অদিতি বসুরায়
কবিতায় ধুয়ে যাচ্ছে একটা রাস্তা। আর সেই পথকে বুকের মধ্যে নিয়ে একের পর এক কাপলেট, লিরিক-সহ পংক্তি লিখে যাচ্ছেন দুই কবি! সে সব ‘উন্মাদের পাঠক্রম’, নীল মলাট পরে, ফুল ছাপ নিয়ে, চাঁদের ইঙ্গিত নিয়ে সেজেছে এক আঁকিয়ের হাতের ম্যাজিকে। তিনি যোগেন চৌধুরী!
‘পার্কস্ট্রিট পদাবলী’— শুদ্দু একটা রাস্তাকে নিয়ে কত কত কবিতা বই— কত প্রেম— কত পদধ্বনি! কলকাতা থেকে দূরে, কলকাতার বুকের ভেতর থাকা এক সরণী জেগে ওঠে, ফিরে আসার মনকেমনে। সেখানেই ‘মিছিল এবং ঠোঁটের সেতুসম্ভব’। অগ্নি রায়, রূপক চক্রবর্তী— এই দুই কবির সঙ্গে, আজ এই অকালপ্রবণ সময়ে শহর পরিক্রমাকালীন দেখা হল— ‘গঙ্গার পাড়ে’ শুয়ে থাকা আমির খান, রানিকুঠি পুকুরে বিমানের দুঃখী ছায়া, রাত্রি নিশীথে জাগে নাগেরবাজার, রোদনভরা পার্কস্ট্রিট, কলোনিবাজার, জলধোয়া স্কাইলাইন, কারশেডের ছায়াকে পিঠে নিয়ে বসে থাকা নুনগোলা ঘাট…
অগ্নি রায়ের কবিতা
অগ্নি রায়ের প্রতিটি কবিতাই কলার তোলা মাস্তানির দিকচিহ্ন। পাঠককে তিনি ‘শুধু বাড়টুকু খাইয়ে’ ছেড়ে দেন পার্কস্ট্রিটের পথে। এবং ঘোষণা করেন, ‘মিছিল এবং ঠোঁটের সেতুসম্ভব’। মির্জা গালিবের কাল থেকে ডেনিম বিপ্লব— সমস্ত ময়দানে কবি এক দুরন্ত তরুণ। যিনি বন্ধুনীর চোখে ‘দানিয়ুবের গভীরতা’ দেখে ‘জাহাজডুবির বার্তা’ পান— তিনি এক দামাল, অশান্ত প্রেমিক। নব্বইয়ের ভারতবর্ষ যেভাবে শাহরুখ খান নামের এক অবুঝ, কিশোরপ্রতিম পুরুষকে আরব সাগরের তীর থেকে দেখে এসেছে— সেভাবে কবি অগ্নি, হাহাকার-অস্থিরতা-দুর্ঘটনা-নাছোড় ইউটার্ন-ব্লাডি মেরি-স্যালাইন-পোস্টার-ট্রাফিক
সতর্কতা-জিপিএসে যানজট-ভূতগ্রস্ত মিডল অর্ডার-যুদ্ধরাত-স্কোয়ার ড্রাইভ ও ব্যক্তিগত ছক্কায় তাঁর শব্দদের নিয়ে যান, সেখানে ‘গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ সেঞ্চুরি’ না পেলেও কবির পংক্তি-স্কোর শতরান ছাড়িয়ে উড়ে যায় আরও গভীর স্বর্গের দিকে। সেই ‘ইটারন্যাল প্যারাডাইস’-এর নাম প্রেম। এবং ওই উড়ে যাওয়ার পথটিকে জীবন বলে ডাকে লোকে। কবি সেই পথ দিয়ে আসা-যাওয়ার সঙ্গে ক্রিজে রেখে দেন তাঁর মাইলফলক, তাঁর স্বজাত উন্মাদনা। ‘রং, যে নামে ডাকো’— এই গুচ্ছ কবিতার মধ্যে যে তীব্র আলো, জেদ এবং অভিমানের মিলিজুলি ক্যাকোফনি আছে— তার অভিঘাত, ধীমাণ পাঠক-মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে যায়। গোলাপি কবিতার— ‘ফুল বাজারে একমেবাদ্বিতীয়ম শো স্টপার এবং টিন এজারের স্বপ্নপণ্য। উভকামী আন্দোলনের জগৎজোড়া প্রতীকও বটে। বিগত শতকের উপন্যাসজুড়ে যার বেধড়ক কটাক্ষ, বাবুদের বুকের তাপজ্বালায় এসেন্স হয়ে থেকেছে। দু ছিলিমের পর তখন চুবিয়ে ফেলতেই হয়েছে চেতনার স্রোতকে।’ দেশ-কাল এভাবেই সেখানে এঁকে দিয়েছেন কবি। একটা রং— মানে কেবল একটা রংকে যে এভাবে নতুন করে দেখা যায়— তা এ কবিতা পড়ার আগে জানা ছিল না। লাল-গোলাপি-নীল-হলুদ-সবুজ এইসব রং আসলে এক নবতম ক্যালাইডোস্কোপ— এক রঙিন বিপ্লব— কবির মিডাস-টাচ, তাদের অমরত্ব দিয়েছে।
পার্কস্ট্রিট পদাবলী
রূপক চক্রবর্তী, অগ্নি রায়
প্রচ্ছদ: যোগেন চৌধুরী
১৯৯ টাকা
দে’জ পাবলিশিং
রূপক চক্রবর্তীর কবিতা
‘দেখা না দেখার শহর’ দিয়ে রূপকের কবিতা যাত্রা শুরু ‘পার্কস্ট্রিট পদাবলী’তে। কলকাতার আনাচে কানাচে, ফুটে থাকা অজানা ফুলের মতো ইতিহাস, চিঠি, রঙিন চশমা, থিয়েটার উঠে এসেছে বারবার— ‘বাতাস আজ হিরণ্ময়। আকাশ আজ অপরাজিতা ফুলের মতো নীল। গঙ্গার পাড়ে ঘাসে শুয়ে রয়েছেন আমির খান। গঙ্গাকে তানপুরা হিসাবে ধরেছেন। পাড়ের কাছে ঢেউয়ের ধাক্কায় যে শব্দ উঠছে তাকেই সুর ধরে নিয়ে তিনি গলা দিয়েছেন জৌনপুরীতে। বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরার সময় ঋত্বিক কিছুটা স্খলিত গলায় বললেন, একটা ডকুমেন্টারি করব আপনাকে নিয়ে মানিকবাবু।’ এইখানে মায়ের চিঠিও থাকে। থাকে, ‘না হওয়া ভাই বোনদের’ মনে করে অঘ্রাণের সন্ধেতে প্রদীপ জ্বালানোর আর্তি। রূপকের লেখার পংক্তিতে এমন সব অলৌকিক বেদনা ছেয়ে থাকে— পড়তে পড়তে মনে হয় দূরের মাঠে মেঘ করে এল। সেই সময় সূর্যের গায়ে লাগে দুঃখী জল। মেঘেরা উড়ে যেতে চায় এবং অসময়ে গানের খাতার পাতা চুপ করে যায়— পদ্মনাভ দিঘির বুকে যে নক্ষত্রের চোখের জল নামে সেখানেও জেগে ওঠে কয়েকটা অমোঘ কবিতা—
‘সোমবার দু’সপ্তাহ পরে এরকম স্মৃতিহীন হয়ে যেতে যেতে/ অত্যন্ত ঘুমে ও নেশায় পাওয়া গেল দু-একটা লাইন প্রকৃত/ ইমাম বক্স লেনে’ কিংবা, ‘চিরদিন ভালোবাসা থেকে অপরাপর ভালোবাসায়/ আমাকে ফিরিয়ে মেরেছে ওই কারুকার্য করা সব বন্ধুদের বোন।/ তাদের ফ্রকের ছায়ায় ঘুমোতে গিয়ে দেখেছি—/ কখন বিকেল হয়ে গেল।’ মূলত বিকেল শব্দটির মেজাজে রূপকের কবিতা ডানা মেলেছে দূরের দিকে। পার্ক স্ট্রিটের বিকেল থেকে সেই শেষ দুপুর ছড়িয়ে যায় মায়ের বন্ধুর চিঠির দিকে। ভাঙা কাচের গেলাসের বিষণ্ণতা পার করে আমরা উপস্থিত হয়ে যাই মেঘের কাছাকাছি— ‘ঝরে পথের বুকে/ মেঘ বাঁধনহারা/ এল আকাশ ছেয়ে/ ভাঙা কাচের গেলাস।’ রূপক চক্রবর্তীর লেখার ধারাবাহিকতা অনুযায়ী, এই লেখাগুলোতেও অনুসন্ধানের মেজাজে যুক্ত হয়েছে বিষাদের চোরা ইশারা। খানিক নির্মোহ রীতিতে তিনি প্রত্যক্ষের সাক্ষী করে রাখেন তাঁর রচনাকে। সেখানে উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে রাজত্ব করে পরিমিত আবেগ। ভাষা ও অলঙ্কার ব্যবহারে তিনি রাজা— ‘এই এক অত্যাশ্চর্য যান। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যত গভীর কবিতাই হোক, তাহার মধ্যেই বিচরণে সক্ষম, এক জায়গায় দিনের পর দিন দাঁড়াইয়া থাকিলেও গায়ে শ্যাওলা জন্মায় না। বাহির হইতে ভাষা কিম্বা ছন্দের লতা-গুল্ম জড়াইয়া ধরিলে কাটিয়া বাহির হইয়া আসিতে পারে। কবিতার গভীরতর তলদেশে বিচরণ করিলেও বহির্বিশ্বের যে কোনও সঙ্কেত গ্রহণে সক্ষম।’