সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
ব্রহ্মাণ্ডপুরের যে আবাসনের বাসিন্দা আমি তার নাম বসুধা। খুব বেশি দিন এই ঠাঁয়ে রয়েছি তেমনটা অবশ্য নয়। আমার চেয়ে ঢের ঢের বছরের পুরনো সব আবাসিকরা রয়েছেন এই আবাসনে। বিচিত্র তাঁদের ধরন, গড়ন, স্বভাব, চরিত্তির। সে এক জমকালো আবাসিক মহল। এ চত্বরে, মানে এই ব্রহ্মাণ্ডপুরে আরও বেশ কিছু আবাসন আছে বটে, তবে তাদের কোনওটাই বসুধা আবাসনের মতো জমজমাট, প্রাণোচ্ছল নয়। আমাদের এই প্রকল্পের যিনি প্রোমোটার, মান্যবর শ্রীল শ্রীযুক্ত দিবাকর তেজোময়, তাঁর দাপট দেখবার মতো। তিনিই ব্রহ্মাণ্ডপুরের এক চিলতে অংশ ইজারা নিয়ে এই আবাসন প্রকল্পটিকে গড়ে তুলেছেন তিলে তিলে, একটু একটু করে। তবে বসুধা আবাসনের ওপর তাঁর যেন বিশেষ নজর। আর হয়তো তাই আয়তনে পাঁচ নম্বরে থাকলেও আবাসিকদের সংখ্যা আর তাদের কর্মকাণ্ডের বৈচিত্রের বিচারে বসুধা এক নম্বরে। সবাই মিলেমিশে একঠাঁই বেশ সুখেই ছিলাম অনেকদিন— আকাশছোঁয়া দ্রুমেরা, বিশালদেহী সরীসৃপেরা, শাকাহারী আর শ্বাপদের দল। শুধু কী তাই! খেচর, ভূচর আর জলচরেরা সবাই মিলেমিশে একঠাঁই, একাকার। টুকটাক ঠোকাঠুকি, হানাদারি, চোরাগোপ্তা হনন— এসব কি আর ছিল না? বিলকুল ছিল। কিন্তু সে সবই ছিল এক নির্দিষ্ট তন্ত্র বা অনুশাসনের কঠোর নিগড়ে বাঁধা। আবাসিক মহলেও জারি ছিল রদবদলের পালা। একেবারে প্রথমে যারা মাথা গুঁজবার ঠাঁই হিসেবে বেছে নিয়েছিল এই আবাসনকে তাদের অনেকেই কালের নিয়মে মহাকালের হিসেবনিকেশের খাতায় নাম লিখিয়ে বিদায় নিয়েছে, আবার একদল আনকোরা নতুন আবাসিকেরা এসে মাথা গুঁজেছে এখানে। খালি হয়ে যাওয়া আবাসন আবার ভরপুর হয়ে উঠেছে নতুন নতুন আবাসিকদের দর্পিত আনাগোনায়। এভাবেই যে আমার আসা, আমাদের আসা, হোমো স্যাপিয়েন্সদের আসা এই বসুধা আবাসনের আঙিনায়।
কিন্তু আজ বড় অশান্ত হয়ে পড়েছে এই বাসস্থানের শৃঙ্খলা। ভাঙনের ভয়াল আর্তনাদ ধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে। সর্বত্র এই গেল গেল রব। আবাসিকরা আজ ত্রস্ত। কে ভাঙল? কেন ভাঙল? কীভাবে ভাঙল?— এমনই সব চোখা চোখা প্রশ্নের দাপটে আজ দিশেহারা জল, স্থল, অন্তরীক্ষবাসী সকলে। আমরাই নাকি এজন্য দায়ী, আমরাই নাকি আবাসনের অন্যান্য আবাসিকদের অস্তিত্বের বিষয়টিকে এমন সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছি! উন্নত মস্তিষ্কের দোহাই দিয়ে এতদিনের চেনা আবাসনের নিয়মকানুনগুলোকে উল্টেপাল্টে বিশৃঙ্খলা তৈরি করার পেছনে আমরাই নাকি দায়ী! সবাই যখন আঙুল তুলে আমাদের দায়ী করছে, তখন আমাদেরই বোধহয় আত্মানুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে। প্রশ্ন ওঠে— আমরা কি আমাদের আবাসনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাকে ঠিকঠাক মান্যতা দিচ্ছি? নাকি ‘বিধাতার শ্রেষ্ঠ কৃতী’র গৌরবে মোহগ্রস্ত হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছি? যে ঘরে আমাদের বাস, আমাদের সৃজন, লালন, বর্ধন, সেই ঘরটাকেই যদি আমরা ব্যবহারের অনুপযোগী করে ফেলি তাহলে যে আমাদের ওই ঘরে থাকা হয় না। ঘরের, আবাসনের নিয়ম-কানুন মেনে চলাতেই যে ঘরের তথা আবাসিকদের নিরাপত্তা তা কি আমরা বুঝছি না? তবে এমনই সব বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার আগে আবাসনতন্ত্র নিয়ে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি কথা সেরে নেওয়া যাক।
বাসস্থানবিজ্ঞানের কথা
আমরা যাকে বলি ঠাঁই, আবাস, আবাসন, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী গ্রিস দেশের মানুষেরা তাকেই বলে Oikos। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মান জীববিদ আর্নস্ট হেইকেল এই শব্দের সঙ্গে আরও একটি গ্রিক শব্দ logos-কে জুড়ে তৈরি করলেন বাসস্থানের বিজ্ঞান বা ইংরেজি ইকোলজি শব্দটিকে। বাসস্থানের বিজ্ঞান বা বাস্তুবিজ্ঞান কথাটি শুনতে একটু অন্যরকম লাগলেও এই সময়ে এই শাস্ত্রের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই তাৎপর্যবৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে দু-এক কথা বলার আগে এই বিজ্ঞানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পরিসর বিষয়ে সামান্য কয়েকটা কথা বলি। একেবারে গোড়ার দিকে, পার্থিব পরিবেশের জড় অথচ প্রাণদায়ী উপাদানগুলোর সঙ্গে সমগ্র জীবকুল তথা প্রাণীকুলের পারস্পরিক সম্পর্কের আলোচনা, মূল্যায়ন করাই ছিল বাস্তুবিজ্ঞানের মূল লক্ষ্য। বলাবাহুল্য পরবর্তীকালে এই শাস্ত্রের আলোচনার ক্ষেত্রসীমা অনেকটাই পরিবর্ধিত হয়েছে।
একটা সহজ ঘরোয়া উদাহরণ দিয়ে বিষয়টাকে আরও একটু পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করি। একটা মানব পরিবার কয়েকজন মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কের ভিত্তি বোঝাপড়ার, সহাবস্থানের, সহযোগিতার, সহমর্মিতার। পরিবারের শৃঙ্খলা মানে এই সদস্যদের কার্যকারণের শৃঙ্খলা। এই সহযোগী অবস্থানের ভিত্তি যত গভীর, যত টেকসই পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন, ততই তার শ্রীবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, বেড়ে ওঠা। পরিবারের প্রতিটি সদস্যই তার ওপর ন্যস্ত দায়-দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করলে পারিবারিক শৃঙ্খলা, সমৃদ্ধির ধারা বজায় থাকে। এমনই কতগুলো পরিবারের একান্ত যাপনের শৃঙ্খলা প্রতিফলিত হয় আঞ্চলিক পারিবারিক শৃঙ্খলায়। কোনওভাবে এই সামগ্রিক শৃঙ্খলায় বিচ্যুতি ঘটলে পুরো ব্যবস্থাটাই মুখ থুবড়ে পড়ে।
বসুধা পরিবারের শৃঙ্খলাতেও যে এমনটাই দস্তুর। এখানে একদিকে সজীব পক্ষ আর অন্যদিকে জড় পরিবেশের পঞ্চভৌতিক উপাদানগুলো। সজীব পক্ষ তাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো প্রকৃতির এই বিপুল ভাণ্ডার থেকেই সংগ্রহ করে নেয়। এই দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয় সহাবস্থানের অমূল্য নীতি। আদর্শ অবস্থায় এই দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের একটা ভারসাম্য বজায় থাকে। আর এই ভারসাম্যের অবস্থায় টান পড়লেই ঘটে বিপর্যয়। বলতে দ্বিধা নেই, বসুধা আবাসনের নবীনতম আবাসিক হয়েও হোমো স্যাপিয়েন্সরা আবাসনের নিয়মকানুনগুলোকে বিন্দুমাত্র সমীহ করেনি। নিজেদের প্রয়োজনকে বড়, আরও বড় করে তুলতে গিয়ে বসুধা আবাসনের সমস্ত নিয়ম-তন্ত্র-শৃঙ্খলাকে ভাঙা হয়েছে দ্বিধাহীনভাবে, কোনও পরিণতির কথা না ভেবেই। ঘরে থেকেই ঘরের নিয়মগুলোকে না মানার দুঃসাহস দেখিয়েছে। আর তাই…
শুরু হল পথ চলা…
১৯৭০ সাল। মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসেবে পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে বসুধা আবাসনের আম-আবাসিকরা তখনও তেমন সরব হয়ে ওঠেননি, এই বিষয়ে আলোচনা থমকে রয়েছে কেবলমাত্র বিজ্ঞানী আর মননশীল লেখকদের চিন্তায়। ক্রমবর্ধমান জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার আর উন্নয়নের লাগামছাড়া দৌড় পৃথিবীর প্রাণদায়ী বাতাবরণকেই যে ক্রমশ বিষময় করে তুলছে সে প্রসঙ্গে বিশ্বের রাজনৈতিক মহলেও তেমন দোলাচলের ইঙ্গিত ছিল না।
কেউ কেউ অবশ্য টের পাচ্ছিলেন এই বদলে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া শৃঙ্খলার বিষয়টা। র্যাচেল কারসন-এর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং, দ্য ক্লাব অফ রোম’-এ প্রকাশিত ‘লিমিটস টু গ্রোথ’-এর ধারণা নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছিল বটে, তবে তার বিশ্বময় প্রতিফলন তখনও তেমন স্পষ্ট নয়। উন্নয়নের নামে, বিকাশের নামে প্রকৃতির অবাধ লুণ্ঠন যে মানুষকে একদিন চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে সে বিষয়ে আগাম সতর্কবার্তা ছিল এ সমস্ত একান্ত প্রয়াসগুলোয়। এই সময়ে আফ্রিকার সহেল অঞ্চলে যেন নেমে এল ধরিত্রী দেবীর অভিশাপ। দীর্ঘস্থায়ী খরা পরিস্থিতির ফলে বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ অনাহারে ভুখা-পীড়িত হয়ে মারা গেল। এবার বুঝি টনক নড়ল আবাসনের তাবড় বাসিন্দাদের!
১৯৭২ সালের জুন মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে সুইডেনের স্টকহোম শহরে আয়োজিত হল এক সম্মেলন— পৃথিবীর প্রথম পরিবেশ সম্মেলন। আয়োজক রাষ্ট্র সুইডেনের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়েই এই মহাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বের মানুষকে তথা ক্ষমতাসীন বিশ্বনেতৃত্বকে বাতাবরণের বদল সম্পর্কে সতর্ক করা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। এই বিশ্ব সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের সামনে তৃতীয় উন্নয়নশীল দুনিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বর্ধমান পরিবেশ সঙ্কটের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানালেন। কী বলেছিলেন তিনি সেদিন (স্টকহোম, ১৪ জুন ১৯৭২)?
…সহবাসীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে কাউকে প্রকৃত অর্থে মানুষ বা সভ্য মানুষ হিসেবে ভাবা যায় না। আজ থেকে ২২০০ বছর আগে সম্রাট অশোক একজন আদর্শ সম্রাটের আবশ্যিক কর্তব্য হিসেবে… দেশের প্রাণীসম্পদ রক্ষা করার কথা বলে গেছেন… যুদ্ধজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার পরিবর্তে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে শান্তিপথে চলার কথা বলেছেন। … অথচ আজকের পৃথিবীতে প্রকৃতিকে নষ্ট করে ফেলাকেই রাষ্ট্রীয় উন্নতির মাপকাঠি বলে গণ্য করা হচ্ছে। … ভুললে চলবে না আমরা প্রকৃতির অংশ। আমাদের জীবনের প্রতিটি অভাব পূরণের জন্য আমরা প্রকৃতির ওপরই নির্ভরশীল। নিজের গরিমাকে নির্লজ্জভাবে জাহির করার জন্য আর কতকাল আমরা অন্যদের খাটো চোখে দেখব? … আপনাদের কি মনে হয় না দারিদ্র হল সবচেয়ে বড় দূষক? … নিদারুণ দারিদ্রের মধ্যে যাদের দিনাতিপাত করতে হয় তাদের কাছে পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নটিই অর্থহীন। … আজ যখন জনসংখ্যা অথবা পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার প্রশ্নকে খুব বড় করে দেখানো হয় তখন মনে হয়, এই কথা বলে আমরা যেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের বহুবিধ সমস্যা থেকে আমাদের নজর ঘুরিয়ে দিতে চাইছি। … পৃথিবীর যে সমস্ত দেশের জনসংখ্যা কম তারাই পার্থিব সম্পদের সিংহভাগ অংশ ভোগ করে। … যৌথ যাপনের মহত্তর ধারণাকে নস্যাৎ করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একক যাপনকেই আজ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা আমাদের প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন করছে … মানুষ রাতারাতি অভ্যস্ত যাপনের সবকিছুকে বদলে ফেলে পিছনের তথাকথিত নিভৃত, শান্তিময় জীবনে ফিরে যাবে না … তবে প্রকৃতির নিয়মের বিপক্ষে না গিয়ে তার সঙ্গে সহাবস্থানের অভ্যাসে অভ্যস্ত হবে … হয়তো এমনটাই হবে আধুনিকতার শ্রেষ্ঠতম স্মারক।
আজ থেকে ঠিক অর্ধশতাব্দী আগে বলা কথাগুলো আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক রয়েছে বসুধার সমস্ত শ্রেণির আবাসিকদের কাছে। স্টকহোম সম্মেলন বিশ্বব্যাপী পরিবেশভাবনার প্রাসঙ্গিকতাকে একটা সর্বাত্মক স্বীকৃতি দিয়েছিল আর সেই কারণেই প্রতিবছর নতুন নতুন বিষয়ভাবনাকে সামনে রেখে উদযাপিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রয়াতা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ নতুন বিশ্বপথে চলার আহ্বান জানিয়েছিল সমগ্র বিশ্ববাসীকে। পৃথিবী এখনও ৫ জুনকে সামনে রেখে পথ চলছে, একটি টেকসই জীবন অর্জনের লক্ষ্যে।
৫ জুন, ২০২১-এর ভাবনা প্রসঙ্গ…
৫ জুন একটা দীর্ঘ পথে নতুন করে পাড়ি দেওয়ার দিন, একটা প্রাণময়, টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান জানানোর দিন। ১৯৭২ সালের ৫ জুন স্টকহোম শহরে প্রথম বিশ্বস্তরে পরিবেশ সম্মেলনের সূচনা হয়েছিল। আর তাই প্রতিবছর এক-একটা নতুন নতুন বিষয়ভাবনাকে সামনে রেখে বসুধা আবাসনের আবাসিকদের পথ চলা। ১৯৭৪ সাল থেকে এভাবেই চলছে। কখনও থিম হিসেবে ভাবা হয়েছে— ‘একটি মাত্র পৃথিবী’ (১৯৭৪), ‘মানব বসতি’ (১৯৭৫), ‘জল: জীবনের প্রধান সম্পদ’ (১৯৭৬), ‘ওজোন স্তরের অবক্ষয়’ (১৯৭৭), ‘ধ্বংসবিহীন উন্নয়ন’ (১৯৭৮), ‘মরুভবন’ (১৯৮৪), ‘বিশ্ব উষ্ণায়ন’ (১৯৮৯), ‘আমাদের পৃথিবী, আমাদের বাসভূমি, আমাদের বাসা’ (১৯৯৬), ‘বরফগলন: এক উষ্ণ বিষয়?’ (২০০৭), ‘সবুজ অর্থনীতি: আপনি যুক্ত তো?’ (২০১২), ‘প্লাস্টিক দূষণকে হারান’ (২০১৮)। এই তালিকার দিকে একটু গভীরভাবে নজর করলেই আমাদের প্রিয় বাসভূমির গভীরতম ক্ষতচিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাসভূমির এমন সঙ্কটের জন্য মানুষই যে দায়ী। এই সঙ্কট মোচনের জন্য আমাদেরই সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। দৈনন্দিন যাপনের তথাকথিত প্রয়োজনগুলোকে মেটাতে গিয়ে আমরা বাসস্থানের ভারসাম্য বিনষ্ট করেছি আপন মত্ততায়। আর তাই এবারের পরিবেশ দিবসের মূল ভাবনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ‘ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন’ বা ‘বাস্তুতান্ত্রিক পুনরানয়ন’-এর মতো এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাকে। সহজ করে বললে ‘আবাসনের ক্ষয়ক্ষতির মেরামতি’।
আগামী ৫ জুন আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে পরিবেশ দিবসের এবছরের অনুষ্ঠানের সূচনা করা হবে ইউএনইপি-র সহযোগিতায়। মূলত তিনটি অন্তর্লীন ভাবনাকে সামনে রেখে এই মেরামতির কাজটা করার কথা বলা হয়েছে উদ্যোক্তাদের তরফে—
- এসো, পুনর্কল্পনা করি (Re-imagine)
- এসো, পুনঃসৃজন করি (Recreate)
- এসো, পুনঃসংস্থাপন করি (Restore)
ক্ষয়ক্ষতির কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েই আহ্বান জানানো হয়েছে বসুধার তরুণতর আবাসিক প্রজন্মের কাছে—
এই সময়টা একান্তভাবেই আমাদের।
একথা সত্যি যে আমরা সময়ের চাকাকে পেছনে ঘোরাতে পারব না। কিন্তু আমরা গাছ লাগাতে পারি, আমাদের কৃতকর্মের ফলে ধূলিধূসরিত হয়ে যাওয়া শহরগুলোকে সবুজে সবুজে ভরিয়ে তুলতে পারি, আমাদের ঘরের পাশের এক চিলতে জমির বাগানটাকে আবারও একটা বুনো চেহারা দিতে পারি, আমাদের অসংযমী খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলতে পারি, আমাদের ঘরের পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে যাওয়া নদীগুলোকে এবং সমুদ্রের বেলাভূমিগুলোকে, যা আমাদের কৃতকর্মের ফলে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে, পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারি; যেমনটা তারা ছিল বহু বছর আগে। আমরা হলাম তেমনই এক প্রজন্ম যারা আমাদের পূর্বজদের ভুলগুলোকে শুধরে নিয়ে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে এক শান্ত, সমাহিত জীবন যাপন করতে পারি।
এসো। সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ছেড়ে সক্রিয় হও। উদ্বিগ্ন হোয়ো না চারিদিকের গেল গেল রব শুনে। এসো। ভীরুতাকে দূরে ঠেলে প্রতিজ্ঞ, সাহসী এক বিশ্বনাগরিক হও। আমরা যে আসলে একটা প্রজন্মের ক্ষয়ে যাওয়া চেতনাকেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যপথে সংস্থাপন করতে চাইছি।
আগামী এক দশক (২০২১-৩০) এই ভাবনাকে আগলে রেখেই পথ চলবে গোটা পৃথিবী। এ বছরের ৫ জুন এই আহ্বানই জানায়।
চাই পুনরুদ্ধার, পুনরানয়ন…
ভেঙেপড়া ব্যবস্থাকে মেরামতির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। বসুধা আবাসন তো আর সেদিনের গজিয়ে ওঠা ঠাঁই নয়— প্রায় ২০০ কোটি বছর বয়স হল তার। এত দীর্ঘ সময়কালের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়মেই বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বটে, তবে তা আপন নিয়মেই সারিয়ে নিয়েছে প্রকৃতি। গোল বাঁধল কমবেশি ২০ লক্ষ বছর আগে, যখন মস্তিষ্ক কোষের নানা বিবর্তনের পথ বেয়ে হোমো স্যাপিয়েন্স নামীয় প্রাণীরা এসে হাজির হল বসুধা আবাসনের আবাসিক হয়ে। গোড়ার দিকে মানুষ ও প্রকৃতির দ্বন্দ্ব অমন সুতীব্র ছিল না। আবাসনের চলতি নিয়মকানুনগুলো রপ্ত করে নিতে অনেকটা সময় লেগে গেল তার। তাই আবাসনের সহাবস্থানের আদর্শের সঙ্কট তেমনভাবে নজরে পড়েনি। কিন্তু যেদিন থেকে মানুষ হুঁশ বাদ দিয়ে নিজের মানটাকেই বড় করে দেখতে শুরু করল সেদিন থেকেই ভাঙতে থাকল ভারসাম্যের অবস্থা। নিজের অস্তিত্বকে বড় করে দেখাতে গিয়ে সে উপেক্ষা করল তার আবাসনের ভারসাম্য, তার সহবাসীদের বেঁচে থাকার অধিকার। এমনই সব অবিবেচক কাজকর্মের ফলে আজ ভেঙে পড়েছে বাসস্থানের শৃঙ্খলা, মূল কাঠামোটাই। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এতটাই যে অবিলম্বে তার পুনরানয়ন প্রয়োজন, কেননা আমাদের প্রতিবেশের সুস্থতার ওপরই একান্তভাবে নির্ভর করে আমাদের সুস্থতা ও অস্তিত্ব। আর হয়তো তাই আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া বাস্তুব্যবস্থার মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে গভীরভাবে। তবে এভাবে ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হবে কিনা তা জোর দিয়ে বলার সময় হয়তো এখনও আসেনি, তবে সকলেই আশাবাদী এই বিষয়ে যে এমন আধুনিক পরিচালনব্যবস্থার হাত ধরে পৃথিবী আবার তার হারানো সুষমা ফিরে পাবে। পৃথিবী আবার প্রাণময় হয়ে উঠবে নতুন করে।
এক আন্তরিক অভিযাচন…
বলা ভালো ঘোষিত বাস্তুতান্ত্রিক পুনরানয়নের এই প্রচেষ্টাটি অনেকটাই আমাদের ইনটেনসিভ কেয়ারে রেখে রোগীর চিকিৎসা করার মত। এই রেস্টোরেশন ব্যবস্থাটি অত্যাধুনিক বাসস্থান পরিচালন ব্যবস্থার অনুসারী। একটা বাড়ি— অনেক অনেক ঘর— প্রত্যেক ঘরে আলাদা আবাসিক— স্বতন্ত্র তাদের মর্জি মেজাজ— ভিন্ন ভিন্ন তাদের আহার বিহার। এতসব বিভিন্নতার বিষয়কে ছাপিয়ে তাদের একটাই পরিচয়— সকলেই এক বাড়ির আবাসিক, বসুধা আবাসনের আবাসিক। এটা নিপাট সত্যি কথা যে, এতকালের এক আবাসন তার চেনা গরিমা খুইয়ে অনেকটাই আজ শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। আর তাই, কলি ফেরানোর তোড়জোড় চলছে নানা উদ্যোগকে সামনে রেখে।
এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবস তাই ডাক দিয়েছে বাস্তুতান্ত্রিক পুনরানয়নের। এসবই মানুষের কৃতকর্মের ফল, আর তাই মানুষকেই খুব আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে, প্রতিবেশের হারিয়ে যাওয়া ভারসাম্য, ফিকে হয়ে যাওয়া গৌরব, নড়বড়ে হয়ে যাওয়া স্থিতাবস্থাকে ফিরিয়ে আনতে। প্রশ্ন উঠবে, আমরা তো আইনকানুন জারি করে প্রতিবেশ সংরক্ষণের নানা ব্যবস্থা কার্যকর করেছি—বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষিত রাখার লক্ষ্যে কত শত অভয়ারণ্য, পাখিরালয়, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ তৈরি করেছি, নাগরিক সচেতনতা বারানোর লক্ষ্যে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, নেচার ট্রিপের আয়োজন করেছি— তারপরেও এমন কর্মসূচি কেন? সঙ্গত প্রশ্ন, তবে আলোচ্য পরিকল্পনায় গভীরতর তাৎপর্য নিহিত আছে। আসলে মানুষ যতই হম্বিতম্বি করুক, যতই আস্ফালন করুক নিজেদের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্ব(!) প্রতিপাদনের জন্য; তাকে তো বারংবার ফিরে আসতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে প্রকৃতির কাছে। প্রশ্ন হল, কোন প্রকৃতির কাছে, কোন আশ্রয়ের নিবিড়তায় ফিরব আমরা? রিক্ত, নিঃস্ব, গহীন শূন্যতায় ভরা ঘর, আবাস, ঠাঁই কোন কাজে লাগবে মানুষের? প্রকৃতি পরিবেশের এই রিক্ততা বড় বেদনার সুর হয়ে বাজে।
তাই প্রকৃতির টানেই প্রকৃতির কাছে ফেরা। প্রকৃতির রূপ-শোভা মলিন হলে মানুষের জীবনও যে মলিন হয়ে যায়। আর তাই, মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য, মানুষের এই প্রকল্প। প্রকৃতির ভেঙে যাওয়া তন্ত্রের শৃঙ্খলাকে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি, মানুষের যথেচ্ছাচারী বিশৃঙ্খল যাপনকেও শৃখলায় ফিরিয়ে আনতে হবে এক নতুন পথে। এইজন্যই মানুষী উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে পুনরানয়ন পরিকল্পনার ঘোষিত খসড়ায়। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রাণ-পরিবেশের ভারসাম্যকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়াসই হল বাস্তু পুনরানয়নের এক ও অভিন্ন লক্ষ্য। আজ আমাদের এই লক্ষ্যপূরণে অবিচল থাকতে হবে। ঘরের কাছের একান্ত প্রতিবেশের হারিয়ে যাওয়া প্রাণস্পন্দনকে ফিরিয়ে আনাই হোক আমাদের প্রথম প্রত্যয়ী পদক্ষেপ। আমাদের শপথ নিতে হবে এই বলে—
আমার উত্তরে, আমার দক্ষিণে, আমার পূর্বে, আমার পশ্চিমে, আমার প্রগলভ সরবতায়, আমার নিস্পৃহ নীরবতায়, যা কিছু বিস্ফারিত আপন অস্তিত্বের নিমগ্নতায়, তাই আমার প্রতিবেশ। আমি কায়মনোবাক্যে অনুভব করি— আমি এই একান্ত পরিবেশের সহচর। প্রতিবেশের নিবিড় ঔদার্যের অফুরান দানকে উপলব্ধি করা আমার কর্তব্য। আমি নিবিষ্ট চিত্তে অনুভব করি আমার মাথার ওপর প্রসারিত নীল আকাশের অপার বিস্তৃতি, বহমান নদীর কল্লোলিত কূলপ্লাবী উচ্ছ্বাস, বায়ুর অপার জীবনদায়ী প্রবাহ, সবুজ বনানীর সঘন শ্যামলিমার সৌন্দর্য, মৃত্তিকার গর্ভে থাকা সম্পদের অপরিমেয় সম্ভাবনা, আর প্রাণময় জীবনের বিপুল বৈভব— যা আমাকে, আমার অন্তর্লীন সত্তার নিরবচ্ছিন্ন অভিসারিতাকে ঘিরে রেখেছে পরম মমতায় এই পৃথিবীতে আমার আবির্ভাবের পরম মুহূর্তটি থেকে।
এই অনুভব-রসে আজ আমাদের প্রত্যেকের মন মজাতে হবে।
শেষ অঙ্গীকার
আলোচনার অন্তিম পর্বে এসে বলি—
জীবধাত্রী আমাদের পুষেছেন
খণ্ডকালের
ছোট ছোট পিঞ্জরে,
তারই মধ্যে সব খেলার সীমা,
সব কীর্তির অবসান।
মানুষ আপন কীর্তিগর্বের অন্ধতায় সেই সীমাকে লঙ্ঘন করেছে বারংবার। আর তাই প্রকৃতির আক্রোশ অভিশাপ হয়ে নেমে আসছে আমাদের ওপর। দ্বন্দ্ব নয়, সংঘাত নয়, অবিমৃষ্যকারিতা নয়, পরমা প্রকৃতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই হল আমাদের বাঁচার একমাত্র পথ। মানহারা ধরিত্রীর প্রতি এই হোক আমাদের শপথবাণী, এই পরিবেশ দিবসের অঙ্গীকার।