মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়
অ্যাডভোকেসি অফিসার, দুর্বার
চার নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ডাঃ স্মরজিৎ জানাকে নিয়ে কিছু লেখার জন্য অনুরুদ্ধ হয়েছি। এই মুহূর্তে ওঁকে নিয়ে কিছু লেখা খুবই কষ্টকর। তবু চেষ্টা করছি। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
ডাঃ স্মরজিৎ জানা নামটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে বইমেলায়, উৎস মানুষ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা থেকে। তারপর এনজিও কর্মী হিসেবে হাওড়ার একটি এনজিওতে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলাম। সেখানেই ডাঃ জানার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। ট্রেনিং-এর মাঝখানে উনি আসেন। কর্তৃপক্ষ ওঁকে মালা পরিয়ে বরণ করে নেন। ওঁর সেদিনের বক্তব্যের বিষয় ছিল Sex and Sexuality। অনেক এনজিও কর্মীর মতো সেদিন আমিও ডাঃ জানার বক্তব্য শুনে অভিভূত হয়েছিলাম।
ওই বছরই দুর্বার-এর প্রথম রাজ্য সম্মেলন। এখানে আমন্ত্রিত রাজ্যের বহু সংখ্যক এনজিও। এখানেই আমার দ্বিতীয়বার ডাঃ জানার বক্তব্য শোনার সুযোগ ঘটে।
এরপর দুর্বার-এ ফিল্ড কো-অর্ডিনেটর হিসেবে নিযুক্ত হলাম। সেটা ১৯৯৯ সাল। এরপর লিয়াজঁ অফিসারের প্রমোশন, পরে অ্যাডভোকেসি অফিসার, আসলে প্রোজেক্ট-এর পোস্ট এর সঙ্গে সঙ্গে নিজের ডেজিগনেশনেরও পরিবর্তন হতে থাকে।
সত্যি কথা বলতে আমাদের সময়ে আমাদের মত শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা সাধারণত যে চাকুরিগুলি করে থাকে, তার থেকে এনজিও কর্মীদের কাজগুলি অনেকটাই আলাদা। প্রোজেক্ট সফল করতে গিয়ে সমাজ উন্নয়নের ধারায় তারা এমনিভাবেই যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু অন্য এনজিও আর দুর্বারের মধ্যে বিস্তর ফারাক। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান আন্দোলনের রূপকার ও দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জানাকে এখন অনেকেই কুর্নিশ জানাচ্ছেন। বেশ্যা থেকে যৌনকর্মী- শব্দটির এই মর্যাদালাভ ড. জানার নিরন্তর লড়াইয়ের ফল। কিন্তু সংগঠন তৈরি এবং তার বিস্তারের ক্ষেত্রে স্যারের নির্দেশে যৌনকর্মী দিদিদের সঙ্গে যে মানুষগুলিকে কাজ করতে হয়েছিল, একমাত্র তাঁরাই জানেন কত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাঁদের হাঁটতে হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে যাঁরা বাড়ির লোকজনের সহযোগিতা পেয়েছেন, দুর্বার সংগঠনের এনজিও হিসেবে কাজের ক্ষেত্রে তাঁরাই টিকে থাকতে পেরেছেন।
স্যার অর্থাৎ ডাঃ জানা জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে ১৯৯২ সালে সোনাগাছিতে এসটিডি এইচআইভি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এটিকে ঘিরে যত ধরনের অন্যায় অত্যাচার সংঘটিত হয় তার মোকাবিলা করতে না পারলে, যৌনকর্মী গোষ্ঠীর জনস্বাস্থ্যের কাজ কখনওই সফল হবে না। আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে দরকার যৌনকর্মীদের সংগঠিত শক্তি অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের সংগঠন।
তাই অনেক ডাক্তার-বিজ্ঞানীদের সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি প্রোজেক্টের কাজ শুরু করেছিলেন ১২ জন যৌনকর্মী দিদিকে ট্রেনিং দিয়ে, পিয়ার এডুকেটেড বা সাথী শিক্ষিকা হিসেবে প্রোজেক্টে যুক্ত করিয়ে। তাঁরা দিনের বেলা স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করতেন প্রোজেক্টে। দিদিদের ফ্লিপচার্ট দেখিয়ে রোগের বিষয়ে বুঝিয়ে ক্লিনিকে নিয়ে আসতেন। পাশাপাশি খদ্দের ও বাবুদেরও ডাক্তারখানায় নিয়ে আসতেন যৌন রোগ নিরাময়ের জন্য। সংগঠন তৈরির পর Health and Hygiene থেকে তিনি STD HIV Intervention Program বা SHIP প্রোগ্রামকে সরাসরি যৌনকর্মী সংগঠনের অর্থাৎ দুর্বার-এর আওতায় নিয়ে আসেন এবং নিজে প্রোজেক্ট ডিরেক্টরের জায়গা ছেড়ে দেন একজন যৌনকর্মীর সন্তানকে। তাঁর নাম মৃণালকান্তি দত্ত বা বাচ্চুদা। স্যার বিশ্বাস করতেন CLSI তত্ত্বে। অর্থাৎ যে জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ, সেই জনগোষ্ঠীর হাতে প্রকল্পের মালিকানা না থাকলে প্রকল্পের কাজ সফল হয় না।
সোনাগাছি প্রোজেক্টের সাফল্য থেকে তিনি সারা বিশ্বকে দেখিয়েছিলেন বা শিখিয়েছিলেন যে একটা প্রোজেক্টের সাফল্যের পিছনে—
১। Enabling environment বা সহায়ক পরিবেশ
২। Leadership building বা নেতৃত্ব দান
৩। Ownership building বা মালিকানা তৈরি
এই উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এই তত্ত্ব NACO-র অ্যাডভাইসর হিসেবে জাতীয় কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
সোনাগাছি প্রোজেক্টের ডিরেক্টর, দুর্বার-এর প্রতিষ্ঠাতা থেকে প্রোজেক্টটি জনগোষ্ঠীকে হস্তান্তর করে তিনি মুখ্য উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করতে থাকলেন। সঙ্গে বাইরে থেকে চাকরি করতে আসা প্রোজেক্ট কর্মীদের এক সুতোয় বাঁধার জন্য ইন্টারভিউ নেওয়ার সময়ই তিনি বলতেন যৌনকর্মীদের প্রতি 3R অর্থাৎ Respect, Reliance এবং Recognition-এর কথা। যাঁরা এগুলি মেনে কাজ করতে পারেন তাঁদের কোনও অসুবিধা হত না। প্রোজেক্ট হ্যান্ডওভার করে দীর্ঘ বছর বাইরে থেকেছেন তিনি কিন্তু দুর্বারকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটার পর একটা স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুর্বারের কর্মীদের আর সেই স্বপ্নগুলো সফল করে তুলেছেন এই সংগঠন দিয়ে, যা পরিণত হয়েছে এশিয়ার সবথেকে বড় যৌনকর্মী সংগঠন।
গতর খাটিয়ে খাই— শ্রমিকের অধিকার চাই।
No condom No sex।
রাস্তার মেয়েরাই পথ দেখাচ্ছে।
এসব স্লোগান দিতে দিতে দুর্বারের কর্মীরা শহরের রাজপথে মিছিল করছে, রাস্তায় ট্রাম বাস থেমে গেছে, কৌতূহলী জনতা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে— এ সমস্তই এখন পশ্চিমবঙ্গের বুকে খুব সাধারণ ঘটনা।
দুর্বার একটা আন্দোলনের অভিমুখ, যে আন্দোলন আস্তে আস্তে জড়িয়ে নিয়েছিল অসংখ্য প্রান্তিক মানুষকে। আমলাশোলের শবর-আদিবাসী অথবা পুরুলিয়ার নাচনি শিল্পীদের কীভাবে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হয়, কীভাবে সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান ছিনিয়ে নিতে হয় এসবই তাদের পাশে থেকে, তাদের সংগঠিত করে শিখিয়েছিল দুর্বার।
যৌনকর্মীদের সংগঠন হওয়ার পর পর অনেকগুলি সংগঠন তৈরি হয় দুর্বারের ছত্রছায়ায়। যৌনকর্মীদের সন্তানরা তৈরি করেন তাঁদের নিজস্ব সংগঠন— আমরা পদাতিক। মায়েদের পেশাকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে দেখা, মাকে শ্রমিকের সম্মান দেওয়া, নাবালক বা নাবালিকাদের অন্য কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বন্ধ করা, ড্রপআউট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার আঙিনায় টেনে আনা, সর্বোপরি সর্বনাশা ড্রাগের নেশা বন্ধ করা— এই সংগঠনের মূল কাজ হয়ে ওঠে।
যৌনকর্মীদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে ডাঃ জানা গড়ে তোলেন তাঁদের নিজস্ব কো-অপারেটিভ— ঊষা মাল্টিপারপাস সোসাইটি লিমিটেড। বর্তমানে অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষজনও এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে পারেন। এশিয়ার সর্ববৃহৎ এই কো-অপারেটিভ বর্তমান সরকার এবং পূর্বতন সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেছে। ৬০ শতাংশ যৌনকর্মী এখান থেকে ঋণ নেন সন্তানদের লেখাপড়া করানোর জন্য, আর ৪০ শতাংশ ঘরবাড়ি তৈরি, মেয়ের বিয়ে ইত্যাদি কাজের জন্য। ইমমরাল ট্রাফিকিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট (ITPA) যার বেশ কিছু ধারা যৌনকর্মী জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা ওপর আঘাত হানে, সেই ধারাগুলি পাল্টানোর জন্য দুর্বার এখনও নিরন্তর আন্দোলন করে চলেছে।
দুর্বারের কাজকর্মকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে সর্বোপরি যৌনকর্মী বা তাঁদের সন্তানকে সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে ডাঃ জানা তৈরি করেছেন কোমলগান্ধার। অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তান ও যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন দুর্বার স্পোর্টস অ্যাকাডেমি। এছাড়াও দুর্বার এখন ক্ষেতমজুর, জরি শ্রমিক, নির্মাণকর্মী, পরিচারিকা ও অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে কার্যকর অসংখ্য নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত।
২০০৮ সাল থেকে ডাঃ জানা শুরু করেছেন দুর্বার-এর প্রকাশনা বিভাগ। স্যার নিজে অসম্ভব ভালো লিখতেন। আগেই বলেছি, উৎস মানুষ-এ আমি প্রথম ওঁর লেখা পড়ি। তখন থেকেই অনেক পত্রপত্রিকায় ওঁর লেখালেখি, বিশেষ করে যুক্তিবাদী লেখাপত্র প্রকাশিত হয় যা পরে দুর্বার প্রকাশনী থেকে বই আকারে প্রকাশিত হতে থাকে। এছাড়াও ডাঃ জানা আমাদের মুখপত্র ‘দুর্বার ভাবনা’ পত্রিকায় নিয়মিত যে সম্পাদকীয় লিখেছেন, তা যৌনকর্মীসহ অন্যন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের কথা সকলের সামনে তুলে এনেছে, তাঁদের কথা, তাঁদের সমস্যার নানা দিক নিয়ে ভাবতে সাহায্য করেছে।
স্যার কলকাতায় ফেরার থেকে নিয়মিতভাবে দুর্বারের অফিসে ওঁর নিজের চেম্বারে উপস্থিত থেকেছেন। দুর্বার সংগঠনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে প্রায় ৮০টি যৌনকর্মী সংগঠন গড়ে তুলে তাদের প্রত্যেককে একসূত্রে বেঁধেছেন। যৌনকর্মীদের সুবিধার জন্য অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অফ সেক্স ওয়ার্কার্স নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছেন।
যৌনকর্মীর সন্তান ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য স্যার বারুইপুরে তৈরি করেছেন আবাসিক হোম যার নাম দিয়েছেন রাহুল বিদ্যানিকেতন। দুর্বার রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি করে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন সুযোগ পেলে যৌনকর্মী সংগঠনও গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে পারে৷
আমরা অর্থাৎ বাইরে থেকে চাকরি করতে আসা কর্মীরা এমন একজন মানুষকে উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছিলাম বলেই দুর্বারের দিদিদের ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে পেরেছি। তাঁর বহু ডাক্তার বন্ধু থাকা সত্ত্বেও তাঁকে কোভিড আক্রান্ত হয়ে এত কম সময়ে চলে যেতে হল এটা তাঁর পরিবার পরিজন ও দুর্বারের সমস্ত সদস্য ও কর্মীদের কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তাঁর মৃত্যুতে যে শুধু দুর্বার-এর ক্ষতি হল তা নয়, সমাজ আন্দোলনও বিরাট ধাক্কা খেল। পরিবার-পরিজনদের থেকেও আমৃত্যু যেকোনও প্রান্তিক মানুষের সাহায্যের জন্য ডাঃ জানা ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
খুব অবাক লাগে যখন দেখি কত মানুষ অনেক কম সামাজিক কাজ করেও কত ধরনের পুরস্কার পান। কিন্তু ডাঃ জানার মত মানুষ, যাঁর বিপুল লেখালেখি, জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ বা অন্যান্য অনেক অসাধারণ কাজের খবর দেশবিদেশের বহু মানুষ জানতেন, স্যারের বন্ধুমহল তো খুব ভালো করেই জানতেন। কিন্তু এসব জেনেও আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়ে স্যারকে পুরস্কৃত করার মতো কেউ কোনও উদ্যোগ নিয়েছেন বলে শুনিনি।
ওঁকে নিয়ে লিখতে গেলে লেখা শেষ হবে না। স্যারের কাছে শিক্ষা নিয়েছি বলেই আমরা দুর্বারের কর্মীরা যৌনতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে শিখেছি, যৌনকর্মীরা যে আদতে পরিষেবাকর্মী বা বিনোদনকর্মী তা আজ সকলের কাছে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।
ডাঃ জানার বক্তব্য, প্রতিটি লেখা আমাদের সামনের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। ভবিষ্যতে তাঁর প্রেরণাই দুর্বারকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
শুধুমাত্র ছবিতে দেখেই আমি বিশ্বাস করতে পারি যে ডাঃ জানা নেই, কিন্তু তিনি আছেন আমাদের সকলের মাঝে, থাকবেন চিরকাল। তাঁর উপযুক্ত উত্তরসূরি সময়িতা জানা, পুত্র সম্বিত ও আমাদের সকলের প্রিয় মধুলীনাদি যাঁর সাংসারিক ত্যাগের জন্য স্যার এই সংগঠনকে অনেক বেশি সময় দিতে পেরেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, সেই সকল সদস্যের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জানিয়ে ও চরৈবেতির মন্ত্র নিয়ে লেখা শেষ করলাম।