুদ্ধের আগেই কোমর ভেঙে দেওয়া। এত মীররজাফর যে বাংলায় ছিল তা আগে কে জানত? বা রাজাকার? হ্যাঁ, সেই একাত্তরের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যেমন বাংলাদেশের ভিতরেই থাকা বাঙালি পাকপন্থীদের বাহিনি, ছিল তারাও। যেন ১৭৫৭-র পর আর এক স্বাধীনতার যুদ্ধ। যেন আর এক পলাশী।

অনেক কাল পর জাতি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি যেন স্মৃতি ফিরে পেল। নেতৃত্বে এক মহিলা থাকলেও গোটা রাজ্যই একেবারে এককাট্টা হয়ে লড়েছে। বর্গিরা বলতে গেলে পালাবার পথ পায়নি।

পালাবার পথ না পেলেও পালিয়েছে। কিন্তু ক্ষত রেখে গেছে। রেখে গেছে কিছু মিইয়ে পড়া মীরজাফর, কিছু রাজাকার। সব যুদ্ধেরই যেমন কিছু ক্ষত সারানো যায় না কিছুতেই। সুযোগ পেলেই দুর্গের পেছনের দরজা খুলে—। হ্যাঁ, সেই তারা তো রয়েই গেছে। আর তাই এত বড় এক যুদ্ধ জয়ের পর পরের যুদ্ধ ঠিক কত দূরের বুঝতে পারা যাচ্ছে না। শত্রুদের পোষ মানা মীরজাফর আর রাজাকাররা কিছু দিন চুপচাপ থেকেই ঠিক নতুন কোনও পরিচয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে হাঁক পাড়বে।

আমাদের ছোটবেলায় এক কমিউনিস্ট পার্টি ছিল, কাজ না থাকলেও দিনে একবার খোকাদা বা সোনাইদা বাড়ি ঘুরে যেত একবার। বলত, বৌদি, ঠিক আছে সবকিছু? ঠিক আর কীভাবে থাকে? তখন তৈরি হতে থাকা কলোনির দিনরাত্রি। মা বলবে, রেশন ওঠেনি এখনও ঠাকুরপো। কাজ নেই তো তোমার দাদার। না, সবকিছু তো আর ঠিক হত না, কিন্তু কিছু হত। পাশে কেউ আছে জানতাম। এতদিনের সেই কমিনিস্ট পার্টি মারা গেল। না, দুম করে কিছু হয়নি। অনেক দিন ধরেই পচনের লক্ষণ স্পষ্ট, রক্ত-মাংস পড়ছে গলে গলে, দুর্গন্ধ, তবু শৈশবের সেই স্মৃতি সে তো নিজের পিতামাতার সমান, তাকে ফেলি কীভাবে। অনেক আশা নিয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে তবু ডাক্তার ডাকি, কিছুই বুঝি না তবু নাড়ি টিপে কিছু বোঝার চেষ্টা করা ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে চাই, চান্স আছে কোনও?

এবার আর ডাক্তার ডাকা তো দূরস্থান, হারিকেন জ্বালানোরও সুযোগ ছিল না, একেবারে দুম করেই ফরসা।

এত বড় এক যুদ্ধের পর বেঁচে গিয়ে আমার অন্য কারও কথা নয়, নেত্রীর বীরত্বের কথা, বা বর্গিদের সেই লাল চোখের অচেনা শব্দে শব্দে ধমকানো বা সহস্র বর্গি আক্রমণকারীর অশ্বখুড়ের ধুলিঝড়ের কথাও নয়। মনে পড়ছে হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আমার সেই কমিউনিস্ট পার্টির কথা। আর কি ফিরবে কোনও দিন?

হ্যাঁ, এতবড় একটা যুদ্ধে এতবড় একটা জয়ের পরও শৈশব-কৈশোরের সেই কমিউনিস্ট পার্টির মৃত্যুই আমার বুকে সবচেয়ে গভীর দাগ হয়ে রইল। অথচ এই যুদ্ধে তাকে এমনকি বর্গিরাও আক্রমণ করেনি কোনও। আমি নিশ্চিত, কেননা, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি ঠিক করে বুঝেই উঠতে পারেনি তার আসল শত্রুটা কে? সে লড়বে কার বিরুদ্ধে? তবে? কার হাতে মৃত্যু হল? নাকি মারেনি কেউই, আত্মহত্যা?

চায়ের দোকানে গুরুগম্ভীর আলোচনা। এতদিনে বেশ একটা শক্তিশালী বিরোধী দল পেল বাংলা। শক্তিশালী মানে? শক্তিশালী মানে গঠনমূলক আলোচনা দিয়ে—। গঠনমূলক মানে? দলটা তো বিজেপি, যাকে চালনা করছে আরএসএস। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়ের পর সংগঠনের সরসংঘচালক মোহন ভাগবত জানিয়েছিলেন, আমাদের ভারতের সব কটি রাজ্য দখল করতে হবে। একমাত্র তবেই আমরা ভারতকে একই সাংস্কৃতিক নির্মাণের অধীনে আনতে পারব। এখন এই একই সাংস্কৃতিক নির্মাণের মধ্যেই ওদের আসল কথাটা লুকিয়ে। গোটা ভারতকে একই ভাষা, একই ধর্ম ও একই রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আনা। বাকি সবকিছুই লোকদেখানো মাত্র। মজাটা হল, আরএসএস-এর মোহিনী মায়ায় ভোলেনি কে? গুজরাটের সেই সম্পুর্ণক্রান্তি আন্দোলনের সময় ১৯৭৩ সালে স্বয়ং জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান নিয়ে হাজির হলেন জনসঙ্ঘের এল কে আদবানির কাছে। অথচ জয়প্রকাশ নিজেই জনসঙ্ঘের তাত্ত্বিক ভিত্তি আরএসএস-কে গান্ধিহত্যার চক্রান্তকারী বলেই ভাবতেন। আর উনি নিজেই আরএসএস-কে ব্যান করার দাবিও জানিয়েছিলেন। আরএসএসের রাজনৈতিক উইং জনসঙ্ঘের তখনও ভারতীয় রাজনীতিতে তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। কমিউনিস্ট নেতা নাম্বুদ্রিপাদ প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু তাতে কী, কয়েক বছর পরেই নাম্বুদ্রিপাদের পার্টি সিপিএমই ‘চোর’ রাজীব গান্ধিকে হঠাতে জনসঙ্ঘের রক্তমাংসে তৈরি নতুন প্রতিরূপ বিজেপি-র হাত ধরলেন ১৯৮৯ সালে। এবং এই সুযোগে বিজেপি বিপুল সংখ্যায়— যা ছিল আগে ২, হয়ে দাঁড়াল ৮৫—  আসন নিয়ে পার্লামেন্টে উদয় হল। মমতা ব্যানার্জি বিজেপির হাত ধরেছেন ১৯৯৯ সালে এবং মন্ত্রীও হন একবার নয়, দু-দুবার। তাঁর তত্ত্ব ছিল ভালো বিজেপি আর খারাপ বিজেপি। অটল ভালো বিজেপি আর মোদি খারাপ। যেন অটলের বিজেপির আরএসএসের অবাধ্য হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল।

যে বিষবৃক্ষের চারায় সবাই মিলে জল দিয়েছেন তা এখন ফলেফুলে মিলে মহাবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরছে সবাইকে। টানছে। এখন আর হাঁসফাঁস করে কী হবে।

না, আজ দোষারোপের দিন নয়, বরং শোকের দিন।

আচ্ছা ২০১১ সালে নির্বাচনে হারার পর পার্টি কারণ বিশ্লেষণ করেছিল কোনও, কেন প্রত্যাখ্যান করল মানুষ। বা ২০১৬তে যখন প্রাপ্ত ভোটের ব্যাবধান নামছে হু হু করে। বা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সব দিক থেকে শূন্য হাতে কেন ফেরা শুরু করল পার্টি? কেন বুদ্ধদেব তো ‘তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে’ ঝাঁপ দিতে বারণ করেছিলেন সবাইকে। ঠিক, কিন্তু উনি তো তখন ঘরবন্দি, উনি জানলেন কী করে যে তার অনুগামীরা সব তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনের দিকে ঝাঁপাতে যাচ্ছে। পার্টিতে তার সমমানের কেউ নিশ্চয়ই বলেছিল তাঁকে। অর্থাৎ তাদের লোকেরা যারা মমতার মতো এক ‘গভর্নমেন্ট’কে ‘গরমেন’ বলা মহিলার কাছে হার না মানতে পেরে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল, তারা এই এতদিনে যেন ক্ষমতায় ফেরার উপায় পেয়ে গেছে একটা। অত্যন্ত সহজ কৌশল, ‘আগে রাম, পরে বাম’। কী বলব, চরম সুবিধাবাদ, না কি প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা না কি—। পার্টির উপরতলার নেতৃত্বের সায় না থাকলে এই বিকৃতচিন্তা পুরো বাংলা জুড়ে ছড়াতে পারত কখনও?

২০১১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত শরীর শুকিয়ে আসছে অথচ রোগটাই জানা যাচ্ছে না। রোগ ধরার চেষ্টা হয়েছে কোনও? আচ্ছা রোগ কি ২০১১ তেই শুরু হল না কি শুরু হয়েছে অনেক আগেই, যতদিন পারা যায় শুধু চোখ বন্ধ করে থাকা। বলা যায় ডাক্তার না দেখানোটা কিছু মানুষের বৈশিষ্ট্য। পাছে খারাপ রোগ ধরা পরে কোনও। পাছে বায়োপ্সি করার নিদান দেয় ডাক্তার, পাছে বলে বসে, আর বেশি দিন নেই গো— লাভ নেই চিকিৎসায় কোনও, বরং অন্তর্জলীতে গঙ্গায়—। তার চেয়ে তো চোখ বন্ধ করে থাকাই ভালো। যে কদিন পারি নিশ্চিন্তে—। হয়তো তাই, যখন এমনকী শোক করার জন্যও পাশে আর খুঁজে লোক পাওয়া যাবে না কোনও।

কী আশ্চর্য ভাবুন, এত বড় একটা যুদ্ধ জয়ে আমাদের সেই পার্টির ভূমিকাই থাকল না কোনও। এমনকী তার মৃত্যুটাই চোখে পড়ল না কারও। শুধু বিমানবাবু জানিয়েছেন, সবাই মিলে বসা হবে, কারণ বিশ্লেষণ হবে আর আর— গত দশ বিশ বছরে এমনি অন্তত বিশবার এই একই কথা। কিন্তু সময় কি আর অতশত জানে? সে আর কতটুকু জানবে বিমানবাবুর ত্যাগ, তিতিক্ষা আর মাহাত্ম্যের কথা। কমরেড বিমান, কমরেড সূর্যকান্ত, কমরেড সুজন, কমরেড সেলিম আর তাঁর নতুন কমরেড আব্বাস সিদ্দিকী। সময়ের নদীতে তুমুল টান। বানের টানে পার্টির নৌকা কখন যে কোথায় উধাও হল টেরই পায়নি কেউ।

শুধু গ্রাম শহরের রুটি-রুজির হিসাব না মেলানো মানুষ, আদিবাসী বা নিচের তলার অসংখ্য লোক রাস্তার পাশে অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছে। অনেক গল্প শুনেছে তারা কমিউনিস্ট পার্টির। বানের টানে কত তলিয়ে যেতে থাকা মানুষ—, জঙ্গলে পথা হারানো আদিবাসী যুবতী, কাজ হারিয়ে ঘরে ফেরা সংখ্যালঘু যুবক। মোট কথা কপালে লাল টিপ পড়া গেরুয়া পাঞ্জাবির কারও গলায় আচমকা ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার ধ্বনি শুনে কেঁপে ওঠা মানুষগুলি ভরসা দেওয়ার জন্য পাশে চাইছে কাউকে। অনেকের কাছ থেকে অনেক অনেক ছোটবেলা থেকে এক যুগের এক কমিউনিস্ট পার্টির অনেক গল্প শুনেছে তারা। সেই সব পাঞ্জাবি-পাজামা আর হাওয়াই চটি পরা পাগলগুলি এখন কোথায় কে জানে?