Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রেড ভলান্টিয়ার্স: সঙ্কটে সম্ভাবনায়

সৌম্যজিৎ রজক

 



রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

আমাদের পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে কিছু ছেলেপিলে ছিল, সুখের চেয়ে দুখেই যাঁদের দেখা যেত বেশি।

প্রতিবেশীদের জ্বর-জ্বালা বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল এঁদের কাজ। হাসপাতালে, শ্মশানে, কবরস্থানে কেটে যেত জীবনের কত কত রাত। যাবতীয় হতাশা ও ব্যথা চেপে বেকার জীবনের কোত্থেকে জোটাত এঁরা এমন জীবনীশক্তি, তাজ্জব বনে যেত সমকাল! কখনও সখনও হয়তো টিউশনি পড়িয়ে জোটানো বিড়ি কেনার পয়সাটুকুও বেরিয়ে যেত কারও প্যারাসিটামল কিনে দিতে!

তারপর কত কিছু হারিয়ে গিয়েছে আমাদের জীবনের থেকে। ভেঙে গেছে কত ঘর। ঝড়ে বা বিবাদে। উনুন আলাদা হয়েছে অধিকাংশ একান্নবর্তী পরিবারের। পাড়াতুতো সম্পর্কগুলো শুকিয়ে গিয়েছে। শুকিয়ে গিয়েছে পাড়াগুলোও। বেকার ছেলেপিলেগুলোও অনেকে চলে গেছে ভিন্ন প্রদেশে রুটিরুজির তাগিদে। গ্রামও ভেঙে গেছে। ভেঙে যাওয়া, সে এক ভঙ্গুর সময় ছিল বটে!

ভাঙছিল সোভিয়েত দেশও। ভাঙছিল পুরনো দুনিয়া। আমরাও হয়ে উঠছিলাম অংশীদার এক নতুন বিশ্বের। নয়া উদার অর্থনীতি এল দেশে। সেসব অনেক জটিল ব্যাপার, কারও কারও অপ্রাসঙ্গিক বোধ হতে পারে, আপাতত থাক!

আমাদের পাড়া, গাঁয়ে তখন ছোট পরিবারগুলো সুখী হতে চাইছিল। ছোট ছোট সংসারে জন্মাছিল ফুটফুটে বাচ্চারা। আমরা জন্মাচ্ছিলাম তখন।

একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছিল সংস্কার পরবর্তী নতুন ভারতে।
একটা প্রজন্ম বড় হচ্ছিল একা একা। একটা প্রজন্মের বন্ধু হচ্ছিল ভিডিও গেম, কার্টুন চ্যানেল।
একটা প্রজন্মের একলা ঘরই হল দেশ। একলা থাকার অভ্যেসে বড় হচ্ছিল একটা প্রজন্ম।
কেউ কেউ বলেছিল, ‘ইঁদুর প্রজন্ম’। প্রতিযোগিতায় মগ্ন। নিজেতে নিজেই রত কেরিয়ারের চিন্তায়।
‘সমাজ’ নামক এক মান্ধাতার ধারণার থেকে দূরে একটা প্রজন্ম ছিল সামূহিক বিচ্ছিন্নতায়। অ-সামাজিক। স্বভাবতই ‘অ-রাজনৈতিক’ তো বটেই!
একটা প্রজন্ম পাতি গোল্লায় গিয়েছিল।

শোনা যায়, মার্কস নাকি বলেছিলেন, কারণ সমস্ত কিছুরই থাকে, হয়তো তা যুক্তিসঙ্গতভাবে দেখা যায় না সবসময়। দেখা না গেলে তাকে ‘ম্যাজিক’ ভাবে লোকজন। বাচ্চেলোগ তালি মারে জোরে! আদতে সে ‘ম্যাজিকে’রও কার্যকারণ থাকে পশ্চাতে।

তেমনই ম্যাজিক এক দেখাল ইতিহাস। এইবার। অভূতপূর্ব এই সঙ্কটকালে।

‘রেড ভলান্টিয়ার’। তরুণ, তরুণতর ছেলেমেয়েরা বাংলার কাঁধে নিয়ে ছুটছে সিলিন্ডার অক্সিজেনের। পকেটে হয়তো কারও র‍্যামডিসিভির। কেউ কেউ বলেছিল ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে। এঁরা ‘সামাজিক সংহতি’র নজির গড়ছে।

সংক্রামক ব্যাধি। স্বাভাবিক কারণেই আতঙ্কে, ভয়ে কেউ কাছে ঘেঁষতে ছাইছে না রোগীর। এই ভয় অযৌক্তিক, রীতিমতো অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রসূত। সতর্কতার কারণ রয়েছে, আতঙ্কের নেই। সতর্কতা অবলম্বন করেই এঁরা প্রয়োজনে ঢুকছেন কোভিড রোগীর ঘরেও। কখনও অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিতে তো কখনও রোগীকে চ্যাংদোলা করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিতে।

অনেককেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে তো নিদারুন হ্যাপা। স্বাস্থ্যভবনের বাবুদের ফোনে পাওয়া সে এক সাধ্যসাধনার ব্যাপার। সরকারি ওয়েবসাইটে দেখাচ্ছে অমুক হসপিটালে বেড আছে, সেইখানে গিয়ে শুনবেন ‘নেই’। হাসপাতালের বেড খুঁজতেও সাহায্য করছেন এঁরা।

‘রেড ভলান্টিয়ার’রা যে কী কী কাজ করছেন, কী কী প্রায়-অসাধ্য তারা সাধন করছেন, সেকথা মোটের ওপর সকলেই কমবেশি জানেন। তাই সে বর্ণণায় গিয়ে লাভ নেই। এখন পুরোদমে কাজ চলছে, আরও পরে হয়তো, হয়তো খানিকটা দূর থেকে যখন ফিরে দেখা হবে এই সময়টাকে তখন এর সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়া সম্ভব হবে। আপাতত রেড ভলান্টিয়ারদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু (সবটা নয়) সাধারণ চিন্ত্রাসূত্র, একেবারেই মোটা দাগে, এক দুই তিন চার করে লিপিবদ্ধ করি! অন্তত চেষ্টা করা যাক!

এক। কোভিড ১৯-এর প্রথম তরঙ্গ বড় শহরগুলোতে জোর ধাক্কা মেরেছিল। ছোট শহরগুলোতে বা গ্রামগুলোতেও সংক্রমণ ছড়িয়ে ছিল, তবে তা এবারের মতো এত তীব্র ছিল না। এইবার মানে দ্বিতীয় তরঙ্গে গ্রাম বাংলা উজাড় হচ্ছে রীতিমতো। মফস্‌সল ছারখার হচ্ছে। প্রচারের আলো সবসময়ই কলকাতায় যতটা পড়ে, প্রান্তে সেইমত পড়ে না। অন্ধকারেই দিনরাত কাজ করছেন রেড ভলান্টিয়ারেরা। এই উদ্যোগটি নিছক কলকাতা-কেন্দ্রিক নয়। এইটে বড় আহ্লাদের ব্যাপার। গ্রামে-গঞ্জে-আধা শহরে-মফস্‌সলে, পশ্চিমবাংলার প্রতিটা জেলায় গড়ে উঠেছে রেড ভলান্টিয়ারদের বাহিনি। নিজেদের বিকেন্দ্রীভূত উদ্যোগে। পূর্ণ উদ্যমে কাজ করছেন কমরেডরা। কিন্তু যে অবস্থানগত অসুবিধাগুলো ঐতিহাসিকভাবেই রয়েছে, তাকে অতিক্রম করে যেতে তো পারছেন না। ওষুধ, অক্সিজেন থেকে অক্সিমিটার বা অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা— যখন যেমনটা প্রয়োজন পাওয়া কি সহজ? এমনকি রেড ভলান্টিয়ারদের মাস্ক, পিপিই ইত্যাদিও তো অপ্রতুল। সঙ্গত কারণেই নাগরিক চৌহদ্দির বাইরে যে যুবক-যুবতীরা লড়ে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি সংহতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ভীষণ রকম। সেটা তুলনায় বেশি রিসোর্সের জোগান আছে এমন জায়গার রেড ভলান্টিয়ার্স টিমগুলির পক্ষ থেকেও যেমন, তেমনই রেড ভলান্টির্সের কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছেন যেসকল সংবেদনশীল মানুষ তাঁদের পক্ষ থেকেও।

দুই। রেড ভলান্টিয়াররা মূলত কাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন? যাঁরা ইতিমধ্যে সংক্রামিত হয়েছেন, তাঁদের। যাঁরা এখনও সংক্রামিত হননি তাঁদের তো যখন তখন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থেকে যাচ্ছে। কমে যাওয়া আয়ে বেড়ে যাওয়া সংসার খরচ পুষিয়ে কিনতে পারছেন স্যানিটাইজার, বাড়তি সাবান সকলে? সকলে কি নিয়মিত নতুন বা পরিষ্কার মাস্ক কিনতে পারছেন? আমরা দেখছি না, কত মানুষ একটাই মাস্ক পরে থাকছেন দিনের পর দিন? তাঁদের কাছে ন্যূনতম এই জিনিসগুলো পৌঁছে দেওয়াও জরুরি। তার উদ্যোগও নিচ্ছেন রেড ভলান্টিয়াররা অনেক জায়গাতেই। এইটে এক শ্রেণিগত দায়বদ্ধতা।

তিন। উপসর্গ দেখা দিলেই সকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারছেন? সেই সুযোগ রয়েছে সকলের? সকলে চাইলেই টেস্ট করাতে পারছেন? পজিটিভ রোগীরা সকলে ঘরে নিয়মিত অক্সিজেন লেভেল ইত্যাদি মাপতে পারছেন? এই কাজগুলির দায়িত্ব কে নেবে? কার দায়? অবশ্যই সরকার, স্থানীয় সরকারের। তাঁরা যখন নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে না তখন দাবি তুলতে হবে না? সেই দাবিতে চাপ তৈরি করতে হবে না কর্তৃপক্ষের ওপরে? প্র্য়োজনে গড়ে তুলতে হবে আন্দোলন। আক্রান্ত মানুষকে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিজেদের এগিয়ে গিয়ে উদ্যোগ নিতে হচ্ছেই। রেড ভলান্টিয়ারেরা নিচ্ছেনও। কিন্তু তাতেই সমাধান সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসঙ্কট মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মানাটা যেমন আবশ্যিক, রাজনৈতিক সঙ্কটে তেমনই রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তোলা।

চার। হ্যাঁ, রাজনীতি। ভাইরাস প্রকৃতিজাত। কিন্তু মানুষ আজ ভাইরাসকে যতটা ভয় পাচ্ছেন তার চেয়ে ঢের বেশি আতঙ্কে রয়েছেন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে। সংক্রামিত হলে চিকিৎসাটুকু মিলবে কিনা তাই ভেবে হয়রান হচ্ছেন। সরকারি হাসপাতালে বেড মিলছে না। বেসরকারি হাসপাতালে দিনে লাখ-দেড় লাখ বিল। ঘরে রেখে চিকিৎসা করাবেন? অক্সিজেন খুঁজতে ছুটে যাবে কালঘাম। সিলিন্ডার থেকে ভালভ কিংবা ওষুধের দেদার চলছে কালোবাজারি। খোলা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করলে সেটা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের চুক্তি ভঙ্গ করা হবে। মানুষের ভোটে নির্বাচিত সরকার সে চুক্তির কাছে যতটা দায়বদ্ধ মানুষের কাছে তার ছিঁটেফোটা নয়। মানুষ মরছে আর মুনাফা চড়ছে বাজার-প্রভুদের। তাদেরকে আরও মুনাফা কামানোর সুযোগ করে দিতে হবে। এমনকি ভ্যাক্সিনও তাই বাজারেই ছেড়ে দেওয়া হল। রাষ্ট্র নিজের ঘাড় থেকে জনস্বাস্থ্যের যাবতীয় দায় ও দায়িত্ব ঝেড়ে সবটাই ছেড়ে দিয়েছে অনিয়ন্ত্রিত বাজারের হাতে। নিছকই স্বাস্থ্যসঙ্কটে সীমাবদ্ধ থাকেনি তাই পরিস্থিতি। মানুষ নিক্ষিপ্ত এক রীতিমতন রাজনৈতিক সঙ্কটে। অতএব কী কী করণীয়?

এখনও পর্যন্ত রেড ভলান্টিয়াররা যে কাজটি করছেন তা আসলে কী? অক্সিজেন সিলিন্ডার না মিললে হাজার জন সাপ্লায়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খুঁজে আনা। অক্সিজেন ভালভ বা অন্যন্য ওষুধের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। অর্থাৎ বাজারে ইন্টারভেইন করছেন। মরণাপন্ন সহনাগরিককে বাঁচাতে এই কাজ আশু, তৎক্ষণাৎ করতেই হবে। কিন্তু এইটুকুতে সমস্যা মিটবে না। একে মেটানোর পথ একটাই। চিরকালের পথ। সংঘর্ষ। আন্দোলন গড়ে তোলা। লড়াই। সরাসরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যে রাষ্ট্র তার জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

এই কাজ অনিবার্য, এর কোনও বিকল্পই নেই। আর এঁরাও তো কেউ নিছকই ‘ভলান্টিয়ার’ নন, ‘রেড ভলান্টিয়ার’ সকলে।

এই মুহূর্তে যে কাজ করছেন এঁরা তাতে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিতি ঘটছে। পরিচিতিই নয়, তৈরি হচ্ছে সম্পর্ক। একেই সম্বল করে, সঙ্কটাপন্ন মানুষগুলোকে জুড়ে জুড়ে অত্যন্ত জরুরি এক রাজনৈতিক সংগ্রাম, গণআন্দোলন গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ এসেছে।

বামপন্থী আন্দোলনের তরুণ কর্মীরা বিলক্ষণ জানেন কীভাবে মিছিল সাজাতে হয়! কীভাবে তেড়ে যেতে হয় প্রচণ্ড রাষ্ট্রশক্তির দিকে! আর কীভাবেই বা উপড়ে ফেলতে হয় তার সমস্ত ব্যারিকেড!

‘ম্যাজিক’ নয়, নির্দিষ্ট কার্যকারণ সূত্রেই ইতিহাসের ভারসাম্য পালটায়। রাজনৈতিক ভারসাম্য। ভারসাম্য পালটায় শ্রেণিশক্তিসমূহের। পাল্টাতে হয়।

স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়েছে এক আপাত ‘সমাজসেবামূলক’ কর্মকাণ্ড। সচেতনভাবে একে সংহত করে সমাজ বদলের লড়াইতে উন্নীত করাই চ্যালেঞ্জ।

এবং চ্যালেঞ্জটি গৃহীত হয়েছে।


*লেখার ভেতরের ছবিগুলি লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত