সায়ন্তন বৈরাগী
ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে কর্মরত, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা
ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন-২০২১ এমন একটি নিজস্ব স্থান তৈরি করে নিয়েছে, যা ভবিষ্যতের নানা তর্ক-আলোচনায় বারবার উঠে আসবে। বিপুল অর্থব্যয়, এলোপাথাড়ি দলবদল, ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত থেকে নেতা-নেত্রী, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের উড়ে এসে ভোট প্রচার, আইটি সেলের তীব্র উত্থান, মিডিয়ার ২৪x৭ সদাসজাগ নজর, সেফোলজিস্ট-রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, ধর্মীয় বিভাজনের অঙ্ক— সব মিলিয়ে এই নির্বাচনের রেশ করে মিলিয়ে যাবে না, বরং আগামী দিনের সামাজিক-রাজনৈতিক বিন্যাসে গভীর ছাপ রেখে যাবে বলেই মনে হয়।
এখন প্ৰশ্ন হচ্ছে, যখন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, মিডিয়া, অনুসন্ধানমূলক সার্ভে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার আভাস দিয়েছিল, তখন মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৯ সালের লোকসভায় প্রাপ্ত ৪৩.৬৯ শতাংশ ভোট শেয়ার থেকে বাড়িয়ে ৪৮ শতাংশে চলে গেল কী করে? কেনই বা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি ৪০.৬৪ শতাংশ থেকে কমে ৩৭ শতাংশে নেমে গেল? অনেক কারণই হয়তো আছে, অধিকারীজনেরা তার বিশ্লেষণও করছেন, কিন্তু আমি এখানে একটি বিশেষ দিকের প্রতি আলোকপাত করতে চাই। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এই নির্বাচনে বিভাজনের চড়া সুরের মধ্যে মহিলা ভোটাররা নিজেদের একটা আলাদা গুরুত্ব তৈরি করতে পেরেছেন। দেখা যাক, কারা শুনল সেই মহিলা ভোটারদের মনের কথা।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ভোটারদের ৪৯ শতাংশ মহিলা, অথচ আমার দেখা কোনও সার্ভে বা সংবাদ চ্যানেলের বিশেষজ্ঞদের কথায় মহিলাদের নিজেদের আশা-আশঙ্কা নিয়ে সেরকম আলোচনা হয়েছে বলে বিশেষ মনে পড়ছে না! নিজের পেশাগত তাগিদে বাংলা জুড়ে নির্বাচনী প্রচারের কাজ খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার নিরিখে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, ঠিক এই জায়গাতেই প্রশান্ত কিশোরের ভোট কৌশল এবং মমতা ব্যানার্জির সার্বিক সরকারি প্রকল্প ও প্রচার বাকিদের থেকে বহু যোজন এগিয়ে ছিল।
মহিলা-কেন্দ্রিক সরকারি প্রকল্প
কন্যাশ্রী-রূপশ্রী প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীরা বা বঙ্গীয় ‘এলিট’ শ্রেণি ব্যঙ্গের হাসি হাসতেই পারেন, কিন্তু বিগত ৮ বছরে ৭০ লক্ষ স্কুলছাত্রী কন্যাশ্রীর আওতায় যে আর্থিক সাহায্য পেয়েছে, বা ‘রূপশ্রী’-র আওতায় ৮ লক্ষেরও বেশি মহিলা উপকৃত হয়েছেন, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। খেয়াল করতে হবে ‘দুয়ারে সরকার’-এ যে ১২টি সরকারি প্রকল্প উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং একইসঙ্গে সরকারের জনকল্যাণী মুখ তুলে ধরছে, তার মধ্যে এই দুটি প্রকল্পও রয়েছে। পরিবারের মহিলা সদস্যের নাম ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড ইস্যু করে যত সূক্ষ্মভাবে মহিলাদের ক্ষমতায়ন হল, ততোধিক সূক্ষ্মভাবে এই মুহূর্তে ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন তিনিই বোঝেন পরিবারে মহিলাদের স্থান।
মমতা ব্যানার্জির সরকারের মহিলাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজের একটি তথ্য না দিলেই নয় যে বিগত ১০ বছরে ৬.৭ লক্ষ মহিলা-পরিচালিত গ্রামীণ স্বনির্ভর গোষ্ঠী ১,৬২৯ কোটি টাকার ঋণ পেয়েছেন, অর্থাৎ মহিলাদের সরাসরি আর্থিক ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। গ্রামেগঞ্জেও মহিলারা সরবে জানিয়েছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উপকারের কথা, আগ্রহ দেখিয়েছেন বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে। একদিকে ক্রমবর্ধমান গ্যাসের দাম যখন হাত পুড়িয়েছে বাংলার রান্নাঘরে, ‘খাদ্যসাথী’ তখন প্রবল দুঃসময়েও ভরসা জুগিয়েছে ঘরে ঘরে— আর প্রচারে বেরিয়ে সেই কথা তৃণমূল বারংবার মনে করতে ভোলেনি। সরকারি চাকরিতে বিজেপির ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতিতে মহিলাদের মন গলানো যায়নি, কারণ মমতা ব্যানার্জির সরকারের পরীক্ষিত জনকল্যাণমুখী মডেল প্রকল্পের সামনে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলির মধ্যে এরম কোনও উদাহরণ দেওয়ার মতো প্রকল্প তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি।
প্রচারে মহিলাদের ক্ষমতায়ন
পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলা আসনের সংরক্ষন মমতা ব্যানার্জি আগেই ৩৩ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে নিয়ে যান।
এই নির্বাচনে মহিলাদের কাছে মহিলারাই পৌঁছে দেবেন দলের বার্তা— এই লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বিধানসভা-কেন্দ্রিক মহিলা মোর্চা গঠন করা হয়। জোর দেওয়া হয় অঞ্চল (গ্রাম পঞ্চায়েত)-ভিত্তিক মহিলা মোর্চা গঠনে, খুঁজে খুঁজে পৌঁছে যাওয়া হয় গ্রামবাংলার কোণায় কোণায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নেত্রী, সমাজসেবী, অল্পবিস্তর প্রভাবশালী মহিলাদের কাছে। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সরকারের ১০ বছরের সাফল্যের খতিয়ান রিপোর্ট কার্ড, মমতা ব্যানার্জির ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার, ‘দিদিকে বলো’-র ফোন নম্বর দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সম্বলিত কার্ড ইত্যাদি। আগেই নির্দিষ্ট করা হয় কোন রাস্তা দিয়ে কোন সময়ে কোন পাড়াতে পৌঁছে যেতে হবে, ট্রেনিং দেওয়া হয় কী বলতে হবে।
উল্লেখযোগ্যভাবে এই প্রচারে দলের কোনও পুরুষকে যুক্ত থাকতে দেওয়া হয়নি, তাদের মতামত চাপিয়ে দিতেও দেওয়া হয়নি, বরং পুরোটাই মহিলাদের স্বাবলম্বী-স্বাধীন প্রচার হয়ে ওঠে। বেশ বোঝানো গেছে, দলনেত্রী সব কোণায় না পৌঁছতে পারলেও, দিদির দূতরা তাঁরই বার্তা বহন করছেন।
‘মহিলাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত থাকে না’, ‘বাড়ির পুরুষ সদস্যের কথা শুনেই ভোট দেয় মহিলা’— এই মিথকে ভাঙতে পুরুষদের সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে মহিলাকেন্দ্রিক প্রচার কৌশল সেই অর্থে প্রশান্ত কিশোরের মাস্টারস্ট্রোক। বাকি ভারতের থেকে বাংলার মহিলারা নিজেদের মত গঠন করতে তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট স্বছন্দ, তাই তাঁদের রাজনৈতিক আঙিনায় নিজেদের পৌঁছে দেওয়ার কর্তব্য অবিশ্বাস্য দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। এখনও অবধি ভরসাযোগ্য ডেটা হাতে না এলেও, এই সম্মান প্রদর্শনের ফল ভোটবক্সে যে তৃণমূলকে যে ঢালাও সমর্থন দিয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। অপরদিকে মহিলাদের স্বকীয় মতামতকে বিজেপি কখনওই গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে, তা অন্তত তাদের ভোট কৌশল দেখে বলে মনে হয়নি।
ডিজিটাল প্রচারে জোর
গত দেড় বছর ধরে প্রশান্ত কিশোরের নির্দেশে তৈরি করা তৃণমূল কংগ্রেসের আইটি সেল বিধানসভা-কেন্দ্রিক তো বটেই, ব্লক এবং গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরেও পৌঁছে গেছে। সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী সহ বাকি বিজেপির নেতারা তাদের ভাষা ব্যবহারে সুনাম অর্জন করেছেন, এ দাবি সম্ভবত কেউ করবেন না। তৃণমূলের আইটি সেল ক্রমাগত মহিলাদের সামনে তুলে ধরেছে বিজেপি নেতাদের মহিলাবিদ্বেষী মন্তব্য। রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বিজেপি রাজ্য সম্পাদক দিলীপ ঘোষের কটূক্তি, বা বাকি নেতা-কর্মীদের মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে অশালীন নামে-আওয়াজে সম্বোধন বাংলার মহিলারা মোটেই ভালো ভাবে নেননি।
সমান্তরালভাবে তৃণমূল পরিচালিত ডিজিটাল মাধ্যমগুলি বারবার তুলে ধরেছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে মহিলাদের উপরে ঘটে চলা একের পর এক অপরাধ, এই রাজ্যগুলিতে সামগ্রিকভাবে মহিলাদের উপর অপরাধের হার। একদিকে হাথরসের হাড় হিম করা ঘটনা, আর অপরদিকে বিজেপি নেতাদের ক্রমাগত মহিলাবিদ্বেষী মন্তব্য ডিজিটাল মাধ্যম হয়ে পৌঁছে গেছে মহিলাদের চোখের সামনে।
বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়
শুধুই গিমিক তৈরি করা ক্যাচলাইন না, সুকৌশলে এই অনুভূতিই তুলে ধরা হয়েছে যে বাংলা থাকুক বাংলার নিজের মেয়ের কাছেই। তৃণমূল কংগ্রেস একদিকে যেমন বিজেপিকে খোঁচা দিয়ে বাংলায় ‘বহিরাগত’দের জায়গা নেই বলতে চেয়েছে, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে বাংলার একমাত্র অভিভাবক হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন যিনি বাংলার সংষ্কৃতি-ঐতিহ্যের একমাত্র রক্ষক, নতুন বাংলা গড়ার কারিগর। বাংলার মহিলাদের কাছে এই অনুভূতি আপন হয়ে উঠতে পেরেছে। ব্র্যান্ডিংয়ের এই দ্বৈরথে বিজেপির ‘আর নয় অন্যায়’ সেখানে শুধু শুকনো হুঙ্কার হয়ে থেকে গেছে।
এই নির্বাচনের ফলাফলের দেখে বলা যায় যে মহিলাদের ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ ধরে নেওয়ার দিন শেষ, ভবিষ্যতেও মহিলারা তাদের নিজস্ব মতামত নিজেরাই গড়ে নেবেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের প্রভাবিত করবে। আর্থিক ক্ষমতায়নের সঙ্গে মহিলারা নিজেদের ভালো নিজেরাই বুঝে নিতে সক্ষম। সরকারি প্রকল্পেও তাই গুরুত্ব দেওয়া হবে মহিলাদের। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প এই মুহূর্তে নারীকল্যাণ ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বিরল, ২০১৩ সালে যাকে জাতিসঙ্ঘও স্বীকৃতি দিয়ে তুলে দিয়েছে ‘পাবলিক সার্ভিস’-এ প্রথম পুরস্কার। আশা করা যায় আগামী দিনে বিভিন্ন রাজ্যের সরকারও আলাদা গুরুত্ব দিয়ে নারীকল্যানের দিকটি বিবেচনা করবেন। সর্বোপরি, ভোটার ফলাফল দেখে আঁচ করা যায় ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধে উঠে সার্বিকভাবে মহিলাদের মন জয় করার ক্ষেত্রে তৃণমূল অনেকটাই সফল।