Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নির্বাচন কমিশন কি কেন্দ্রীয় শাসকদলের তল্পিবাহক? ঘটনা পরম্পরা তো তাই বলছে

সুমন সেনগুপ্ত

 

 



কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার

 

 

 

 

এই মুহূর্তে সারা দেশের কোভিড পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবরে গণমাধ্যম ভরে আছে। তার মধ্যে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। যে সময়ে বাংলার নির্বাচন চলছিল সেই সময়কার একটা খবর হয়তো অনেকের চোখ এড়িয়ে গেছে। চার দফা নির্বাচন যখন হয়ে গেছে ঠিক সেই সময়েই মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি মামলার শুনানির সময়ে নির্বাচন কমিশনকে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। তাঁরা বলেন যে এই মুহূর্তে ভারতের কোভিড পরিস্থিতি এত খারাপ হওয়ার জন্য অন্যতম দায়ী নির্বাচন কমিশন। শুধু এটুকু বলেই তাঁরা নিষ্কৃতি দেননি, তাঁরা এও বলেছেন যে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে খুনের মামলাও দায়ের করা উচিত। এই রকম অতিমারির আবহে কেন তাঁরা এই আট দফা নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন সেই প্রশ্নও তোলা হয় মাদ্রাজ হাইকোর্টের পক্ষ থেকে। কেন এই ভাবে নির্বাচনী সভা, কেন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচার অভিযানের বিরুদ্ধে রাশ টানা হয়নি? এমনিতে গণমাধ্যমে এইরকম ধরনের খবর কম আসে, কিন্তু আজকের সামাজিক মাধ্যমের সময়ে এই ধরনের খবর চেপে যাওয়া সম্ভব নয়। যথারীতি এই খবর বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই শোরগোল পরে যায়। মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যে নির্বাচন কমিশনের সম্মানহানি হয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে কমিশন সর্বোচ্চ আদালতের কাছে যায়। এর পাশাপাশি তাঁরা এও আর্জি জানায় যে আদালতের মৌখিক পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য যেন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না করা হয়। আশার কথা এটাই যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই আপিল খারিজ করে দিয়েছেন।

যে কোনও নির্বাচনে মুখ্য চরিত্র হওয়ার কথা রাজনৈতিক দল এবং নেতানেত্রীর, কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেরা খলনায়কের চরিত্র নিঃসন্দেহে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া যায়। এমনিতে কোনও নাগরিকের এই আশা নেই যে নির্বাচন কমিশন সম্পুর্ণ পক্ষপাতহীন আচরণ করবে। কিন্তু এই রকম নির্লজ্জভাবে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে ওকালতি করবে সেটাও কি কেউ ভেবেছিলেন? যখন বলা হয় যে শেষ চার দফা নির্বাচন একসঙ্গে করা হোক, এবং রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশের ওপরে নিয়ন্ত্রণ করা হোক, তখন নির্বাচন কমিশন সেই আবেদনে কর্ণপাত করেনি। এর আগের বহু নির্বাচনে কমিশনের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু এইরকমভাবে হেনস্থা কি কোনও দিন হতে হয়েছে? একদিকে নির্বাচন পরিচালনায় খামতি অন্যদিকে মাদ্রাজ হাইকোর্টের তরফ থেকে এইরকম মন্তব্য সব মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনের শুধু মাথা হেঁট হয়নি, ভারতের গণতন্ত্রেরও হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন একটি স্বশাসিত সংস্থা। দেশে যখন প্রথম নির্বাচন হয় তখন নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন সুকুমার সেন। তখন এইরকম পরিকাঠামো না থাকলেও দক্ষতার সঙ্গে সেই নির্বাচন পরিচালনা করে তিনি যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। তার পরে বিভিন্ন নির্বাচন কমিশনার এসেছেন যাঁরা নিজের দক্ষতায় কমিশনের স্বাতন্ত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। টি এন শেষন, এস ওয়াই কুরেইশি সহ অন্যান্য বহু কমিশনার নিজেদের একটা স্থান করে নিতে পেরেছিলেন। মানুষকে এটা অন্তত তাঁরা বোঝাতে পেরেছিলেন যে নির্বাচন কমিশন কারও অধীনস্থ কোনও সংস্থা নয়। এবারের নির্বাচনের আগেও কুরেইশি সাহেব, বিভিন্ন পত্রিকাতে নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতাও করেন। অথচ সর্বোচ্চ আদালতে তার স্বপক্ষে দাঁড়ায় এখনকার নির্বাচন কমিশন। আসলে এবারের নির্বাচন কমিশন প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় শাসকদলের তল্পিবাহকের ভূমিকায় থাকবে বোঝা গিয়েছিল যখন তাঁরা এই কোভিড পরিস্থিতিতেও আট দফায় বাংলার নির্বাচন করার সুপারিশ করেছিলেন। যে কোনও নির্বাচনে মানুষ তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে তাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। একইভাবে নির্বাচন কমিশনও প্রতিটি নির্বাচনে নিজেদের আরও গণতান্ত্রিক আরও স্বাধীন আরও স্বতন্ত্র হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু এবারের বাংলার নির্বাচনে কি তা দেখা গেল? সমস্ত রকমের প্রযুক্তি, নানান ধরনের সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এক কথায় ব্যর্থ হয়েছেন। নির্বাচন শেষ হয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হয়ে গেলেও মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন যে এই নির্বাচন কমিশন নিজেই কেন্দ্রের শাসকদলের হয়ে রিগিং করেছেন। বিধানসভার ধারাবিবরণীতে কিন্তু এটাও লেখা হয়ে থাকল। আগামীদিনে যখন ভারতের নির্বাচনের ইতিহাস নিয়ে কোনও ছাত্র পড়াশুনা করবেন তখন নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে এবারের বাংলার নির্বাচনকে তিনি নিশ্চিত আলাদা করে পড়বেন।

মাদ্রাজ হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ নিয়ে নির্বাচন কমিশন এতটাই অপমানিত হয়েছেন যে তাঁরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন যে এইরকম ধরনের মৌখিক মন্তব্য যেন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ না করা হয়। তাঁদের আবেদনে বলা হয় যে যেহেতু আদালত এবং নির্বাচন কমিশন উভয়েই স্বশাসিত সংস্থা তাই এই খবর প্রকাশের মধ্যে দিয়ে দু পক্ষেরই সম্মানহানি হয়েছে। কিন্তু এই আবেদন করার সময়ে কোথাও তাঁরা এটা ভুলে গেলেন যে সংবাদমাধ্যমেরও একটা স্বাধীন সত্তা আছে। তার স্বাধীনতা কোথাও খর্ব করা হবে না তো? আশার কথা এটাই যে সর্বোচ্চ আদালত নির্বাচন কমিশনের এই আবেদনকে খারিজ করে দিয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির মন্তব্য হয়তো করোনা অতিমারির সময়ে এইরকম মৃত্যুমিছিল দেখে তাৎক্ষণিক উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ কিন্তু তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। এমনিতে সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪২ তম। সেখানে যদি নির্বাচন কমিশনের এই আবেদনে সর্বোচ্চ আদালত আবার সায় দিতেন তাহলে কি বিশ্বের কাছে ভারতের সম্মান বাড়ত? এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের মন্তব্যে বরঞ্চ বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রহরায় সংবাদমাধ্যম একটু হলেও আশস্ত হল। কিন্তু সেটুকুতেই নিশ্চিন্ত হওয়ার কি কোনও অবকাশ থাকে? বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আদালতে জনসবার্থ মামলা হয়। বহু মানুষ দাবি করে আসছেন এই ধরনের মামলার শুনানিও যেন সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। আদালতের তাতে এখনও সায় নেই। আগামী দিনে সংবাদমাধ্যমও এই দাবিকে যাতে সামনে নিয়ে আসে সেই লড়াইও করা জরুরি। যেকোনও স্বশাসিত সংস্থার সায়ত্বতা রক্ষার দায়িত্ব সেই সংস্থাগুলোরই। প্রতিটি এই ধরনের সংস্থা একে অন্যের পরিপূরক। এই বিষয়টি যদি প্রতিটি সংস্থা মাথায় রাখে তাহলে ভারতের গণতন্ত্রেরই লাভ হয় না কি?