অনিঙ্ক আচার্য্য
বন্যার জল নেমে গেলে মানুষের ভাববোধে যেমন একটা অস্বস্তিকর পচা গন্ধ এসে একরকমের বিরক্তি আনে, বন্যা নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রেও একই– জল আর কই? কী লিখব ভায়া? লোকে পাত্তা দেবে না!
উত্তরবঙ্গে বন্যা এসেছিল এবছর আমাদের স্বাধীনতা দিবসের আশপাশ দিয়ে, স্বাধীন চিন্তাধারী মানুষজন যে যেমনভাবে পেরেছেন কাজ করেছেন– কেউ কলম ধরে, কেউ নৌকা নিয়ে। এবার প্রশ্ন, এখন অবস্থাটা ঠিক কেমন? মানে ধরুন– নৌকা বইবার মতো জল নেই, প্রকাশ করার মতো ‘কষ্ট’ খুব একটা নজরের সামনে নেই; পুজোর প্যান্ডেলে বাঁশের উপর কাপড় পড়ছে, পুজোর জন্যে অর্ডার দেওয়া জিনিসগুলো ধীরে ধীরে ডেলিভারি হচ্ছে, মাঝবয়সী জেলেরা হেঁটেই নদী পার হচ্ছে। বন্যা কই?
কলকাতা থেকে যদি এখন কেউ জানতে চান ‘তোমাদের ওখানে বন্যার কী খবর?’ সত্যি বলতে কী, উত্তর দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। যাই হোক, এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক– শহর, গ্রাম, মফঃস্বল, সবাই নিজের নিজের লয়, ছন্দ আর যা হয় সব ফিরে পেয়েছে– পুজো আসছে তো! এই পরিস্থিতিতে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন: আর তা হল মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছে, আর ঘুরে দাঁড়ানোর মানসিক দৃঢ়তা, ওই চলতি ভাষায় যাকে বলে “সার্ভাইভাল ইনস্টিনক্ট”।
যে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে মানুষের ইতিবাচক ও নেতিবাচক মাতামাতির দু’টো প্রধান দিক থাকে– একটা হল প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা (পড়ুন অভিযোগ), যেটা অনেকটা ওই দায়সারা কাদা ছোঁড়া গোছের মানসিকতার প্রকাশ; অন্যটা ত্রাণ-বিলি-পয়সা-তুলি-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা, যেটার অনেকটাই কাজে আসে, তাই সমস্যা নেই। এবার, এই দু’টো বিশাল বিশাল দিক যদি ছেঁটে ফেলা হয়, তাহলে কিন্তু বন্যা নিয়ে বলার মতো সেরকম কিছু নেই। আর এখানেই আড়াল হয় সাবঅলটার্নরা। আচ্ছা, (স্পিভাকের থেকে ধার নিয়েই বলি) সাবঅলটার্নরা কথা কইতে পারে?
দক্ষিণ দিনাজপুরে বন্যা পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়া শুরু হয় ওই ১৪ই আগস্ট নাগাদ। স্বাধীনতার পতাকা তুলে, সন্ধ্যায় সেটা যতক্ষণে নামানো হয়, ততক্ষণে গ্রামগুলো ডুবে গেছে। সদর বালুরঘাট আর গঙ্গারামপুরের মানুষ ততক্ষণে ঘর ছাড়ার তোড়জোড় শুরু করেছে। প্রশাসন স্বভাবতই তখনও মিটিং নিয়ে ব্যস্ত, আর টিভির খবরে কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজোর তালের বড়ার গল্প চলছে। এইবার এই ৭২ ঘণ্টার কাছাকাছি সময়, যখন বাইরের কেউ টেরই পায়নি বাংলার এক জেলা বন্যায় ভাসছে, প্রশাসন বুঝেই উঠতে পারেনি বন্যা ঠিক কতটা ভয়াবহ (ওদের হিসেবে বন্যা হয়নি, সরকারি কোনও ঘোষণা নেই এই জেলা নিয়ে), তখন এই মানুষগুলো কী করে বেঁচে থাকল?
প্রান্তিক জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর, ম্যাপে দেখলে বুঝবেন পশ্চিমবঙ্গের নিচ থেকে উপরে উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে একটা ছোট্ট অংশ হোঁচট খেয়ে ডান দিকে ঢুকে গেছে, ওই পাণ্ডববর্জিত জমির টুকরো আমাদের দিনাজপুর। কলকাতা থেকে আসার পথ লম্বা, তাই ওই NDRF টিমের আসতে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লেগে যায়। স্পিডবোট জলে নামার আগেই স্রোত ফুরিয়ে যায়। হতভাগা জেলা! পাশের গ্রামের ছেলেপুলে এসেছিল ওই রাবারের স্পিডবোট দেখতে, কিন্তু স্রোত নেই যে, তাই দেখে মজা পেল না। ওই একটা জলের প্যাকেট বানানোর মেশিনও এসেছিল বি.ডি.ও অফিসে, ওটাও দেখতে পায়নি; কপাল খারাপ হলে যা হয়। ওই মেশিন অফিসেই থাকল, প্যাকেটগুলো মাটিতেই লোটালুটি খেল। সে যাই হোক, আফসোস একটাই ওই মেশিন দেখতে পেয়ে ছেলেপুলে জল না পাক আনন্দ পেত, বাড়ি গিয়ে গল্প করত।
বন্যার কয়েকদিন জেলার আনাচে কানাচে প্রচুর গ্রামে ঘুরতে হয়েছে, সেখান থেকে একটা জিনিস প্রচণ্ডভাবে উপলব্ধি করেছি, বন্যার বা যেকোনও দুর্যোগের সময় মানুষ সবার আগে একটা মানসিক আশ্বাস খোঁজে। খরিকাডাঙ্গা বলে একটা গ্রামে একদিন গিয়েছিলাম ওখানে এক বয়স্ক মহিলা কাছে। এসে বললে, “বাবা, পূজার আগে সব ঠিক হয়ে যাবে, না? ব্যাটা আমার ওই বৎসরে একবারই আসে, রাস্তা ঠিক হবে?” এখনও পুজো আসতে সপ্তাহখানেক বাকি, রাস্তা খুলে গেছে অনেকদিন হল, কিন্তু ওই দিদার ব্যাটা এসেছে কিনা জানি না।
প্রত্যেকটা জিনিসের একটা রং থাকে, এই বন্যার থাকবে না, তা কী করে হয়? আর যদি কোনও কারণে না থাকে, আমরা না হয় নিজেরাই একটু লাগিয়ে দিলাম। বন্যা-পরবর্তী জেলার ছবিটা হল ওই অনেকটা অকাল-বসন্তের মতো, সবাই রং মাখাতে ব্যস্ত। আর এই ব্যস্ততা থাকবেই, কারণ প্রশাসন স্বয়ং ততক্ষণে একদম পুরোদমে কাজে নেমে পড়েছেন। আমার নিজের বাড়িতে জল নামার এক সপ্তাহ পর দু-প্যাকেট বিস্কুট দিয়ে গিয়েছিলেন মাননীয়া কাউন্সিলর মহাশয়া, খুব তৃপ্তি করে বিকেলের চায়ের সাথে খেয়েছিলাম। অকালবোধনের আগে অকাল-বসন্ত হলে ক্ষতি কী? আর তাছাড়া বিস্কুটের প্যাকেট বন্যার মধ্যেও যেমন কাজের, বন্যার পরেও তাই। সে জন্যে ত্রাণের চাল কোন নেতা বিক্রি করে দিল, কোন নেতা মার খেল, এসব নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। তবে আসল সমস্যা হচ্ছে আমাদের মতো কৃষিনির্ভর জেলায় বন্যার একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সরাসরি এসে পড়ে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর। এবং এই বন্যার পরে সেই অর্থনৈতিক কাঠামো নড়বড়ে হয়ে গেছে। যদিও এসব বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা টিপিক্যাল বন্যা-রিলিফ নির্দেশিকাগুলোতে থাকে না; তাই ওসব আড়ালেই থাক। আপাতত মন দেওয়া যাক বিশ্ব-বাংলার সেরা পুজোর দিকে।
আত্রেয়ী, পুনর্ভবা, টাঙ্গনে জল নামার পর অনেক কিছু ঘটেছে: আমেরিকায় হার্ভে এসেছে, ইরমা এসেছে, মুম্বাই দু’দিন ভেসে থেকেছে, কলকাতায় বৃষ্টির জন্য টালিগঞ্জ মেট্রোতে অনেকে আটকে থেকেছে। তবে সবকিছুর মাঝে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট, অন্যের জুতোয় পা রাখার ক্ষমতা কিন্তু মানুষ সাবলীলভাবে হারিয়ে ফেলছে। এই যখন বালুরঘাটে বন্যা, তখন আমরা ভাবছি কেন খবরে আমাদের কথা বলছে না, কেন কেউ আসছে না। আবার জল নেমে যেতেই সব আলগা। যখন ডিভিসির জলে দক্ষিণবঙ্গ ভাসছে তখন আমরা নির্বিকার। সমস্যাটা বোধহয় মানুষের খুব একটা নয়, কোনওভাবেই দোষ দেওয়া যায় না। সমস্যাটা সময়ের, যেটা আর কিছুতেই মানুষের হাতে থাকছে না।
সবকিছুর শেষে দু’টো ভালো খবর আর দু’টো খারাপ খবর দেই। ভালো খবর হল বন্যা নেই, মানুষ এখন খানিকটা সুখে আছে, পুজোর প্রস্তুতিতে টান সেরকম পড়েনি, আর যাদের জমি গেছে তারা ভিনরাজ্যে ৬-৭ মাস কাজ করতে যাবে। অন্যদিকে প্রশাসনের তরফ থেকে নাকি কিছু টাকা-পয়সা দিচ্ছে, ঘরবাড়ি বাঁধবার জন্যে, যাই হোক ঋণের দায় যদি ২ টাকাও মকুব হয় সেটাও তো মকুবই বটে।
আর থাকল পড়ে খারাপ খবর, সে নতুন কিছু নয়। উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক ভারসাম্য প্রচণ্ড নড়বড়ে, অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি কোনওটাই অবাক করার মতো কিছু নয়। আর মানুষের চাপে পুরনো নদীগুলো নিজেদের শাখাপ্রশাখা হারিয়েছে, ফলে সমস্ত জল একাই বহন করতে হয়, আর মূল নদীগুলো ক্রমশ নিজেদের নাব্যতা হারাচ্ছে। ফলে এরকম বন্যা পরের ৫ বছরে আরো ৫ বার আসলে, নতুন করে বন্যা পূজা শুরু করা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। আর সব শেষে মাথায় রাখতে হবে ডি.ভি.সি, ফারাক্কা, আর তিস্তা ছাড়া আরও জল আছে যা মানুষকে কাঁদায়। এবার কিন্তু সত্যি নদী নিয়ে ভাববার সময় এসেছে, আমাদের নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আমাদের গল্পে নদী সবেতেই আছে আবার কিছুতেই নেই, নদী আমাদের সাবঅলটার্ন। আর সাবঅলটার্ন কথা কয় না, ওর হয়ে কথা কইতে হয়। শুধু প্রান্তিকের আবদার কেন্দ্র অবধি পৌঁছয় না।