অভয় শুক্লা
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস, পরিবেশবিদ, ট্রেকার ও লেখক শ্রী অভয় শুক্লার এই লেখাটি তাঁর ব্যক্তিগত ব্লগ View from (Greater) Kailash থেকে গৃহীত ও ইংরেজি থেকে অনূদিত।
ওয়াশিংটনে অবস্থিত ইউএস হলোকস্ট মেমোরিয়ালের স্মরণ-কক্ষের দরজায় লেখা আছে—
তোমার চোখ যা দেখেছে, তা যেন তুমি বা তোমার আত্মা না ভুলে যায়, সে বিষয়ে সচেতন থেকো।
ফ্রান্সের ইহুদিদের কাছে এই একই বক্তব্যের আরেকটি সংক্ষিপ্ত রূপ হল, N’oublions Pass বা Lest We Forget। ইহুদিরা দীর্ঘ স্মৃতির অধিকারী। এই সময়ে আমাদেরও ঠিক একই ধরনের সক্ষমতা অর্জন করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমাদের সমষ্টিগত জাতীয় স্মৃতিতে এই চরমতম বিপর্যয় এবং তার জন্য দায়ী লোকেদের কথা গেঁথে রাখা উচিত। একটা সময় ছিল যখন আমাদের বাঁচার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হত, সেটিও যথেষ্ট দুঃখজনক ছিল, কিন্তু এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যখন একটি অক্সিজেন ক্যান বা বেড পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শেষমেশ আমাদের মৃত্যুর জন্যেও লাইন দিতে হচ্ছে। এসবের কিন্তু এখানেই শেষ হচ্ছে না— আমাদের এমনকি দাহ করার বা সমাধিস্থ হওয়ার জন্যেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এই ছবি কোনওভাবেই নেহরুর প্রতিশ্রুত ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি-র নয় অথবা বর্তমান প্রশাসনের অচ্ছে দিন-এর সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ নয়।
ভারতীয় অর্থনীতির ব্যবচ্ছিন্নকরণ, সামাজিক বন্ধনের ভাঙন ধরানো, সমস্ত সাংবিধানিক মূল্যবোধ বা সংস্থার বিলুপ্তিকরণ, সীমান্ত রক্ষার ব্যর্থতা, দারিদ্র থেকে বেরিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষকে আবার দারিদ্রের অন্ধকারে নিমজ্জিত করা, মিথ্যাচার, বিদ্বেষ এবং বিক্ষিপ্ত হত্যালীলা— সবকিছুই এই সরকারের প্রথম ছ বছরের জঘন্য কিছু কীর্তিকলাপের দৃষ্টান্ত ছিল। কিন্তু সেই সমস্ত কিছু বর্তমান কাজকর্মের কাছে ম্লান হয়ে গেছে।
নিজের দেশের হাসপাতালগুলির অবস্থা জানার বদলে দাভোসের মঞ্চে ওঠা, কোভিড টাস্ক ফোর্সের সঙ্গে আলোচনার বদলে ময়ূর নিয়ে ঘোরাঘুরি, দ্বিতীয় তরঙ্গ মোকাবিলার বদলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া, পর্যাপ্ত ভ্যাক্সিনেশনের বদলে সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রোজেক্ট বা প্রাইভেট জেটের মতো অবান্তর লোক-দেখানো কর্মকাণ্ডে কোটি কোটি টাকা ঢালা, শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মতামতগুলিতে আমল না দিয়ে করোনিলের মতো হাতুড়ে পদ্ধতিতে ভরসা করা, করোনার জিনোম সিকুয়েন্সিং না করে এনআরসি-র কথা বারবার মনে করানো— সবকিছুই যে কেউ একধরনের অন্তিম বিপর্যয়ের রেসিপি হিসেবে ধরে নিতে পারেন। বলা বাহুল্য, এই ‘যে কেউ’-এর মধ্যে শীর্ষ নেতা, তাঁর সাঙ্কো পাঞ্জা এবং বিকৃতমস্তিষ্ক সমন্বিত প্রাগৈতিহাসিক কিছু ভক্তকুল পড়েন না।
দেশ ঠিক যে কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে লড়ছে, সে সম্পর্কে আমাদের জানতেই দেওয়া হচ্ছে না। কোভিড সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সবরকম লুকোছাপা, তথ্যবিলোপ ইত্যাদির পূর্ণ আশ্রয় নিয়েছে সরকার। সবচেয়ে বিশ্বস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির মতে, যা প্রকাশ করা হচ্ছে তার চেয়ে প্রকৃত ছবিটি দশ থেকে পনেরো গুণ বেশি ভয়ঙ্কর। এর অর্থ, অন্তত দিনে অন্তত তিন মিলিয়ন সংক্রমণ এবং চল্লিশ হাজার মৃত্যু— এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে, গ্রাফ কিন্তু এখনও শীর্ষে ওঠেনি।
এই অবস্থার কথা দুঃখের সঙ্গে মেনে নেওয়ার বদলে সরকার থেকে বারবার করে গত বছরে ইউরোপ-আমেরিকায় মৃত্যুহারের সঙ্গে তুলনার অবান্তর সংলাপ আওড়ানো হচ্ছে। অন্যান্য প্রচারের মতোই এসবও একগুচ্ছ মিথ্যার সমারোহ। অধিকাংশ দেশেই মানুষ মারা যাচ্ছেন কোভিড ভাইরাসের জন্য, এখানকার মতো অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, হাসপাতালের বেড, ভ্যাক্সিন ইত্যাদির অভাবের জন্য নয়। দ্বিতীয় তরঙ্গ আসার আগেই দেশগুলি ওইসব প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলির জোগানে স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। অথচ আমাদের সরকার বিশেষজ্ঞের মতামত না শুনে গুরুত্ব দিয়েছে নিজেদের পিঠ চাপড়ানো, দাড়ি বাড়ানো, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা এবং অপ্রয়োজনীয় বিল ও আইন পাশ করানোর প্রক্রিয়ায়।
গত শতকের বিশের দশকের বাংলার দুর্ভিক্ষের পর ভারতে এতবড় অসহায়তা আগে কখনও আসেনি; তখন তা তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার, এখন করছে আমাদের নিজেদেরই নির্বাচিত সরকার। পৃথিবীর ‘ভ্যাক্সিন ফ্যাক্টরি’র তকমা পাওয়া একটি দেশ ক্রমশ ভ্যাক্সিন ও অক্সিজেনের জন্য ভিক্ষুকের স্তরে নিজেকে নামিয়ে এনেছে। শ্রীযুক্ত মোদি ভারতকে আন্তর্জাতিক ভিক্ষুক ও শববাহকে পরিণত করেছেন, অথচ তিনি নিজে জনগণকে তাঁদের অধিকার হিসেবে ভোট দেওয়ায় এবং স্বনির্ভর বা আত্মনির্ভর হওয়ার জন্য বড় বড় ভাষণ দিচ্ছেন। বরং, আমরা হয়ে উঠেছি ‘পরমাত্মানির্ভর’, যারা ঈশ্বরের দয়ার উপর নির্ভর করে আছি, যদিও সেই ঈশ্বর কোটি কোটি টাকা খরচ করা মূর্তি বা মন্দিরে আদৌ আছেন কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।
এই বিপর্যয়ের মূল কাণ্ডারী সেই ভয়ঙ্কর জুটি, নাম না করলেও যাঁরা জনগণের যন্ত্রণা ও দুর্দশার উপর দাঁড়িয়ে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছেন। কিন্তু জাতিকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করতে তাঁরাই একা দায়ী নন, তাঁদের সঙ্গে জুটেছেন দুষ্ট এক পরজীবী বৃত্ত, যাঁরা সেই জুটির সঙ্গে মিলেমিশে যেটুকু পেরেছেন শুষে খেয়ে নিচ্ছেন। আমাদের এই চক্রকে সনাক্ত করতে ইতস্তত করার কোনও কারণ নেই— মহান শপথ ও দপ্তরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা সেই তিনজন প্রধান বিচারপতি; দেহ ও আত্মা বিকিয়ে দেওয়া নির্বাচন কমিশনার; সিবিআই রেইড ও আয়কর দপ্তরের আধিকারিকেরা; দিল্লি পুলিশ— যাঁদের বাড়বাড়ন্ত এখন সত্যিই নথিভুক্ত করার জায়গায় পৌঁছে গেছে; একজন সিএজি— যিনি অডিটের চেয়ে কাঁচি চালাতে বেশি পারদর্শী; গোরখপুরের সেই দুষ্ট সন্ন্যাসী— যাঁর বীভৎসতা আমাদের উৎসুক করে তোলে সেই ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে জানতে যাঁকে তিনি পুজো করেন; মিডিয়া ম্যাগনেট এবং সঞ্চালকরা— যাঁরা কয়েক কোটির বিজ্ঞাপনের জন্য নাগরিককে সত্য থেকে বঞ্চিত করে দৈত্যদের উৎসাহ দিয়ে বিপর্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন; একজন সলিসিটর জেনারেল— যিনি যখনই উঠে বসছেন তখনই দাঁতের ফাঁক দিয়ে শুধুই মিথ্যেভাষণ করে চলেছেন, তা সে অভিবাসী শ্রমিক, অক্সিজেন সমস্যা বা কারারুদ্ধ সাংবাদিক যে বিষয়েই হোক না কেন; সেই সমস্ত সুবিধাবাদী মন্ত্রী— যাঁরা ইতিহাসে থেকে যাওয়ার জন্য ল্যুতিয়েনের দিল্লিতে একটি বাংলোর জন্য হন্যে হয়ে বসে আছেন; কর্পোরেট হাসপাতাল মালিক— যাঁরা অতিমারির কোপ আসবে জেনেও পিএএস অক্সিজেন প্ল্যান্ট না বসিয়ে শুধুই মৃত রোগীর জন্যেও একগুচ্ছ বিল বাড়িয়ে তাঁদের আত্মীয়দের শুষে নিচ্ছেন বিগত এক বছর ধরে; নীতিহীন আমলারা— যাঁরা এক্সটেনশন অথবা কোনও কর্মভারহীন পদ পাওয়ার লোভে জাতির পিঠে ছুরি বসাচ্ছেন; এবং সেইসব বিজেপি মুখপাত্ররা যাঁরা প্রত্যেক প্রাইম টাইম শোতে সহমর্মিতার বদলে ঔদ্ধত্য ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
আমাদের মনে রেখে দিতে হবে বোবদে এবং সুনীল অরোরাদের কথা, অর্ণব গোস্বামী বা রবিশঙ্করদের কথা, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা, ডক্টর হর্ষবর্ধন ও আইসিএমআর-এর প্রধানের কথা, অমিত মালব্য বা তেজস্বিনী সূর্যদের কথা, অথবা স্মৃতি ইরানি ও সাধ্বী প্রজ্ঞাদের কথা— এবং প্রশ্ন করতে হবে জাতিকে নরকে পরিণত করার জন্য তাঁরা আদৌ নিজেদের দোষী মনে করেন কিনা। বহু মানুষ ইতিমধ্যেই অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন, এবং অবস্থা এমন হয়েছে যে একটি হাইকোর্টকে সম্প্রতি বলতে হয়েছে, এই সরকারের ‘হাতে রক্ত লেগে আছে’ এবং অন্য আরেকটি হাইকোর্ট অবস্থাটিকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। প্রত্যুত্তরে সবরকমভাবে ব্যর্থ আমাদের বিদেশমন্ত্রী এই সবকিছুই অস্বীকার করে গণতন্ত্র কাজ করছে বলে আত্মসমর্থন করেছেন। আমাদের নেতাদের এই নির্লজ্জতা ও অমানবিকতা না দেখলে বা না শুনলে বিশ্বাস করা কষ্টকর হত। যেভাবে ইজরায়েলিরা তাঁদের অত্যাচারীদের প্রত্যেককে মনে রেখেছেন, সেভাবেই আমরাও যেন এঁদেরকে মনে রাখি। সেসব রাষ্ট্রেরই বৃদ্ধি হয়, যাদের ভালো ও খারাপ দুরকম সময়েরই দীর্ঘ এক স্মৃতি থাকে। ঠিক যেমনটি অশ্বিনীকুমার The Wire পত্রিকায় লিখেছেন, “ক্ষমতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনীয়।” একমাত্র এই মনে রেখে দেওয়াই অতিক্ষমতার দম্ভকে ভয়ে ভয়ে থাকতে বাধ্য করবে। এক আদর্শ পৃথিবীতে, যখন যুক্তির যুগ ফিরে আসবে, এইসব মুখগুলির দিকে আঙুল তুলতে হবে, বলতে হবে তাঁদেরকে যাঁরা বিশ্বাস করেছিলেন সেইসব সাধারণ মানুষকে ভয়ঙ্করতম কষ্ট এবং মৃত্যু উপত্যকায় ফেলে দিয়ে এককালীন গর্বিত এক জাতিকে কোন অবস্থায় নামিয়ে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। যদিও তাঁদের অভিসন্ধি শেষমেশ কোনওভাবেই বাস্তবায়িত হবে না। কারণ আমরা এখনও বুদ্ধ ও মহাবীরের ভারতবর্ষেই আছি। আজকের এই দিনগুলি দুঃখ ও যন্ত্রণার অগ্নিপরীক্ষায় একদিন না একদিন পাল্টে যাবেই। এঁদের নাম এবং কাজকর্ম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নথি হিসেবে রেখে দেওয়া উচিত যাতে সেই প্রজন্ম পাইড পাইপারের ছদ্মবেশে আসা ক্যালিগুলাকে চিনতে ভুল না করে।
আমরা কোনওদিন যেন না ভুলি— যেন ক্ষমা না করি।