শুভঙ্কর ঘোষ রায়চৌধুরী
অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক
শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িকতায় বা শাসকদলের সমস্ত সিদ্ধান্তের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যেই নয়, ভারতের সাংস্কৃতিক চর্চার নানা অলিন্দতেও সময়ে-অসময়ে জারিয়ে দেওয়া হয়েছে সমস্ত বৈচিত্র্যের সংহারক জাতীয়তাবাদী প্রকট বা প্রচ্ছন্ন ঢেউ। আপাতভাবে বিনোদনের আঙ্গিকে বেঁধে দেওয়া শিল্পচর্চার অলিন্দগুলি যে-কোনও দেশের শাসকশ্রেণির কাছেই ‘সফট টার্গেট’— প্রয়োজনে নিজেদের মতাদর্শ একটি সুতোয় বেঁধে শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে মানুষকে গিলিয়ে দেওয়া কঠিন নয়; কারণ দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি বা দাঙ্গা বা উচ্ছেদ নিয়ে জনসাধারণ যত সহজেই ক্ষেপে উঠুক না কেন, শিল্পমাধ্যম তাদের কাছে প্রাথমিকভাবে উপভোগ্য, বিনোদনমূলক। তার মধ্যেও যে রাজনীতির স্তর থাকতে পারে, এ বিষয়ে মানুষের সচেতনতা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু আত্মসচেতন শিল্পমাধ্যমেরও নিজস্ব এক আবর্ত আছে— সময় ও প্রজন্মের চাহিদা অনুযায়ী বহিরঙ্গে সে পরিবর্তন নিয়ে এলেও, তার ভিতে সহজে ঘা লাগতে দেয় না।
ভারতীয় দেশপুঞ্জের স্বতন্ত্র বহুত্বকে ঠুলি পরাতে চাইছে আজ যে উগ্র হিন্দুত্ববাদ, এই প্রবণতা কিন্তু তার একার নয়। ইতিহাসে তাকালে, কেন্দ্র বরাবরই বহুত্বের উপস্থিতিতে সন্ত্রস্ত হয়েছে। আর সব ছেড়ে যদি শিল্পমাধ্যমকেও ধরি, এবং নির্দিষ্টভাবে থিয়েটারকে— রাজনীতি ও সমাজের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে থাকা মাধ্যমটি— আমরা দেখব, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে কীভাবে সময়ে সময়ে তার উপর ফিরে এসেছে জাতীয়তাবাদের বা ‘এক দেশ’ তত্ত্বের ছায়া। স্বাধীনতা-উত্তর বললাম, কারণ প্রাক-স্বাধীনতা যুগে পাশ্চাত্য, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সরব হতে ভারতের থিয়েটার-চর্চাতেও ন্যূনতম সমমতের পরিসর তৈরি হয়েছিল। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকে সৃষ্ট ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক শাখাগুলি ছিল এর মূলে। ইউরোপ জুড়ে ১৯২৯-এর চরম অর্থনৈতিক মন্দা এবং ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক যে সচেতনতার স্বর গড়ে তুলতে চেয়েছিল প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন, তার সূত্র ধরে ভারতীয় সামাজিক প্রেক্ষাপটে আইপিটিএ ১৯৪৩ সালে তার প্রথম সমাবেশে শিল্পীদের রাজনৈতিক-সামাজিক দায়কে সমমতে বাঁধার দিকে এগোয়। বসুধা ডালমিয়ার কথায়, “There was a new emphasis on Indianness, a new enthusiasm for the culture of the people coupled with a fervent post-1942 patriotism that condemned alien rule in its entirety.” আমাদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় ‘Indianness’ কথাটির দিকে— ভারতীয়ত্ব— অর্থাৎ, প্রাথমিকভাবে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার শাখা হয়েও সেই মুহূর্তে আমাদের দেশে উপস্থিত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রেক্ষিতে বৈচিত্র্যের বিচ্ছিন্নতা থেকে ভারতীয়ত্বের সমমনস্কতাকে বেশি জোর দিয়েছিল। ব্রিটিশদের বহুদিনের প্রিয় ‘Divide and Rule’ পলিসি ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় সমস্বর হয়ে ওঠার ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল তখন।
আসল গল্প অবশ্য শুরু হয় ১৯৪৭-এর পর থেকে। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের পরিস্থিতি ও চাহিদা ততদিনে বদলে গেছে; যে ঐক্য ভারতীয় দেশপুঞ্জদের বেঁধে রেখেছিল এক সুতোয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, নতুন গণতন্ত্রের উন্মেষে সে বিস্মৃতপ্রায়। আইপিটিএ যে আশু উদ্দেশ্যে আন্দোলনে নেমেছিল, সেই উদ্দেশ্য প্রাসঙ্গিকতা হারানোয়, এবং তার ঘনিষ্ঠ সিপিআই পার্টির ঘনঘন পলিসি বদলের জেরে আন্দোলনও কিছুটা দিকভ্রষ্ট। ফলত, এমন বৈচিত্র্যময় দেশে যে-কোনও নিউক্লিয়াস একটু আলগা হলে প্রচণ্ড কেন্দ্রাতিগ গতিবেগে যেভাবে সমস্ত জড়ো করা উপাদান ছিটকে বেরিয়ে যেতে থাকে, সেভাবেই আইপিটিএ-র কাণ্ডারীরা সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করতে থাকলেন নতুন দল। আইপিটিএ-র বাংলা শাখার কথাই যদি ধরি, বিজন ভট্টাচার্য বেরিয়ে এসে তৈরি করছেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’; ক্রমে বেরিয়ে আসছেন শম্ভু মিত্র, সৃষ্টি হচ্ছে ‘বহুরূপী’র; উৎপল দত্তের হাতে গড়ে উঠছে ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের একক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিছুটা অচল হল; এমনকি, পাশ্চাত্যের নাট্য-সংস্কৃতির উত্তরে লোকনাট্যের পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে আইপিটিএ যে কেন্দ্রীভূত ভারতীয়ত্ব নিয়ে এসেছিল, তার বদলে দেখা গেল তীব্র, স্বতন্ত্র আঞ্চলিকতা। এমনকি একটি অঞ্চলের স্বরের মধ্যেও দেখা যেতে শুরু করল আরও বহু উপস্বর-ভাষা-প্রথা। এই বহুস্বরকে মান্যতা দিয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, “একটা সময় ছিল যখন আমরা একটি একক ‘ভারতীয় থিয়েটার’-এর কথা ভাবছিলাম, ভাবছিলাম কিভাবে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষ্য এই ভারতীয় থিয়েটারে নিজেদের অবদান রাখবে। শেষ কিছু বছরে এই উদ্দেশ্য ভালোমতই হোঁচট খেয়েছে … এখন গুরুত্বপূর্ণ এটুকুই নিশ্চিত করা যে প্রতিটি অঞ্চল, তা সে যতই ছোট হোক না কেন— শুধু বাংলা, বা মারাঠি বা গুজরাটি বা মণিপুরী নয়, এমনকি বাংলার, মারাঠির, গুজরাটির, মণিপুরীর অভ্যন্তরস্থ আঞ্চলিকতাগুলিও যেন পৃথকভাবে এক একটি পারফর্মেন্স সংস্কৃতি হয়ে ওঠে।” (আমার অনুবাদ)
তবে নতুন দেশ হিসেবে ভারত যে ঐক্যবদ্ধ, তা প্রতিপন্ন করার রাজনৈতিক তাগিদেই, এই আঞ্চলিক বহুস্বরের স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’; আবারও একবার কেন্দ্রীকরণের ঢেউ এসে লাগে নাট্যতত্ত্বে, যার পুরোধা হয়ে ওঠেন সুরেশ অবস্থি। মূলস্রোতকে ছাড়িয়ে বিকেন্দ্রীভূত যে আঞ্চলিক বিকল্প বহুভাষ উঠে আসছিল থিয়েটারে, অবস্থি তাদেরই বাঁধতে চান নিজের ‘থিয়েটার অফ রুটস’-এর রশিতে। ১৯৭১–এ তাঁর পরিচালিত লোকনাট্যের সমসাময়িক প্রায়োগিকতা সম্বন্ধীয় গোল-টেবিল বৈঠকে অবস্থি আঞ্চলিক বহুস্বরের মধ্যেও একটি সার্বজনীন শিকড় খোঁজার চেষ্টা করেন, আদর্শে ও গঠনে। লোকসংস্কৃতির পুনরুন্মেষবাদকে নিজের অস্ত্র করেই তিনি আঞ্চলিক বহুমুখী চর্চার মধ্যেও একপ্রকার ‘জাতীয়’ সংযোগ লক্ষ করছেন, পাশ্চাত্য প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দেশজ শিকড়ের খোঁজ করে চলার ন্যূনতম সমমতে। তাই, অবস্থির আলোচনায় একই ছত্রছায়ায় উঠে আসে বি ভি করন্থ, কে এন পানিক্কর, রতন থিয়াম, হাবিব তনভির, বাদল সরকার, এমনকি শম্ভু মিত্রের রবীন্দ্রনাট্যগুলিও।
অবস্থি-পরবর্তী সময়ে থিয়েটারে এই দুই ধারাই পাশাপাশি কাজ করে চলেছে। একদিকে যেমন কেন্দ্রানুগ একক স্বর গড়ার প্রয়াস দেখা গেছে, তেমনই কেন্দ্রাতিগ হয়ে আঞ্চলিক বহুস্বরে বারবার ছড়িয়ে পড়েছে থিয়েটার। ক্ষেত্রবিশেষে ক্যাপিটালিজমের মূলস্রোতের আওতায় অবশ্য আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতিও এসেছে, পণ্য হয়ে, urban folk নামে। কিন্তু বিকল্প ধারায় এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে নিবিষ্ট নাট্যচর্চা হয়ে চলেছে, তা প্রতিনিয়তই জানিয়ে যায়, আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রের যুগে ‘ভারতীয় থিয়েটার’ (Indian Theatre) বলে কোনও অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব, তা আরোপিত; বরং ‘ভারতের থিয়েটার’ (Theatres of India) বললে তাকে যথাযথ মান্যতা দেওয়া হয়। অবশ্য সে কথা ১৯৯৫ সালে জি পি দেশপাণ্ডের “Is There or Should There be a National Theatre in India?” প্রবন্ধেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে—
ধরুন, আপনি থিয়েটার করছেন; কিভাবে বোঝাবেন যে আপনি ভারতীয় থিয়েটার করছেন? আমরা থিয়েটার করলে আমাদের ‘ভারতীয়ত্ব’র পরিচয়টা কি প্রয়োজনীয় নয়? আমার কাজ নিজের সেই পরিচয় খোঁজা নয়; আমার কাজ নিজের থিয়েটারকে খোঁজা। আমার থিয়েটারই আপনাকে আমার পরিচয়ের কিছুটা জানিয়ে দেবে। আর সর্বোপরি তো আছেই, থিয়েটারের ‘জাতীয়তা’ সম্বন্ধীয় বাগবিতণ্ডা। আমার কাজ হল নিজের থিয়েটারকে চিহ্নিত করা, ‘জাতীয়’ থিয়েটারকে নয়। কী এমন জানি আমি এই দেশের? সংবিধানের অষ্টম স্কেডিউলে মান্যতা পাওয়া চোদ্দো-পনেরোটা ভাষার কটা আমি নিজে বলি? টেনেটুনে দুটো বলি, আর সঠিকভাবে জানি মাত্র একটা ভাষাকে। আমার সাহস হয় কী করে এই কথা বলার যে আমি এই দেশকে জানি? আমার মনে হয়, আমি জানি থিয়েটার কাকে বলে, কিন্তু কোনওদিনই আমার থেকে তা জানতে চাওয়া হবে না; উপরন্তু যারা দেশের কিছুই জানে না বোঝে না, তারা আমার উপর চাপিয়ে দেবে দেশের একটা সংজ্ঞা। … শুধু ‘জাতীয়’ থিয়েটার কেন, আপনি করতে চাইলে রাজ্য থিয়েটার, জেলা থিয়েটার, শহুরে থিয়েটার, মহল্লা থিয়েটার করুন না! এটা অনেকটা সেই চিনাদের বলা কথার মতো, যে তারা ঠিক সোশ্যালিজম নয়, এক ধরনের ‘চিনা’ সোশ্যালিজম আনতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই, দেশকে সংজ্ঞায়িত করার এই কাজ কয়েক ধাপ এগিয়ে ‘জাতীয়’ থিয়েটারকেও সংজ্ঞায় বাঁধতে চায়। কিন্তু সত্যি বলতে, এর মূল উদ্দেশ্য আধুনিকতাকে বাধা দেওয়া, বা থিয়েটারের ভাষায়, আধুনিক থিয়েটারকে বাধা দেওয়া। (আমার অনুবাদ)
আঞ্চলিক বহুস্বরের সামনে, ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের সামনে ‘এক দেশ’ তত্ত্ব যে কেবল অসংলগ্ন নয়, হাস্যকরও বটে, তথাকথিত ‘বিনোদন’-দ্রব্য থিয়েটারও সেই কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে বারংবার, এই ভারতবর্ষে।
ঋণ –
১। বসুধা ডালমিয়া, Poetics, Plays and Performance: The Politics of Modern Indian Theatre (2006)
২। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, “The Cultural Body of the Community” (2009)
৩। জি পি দেশপাণ্ডে, “Is There or Should There be a National Theatre in India?” (1995)