Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডামাডোল

সত্যব্রত ঘোষ

 




প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

সম্প্রতি ফেসবুকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের নিজস্ব দেওয়ালে নীতি আয়োগের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডাক্তার ভি কে পল একটি পোস্টে জনসাধারণকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে রেমডিসিভির ওষুধটি যথেচ্ছভাবে বাড়িতে ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। সরকারি পদাধিকারী হিসেবে নিজের এই দায়িত্বটি সংক্ষেপে ও সুচারুভাবে পালনের প্রতিক্রিয়ায় জনসাধারণ যে তথ্যাদির বন্যা বইয়ে দেন তা অতি চমকপ্রদ। কারণ, দূরদূরান্তে ভাইরাসের সঙ্গে তার সম্পর্কই নেই!

ফেসবুকের এই ধরনের দেওয়ালগুলিকে এখন নির্দ্বিধায় ব্যবহার করছে জুয়াড়িরা, যা সরকারি বার্তা প্রচারের জন্যেই নির্দিষ্ট থাকবার কথা। কিন্তু সেখানে চলছে আইপিএল-এর ড্রিম ইলেভেন সংক্রান্ত বাজির তথ্য চালাচালি। অবাক হওয়ার তখনও কিছুটা বাকি ছিল। পরিচিত কিছু মানুষদের (সর্বভারতীয় এক সুপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজি দৈনিকে সদ্য যোগ দেওয়া ক্রীড়াসাংবাদিকও তাঁদের মধ্যে আছেন) সঙ্গে আইপিএল এবং জুয়াখেলা নিয়ে আলোচনায় জানা গেল আইপিএল-এ বেটিং-এর প্রচলন এখন শুধু ব্যাপকই নয়, আইনসিদ্ধও (!!) বটে। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের দেওয়ালে জুয়ার প্রচার মোটেই অন্যায় নয়।

দ্বিতীয় দফায় কোভিড ভাইরাসের সংক্রমণের পর অন্তত একটি বিষয় স্পষ্ট। স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ভারতের প্রশাসন যন্ত্র দক্ষ হতে পারে। তবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেই দক্ষতার ভগ্নাংশটুকু দেখা যায় না। বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রজ্ঞা অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমলা শ্রেণিভুক্ত মানুষগুলির এখন সাপের ছুঁচো গেলা অবস্থা। একদিকে ‘কর্তব্যপরায়ণতা’-র চাপ, অন্যদিকে লালবাহাদুর শাস্ত্রী অ্যাকাডেমিতে শেখানো ‘Anticipate – Plan – Implement’ কর্মপদ্ধতিকে নেতাদের প্রতি বিশ্বস্ততার খাতিরে জলাঞ্জলি দেওয়াটাই এখন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, সারা দেশের রোগীরা যখন সম্প্রতি অক্সিজেন সরবরাহে ব্যাঘাত সহ অন্যান্য অভাবজনিত সমস্যায় বিপন্ন, প্রশাসকেরা প্রধান সেবকের অনুমতির প্রতীক্ষায় কালযাপন করছেন।

অবাক হওয়ার পর্ব অতিক্রম করে কিংকর্তব্যবিমুঢ় পর্যায়ে পৌঁছায় যখন দেখা যায় ভয়াবহ শ্বাসরোধী এই বাস্তবিক পরিস্থিতিতেও দেশের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার হুল্লোড়প্রিয় মানুষরা দুটি বিষয়ে এখন আগ্রহী: ১। পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন প্রক্রিয়া ও পরিণাম এবং ২। আইপিএল অর্থাৎ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ক্রিকেট।

মানুষের রোগ ও মৃত্যু নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলি যখন ‘ইনফোডেমিক’-এর আক্রমণ শানিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে মানুষদের আগ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সেই আগ্রহে বিজেপি-র উত্থান বা পতন নিয়ে দেশের সাট্টাবাজারগুলির ফাটকার তারসপ্তকে মগ্ন। সেই মগ্নতার মাঝে আইপিএল সংক্রান্ত জুয়াও অন্তর্ভুক্ত।

অনলাইন রামি জাতীয় অ্যাপগুলির মতো ড্রিম ১১-ও একটি গেমিং অ্যাপ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ক্রিকেটারের নিয়ে দল বানিয়ে জুয়ারিরা টাকা লাগিয়ে বাজি ধরে। শূন্য স্টেডিয়ামগুলিতে ক্রিকেটাররা সশরীরে যে ম্যাচগুলি খেলছেন, তার ফলাফলগুলিকে যে জুয়াড়ির বানানো দল হারিয়ে দেবে, তাহলে তার বাজিমাৎ। অন্য জুয়াড়িদের থেকে সংগৃহীত টাকার একটি অংশ জমা পড়বে বাজিমাৎ করা জুয়াড়ির অ্যাকাউন্টে। বাস্তব ক্রিকেটাররা যদি তার বাজি ধরা রানের চেয়ে বেশি স্কোর করেন, বা প্রতিদ্বন্দ্বীর উইকেট বা ক্যাচ নিয়ে আউট করেন, তাহলে জুয়াড়ি হারল। অর্থাৎ টেলিভিশন ছাড়াও বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে খেলার সরাসরি সম্প্রচার নির্ভর করে জুয়াখেলাটি চলতে থাকে।

প্রতি গ্রীষ্মেই আইপিএল নিয়ে সোরগোল ওঠে। বিজ্ঞাপনদাতা থেকে শুরু করে চিত্রতারকাদের অনেকে এই ক্রিকেট লিগটির আয়োজন এবং উপস্থাপনে একেবারে সরাসরি যুক্ত। প্রকাশ্যে যদিও বলা হয়ে থাকে যে ক্রীড়া বিষয়ে উৎসাহ থেকেই এই অংশগ্রহণ, তবে অর্থকরী লাভ করার উৎসাহটিও যে এক্ষেত্রে সমানভাবে সক্রিয়, তা সবারই জানা। তার চেয়েও বড় কথা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য খরিদ্দারদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে আইপিএল-কে চিন সহ অন্যান্য দেশের উচ্চকোটির ব্যবসায়ী মহল একটি অন্যতম উপায় হিসেবে মরিয়া হয়ে বিজ্ঞাপন ও প্রচারে ব্যবহার করে।

খেলা উপভোগের নামে এই উৎকট উত্তেজনাকে ছড়িয়ে এই যে জুয়াপর্ব চলছে, বিসিসিআই সহ অন্য কতৃপক্ষদের চোখে তা এখন আর বেআইনি নয়। ভারতের ১৩টি রাজ্যে প্রচলিত লটারি এবং দুটি রাজ্যে চলা ক্যাসিনোগুলির মতো এই দেশ জুড়ে বেটিং এখন সর্বজনস্বীকৃত। কারণ ১৮৬৭ সালে রচিত জুয়া সংক্রান্ত ভারতের আইন (দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট)-টি ইন্টারনেট সঞ্চারিত জুয়া নিয়ন্ত্রণে স্বাভাবিকভাবেই সমর্থ নয়। সম্প্রতি পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার আদালতে বিচারপতিরা এই ড্রিম ইলেভেন অ্যাপটির আইনসিদ্ধতা খতিয়ে দেখছেন।

জুয়াড়িদের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে জানানো হয়েছে যে এই ‘ফ্যান্টাসি গেম’ অ্যাপটির মূল আকর্ষণ হল খেলোয়াড়দের বিষয়ে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কল্পনাপ্রসুত ধারণা অবলম্বন করে একটি সাময়িক উত্তেজনায় ব্যস্ত থাকা। তাই তা বাস্তবে মাঠে নামা খেলোয়াড়দের কৌশল, দক্ষতা এবং খেলার প্রতি দায়বদ্ধতাকে একেবারেই প্রভাবিত করছে না। এখানে ভাগ্যের ভূমিকাটি ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত ও দলগত দক্ষতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোদ্দা কথা, সময় কাটানোর একটি নিরীহ জনপ্রিয় উপায় ছাড়া এই ড্রিম ইলেভেন অ্যাপটি কোনওভাবেই ক্ষতিকর হিসেবে প্রতিপন্ন করা যাবে না। এই যুক্তির মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় ‘নিরীহ’ শব্দটি।

বস্তুত, বিগত সাত বছর ধরে আইনত নিরীহ সাজবার এই প্রবণতাটিই ধর্ম আর মোহের শাঁসে জলে ভারতে ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে উঠেছে। ২০১৪ সালে যে নিরীহ ভঙ্গিতে ‘অচ্ছে ভারত’ গড়বার কথা বলা হয়েছিল, সেই একই ভঙ্গিতে ২০১৬ সালে নোটবন্দি ঘোষণার পর দেশের অর্থব্যবস্থাকে ডামাডোলে ফেলা হল। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশপ্রেমের জিগির তুলে নিরীহ ভঙ্গিতে প্রধান সেবক দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম। ২০২০ সালে সেই নিরীহ ভঙ্গিতেই থালা আর কাঁসি বাজিয়ে করোনা ভাইরাস তাড়ানোর নাম করে লকডাউন ঘোষণা করে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চেয়ে বেশি মানুষকে বিপদে ফেললেন। এক ঢিলে দুই পাখি মেরে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনকে প্রায় স্তব্ধ করতে পারলেন প্রধান সেবক।

এবার ‘এক দেশ, এক সরকার, এক ধর্ম’-র স্লোগান নিয়ে বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে আগ্রাসনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে ২০২১ শুরু করেছিলেন বটে। তবে করোনার দ্বিতীয় দফার প্রাদুর্ভাবের মোকাবিলায় বিপদ বুঝে নিরীহতার পরাকাষ্ঠা সেজে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়ভারগুলিকে একের পর এক রাজ্য সরকারের চাপিয়ে নিজের ভানসর্বস্বতা নিয়ে জনসমক্ষে আবির্ভূত হচ্ছেন তিনি।

যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ঘোষণা করে চিকিৎসকেরা বারবার করোনার ভাইরাসের দ্বিতীয় প্রবাহ মোকাবিলার দাবি তুলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তা এখন কানে নিয়েছেন বটে। তবে যুদ্ধের সময়ে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রসদের গমনাগমনের সুযোগে ধুরন্ধরেরা যেভাবে বিপুল লভ্যাংশ ঘরে তোলে, সেই ধুরন্ধরদের স্বার্থ রক্ষার প্রতি প্রধান সেবকের দায়বদ্ধতা রয়েই গেছে। তাই ওষুধ আর অক্সিজেন সিলিন্ডারের কালোবাজারির পাশাপাশি সপ্তাহান্তগুলিতে আইপিএল-এর বিনোদন টেলিভিশনে সম্প্রচার আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলিতে স্ট্রিমিংও চলে। ড্রিম ইলেভেন-এর বীভৎস আনন্দ পাড়ায় পাড়ায়, গলিতে গলিতে উচ্ছ্বাস হয়ে ক্রমশ যখন অতিমারিতে আক্রান্তদের হাহাকারকে ছাপিয়ে যায়, তখন বাজিতে জেতার আনন্দে আত্মহারা জুয়াড়িদের হাসি দুর্দশাগ্রস্ত সেই ভারতবাসীদের পীড়াকেই বিদ্রুপ করে যারা অতিমারি ব্যাতিরেকে শুধুমাত্র দারিদ্রের অনিশ্চয়তাতেই ক্ষয়িষ্ণুতার চরম সীমা অতিক্রম করতে চলেছে।

মন্দের ভালো, কোভিডের কারণে বায়ো বাবল সুরক্ষা পরাস্ত হওয়ায় আইপিএল আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। দেশের এত বড় দুর্দিনে এমন উৎকট বিনোদন ও জুয়াখেলা চালিয়ে যাওয়ার মতো সংবেদনহীনতা আমাদের আর দেখতে হচ্ছে না।