জয়ন্ত ভট্টাচার্য
প্রাবন্ধিক, চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য কর্মী
করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ে কলকাতা শহরে এক করোনা রোগীর চিকিৎসার বিল হয়েছিল প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। এবিপি আনন্দের সুমনের সঙ্গে ঘন্টাখানেক থেকে টানা কদিন ধরে আমরা মজেছিলাম, বুঁদ হয়েছিলাম এরকম অমানুষিক ঘটনায়। পুনে থেকে প্রকাশিত পুকার সংবাদপত্রে ২৬.০৭.২০২০-তে খবর হয়েছে— “After Audit COVID Treatment Bills Reduced by Rs 50 Lakh in Pune and Pimpri Chinchwad”। ওখানকার ঘটনা কলকাতার চেয়ে আরও “মনোগ্রাহী”। সংবাদপত্রটির রিপোর্ট অনুযায়ী ৬৫টি পেমেন্টের ক্ষেত্রে রোগীদের ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছিল। অডিট করার পরে ৩৮ লাখ টাকা কমে যায়। আরেকটি ক্ষেত্রে ৩১টি পেমেন্টে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার টাকার থেকে অডিটের পরে ১২ লাখ ৬ হাজার টাকা কম দিতে হয়। দুটো মিলে ৫০ লাখ টাকা। ব্যাঙ্গালোরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানা যায় ৭ দিন হাসপাতালে থাকার বিল হয়েছিল ৯৩ লাখ টাকা। বিদেশে, একমাত্র আমেরিকা ছাড়া, ইউরোপের দেশগুলোতে এরকম বিলের কথা ভাবা যায় না। নিউজিল্যান্ড সহ অধিকাংশ দেশেই স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরকারের পরিচালনায়। ফলে এ্ররকম ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। পুনেতে তাও সরকারি একটা অডিট হয়েছে, বিলের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর’স ফোরামের মতো সংগঠনের তরফে বারংবার চিঠি দেওয়া এবং হস্তক্ষেপের পরেও অবস্থার খুব কিছু ইতরবিশেষ হয়নি।
প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, এরকম খবরের পরেও মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ এবং ক্রোধ থাকা সত্ত্বেও মানুষ আবার এই প্রতিষ্ঠানগুলোরই দ্বারস্থ হবে। ঘটিবাটি খুইয়ে একটি প্রাণ বাঁচানোর জন্য সর্বস্ব ঢেলে দেবে। আবার রোগীর মৃত্যু হলে চোখের সামনে যে নরম টার্গেট ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের পাওয়া যাবে তাদেরকে পেটাবে। এ এক অদ্ভুত সোশ্যাল সাইকি। মিডিয়া, কর্পোরেট বিজ্ঞাপন এবং লোকশ্রুতির গুণে কর্পোরেট হাসপাতাল যে সেরা এটা গণমানসিকতায় দৃঢ়প্রোথিত। আবার উল্টোদিকে ক্রমাগত সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এবং বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা আজ প্রান্তে বিলীন হওয়ার মতো অবস্থায়। কেবল একটি কাঠামো, কিছু স্টাফ এবং কিছু রুটিন প্রোগ্রাম পড়ে রয়েছে। কোভিডের আক্রমণে আজ সেগুলোও বিধ্বস্ত। মানুষ যাবে কোথায়? প্রায় অবধারিত যাত্রা কর্পোরেট হাসপাতালে, লক্ষ লক্ষ টাকার বিল হওয়ার পরে কয়েকদিন প্রবল হুল্লোড় হবে, কদিন বাদে থিতিয়ে যাবে। আমাদের রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং কয়েক দশক ধরে নির্মিত সামাজিক ব্যবস্থা সবকিছুকে হজম করে নেবে। আমরা আবার স্থিতাবস্থায় ফিরে যাব।
ল্যান্সেট জার্নালে (১৪.০৭.২০২০) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় “COVID-19 outbreak and decreased hospitalization of pregnant women in labour” শিরোনামে। সেখানে পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছে ভারতে ১৯৯৫ থেকে ২০১৫-১৭ সালের মধ্যে মায়েদের প্রসবকালীন মৃত্যুহার ৭৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে যে সংখ্যা ছিল প্রতি ১০০,০০০ জীবিত শিশুর ক্ষেত্রে ৫৫৬ জন মায়ের মৃত্যু, ২০১৫-১৭ সালে সে সংখ্যা কমে দাঁড়ায় প্রতি ১০০,০০০ জীবিত শিশুর ক্ষেত্রে ১২২ জন। এর প্রধান কারণ তিনটি— (১) বাড়িতে প্রসব না হয়ে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব হওয়া। এর ফলে প্রসবকালীন যে জটিলতা তৈরি হতে পারে সেগুলো সামাল দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী আছে। (২) বাড়ি থেকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সুগম যোগাযোগের ব্যবস্থা, এবং (৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্রিয় উপস্থিতি। কারণ প্রসবকালীন মৃত্যু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকায় ঘটে এবং সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী থাকলে এরকম মৃত্যুকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এড়ানো যায়।
ল্যান্সেট-এর আরেকটি প্রতিবেদন (৫.০৫.২০২০) “Has COVID-19 subverted global health?”-এ বলা হয়েছে করোনা অতিমারির ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ (যেমন দীর্ঘকালীন কড়া লকডাউন) সমগ্র বিশ্বে নেওয়া হয়েছে সেগুলো মূলত পশ্চিমি দেশগুলোকে অনুসরণ করে— “one-size-fits-all message” (সবার জন্য একই মাপ কাজ করবে এরকম একটি বার্তা)। আরেকটি অনুধাবনযোগ্য বিষয় আছে এ প্রবন্ধে— মে মাসের প্রথম দিকে সমগ্র পৃথিবীর কোভিড-১৯ কেসের ৯০ শতাংশ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে সবচেয়ে ধনী দেশগুলো থেকে। অথচ ঐতিহাসিকভাবে এই ধনী দেশগুলো পৃথিবীর বাকি দেশগুলোকে পৃথিবীর সমস্ত মহামারি ও রোগের আধার (reservoir of pestilence and disease) মনে করত। শুধু তাই নয়, কীভাবে এদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে থাকা যায় সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকত। বাকি দেশগুলো এ দেশগুলোর এবং সাহায্যকারী সংস্থাদের কাছ থেকে উদারহস্তে উপদেশ আর যৎসামান্য সাহায্য পেত।
আমরা এই অতিমারির সময়ে দেখেছি কিভাবে “অপর” তথা “other”-এর নির্মাণ চলছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা-য় (২৩ এপ্রিল, ২০২০) তুরস্কের নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুক একটি বিশেষ প্রবন্ধ লিখেছিলেন— “What the Great Pandemic Novels Teach Us”। শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি ছিল যেকোনও সঙ্কটের সময়েই মানুষ, বিশেষ করে রাষ্ট্র, একটি অপর বা other খোঁজে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর অন্য একটি প্রবন্ধে (“History in a Crisis — Lessons for Covid-19”, ৩০.0৪.২০২০) মন্তব্য করা হয়েছে— “মহামারি নিয়ে প্রতিক্রিয়ার একটি নাটকীয় উপাদান হল অন্য কারও ঘাড়ে দায় ঠেলে দেওয়া। মধ্যযুগের ইউরোপে এটা ইহুদিদের দিয়ে শুরু হয়েছিল আর এখন হল চিনে যারা বিভিন্ন মাংস খায় তারা (এর অর্থ চিনারা), কাউকে একটা সবসময়েই দোষারোপ করতে হবে। দোষারোপের এই ডিসকোর্সটি সমাজে বিদ্যমান ধর্মীয়, জাতিগত, আদি জন্মগত (ethnicity), শ্রেণিগত অথবা লিঙ্গবৈষম্যগত সামাজিক বিভাজনকে নিজের কাজে ব্যবহার করে।” আমাদের এখানে এই “অপর” কখনও “চিনা ভাইরাস”, কখনও তবলিঘি জমায়েত (যদিও মহারাষ্ট্রে কোনও জমায়েত ছাড়াই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে এখনও পর্যন্ত), আবার কখনও সমাজের “আপদ” স্থানান্তরী অসংগঠিত শ্রমিকেরা। একটি অপর পেলে রাষ্ট্র তার নজরদারি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী এবং জনসাধারণের কাছে গ্রাহ্য ও মান্য করে তুলতে পারে “অপর”-কে দমনের অজুহাতে।
অথচ আমাদের সাধারণ আলোচনায় আসে না যে মাত্র ৪ ঘন্টার নোটিসে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল। যুক্তি? ইউরোপ আমেরিকার সমৃদ্ধ দেশগুলো যেখানে দুর্বলতর অংশের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে তারা এরকম লকডাউন করেছে। এত পরিমাণ বৈষম্যের পৃথিবীতে “one-size-fits-all” মেসেজ সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। এ সাধারণ সত্যটি আমাদের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের ভাবনার বহুযোজন দূরে ছিল। কারণ কোনও নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে মানুষ নেই। আছে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা। নীতিনির্ধারণের জন্য গ্রহণ করা হয়নি এপিডেমিওলজিস্ট, মেডিক্যাল মডেলার, মেডিক্যাল এক্সপার্ট বা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের মতামত। রাজনৈতিক আকাঙ্খা, রাজনীতিবিদ এবং আমলারা।
যাহোক, আমরা অতিমারিকালে কোটি কোটি জনতার স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং তার জন্য কী কী উপাদান আমাদের ভাঁড়ারে তা আরেকবার ফিরে দেখি। এই দেখার সময়ে আমরা স্পষ্ট করে মনে রাখতে চেষ্টা করব আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যের জগতে দু-তিনটি অপরিহার্য উপাদান রয়েছে— (১) প্রেক্ষিত বা কনটেক্সট (উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আমেরিকার মারাত্মক রকমের ইন্সিউরেন্স-নির্ভর, অতি উচ্চমূল্যের স্বাস্থ্যের কাঠামো আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে প্রযোজ্য নয়, যদি না মানুষগুলোকে আমরা কর্পোরেটদের হাতে ছেড়ে দারিদ্র্যের অতল খাদে নিয়ে যেতে না চাই। এমনিতেই জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির (২০১৫, ২০১৭) হিসেব বছরে ৬৩ থেকে ৬৫ লক্ষ ভারতবাসী চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে “মেডিল্যাল পভার্টি ট্র্যাপ”-এ বাঁধা পড়ে এবং দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যায়। এত সংখ্যক মানুষ প্রায় ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার সমান। আগ্রহী পাঠকেরা জনস্বাস্থ্যেরর জগতে মান্য ব্যক্তিত্ব শ্রীনাথ রেড্ডির লেখা “India’s Aspirations for Universal Health Coverage” (নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন, জুলাই ২, ২০১৫) দেখে নিতে পারেন। রেড্ডি বলেছেন ভারত প্রথমে (১৯৪৭-এর পরে) সমস্ত ভারতবাসীর জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে “যেহেতু পাবলিক-সেক্টর স্বাস্থ্যব্যবস্থাগুলো শুকিয়ে যেতে লাগল এবং মানুষের ক্রমবর্ধমান প্রয়োজনে আর সাড়া দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না,” প্রাইভেট সেক্টর বেড়ে উঠতে লাগল। শুধু তাই নয়, রেড্ডির বিশ্লেষণে, “১৯৯০-এর দশক থেকে অর্থনীতিকে খুলে দেওয়ার জন্য বৃহৎ কর্পোরেট হাসপাতালগুলো এই ফাঁকা জায়গা অধিকার করল। এখন প্রায় ৯০ শতাংশ বহির্বিভাগে রোগীর চিকিৎসা হয় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে, আর হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা ৬০ শতাংশ। অথচ বড় এই হাসপাতালগুলো গ্রামীণ জনসংখ্যার বৃহদংশের কাছে কোনও বুনিয়াদি স্বাস্থ্যের সুযোগ পৌঁছে দেয় না, যেমনটা দেয় না শহরের গরীব জনসমষ্টির কাছেও।”
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যের অন্য দুটো উপাদান নিয়ে কথা বলব— (২) সামাজিক ন্যায় এবং (৩) স্বাস্থ্যের ন্যায্যতা বা equity।
লেখার শুরুতে আর্ত মানুষের ওপরে চেপে বসা পাহাড়ের মতো মেডিক্যাল বিলের আলোচনা করেছি সেগুলো গত অন্তত ৩০ বছর ধরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্রমবিলুপ্তি এবং কর্পোরেট হাসপাতালের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্যের একটি খণ্ডচিত্র। মনে রাখব এ সময়ের জনস্বাস্থ্যের জন্য এবং “সামাজিক ন্যায়” ও “স্বাস্থ্যের সাম্য”-র জন্য একটিও সর্বব্যাপী গণআন্দোলনের জন্ম হয়নি— বিক্ষিপ্ত, স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ কিছু উদ্যোগ ছাড়া। কোনও নির্বাচনী দলের কর্মসূচিতে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনও দাবী বা পর্যালোচনা থাকে না। কিন্তু পৃথিবীর “উন্নত” বা ধনী দেশগুলোতে স্বাস্থ্যের কার্যক্রম কী হবে বা তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার কী কী পরবর্তী কর্মসূচি নেওয়া হবে সেগুলো একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা হয়ে থাকে।
কোভিডকালে ভারতের চিত্র
বিমলা কুমারী, কল্পনা মেহতা এবং রাহুল চৌধুরী এই তিনজন চিকিৎসক পশ্চিমভারতের ৪টি হাসপাতালে (যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে টারশিয়ারি কেয়ার যুক্ত) লকডাউনের প্রথম ১০ সপ্তাহের (মার্চ ২৫ থেকে জুন ২, ২০২০) গর্ভবতী মায়েদের অবস্থা নিয়ে লকডাউন পূর্ববর্তী ১০ সপ্তাহের সঙ্গে (জানুয়ারি ১৫-মার্চ ২৪, ২০২০) একটি “retrospective analysis” করেন। এঁদের প্রাথমিক বিশ্লেষণে লকডাউন পুর্ববর্তী সময়ের তুলনায় পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কমেছে ৪৩.২ শতাংশ, এবং ২০১৯-এর তুলনায় ৪৯.৮ শতাংশ। প্রসূতিকালীন ইমার্জেন্সি রেফার হবার সংখ্যা কমেছে ৬৬.৪ শতাংশ। রোগীরা বহুক্ষেত্রেই আগাম আতঙ্কে হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। কারণ সরকারের তরফে চিকিৎসার সমস্ত সুযোগসুবিধে সরে গেছে কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে, এমনকি হাসপাতালের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও সাধারণ রোগীর চিকিৎসা করতে অনেকক্ষেত্রেই অস্বীকার করছে। লকডাউনের সময়ে প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশন করে প্রসব করানো ৩৭.০৩ শতাংশে পৌঁছেছে, এ চিত্র প্রাক-লকডাউন পর্বে ৩৩ শতাংশ ছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, হাসপাতালে ভর্তি থাকা গর্ভিনী মায়েদের মৃত্যুর হার। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে দেহাভ্যন্তরে শিশুর মৃত্যু এবং মৃত শিশু প্রসব হওয়া— লকডাউন পরবর্তী সময়ে এই দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যা বেড়ে গেছে। সমীক্ষক চিকিৎসকদের মন্তব্য—
This current study showed a substantial rise in late intrauterine fetal death and stillbirth, along with in-hospital maternal mortality, which might be because of the delayed presentation of women requiring emergency obstetric care … along with the provision of an adequate number of emergency ambulances at primary and secondary health-care facilities for patients in emergency obstetric care requiring urgent referral.
ল্যান্সেট-এর “Has COVID-19 subverted global health?”-এ ভারতের ন্যাশনাল হেলথ মিশন-এর দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে – মার্চ ২০২০-তে (২০১৯-এর তুলনায়) হাম, মাম্পস এবং রুবেলার জন্য শিশুদের টীকাকরণ ৬৯% হ্রাস পেয়েছে, বিসিজি টীকাকরণ ৫০% হ্রাস পেয়েছে, হাসপাতালে প্রসবের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ২১%, হার্টের অ্যাকিউট সমস্যায় হাসসপাতালে চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসার জন্য আসার সংখ্যা ৫০% কমে গেছে, এবং শ্বাসকষ্টের রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হওয়া কমেছে ৩২%। একইসঙ্গে, আরেকটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হাসপাতালে ক্যান্সার রোগী আসার সংখ্যা কমেছে ৫০%। ভারতের মতো দেশে যেখানে প্রতিবছর ২ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু (প্রতিদিন ৭০,০০০ শিশু) জন্মগ্রহণ করে সেখানে শিশুদের ইমিউনাইজেশন বন্ধ বা স্থগিত হয়ে যাওয়া কী মারাত্মক পরিণতির জন্ম দিতে পারে। হারিয়ে যাওয়া রোগগুলো আবার ফিরে আসতে পারে।
Wire.in-এ প্রকাশিত (৫.০৬.২০২০) একটি খবরের শিরোনাম “Rajasthan: TB Services Hit as Staff, Diagnosis Machines Diverted to COVID-19”। এই খবর অনুযায়ী ২০১৭ সালে রাজস্থানে সরকারি হিসেব অনুযায়ী টিবি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৮ হাজার। ২০১৮-তে সে সংখ্যা বেড়ে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার, ২০১৮-তে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। ২০১৯-এর হিসেব পাওয়া যায়নি।
এখানে কতকগুলো ডায়াগ্রাম দিচ্ছি। আমাদের বুঝে নিতে সুবিধে হবে।
এরকম একটা প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে আজকের করোনা অতিমারি যে বিশ্ব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে তা বুঝতে সুবিধে হবে। ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত (জুন ১৫, ২০২০) একটি প্রবন্ধে (“COVID-19: rethinking risk”) যা বলা হল তার মূল কথা— করোনা অতিমারিতেও সবাই একইরকমভাবে আক্রান্ত হবে না। যাদের ক্ষেত্রে রোগের সামাজিকভাবে নির্ধারক শক্তিগুলো (social determinants) সঠিকভাবে ফলপ্রসূ হয় না— যেমন, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণি বা যারা চাকরি, বাসস্থান, খাদ্য এধরনের সামাজিক সুযোগ-সুবিধের ক্ষেত্রে বঞ্চিত— তাদের মধ্যে এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যাবে। পৃথিবী জুড়ে হয়েছেও তাই। আমেরিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার মতো দেশগুলোতে সর্বত্র একই চিত্র।
করোনা অতিমারির সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা মানুষের দৃষ্টিপথ (visibility), শ্রুতি (discernibility) এবং ভাবনার ক্ষেত্রপথের একেবারে বাইরে চলে যাচ্ছে। অতি উচ্চমূল্যের আইসিইউ পরিষেবা, উচ্চচাপের অক্সিজেনের ব্যবস্থা, ECMO ইত্যাদি জন মানসিকতায় ক্রমশ গ্রাহ্য হয়ে উঠছে, মান্যতা পাচ্ছে। মনে ক্ষোভ পুষে রেখেও সাধারণভাবে মানুষ চাইছে বেশি দামের রেমডেসিভিরের চিকিৎসা— নিতান্ত কমদামের এবং একমাত্র “improved survival” ঘটাতে সক্ষম ডেক্সোমেথাসোনের চিকিৎসা নয়। চিকিৎসকেরাও এই সোশ্যাল সাইকি বা গণমানসিকতার বশে থাকছেন। বাজারের, মিডিয়ার এবং বিজ্ঞাপনের দুর্দমনীয় শক্তি উভয়কেই নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবিত করছে। ফলে চিকিৎসা আরও বেশি করে হাই-টেক হয়ে উঠছে, ভার্টিকাল প্রোগ্রামের দিকে ঝুঁকছে। এবং ক্রমাগত ঝুঁকবে কেবলমাত্র রোগ-কেন্দ্রিক প্রোগ্রামের দিকে, সামাজিক স্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথের দিকে নয়।
নেচার-এর মতো পত্রিকায় (১৩.০৮.২০২০) বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে “Covid-19 is fuelling a resurgence of AIDS, malaria and TB”, অর্থাৎ এইডস, ম্যালেরিয়া এবং টিউবারকিউলোসিস প্রবল গতিতে বাড়ছে। নেচার-এর আলোচিত প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণে— “তিন মাসের বেশি সময় ধরে লকডাউন অসংখ্য নন-কোভিড মানুষ বা কোভিড নয় এমন রোগীরা সাধারণ চিকিৎসার কাছে পৌঁছুতে পারেনি, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন রোগীদের উপসর্গ চিহ্নিতই হয়নি। ফলে চিকিৎসার প্রসঙ্গ আসে না।” এদের হিসেবে চিন, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ২০২০ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ২০০,০০০ অতিরিক্ত মৃত্যু ঘটবে, সাব-সাহারা আফ্রিকায় ২০২০-তে ৭৭৯,০০০ জন মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।
এদেরকে কে বাঁচাবে? একমাত্র সক্রিয় ও জীবন্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এদের বাঁচাতে পারে। যদি এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা না যায় তাহলে কোভিডে যত মানুষের মৃত্যু হবে তার চেয়ে বেশি মৃত্যু হবে এ রোগগুলোর জন্য। নেচার-এর উল্লেখিত প্রবন্ধের শেষে মন্তব্য করা হয়েছে— “কোভিড-১৯ সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়েছে কয়েক বছরের জন্য তো বটেই, এমনকি কয়েক দশকের জন্যও হতে পারে।” বলা হয়েছে— “একটি সংক্রামক ব্যাধির হাত থেকে (পড়ুন কোভিড) মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে আরেক সংক্রামক ব্যাধিতে মানুষ মারা যাচ্ছে সেটা হল এমন এক শেষ হিসেব যা মানুষ কখনও চায় না।”
অথচ মানুষের চাহিদায় কখনওই খুব বেশি কিছু ছিল না— সামাজিক ন্যায় এবং স্বাস্থ্যের ন্যায্যতা ছাড়া। সরকারের তরফে প্রয়োজন ছিল স্বচ্ছতার, তাহলে মানুষের আস্থা অর্জন করা খুব শক্ত বিষয় কিছু নয়। সামাজিক ন্যায় এবং স্বাস্থ্যের ন্যায্যতাকে ভিত্তি করে যেগুলো নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখতে পারতেন সেগুলো হল— (১) কী করা সম্ভব, (২) মানুষের কাছে কোনটা গ্রহণীয়, (৩) ন্যায়, এবং (৪) কোনটা sustainable।
এখানে ভিন্ন একটি বিষয় আমরা ভেবে দেখব। ১৯৭৪-৭৫-এ প্রধানত জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্ত ছুঁয়ে যে ঐতিহাসিক গণআন্দোলন হয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে জরুরি অবস্থার ঘোষণা আর পরবর্তী নির্বাচনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধির পরাজয়— সেরকম কোনও ঐতিহাসিক মুহূর্ত কি আমরা বর্তমান অবস্থায় ভাবতে পারি? বোধ করি না। একাধিক বিষয় রয়েছে এখানে। প্রথমত, রাষ্ট্র প্রতিমুহূর্তে “অতিরাষ্ট্র” হয়ে উঠছে— স্বশাসিত গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন সংগঠনগুলো রাষ্ট্রের প্রসারিত শাখা হয়ে যাচ্ছে হয়তোবা প্রতিদিন। দ্বিতীয়ত, সেসময়ের আন্দোলনে মানুষ মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসে কথা বলত, একজন মানুষ আরেকজন মানুষের শরীরী ভাষা, প্রতিটি অভিব্যক্তি বুঝতে পারত, একজন মানুষের উষ্ণতা স্পর্শ করত আরেকটি মানুষকে। কিন্তু আজকের এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আমরা মুখহীন, মানুষের স্পর্শহীন। ফলে প্রত্যেকেই পুরনো ক্ল্যান বা গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের মতো আমরা সবাই একেকজন গোষ্ঠীপতি। প্রত্যেকে নিজেদের মত এবং নিজেদের ভার্চুয়াল সত্তা অতি যত্ন নিয়ে রক্ষা করি। এরকম কনটেক্সটে কীভাবে গড়ে ওঠে স্বাস্থ্য নিয়ে দেশব্যাপী গণআন্দোলন? আর এটা তো কোনও বিশেষ রাজ্য বা অঞ্চলের সমস্যা নয়— সমস্যা সমগ্র ভারতভূমির। তৃতীয়ত, শিক্ষকেরা এখন “এডুকেশনাল ম্যানেজার”— শিক্ষা থেকে দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে “কেন” প্রশ্নের অস্তিত্ব। “কেন” প্রশ্নের অস্তিত্ব বিলীন হওয়া নিওলিবারাল অর্থনীতির সঙ্গে বিশেষ সঙ্গতিপূর্ণ, পুঁজির পক্ষে অনুকূল।
সায়ান্স-এর মতো বিশ্ববন্দিত জার্নালের সম্পাদকীয়তে (৮.০৫.২০২০) এরকম এক পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে শুধুমাত্র কিছু ব্যবহারিক ওষুধ তৈরির পরিবর্তে আমাদের গবেষণার অভিমুখ হওয়া উচিত— “‘কেন’ এই প্রশ্নকে জিজ্ঞাসা করা (উদাহরণ হিসেবে, এ রোগের প্যাথোফিজিওলজি বোঝার জন্য বুনিয়াদি গবেষণা) এবং কেবলমাত্র “গাদা করে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত” (shovel n ready) ওষুধের আবিষ্কারের প্রোজেক্ট বাড়িয়ে চলা নয়।” আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্যবেক্ষণ হল— “কোভিড-১৯ পৃথিবীর কাছে নিয়ে এসেছে একটি পাশবিক পছন্দ (brutal choice)— অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এবং পাবলিক হেলথের মধ্যে বেছে নেওয়া।” পৃথিবীর আগামী যাত্রাপথে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেবলমাত্র একটি অধরা আশা হয়ে পড়ে থাকবে হয়তো আমাদের সবার কাছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম-এর মুখপত্রে প্রকাশিত হয়েছে (৯.০৯.২০২০) একটি প্রতিবেদন “7 countries we can all learn from to fight future pandemics, according to the WHO” শিরোনামে। এ প্রতিবেদনে বলা হল— “ডঃ টেড্রোস (হু-র ডিরেক্টর জেনারেল) সমস্ত দেশকে আহ্বান করছেন জনস্বাস্থ্যের জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে। এই বিনিয়োগ সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুস্থিরতার ভিত্তি।” তিনি কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করেছেন যারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে (যেমন, বাসস্থান, খাদ্য এবং কর্মসংস্থান ইত্যাদি) কাজ করেছে বলে করোনার বিপর্যয় এড়াতে পেরেছে। এ দেশগুলো হল— থাইল্যান্ড, ইতালি, মঙ্গোলিয়া, মরিশাস, পাকিস্তান, উরুগুয়ে, নিউজিল্যান্ড, জাপান এবং ভিয়েতনাম।
ধারাভির সাধারণ মানুষ রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। এরা নিজেরাই কনটেইনমেন্ট জোন তৈরি করেছে, সংক্রামিতদের আলাদা করেছে এবং তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহের ক্ষেত্রে যা করার করেছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত সরকারি তরফে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় যে চিকিৎসকেরা ছিলেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা ছিলেন তারা এগিয়ে এসেছেন।
এগুলো তো প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার অঙ্গ। সেটা ভেঙেচুড়ে গিয়েছে বলে মানুষ উদ্যোগ নিয়ে রোগ ঠেকাচ্ছে। এজন্য করোনা অতিমারির সময়েও মাথায় রাখতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, social determinants of health এবং Sustainable Development Goals-এর মতো অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে, সক্রিয় ও জীবন্ত রাখতে না পারলে আগামী অতিমারির সংক্রমণ কিছুতেই সফলভাবে ঠেকানো সম্ভব নয়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে জোর দিয়েই নিউজিল্যান্ড এই মুহূর্তে করোনা মুক্ত। ইংল্যান্ড নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে।
এরকম সঙ্কটের সময়ে নজরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সাধারণ মানুষের তরফে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনেতাদের ওপরে ট্রাস্ট বা বিশ্বাস। এবং এই বিশ্বাসের ভিত্তি হয় সরকারের তরফে স্বচ্ছতা-কে নিশ্চিত করা। এই মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে এবং ভারতবর্ষে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার একেবারে গোড়ার যে কাজগুলো সেগুলো বন্ধ হয়েছে বা থমকে আছে। এগুলোর মধ্যে পড়ে সার্বজনীন টিকাকরণ, যেগুলোকে “নেগলেকটেড ট্রপিকাল ডিজিজেজ” বা অবহেলিত গ্রীষ্মকালীন দেশের রোগ বলা হয়, যেমন ম্যালেরিয়া, টিবি বা শিশুদের ডায়ারিয়া এবং গর্ভবতী মায়েদের যত্ন নেবার জন্য যে সমস্ত প্রোগ্রাম আছে। নেচার-এর মতো পত্রিকায় (১৩.০৮.২০২০) বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে “এইডস, ম্যালেরিয়া অ্যন্ড টিউবারকিউলোসিস আর সার্জিং”, অর্থাৎ এইডস, ম্যালেরিয়া এবং টিউবারকিউলোসিস প্রবল গতিতে বাড়ছে।
পারস্পরিক এই বিশ্বাস, স্বচ্ছতা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জীবন্ত ও বেগবান রাখার ফলে আরেকবার বলব নিউজিল্যান্ড করোনামুক্ত হতে পেরেছে।
আমাদের মাথায় রাখতে হবে পৃথিবীর ৭০০ কোটির ওপরে মানুষের সবার জন্য ভ্যাক্সিন তৈরি করা এবং এর সরবরাহ সুনিশ্চিত করা রীতিমতো দমিয়ে দেওয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। এই বাস্তব চ্যালেঞ্জও বিজ্ঞানীকুল, ওষুধ উৎপাদক সংস্থা এবং রাষ্ট্রগুলোর কাছে রয়েছে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ প্রকাশিত (২৫.০৪.২১) বিশ্লেষণে (An Uncertain Public – Encouraging Acceptance of Covid-19 Vaccine) আমেরিকার অভিজ্ঞতায় বলা হয়েছে— “আমেরিকাতে কোভিড-১৯-এর ছড়িয়ে পড়াকে ভ্যাক্সিন দিয়ে আটকানোর ক্ষমতা কেবলমাত্র ভ্যাক্সিন টেকনিক্যালি কত ভালোভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে তার ওপরে নির্ভর করে না, নির্ভর করে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভ্যাক্সিন নেওয়ার সদিচ্ছার ওপরে।” বলা হয়েছে, মানুষের সদিচ্ছা তৈরির কাজে সাফল্য নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতা এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর পরিবর্তে সর্বস্তরের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মিলিত উদ্যোগের ওপরে। এবং এটাই নীতি হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
একই জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে বিশেষ প্রবন্ধ (৮.০৪.২০২১) “From Vaccine Nationalism to Vaccine Equity – Finding a Path Forward”। এখানে বলা হয়েছে, “বর্তমানে বিশ্বে যে হারে টিকাকরণ (প্রতিদিন মোটের ওপরে ৬৭ লক্ষ মানুষের টিকাকরণ হচ্ছে) চলছে তাতে হার্ড ইমিউনিটি (জনসমষ্টির ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশের দুটি ডোজ পেতে হবে) অর্জন করতে প্রায় ৪.৬ বছর সময় লাগবে” এবং “দরিদ্র অবস্থায় থাকা (low-resource setting) ৮০ শতাংশ মানুষের কাছে একটি ভ্যাক্সিনও এ বছরে পৌঁছুবে না।” এর কারণ বলতে গিয়ে পরিষ্কার মন্তব্য করা হয়েছে— “বিশ্বের সার্বজনীন, সকলের জন্য অবারিত ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর (public goods) পণ্যায়ন বহুবিস্তৃত সুযোগ পাওয়ার অসাম্যকে আরও শক্তিশালী করে তোলে এবং স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিপুল বৈষম্যকে তীব্রতর করে।” অস্যার্থ, হাঁ-মুখ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো মানুষের বেঁচে থাকার স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক অধিকারকে (natural rights) নিত্যনতুন পণ্য হিসেবে মুনাফার সামগ্রী করে তোলে। এমনকি করোনা অতিমারির আর্ত সময়ও এর ব্যতিক্রম নয়। গার্ডিয়ান সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সংবাদ অনুযায়ী (“How the AstraZeneca vaccine became a political football and a PR disaster”, ২৬.০৩.২০২১) ভ্যাক্সিনের বিক্রি থেকে মডার্না ১৮ বিলিয়ন ডলার এবং ফাইজার/বায়োএনটেক ১৫ বিলিয়ন ডলার রেভেন্যু আশা করছে।
ভিন্ন প্রসঙ্গে গিয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন নেচার-এ প্রকাশিত (২২.০৪.২১) প্রবন্ধের কথা— “How Covid Hurt the Fight against Other Deadly Diseases”। এ প্রবন্ধে বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছে— টিবি রোগে প্রতিবছর ১৪ লক্ষ মানুষ মারা যায়। কোভিডের দরুন যারা রোগটির চিকিৎসা পেত এরকম ১০ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসেব অনুযায়ী, সাধারণভাবে যতজন এ রোগে মারা যায় তার চাইতে আরও ৫ লক্ষ বেশি মানুষ মারা যাবে। ২০১৯-এ যতজন মানুষের টিবির চিকিৎসা হত ২০২০-তে তার মধ্যে ২১ শতাংশ মানুষ চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একই কথা হাম এবং পোলিওর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পোলিও রোগীর সংখ্যা ৫৫৪ (২০১৮-এ) বেড়ে ১,২১৬ (২০২০-তে) হয়েছে। শিশুদের রুটিন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম মাসের পর মাস বন্ধ হয়ে গেছে। একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল PLoS জার্নালে ২০১০ সালে “Nuclear Weapons and Neglected Diseases: The ‘‘Ten-Thousand-to-One Gap’’” শিরোনামে। সেখানে বলা হয়েছিল—
“বিশ্বের ১১টি পরমাণু শক্তিধর দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে এবং রক্ষণাবেক্ষণে যা খরচ করে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা ভগ্নাংশ (১/১০০০০ অংশ) দিয়ে তারা বেশিরভাগ অবহেলিত ব্যাধিগুলিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারে, অবহেলিত ব্যাধিগুলি নিয়ে যৌথ গবেষণায় সামিল হতে পারে, যৌথ উন্নয়নমূলক কাজকর্মে সামিল হতে পারে, যার ফলে শেষ বিচারে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বগুলির মাত্রা কমে এবং বিশ্বশান্তি অর্জনের পথ প্রশস্ত হয়।”
দ্বিতীয় ঢেউ এবং “পলিসি প্যারালিসিস”
কেন এরকম একটি স্বাস্থ্যসঙ্কটের সুনামির সম্মুখীন হতে হল আমাদের? কেন কোনও বেড পাওয়া যাচ্ছে না আপৎকালীন পরিস্থিতিতে? সামান্য অক্সিজেনের জন্য খাবি খেতে খেতে কেন এত এত রোগী মারা যাচ্ছে, এমনকি হাসপাতালেও? কেন ভেন্টিলেটরের এমন সঙ্কট শুরু হল? অথচ গতবছরের অমানুষিক লকডাউন আমাদের হাতে দিয়েছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা এবং সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সময়। বিশেষজ্ঞরা— এপিডেমিওলজিস্ট, মেডিক্যাল এক্সপার্ট, হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট, সামাজিককর্মী এবং পরিসংখ্যানবিদ প্রমুখ— সতর্ক করে আসছিলেন এরকম এক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে এই মর্মে। আমরা কর্ণপাত করিনি। আমাদের স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে (শুধু স্বাস্থ্য কেন, সব নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেই) প্রধান ভূমিকা নেয় আমলা এবং রাজনীতিবিদরা। এক্সপার্টরা উপেক্ষিত থাকেন। এটা দেশের এবং জাতির দুর্ভাগ্য। নীতিনির্ধারকেরা এই সতর্কবাণীতে আদৌ কর্ণপাত করেননি। তার একটি পরিণতি আজকের এই মর্মান্তিক মৃত্যুমিছিল। সিএনএন সংবাদসংস্থার এই ডায়াগ্রামটি (১.০৫.২১) দেখলে আরও ভালোভাবে সঙ্কটের চেহারা বোঝা যাবে। এ সংবাদে বলা হয়—
মোদির নিষ্ক্রিয়তা এক ব্যাপক ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। টুইটারে শয়ে শয়ে #ModiMustResign বা #ModiMadeDisaster-এর মতো হ্যাশট্যাগ শেয়ার হচ্ছে। স্থানীয় সংবাদসূত্রে জানা গেছে রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল বা হরিদ্বারে হিন্দু ধর্মীয় উৎসব কুম্ভ মেলার জন্য লোক জমায়েতের অনুমতি দেওয়ায় ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নভজোৎ দাহিয়া মোদিকে ‘সুপার স্প্রেডার’ আখ্যা দিয়েছেন।
নেচার পত্রিকায় (৬.০৫.২১) প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের শিরোনাম “Indian government should heed its scientists on COVID”। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হল— “গোটা বিশ্ব বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে ভারতের কোভিড-১৯ সঙ্কটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গত সপ্তাহের প্রতি দিনই নতুন করে ৩০০,০০০-এর বেশি মানুষ সংক্রামিত হয়েছেন; হাসপাতালগুলি পূর্ণ; অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি; আর শ্মশানে উপচে পড়ছে মৃতদেহ। দাহ করার জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না।” বলা হল— “কয়েক মাস ধরেই মহামারি-বিশেষজ্ঞরা, ভাইরোলজিস্টরা, ইমিউনোলজিস্টরা এবং জনস্বাস্থ্য-বিশারদরা সতর্ক করে আসছেন যে এই অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই শেষ হয়নি, সঠিক তথ্য সরবরাহ করা দরকার, এবং প্রতিষেধক-ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দরকার। তাঁদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। তাঁদের যুক্তির সঙ্গে সরকারের অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলার দাবির কোনও মিলই নেই।” সরকারের দেওয়া তথ্য এবং বয়ানের সঙ্গে এত এত এক্সপার্টের মতামত খাপ খাচ্ছিল না বলে সরকার এঁদেরকে কোনও তথ্য সরবরাহ তো করেইনি, এঁদের কোনও পরামর্শও কানে তোলেনি।
২০১৬ সালে সংসদীয় কমিটির প্যানেল রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি ১০,১৮৯ জন মানুষের জন্য ১ জন সরকারি ডাক্তার, প্রতি ২,০৪৬ জনের জন্য সরকারি হাসপাতালে একটি বেড বরাদ্দ এবং প্রতি ৯০,৩৪৩ জনের জন্য একটি সরকারি হাসপাতাল— এই হচ্ছে সেসময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যের চিত্র। ২০২০ সালের মার্চ মাসের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৩৭ কোটি মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে বেড রয়েছে ৭,১৩,৯৮৬টি। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি ১০০০ ভারতবাসীর জন্য ০.৫টি করে বেড। বিহারে আবার এই সংখ্যা ১০০০-এ ০.১১, দিল্লিতে ১.০৫— বৈষম্য সহজেই চোখে পড়ে।
এখানে আরেকটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। এবারের স্বাস্থ্য বাজেট পেশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নন, করেছেন অর্থমন্ত্রী। স্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের দায়িত্বের আওতা থেকে পূর্ণত বিদেয় দিয়ে মুক্ত বাজারের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও ইঙ্গিত কি এর মাঝে প্রচ্ছন্ন আছে? Wire.in সংবাদপত্রের খবর ছিল (০১.০২.২১) “Despite Govt Claims, India’s Health Budget Only Around 0.34% of GDP”। এই সংবাদে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে— “যেখানে এরকম সঙ্কটকালীন মুহূর্তে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোর একান্ত প্রয়োজন ছিল সেখানে সমস্ত হিসেবনিকেশ করে দেখা গেছে জিডিপির মাত্র ০.৩৪ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ আছে। গতবছর এই পরিমাণ ছিল ০.৩১ শতাংশ।” যদিও মুদ্রাস্ফীতির হিসেব এর মধ্যে ধরা হয়নি। প্রতিবেদনের সিদ্ধান্ত— “বিশ্বজোড়া এমন একটা বিধ্বংসী অতিমারিও যদি সরকারের এই উপলব্ধি না আনতে পারে যে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির কাজটাকেই এখন অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, তবে জানা নেই আর কিসে সরকারের বোধোদয় হবে।” ফেব্রুয়ারি মাসের এরকম সতর্কবাণীর পরেও স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ নিয়ে আলাদা করে কোনও চিন্তাভাবনা করা হয়নি। এর খেসারত সমগ্র ভারতবাসী দিচ্ছে— অগণিত চিতা জ্বলছে যমুনা এবং সবরমতী নদীর ধারে।
এখানে মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য রাজ্যের তালিকাভুক্ত বিষয়, কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব নয়। কেন্দ্রীয় সরকার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে, এমনকি কোভিডের এই মারণান্তক সময়েও, প্রায় হাত ধুয়ে বসে আছে।
Center for Disease Dynamics, Economics and Policy (CDDP)-র (ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগ) সমীক্ষা অনুযায়ী (২০২০), সরকারি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা প্রায় ৭,০০,০০০। এই সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, ভারতে প্রায় ১৯ লক্ষ হাসপাতাল বেড আছে (সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে), ৯৪,৯৬১টি আইসিইউ বেড আছে (এর মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রে রয়েছে ৩৫,৬৯৯ এবং প্রাইভেট সেক্টরে ৫৯,২৬২), আছে ৪৮,০০০ ভেন্টিলেটর। ৭টি রাজ্যে ঘনীভূত হয়ে আছে এই বেড ও ভেন্টিলেটর— উত্তরপ্রদেশ (১৪.৮ শতাংশ), কর্নাটক (১৩.৮ শতাংশ), মহারাষ্ট্র (১২.২ শতাংশ), তামিলনাড়ু (৮.১ শতাংশ), পশ্চিমবঙ্গ (৫.৯ শতাংশ), তেলেঙ্গানা (৫.২ শতাংশ) এবং কেরল (৫.২ শতাংশ)। এখানে একটি চিত্র দিলে আন্তর্জাতিক মানে আমাদের দেশের ক্রিটিক্যাল কেয়ার বেডের সংখ্যার একটি প্রতিতুলনা পাওয়া যাবে।
২০২০ থেকে কোভিড অতিমারি শুরু হবার পরে এ সংখ্যা খানিকটা বেড়েছে আশা করা যায়। ২০২১ সালের সর্বশেষ তথ্য আমাদের হাতে নেই।
অক্সিজেন সঙ্কট
ভারতে প্রতিদিন ৭,৫০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন তৈরি হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় চিকিৎসার বা মেডিক্যাল ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হয় প্রতিদিন ৬,০০০ মেট্রিক টন। বর্তমানের অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে চিকিৎসার জন্য চাহিদা বহু বহুগুণ বেড়ে গেছে। এক নারকীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে রোগী এমনকি ফুটপাথেও খাবি খেতে খেতে মারা যাচ্ছে। Scroll.in সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী (১৮.০৪.২১)— “১৫০টি অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট, যাদের খরচ মাত্র ২০০ কোটি টাকা, তার জন্য বিড নিতে ৮ মাস সময় লাগল। আর তার ৬ মাস পরেও বেশিরভাগেরই কোনও কাজ হয়নি।”
আমাদের নীতিনির্ধারকদের কি কোনও অনুমানই ছিল না যে এরকম এক পরিস্থিতি জন্ম নিতে পারে? আমাদের রাষ্ট্রিক নীতি নির্ধারণের মাঝে জনস্বাস্থ্যের কি কোনও স্থানই নেই? যে মানুষটি মারা যাচ্ছে সে কখনও এ প্রশ্ন করতে পারবে না। কিন্তু ঢাল-তলোয়ারহীন প্রতিটি স্তরের নিবেদিতপ্রাণ স্বাস্থ্যকর্মীদের যে বাহিনি লাঠি দিয়ে কোভিডের কামানের গোলার মোকাবিলা করছে তারা এই সঙ্গত প্রশ্ন নিশ্চয়ই করবেন। এ সঙ্কট তো আসলে ভারতের জনস্বাস্থ্যের মহাবিপর্যয়। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী নির্ঘন্ট ঘোষণার পরেই ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম সরকারের কাছে করোনা বিপর্যয়ের আশঙ্কা করে বারংবার চিঠি দিয়েছে। সতর্ক করেছে। কিন্তু সতর্কতার বিধি শিকেয় তুলে নির্বাচন কমিশন ৮ দফায় এ রাজ্যে ভোট করিয়েছে। কোভিড ছড়িয়ে পড়ার পথ সুগম হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার কুম্ভমেলায় ধর্মাচরণের জন্য কয়েক লক্ষ লোকের জমায়েতে অনুমতি দিয়েছে। সংক্রমণ ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে।
এতগুলো মানুষের প্রাণ ঝরে যাওয়া কি অনিবার্য ছিল? হিন্দু সংবাদপত্রে (২৮.০৪.২১) একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে “A pragmatic approach for COVID-19” শিরোনামে। এখানে বলা হয়েছে “সঙ্কটটিকে সঙ্কট বলে স্বীকার করতে হবে” এবং গণটিকাকরণ করতে হবে। এর সঙ্গে সাধারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধিগুলো, যেমন আবশ্যিকভাবে নাক-মুখ ভালোভাবে ঢাকা মাস্ক, সাবান জল বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, ৬-৮ ফুটের দূরত্ব রক্ষা করে চলা, অবশ্যই কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
গণটিকাকরণ
Scroll.in সংবাদপত্রের খবর অনাযায়ী (২১.০৫.২১)— “এইরকম হারে চলতে থাকলে ভারত ২০২১-এর শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৩ শতাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনতে পারবে বলে আইএমএফ-এর ভবিষ্যদ্বাণী।” অথচ, মজার কথা হল যে এখন গণটিকাকরণের যে হাল তার বিপরীত চিত্রও ছিল একসময় এ দেশে।
(১৯৯৭ সালের জানুয়ারির একদিনে স্বাস্থ্যকর্মীরা ১২ কোটি ৭০ লক্ষ শিশুকে পোলিও টিকা দিয়েছিলেন। পরের বছর আরও ১৩ কোটি ৪০ লক্ষ শিশুকে টিকা দেওয়া হয়েছিল।)
এনডিটিভি-র সংবাদ অনুযায়ী (২৯.০৪.২১)— একদিকে ভারতে গত ২৪ ঘন্টায় রেকর্ডসংখ্যক (৩,২৯৩) মৃত্যু হয়েছে এবং নতুন কেসের সংখ্যা (৩ লক্ষ ৬০ হাজার) বিশ্বে রেকর্ড করেছে, অন্যদিকে ১ কোটি ৩৩ লক্ষ ভারতবাসী কোভিডের ভ্যাক্সিনের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। মৃত্যুর পাশাপাশি রয়েছে বেঁচে থাকার সুতীব্র আকাঙ্খা। বিবিসি-র সংবাদ অনুযায়ী (২৮.০৪.২১ – “India coronavirus: Can it make enough vaccines to meet demand?”) ভারতে এখনও পর্যন্ত জনসংখ্যার ১০ শতাংশের কম লোকের ভ্যাক্সিনের প্রথম ডোজ নেওয়া হয়েছে।
নেচার-এর মতো জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদন (“India’s COVID-vaccine woes – by the numbers”, ১৫.০৪.২০২১) জানাচ্ছে— “গতবছর জুন মাসে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ঘোষণা করেছিল সিরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়াকে ১০০ কোটি ভ্যাক্সিন ডোজের জন্য লাইসেন্স দিয়েছে নিম্ন এবং নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে পৌঁছনোর জন্য। কিন্তু গত মার্চ মাসে যখন ভারতের তরফ থেকে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন অব্দি মাত্র ৬ কোটি ৪০ লক্ষ ডোজ রপ্তানি হয়েছে। এবং এর মধ্যে ২ কোটি ৮০ লক্ষ ডোজ রপ্তানি হয়েছে COVAX (দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের দেশে সবার কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা) মারফৎ।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র সংবাদ অনুযায়ী (২১.০৪.২১), এখনও অব্দি পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লক্ষ ভারতীয়ের। এর মধ্যে ১ কোটি ১৪ লক্ষ জন হচ্ছেন প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মী এবং অন্যান্যদের। এছাড়াও ১৯.০৪.২১ তারিখ অব্দি ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী গ্রুপে ৪ কোটি ২৩ লক্ষ জনের এবং ৬০ বছরের ওপরে ৪ কোটি ৬৬ লক্ষ মানুষের টিকা হয়েছে। এ রিপোর্টেই বলছে, ১৯.০৪.২১-এর পরবর্তী সপ্তাহে ২৮ লক্ষ মানুষ ভ্যাক্সিন নিয়েছে। এ সংখ্যা এর আগের সপ্তাহের (১২.০৪–১৮.০৪) থেকে কম। আগের সপ্তাহে সংখ্যা ছিল ৩৪ লক্ষ ৫০ হাজার। অর্থাৎ, টিকারণের ক্ষেত্রে একটি দ্বিধা কাজ করছে একদিকে, অন্যদিকে টিকার সরবরাহ কম— এ দুয়ে মিলে এক সপ্তাহে টিকাকরণ অনেকটাই কমে গেছে।
২১.০৪.২১ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকা-র সংবাদ “টিকা: এখন দামও বেশি, দায়ও রাজ্যের”। টিকাকে অন্যান্য পলিসির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বাজারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বর্তমানে সিরাম ইন্সটিটিউট যে টিকা ১৫০ টাকায় এবং ভারত বায়োটেক ২০৬ টাকায় দিচ্ছে সে দাম (দুটি ডোজ মিলে) ২০০০ টাকা থেকে ৮০০-১০০০ টাকা অব্দি লাগতে পারে। যেদেশে সামাজিক সুরক্ষা বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব প্রায় নেই, কয়েককোটি মানুষ কর্মহীন, দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করা মানুষের সংখ্যা ইংল্যান্ডের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি, সেদেশে এভাবে, এই অর্থমূল্যে কজন টিকা কিনতে পারবে? মোদ্দা কথা হল, সার্বজনীন টিকাকরণ হয়তো একটি কুহকী আশা হিসেবে রয়ে যাবে।
২০.০৪.২০২১ তারিখ রাতে টিভিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেঊ মোকাবিলার লক্ষ্যে ভাষণ দিয়েছেন। জোর দিয়েছেন ব্যক্তিগত আচরণবিধি এবং ঘরের মধ্যে থাকার ওপরে। কিন্তু যারা কোভিড রোগী, বিভিন্ন হাসপাতালে আক্ষরিক অর্থে অক্সিজেনের জন্য খাবি খাচ্ছেন, শ্বাস নিতে পারছেন না তাদের অক্সিজেনের ব্যবস্থা কী হবে তা জানাননি। (উল্লেখ করা দরকার, অক্সিজেনের সরবরাহের সমস্যার জন্য ভেলোরের সরকারি হাসপাতালে ১৯.০৪-এ ৭ জন কোভিড রোগী এবং ২১.০৪-এ মহারাষ্ট্রের নাসিকে ২৪ জন কোভিড রোগী মারা গিয়েছে।) দেশের মধ্যে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ট্রান্সমিশন চেইন আটকানোর যে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করতে হবে তার কী হবে সেকথা আমরা জানতে পারিনি। নতুন করে কোভিড হাসপাতাল তৈরি বা হাসপাতালের কোভিড বেড বাড়ানোর লক্ষ্যে নির্দিষ্টভাবে কী কী করা হবে সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া যায়নি। উত্তর পাওয়া যায়নি চিকিৎসার একান্ত প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য সামগ্রীর সুরাহা কীভাবে হবে এবং তার জন্য কী পরিকল্পনা রয়েছে। এসব কোনও কথাই আমরা জানি না। যেমন আমরা জানতে পারিনি কি কারণে একেবারে ফ্রন্টলাইন কোভিডযোদ্ধা ডাক্তারদের চিকিৎসার জন্য যে ইন্সিওরেন্স কেন্দ্রীয় সরকার গতবছর চালু করেছিল সে ইন্সিওরেন্স গত কয়েকদিন আগে বন্ধ করে দেওয়া হল কেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় (১.০৫.২১) মন্তব্য করা হয়েছে— “সমালোচকদের মতে, আত্মতুষ্টি এবং হারাকিরি দেশে দ্বিতীয় তরঙ্গকে ধ্বংসাত্মক করে তুলেছে, যার ফলে তাঁর রাজনৈতিকভাবে অপরাজেয় যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে খানখান হয়ে গেছে।” এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে প্রবল আত্মতুষ্টির ফোলানো বেলুন। এ সমস্ত কিছুর সম্মিলিত যোগফলে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ বেলাগাম হয়ে গেল।
বর্তমানে করোনাভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617) এমন বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে সে ব্যাপারে Indian SAARS-CoV-2 Genetics Consortium বা INSACOG-এর বিজ্ঞানীরা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সরকারকে সতর্ক করে আসছিলেন। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন। রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের নিয়ে তৈরি নীতিনির্ধারক সংস্থা এগুলোকে পাত্তা দেয়নি। নিজেদের আত্মম্ভরিতা এবং প্রবল আত্মতুষ্টিতে মগ্ন হয়ে ছিলেন। INSACOG-এর বিজ্ঞানীরা তাদের পর্যবেক্ষণের ফলাফল ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (NCDC)-কে দিয়ে সতর্ক করেছিলেন যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল মানুষ বেশি বিশ্বাস করে রাজনীতিকদের, বিজ্ঞানীদের নয়।
ডেটা বা তথ্যের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, ভুল তথ্য, পছন্দমতো তৈরি-করে-নেওয়া তথ্য এবং বিজ্ঞানীদের হাতে পূর্ণ তথ্য তুলে না দেওয়া আজকের অতিমারিকে অনেক বেশি বিপজ্জনক করে তুলেছে। সায়ান্স-এর মতো বন্দিত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (৪.০৫.২১) “‘There are so many hurdles,’ Indian scientists plead with government to unlock COVID-19 data”। প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে— “ভারত সরকার তথ্য দিতে এত অনিচ্ছুক কেন সেটা অস্পষ্ট।”
২৯.০৪.২১-এ এখন অব্দি ৯০০-র বেশি বিজ্ঞানী ও স্বাধীন চিন্তা সম্পন্ন মানুষের স্বাক্ষর সমন্বিত (যার একজন স্বাক্ষরকারী এই প্রবন্ধ লেখকও) চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে “AN OPEN APPEAL TO THE HON’BLE PRIME MINISTER OF INDIA” শিরোনামে। সেখানে একেবারে নীচের দিকের (granular) ডেটা চাওয়া হয়েছে। চিঠির কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি—
We emphasize the need for systematic collection and timely release of data on:
(a) large-scale genomic surveillance for new variants,
(b) testing and clinical data for better predictions of the spread of infection,
(c) the clinical outcomes of hospitalized patients, and
(d) immune response to vaccination in our population.
কিন্তু এখন অব্দি অরণ্যে রোদন ছাড়া কিছু হয়নি।
আমেরিকার নির্বাচনের প্রাক্কালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সমস্ত সদস্যের যৌথভাবে লেখা সম্পাদকীয়তে (৮.১০.২০২০) বলা হয়েছিল যে কোভিড-১৯ বিশ্ব জুড়ে সঙ্কট তৈরি করেছে। এবং এ সঙ্কট দেশের নেতৃত্বকে বুঝে নেওয়ার একটা পরীক্ষা। আমেরিকাতে নেতৃত্ব এ পরীক্ষায় পূর্ণত বিফল হয়েছে। সম্পাদকীয়টির শুরুতেই বলা হয়েছিল— “এখানে, আমেরিকায়, আমাদের নেতারা এই পরীক্ষায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। একটা সঙ্কট মোকাবিলা করতে নেমে তাঁরা সেটিকে একটি মর্মান্তিক শোকগাথায় পরিণত করেছেন।” ২০০,০০০ মানুষের উপরে জীবনহানি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, অসংখ্য বেকার তৈরি হয়েছে। সম্পাদকীয়টির সিদ্ধান্ত— সম্পাদকীয়র শিরোনাম Dying in a Leadership Vacuum—
নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কেউ এভাবে হঠকারীভাবে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললে কিংবা টাকা তছনছ করলে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হত। এরপরেও আমাদের নেতৃত্ব তাদের কৃতকর্মের জন্য আমাদের কাছে অব্যাহতি দাবী করেছে। কিন্তু এই নির্বাচন আমাদের হাতে বিচারের ক্ষমতা দিয়েছে। যৌক্তিক মানুষেরা আমাদের প্রার্থীদের বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আপত্তি জানাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সত্য কখনো ‘লিবারাল’ বা ‘কনজারভেটিভ’ নয়। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশার সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্যের সঙ্কটের প্রশ্ন যখন আসে তখন পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিপজ্জনকভাবে অকর্মণ্য। আমরা এদেরকে আর উৎসাহ কিংবা সামর্থ্য জোগাতে পারি না যাতে তারা আবার নেতা হিসেবে ফিরে আসে এবং হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যু ঘটে। আমরা এদের আর ফেরার অনুমতি দিতে পারি না।
আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে কোনও মিল বা সংযোগ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে?
আমাদের স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে “পলিসি প্যারালিসিস” চলছে।
এরকম পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কর্পোরেট দানবদের কবল থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। স্বাস্থ্যকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। করোনাকালে জনসমাজের গর্ভ থেকে এ দাবী আরও জোরদার হয়ে ওঠা দরকার।
এরপরেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে আমরা দিশেহারা। কোথায় মিলবে এর উত্তর? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক নেতারা কিংবা আক্রান্ত জনসাধারণ? কে দেবে এর উত্তর?