বিষাণ বসু
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, পেশায় চিকিৎসক
কোভিড-সঙ্কট দেশের নড়বড়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আসল চেহারাটা একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে। এতদিন যাঁরা ভাবছিলেন, কু-লোকে নিন্দেমন্দ করলেও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা পরিকাঠামোর হালত আসলে তেমন খারাপ নয়, পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে তাঁরাও রীতিমতো বিচলিত। কোভিডকালে যেমনই হোক, আগামীদিনের স্বার্থে স্বাস্থ্যনীতিতে বদল আনার দাবিও ইতস্তত উঠতে শুরু করেছে। মিলটন ফ্রিডম্যান যেমন বলেছিলেন, সঙ্কট ছাড়া বদল আসে না— সেই পরিবর্তনের বার্তাবাহী সঙ্কটের দিন আগত। কিন্তু তিনি আরও বলেছিলেন, সঙ্কটের দিনে বদল এলেও, বদলটা আসে চালু ভাবনাচিন্তার ধারা অনুসরণ করেই। অতএব, বিকল্প স্বাস্থ্যভাবনা কেমন দাঁড়াতে পারে, বা কেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা হলে ভালো হয়, সেই নিয়ে এই বাজারে কিছু কথা ভাসিয়ে রাখাটা সমীচীন— বলা তো যায় না, কখন কোন শুভ মুহূর্তে কোনও সরকার বাহাদুরের শুভবুদ্ধির উদয় হয়!!!
শিক্ষায় প্রাথমিক শিক্ষার মতোই জনস্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য। যেকোনও দেশের স্বাস্থ্যোন্নতির শিকড়টা প্রাথমিক স্বাস্থ্যের মধ্যে থাকে। উচ্চতর স্বাস্থ্য-পরিষেবার মহীরূহ দুর্বল প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর দাঁড়াতে পারে না। এই লেখায় তাই মূলত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকগুলো নিয়েই কথা বলার চেষ্টা করব।
শুরুতেই স্বীকারোক্তি শুনিয়ে রাখা যাক, আমার জনস্বাস্থ্য বিষয়ে কোনও প্রথাগত ডিগ্রি নেই, জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও নেই, স্বাস্থ্য-প্রশাসনের সঙ্গেও আমি যুক্ত নই— স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে আমার ভাবনা খানিকটা ব্যক্তিগত, কাণ্ডজ্ঞান ও লজিক-নির্ভর। পরপর ধাপে ধাপে কী কী করা যেতে পারে, তেমন করে ভাবার চাইতেও স্বাস্থ্যনীতির চিন্তাভাবনা ঠিক কোন পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে একটা অগোছালো আলোচনা হিসেবেই লেখাটিকে পড়া উচিত হবে— যে আলোচনা থেকে পথের নির্দেশ পাওয়া যেতেও পারে, নাও পারে— তবে আমার আশা, লেখাটিতে সুনির্দিষ্ট একটি পথের কথা জানানো সম্ভব হয়েছে।
পাশাপাশি একথাও জানানো যাক, যে ভাবনাগুলো এখানে লেখা হল, তার কোনওটিই আকাশের চাঁদ পেড়ে দেওয়ার দাবি নয়। অর্থাৎ প্রতিটিই বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব— বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই কার্যকর করা সম্ভব— এবং কোনওটির জন্যই যে নতুন করে প্রচুর অর্থব্যয় জরুরি, এমনও নয়। প্রাথমিক খরচাপাতি কিছু বাড়লেও, সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে, এই মডেলে, শেষমেশ, সরকারি ব্যয় বাড়ার চাইতে কমারই সম্ভাবনা, এবং বরাদ্দ অর্থ যে অনেক বেশি দক্ষ, কুশলী ও কার্যকরী পথে ব্যয় হবে, সেটুকু নিশ্চিত।
আগের অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যানের অর্থ এই নয় যে, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এমনিতেই যথেষ্ট এবং ঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে সেই অর্থেই কার্যকরী স্বাস্থ্যব্যবস্থার নির্মাণ সম্ভব। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, তা নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। একইসঙ্গে জরুরি বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু সেসব যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ এই প্রস্তাবের কথাগুলো মুলতুবি রাখতে হবে, এমন মানে নেই। বরাদ্দ বাড়লে, মডেলটা আরও ভালোভাবে প্রযুক্ত হতে পারবে, বরাদ্দ না বাড়লেও প্রস্তাবগুলো খানিকটা কাজে আসতে পারে। বরাদ্দ যা-ই হোক, বর্তমানে তার সিংহভাগ খেয়ে নেয় টার্শিয়ারি হাইটেক কেয়ার। চালু ব্যবস্থা বা চিন্তাপদ্ধতি জারি থাকলে, বরাদ্দ চতুর্গুণ হলেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চুঁইয়ে আসা ছিঁটেফোঁটার বেশি জুটবে না। কাজেই, বরাদ্দ-নিরপেক্ষভাবেই এই প্রস্তাবগুলোর কথা ভাবা যেতে পারে।
এধরনের যেকোনও লেখার ক্ষেত্রে কিছু পূর্বস্বীকৃতি থাকে, অর্থাৎ কিছু কথা ধরে নিয়েই আলোচনা শুরু করা হয়। এই লেখাতেও তা রয়েছে। যেমন, আমি ধরে নিয়েছি, স্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আপনি (অর্থাৎ পাঠক ও নাগরিক) এবং সরকার উভয়েই বিশ্বাস করেন (যদিও স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার হিসেবে আপনি বা সরকার কেউই মানেন কিনা, জানি না)। এ লেখার আগে এও মেনে নিয়েছি, অর্থনীতিতে সাধ এবং সাধ্যের ফারাক অবশ্যম্ভাবী। আমরা চাইলেও, এমনকি সরকার সর্বান্তঃকরণে চাইলেও প্রতি পাড়ায় সর্বোচ্চ মানের হাইটেক স্বাস্থ্যপরিষেবা পৌঁছানো যাবে না (তেমনটির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা, সে অবশ্যই ভিন্ন তর্ক)। আমরা যত গর্বই করি না কেন, আমরা তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা— দেশের অর্ধেক লোকের পেটে দুবেলা ভরপেট খাবার নেই, শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে, শিক্ষারও সুবন্দোবস্ত নেই। এমতাবস্থায় আচমকা প্রথম বিশ্বের দেশের মতো স্বাস্থ্যব্যবস্থা এদেশে বানিয়ে ফেলা যাবে, এমন আশা অবান্তর। প্রথম বিশ্বেও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে অনেক অপ্রাপ্তি অভাব-অভিযোগ রয়েছে, আমাদের এখানে তো অবশ্যম্ভাবী। কাজেই, সীমাবদ্ধতার মধ্যেই কী কী করা সম্ভব– অর্থসংস্থান যেটুকু বাড়ানো সম্ভব, তা দিয়ে সর্বোচ্চ কী উন্নতি সম্ভব— অর্থাৎ অপটিমাইজেশন— আলোচনা করতে চাইছি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সামগ্রিক রদবদল এই প্রস্তাবের পূর্বশর্ত নয়। প্রস্তাবগুলো বর্তমান শ্রেণিকাঠামোর মধ্যেই কল্যাণকামী ও দায়বদ্ধ রাষ্ট্রের কাছে দাবি হিসেবে তোলা সম্ভব বলে বিশ্বাস করি।
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অর্থসঙ্কট অতি বাস্তব সমস্যা। কাজ চালানোর মতো একটা স্বাস্থ্যপরিকাঠামো গড়তে প্রয়োজন জিডিপির অন্তত পাঁচ শতাংশ— আমাদের লক্ষ্য তার অর্ধেক— বাস্তবে পাই তারও অর্ধেক, অর্থাৎ মেরেকেটে সওয়া এক শতাংশ। এ দিয়ে খুব বেশি এগোনো সম্ভব নয়। অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি অবশ্যই। কিন্তু স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার ভাবার অভ্যেস না হলে বরাদ্দ বাড়বে না। আর আগেই বললাম, বর্তমান চিন্তাক্রম অনুসারে চললে, বরাদ্দ বাড়লেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি হতে পারবে না। সেন্ট্রাল ভিস্টার টাকা স্বাস্থ্যে ঢাললেই যে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ফেরানো যায় না, সে-কথা মানি— কিন্তু, সরকারের অগ্রাধিকার বিষয়ে একটা সদর্থক বার্তা অবশ্যই মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। ঠিক যেমন, সরকারি প্রচারকার্যে সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল বা স্টেম সেল সংক্রান্ত গবেষণা কিংবা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতির বাইরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা উঠে এলে কিছুটা ভরসা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যেক মানুষ দুনিয়াটা দেখেন নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে। তথাকথিত বড় ডাক্তার যাঁরা, তাঁরা অনিবার্যভাবেই কোনও না কোনও বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, কেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা হলে ভালো হয়, সে বিষয়ে মতামত দেওয়ার মুহূর্তে তাঁরা বিশেষজ্ঞের চশমাটা খুলে রাখতে পারেন না। অর্থাৎ, যিনি হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ, তাঁর কথায় রাজ্যের প্রতি ব্লকে চটজলদি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টির ব্যবস্থা করা গেলে কতজন মানুষের প্রাণ বাঁচতে পারে, সে কথাই প্রাধান্য পাবে। তাঁর কথাগুলো একেবারেই মিথ্যে নয়— তাতে অনেক প্রাণ বাঁচবে অবশ্যই, কিন্তু, পরিশুদ্ধ পানীয় জল ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা গেলে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচে। আগেই বলেছি, আমাদের অর্থব্যয়ের ক্ষমতা সীমিত— স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের সামর্থ্য আরও সীমিত— টাকাটুকু কোন পথে খরচা হলে সবচেয়ে বেশি মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার হবে, প্রাথমিক গুরুত্ব কোন কোন জায়গায় দিতে হবে– তা নিয়ে একটু না-ভাবলেই নয়।
কদিন আগেই বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলছিলেন, হার্ট অ্যাটাকের অত্যাধুনিক ইমার্জেন্সি চিকিৎসা, তাঁর মতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কারগুলির অন্যতম। কেননা, তা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাঁর কথার প্রথমাংশের সঙ্গে সহমত হলেও দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে নই। কেননা, হামের টিকা বা ডায়েরিয়ায় ওআরএস কিম্বা ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় আর্টেমিসিনিন পুনরাবিষ্কার অনেক অনেক বেশি প্রাণ বাঁচিয়েছে। সেই চিকিৎসক খুব সৎভাবেই সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য কিংবা স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার, এমন দাবিতে সোচ্চার। কিন্তু তাঁর চোখে স্বাস্থ্যের অধিকার, সম্ভবত, প্রত্যন্ত প্রান্তে হাইটেক চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার— যে কাজটা দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয় দুরূহ, স্বাস্থ্যবাজেট দশগুণ বাড়ালেও প্রায় একইরকম দুরূহ রয়ে যাবে। অতএব, উচ্চতম হাসপাতালের সুদক্ষ ও শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারী জনস্বাস্থ্য-পরিকল্পনা বা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যনীতি গড়ে তোলা হলেও তা সবসময় যথোপযুক্ত হবেই, তেমন দাবি করা চলে না। খ্যাতনামা ও দক্ষ কার্ডিয়াক সার্জেন সফল উদ্যোগপতি হয়ে উঠতে পারেন— পেরেছেনও— কিন্তু চিকিৎসাশিক্ষার পাঠ্যক্রম কিম্বা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোন পথ ধরে চলবে, সে ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ সর্বদা শিরোধার্য না-ও হতে পারে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা শুরু করার মুহূর্তেই এই কথাগুলো মাথায় রাখলে ভালো হয়।
সরকারের হাতে সবার সব প্রয়োজন বা সাধ-আহ্লাদ মেটানোর মতো অর্থ থাকলে অর্থনীতি বিষয়টাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। যেকোনও খাতে অর্থবরাদ্দের অর্থই হল অন্য খাতে বাজেট-বরাদ্দের কমবেশি কাটছাঁট। একইভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রকৃত স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পে কিছু মানুষের সুরাহা হয় অবশ্যই, কিন্তু সে সুরাহা এককালীন, দীর্ঘমেয়াদে যার অভিঘাত নগণ্য। স্বাস্থ্যবরাদ্দের বড় অংশ এককালীন স্বস্তি দিতে ব্যয় হলে দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর উন্নতি ব্যাহত হয়, হতে বাধ্য, কেননা আগেই বললাম, টাকা তো অঢেল নেই। কাজেই আমাদের দেখতে হবে, সবচেয়ে কম অর্থে সবচেয়ে বেশি মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কীসে। সবার সব চাহিদা মেটানো সামর্থ্যের বাইরে, একথা মেনে নিয়েই স্বাস্থ্য-অর্থনীতির আলোচনা— অতএব ভাবতে হয় অগ্রাধিকারের কথা। এই লেখা সেই আর্থিক সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিয়েই। হ্যাঁ, সেই সীমাবদ্ধতা স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বর্তমানের চতুর্গুণ হলেও থাকবে, আমাদের তখনও অগ্রাধিকার নির্দিষ্ট করেই এগোতে হবে। এই লেখা প্রাথমিক স্বাস্থ্যে সেই অগ্রাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে, এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নকে প্রাথমিক গুরুত্বদানের ভাবনা থেকে লিখিত।
স্বাস্থ্য বিষয়ে নীতিপ্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা স্বল্পমেয়াদে ভাবনার অভ্যেস। কিন্তু একটু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া মৌলিক পরিবর্তন আসা মুশকিল। অন্তত তেমন পরিবর্তন, যা কিনা স্বাস্থ্যসূচকে প্রতিফলিত হতে পারে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বা একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্বাস্থ্যোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপের সুফল টের পেতে কমপক্ষে আট-দশ বছর সময় লাগে— সে সময়টুকু ধৈর্য ধরতেই হয়। তবু যাঁদের এই সময়কালের মধ্যে গোটাতিনেক বড় নির্বাচনের হিসেব কষতে হয়, তাঁদের বাধ্যবাধকতার কথা মাথায় রেখেই আশ্বস্ত করা যাক— বর্তমান প্রস্তাবগুলো প্রয়োগ করা গেলে মাঝের এই আট-দশ বছরে স্বাস্থ্যসূচকে কিছু লক্ষ্যণীয় উন্নতি দেখা না গেলেও, যাঁদের জন্য এই পদক্ষেপগুলো গৃহীত হচ্ছে, সুফলগুলো তাঁরা ঠিকই অনুভব করবেন। অতএব ভোট হারানোর ভয় নেই।
আবার স্বাস্থ্যনীতিকে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হল, আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় উপর থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত নিচুতলায় কার্যকর করার চিন্তাপদ্ধতি। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রাজনৈতিক দলগুলোর নিচুতলার মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ থাকে। এতদসত্ত্বেও কার্যকালে সরকারবাহাদুর এবং আমলাতন্ত্র জনগণের চাহিদা অনুসারে জামা বানানোর চাইতে একটি সাইজের জামা বানিয়ে সর্বত্র সরবরাহ করতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। আশা করেন, সকলেই সেই জামাটিতে সাধ্যমতো নিজেদের আঁটিয়ে নেবেন।
আমার মনে হয়, এই দুই মূলগত ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে না-পারলে কাজের কাজ কিছু হবে না। যেহেতু এই লেখা বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য কিছু আশু পদক্ষেপের প্রস্তাব হিসেবে, বর্তমান স্বাস্থ্যদর্শনের মূল সমস্যাগুলোর কথা এখানে তুলছি না। সেসব নিয়ে আগে অনেকবারই লিখেছি, পুনরাবৃত্তি করতে চাইছি না। ধীরে ধীরে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবসার অধস্তনে পরিণত করা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা কোন পথে এগোবে সে নিয়ে কর্পোরেট হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের মতামত শিরোধার্য করা, সরকারি বিমার মাধ্যমে সরকারি অর্থ বেসরকারি তহবিলে জমা করা, পিপিপি মডেলের মাধ্যমে সরকারি স্বাস্থ্যমডেলের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বেসরকারি অনুপ্রবেশ ক্রমশ মেনে নেওয়া— এই সবকিছুরই মূলে রয়েছে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার উত্তরোত্তর হীনম্মন্যতাবোধ— যে হীনম্মন্যতার মূলে স্বাস্থ্যকে ক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে ভাবার দর্শন, যে দর্শন অনুসারে উন্নততর চিকিৎসা হয় একমাত্র পাঁচতারা হাসপাতালে। মুনাফাভিত্তিক চিকিৎসাদর্শন বা স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ক্রয়বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী, এই ধারণায় বদল না-আনলে জনমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা ভেবে ওঠা মুশকিল। তবু সে আলোচনায় এখন আর যাচ্ছি না। ধরেই নিচ্ছি, সরকার জনকল্যাণমূলক কিছু পদক্ষেপ নিতে চান, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিকল্পে কিছু সদর্থক ভাবনার কথা শুনতে চান। কাজেই, আবারও বলি, আজ শুধু তেমন কথাই বলব যেগুলো সমাজব্যবস্থার খোলনলচে না বদলে বর্তমান ব্যবস্থার মধ্যেই কার্যকর করা সম্ভব।
যে কথা দিয়ে শুরু করলাম, সঠিক স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের জন্য জরুরি হল— দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। কিন্তু তেমন পরিকল্পনার জন্যে জরুরি— তথ্য। জনস্বাস্থ্য পরিসংখ্যান। ঠিক কেমন তথ্য? রাজ্যের মানুষ ঠিক কেমন অসুখে ভুগছেন, তার ব্লকওয়াড়ি তথ্য, ব্লকওয়াড়ি যদি নাও হয়, নিদেনপক্ষে মহকুমা-ওয়াড়ি তথ্য। যে তথ্য না-হলে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার জামাটি কখনওই জনগণের চাহিদার মাপ অনুসারে বানানো সম্ভব নয়, কেননা পুরুলিয়া-জলপাইগুড়ি-সুন্দরবন-মুর্শিদাবাদের মানুষের স্বাস্থ্যচাহিদা ভিন্ন। সবার জন্য ঠিক একইরকম প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কুশলী ও কার্যকরী হতে পারে না। একমাত্র যথেষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে তবেই উপযুক্ত জেলাভিত্তিক বা অঞ্চলভিত্তিক স্বাস্থ্যপরিকল্পনা সাজানো যেতে পারে।
তথ্য বলতে ঠিক কেমন তথ্য? স্বাস্থ্যের সবচেয়ে গোদা সূচক, গড় আয়ু এবং মৃত্যুহার। ব্লকভিত্তিক মৃত্যুর কারণ এবং ঠিক কোন-কোন অসুখে মানুষ হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছেন, সে থেকে তাঁদের অসুস্থতার কারণের একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটাই চূড়ান্ত হিসেব নয়। বিশেষত স্বাস্থ্যের হিসেব এভাবে কষতে গেলে মুশকিল। স্বাস্থ্যের প্রথাগত সংজ্ঞার দিকে যাচ্ছি না। লক্ষ করবেন, সাধারণত মানুষ স্বাস্থ্যকে কর্মক্ষমতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন। অর্থাৎ, যখন তিনি কাজকর্ম করতে পারছেন তেমন সমস্যা ছাড়াই, ততদিন মানুষ নিজেকে সুস্থ ভাবেন। যিনি নিয়মিত জ্বর-সর্দি-কাশি-পেটের অসুখে ভোগেন এবং প্রায়শই কাজে যেতে পারেন না, তিনি অবশ্যই অসুস্থ— কিন্তু তিনি যেহেতু হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না, হিসেবের বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও বেশি। মহিলাদের গড় আয়ু পুরুষদের চেয়ে বেশি হলেও স্বাস্থ্যসূচকে তাঁদের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা কম, অপুষ্টি বা রক্তাল্পতায় পুরুষদের তুলনায় তাঁরাই বেশি ভোগেন, অথচ গুরুতর অসুস্থতা ছাড়া তাঁরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৌড়ান না। কাজেই, খুচরো বা প্রচলিত বয়ানে ছোটখাটো অসুস্থতা, বিশেষত তেমন অসুস্থতা যেগুলো ভোগাতে থাকে, কিন্তু গুরুতর অসুস্থ করে ফেলে না বা মৃত্যু ঘটায় না, সেগুলোর হিসেব না-পাওয়া অব্দি সার্বিক স্বাস্থ্যের উন্নতির উপযুক্ত স্বাস্থ্য-পরিকল্পনা সম্ভব নয়।
অসুস্থতার কারণও তো এক জেলার তুলনায় আরেক জেলায় ভিন্ন হতে পারে। খুবই সাধারণ একটি সমস্যা, যেমন রক্তাল্পতার কথাই ধরুন। তার তো অনেক কারণ থাকতে পারে। কোথাও হয়ত কারণটা অপুষ্টি, কোথাও বা কৃমি, কোথাও খাদ্যে লৌহ-জাতীয় উপাদানের অভাব, কোথাও বা বিভিন্ন ভিটামিনের অভাব। কোনও জায়গায় হয়ত আয়রন ট্যাবলেট বিলি করলেই কাজ হবে, কোথাও কৃমির ওষুধ জরুরি, কোনও ব্লকে হয়ত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন দিয়েই পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব— আবার কোথাও হয়ত সার্বিক পুষ্টির বন্দোবস্ত করা না-গেলে কাজের কাজ হবে না। অর্থাৎ সব জায়গায় আয়রন ট্যাবলেট বা কৃমির বড়ি বিলি করলে সমাধান হবে না। কোনও জায়গায় সেটা কার্যকরী, আবার কোথাও বা অপচয়। আবার রক্তাল্পতা মাত্রেরই সরল সমাধান নাও মিলতে পারে। সরল সমাধান পদ্ধতিতে কাজ না-হলে চটজলদি উচ্চতর পরিকাঠামোয় রেফার করতে পারাও জরুরি— সেখানে যেন চিকিৎসায় খুব দেরি না-হয়, সেটুকু নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। কার্যকরী রেফারেল সিস্টেম ও সেকেন্ডারি/টার্শিয়ারি কেয়ার সিস্টেম ছাড়া প্রাইমারি হেলথকেয়ারের পক্ষে সফল হওয়া মুশকিল। কিন্তু শুরুতেই বলেছি, এই আলোচনায় শুধু প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ থাকছি, সেকেন্ডারি বা টার্শিয়ারি কেয়ারের মডেল প্রসঙ্গে আজ ঢুকছি না।
যে কথা বলছিলাম, প্রাথমিকভাবে তথ্যসংগ্রহ ছাড়া কোনওদিক থেকেই কার্যকরী কিছু করে ওঠা মুশকিল। বিভিন্ন প্রান্তের ডিজিজ বার্ডেন এবং হেলথ নিড না জেনেই একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করে সবজায়গায় তা কার্যকর করে ফেললে, এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপযুক্ত পরিকাঠামোর দিকেও নজর না-দিলে স্বাস্থ্য-অর্থনীতির দুটি মূল বিবেচ্য বিষয়— এফিশিয়েন্সি এবং ইক্যুইটি— ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এফিশিয়েন্সি, অর্থাৎ কম খরচে সবচেয়ে বেশি মানুষের স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করা; আর ইক্যুইটি, অর্থাৎ যাঁদের বেশি প্রয়োজন, তাঁদের জন্য ব্যয় বেশি করা, যাতে তাঁরা বাকিদের সঙ্গে সমমানের স্বাস্থ্যে পৌঁছাতে পারেন। ব্লকওয়াড়ি অসুস্থতার তথ্য যতক্ষণ না-মিলছে, ততক্ষণ এফিশিয়েন্সি বা ইক্যুইটি, দুইয়ের কোনওটিতেই পৌঁছনো মুশকিল।
তথ্য সংগ্রহ হবে কীভাবে? প্রাথমিকভাবে স্যাম্পলিং পদ্ধতিতে, যেমন জনসংখ্যাকে বিভিন্ন ক্লাস্টারে ভাগ করে সেখান থেকে নমুনার ভিত্তিতে তথ্য জোগাড় করা যায়। সেনসাস জাতীয় বিস্তারিত তথ্য অবশ্যই বেশি ভালো, কিন্তু ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। তথ্যসংগ্রহ হবে কোত্থেকে? প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো যতদিন নড়বড়ে রয়েছে, ততদিন কাজটা দুরূহ। কেননা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আগত রোগীর হিসেবই বলুন বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্যসংগ্রহ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নজরদারি ছাড়া ব্যাপারটা সামলানো মুশকিল। অতএব, প্রথমেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাল ফেরানো জরুরি। কিন্তু যে চিকিৎসক একার হাতে রোজ তিন-চারশো রোগী সামলান, তাঁর পক্ষে তথ্য জোগাড় করে সেই তথ্যের ট্যাবুলেশন অসম্ভব। অতএব, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োগ বাড়াতে হবে। চিকিৎসক তো বটেই, বাকি সমস্ত শ্রেণির কর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তথ্যসংগ্রহই বলুন বা সাধারণ অসুখের চিকিৎসা কিংবা জটিল অসুখের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগনির্ণয়, সেগুলো প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হতে পারা জরুরি। যেহেতু তথ্যসংগ্রহ পপুলেশন-ভিত্তিক, শুধুই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বসে কাজটা হবে না। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নোডাল সেন্টার হলেও একজায়গায় বসে তথ্যসংগ্রহ হবে না। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী সবাইকে মিলিয়েই তথ্যসংগ্রহের কাজ করতে হবে। এবং প্রাথমিক শিক্ষকরা এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেন। বাচ্চারা কেন স্কুলে আসছে না, বাড়ির বাকিদের শরীর খারাপ কিনা, শরীর খারাপ হলে ঠিক কী সমস্যা হচ্ছে— এই তথ্যগুলো তাঁদের পক্ষে গল্পের ছলেই জোগাড় করা সম্ভব।
এর পাশাপাশি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের প্রত্যাশার কথাগুলোও জানতে চাওয়া হোক। ওই একই তথ্যসংগ্রহের সময়েই এই তথ্যও সংগ্রহ করে ফেলা যায়। মানে, স্বাস্থ্যপরিষেবা নিতে গিয়ে তাঁরা ঠিক কী-কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, বা রোগের প্রাথমিক অবস্থায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না-গিয়ে কেন তাঁরা দেরি করে অসুখ বাড়িয়ে ফেলছেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না-গিয়ে কেন তাঁরা জেলা হাসপাতালে দৌড়চ্ছেন কিংবা কেন নার্সিংহোমে যাচ্ছেন, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিষয়ে তাঁদের প্রাথমিক অভিজ্ঞতা বা ধারণা কী— কথাগুলো তাঁদের মুখ থেকেই জানা জরুরি। কথাগুলো তাঁদের মুখ থেকে না-জানলে, এবং সেই তথ্য সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নথিবদ্ধ ও ট্যাবুলেটেড না-হলে সিদ্ধান্ত নেব কীসের ভিত্তিতে? সেই তথ্যের অনুসরণে স্বাস্থ্য-সিদ্ধান্ত গৃহীত না-হলে বা পরিকল্পনা সেই তথ্যের মাপমতো সাজানো না-গেলে আমাদের যাবতীয় স্বাস্থ্যভাবনা বটম আপ না হয়ে টপ ডাউনই রয়ে যাবে।
একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্য-প্রশাসনের ক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্য-আমলারা শোনেন কম, বলেন বেশি। ঠিক উল্টোটা হওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষের কথা শুনুন। তাঁদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বা সমস্যার কথাগুলো শুনুন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকদের মুখ থেকে ফিডব্যাক নেওয়াটা প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া জরুরি। মোদ্দা কথা হল, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমজনতার অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও কাজের কাজ হয় না— স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তো একেবারেই হয় না। স্বাস্থ্যবিষয়ে মানুষের প্রত্যাশার কথাটুকু জানতে চাওয়া এবং মানুষের অসুস্থতার মূল কারণগুলো বুঝতে চাওয়া— কমিউনিটি পার্টিসিপেশনের একেবারে প্রাথমিক ধাপ হিসেবেই এগুলো ভাবা যেতে পারে। এবং এই অংশগ্রহণ খুবই কার্যকরী হয়ে উঠবে যখন স্বাস্থ্যবিধান ও স্বাস্থ্যসচেতনতার বার্তা সমাজের প্রতি স্তরে ছড়াতে চাইব। কেননা, স্থানীয় মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া, কোনও স্বাস্থ্যকর্মীর পক্ষেই স্থানীয় সমাজের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য ভাষায় স্বাস্থ্যের বার্তা শোনানো সম্ভব নয়।
রাজ্যে ‘দুয়ারে সরকার’ ভাবা হয়, কিন্তু ‘দুয়ারে স্বাস্থ্য’-এর কথা ভাবা হয় না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডাক্তারি করার কথা বলছি না, কিন্তু প্রতি গ্রামে হাঁটাপথের দূরত্বে প্রাথমিক চিকিৎসা মেলা জরুরি। প্রশ্নটা অবশ্যম্ভাবী, ডাক্তার পাওয়া যাবে কোত্থেকে? আগেই বললাম, চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি, সব শ্রেণির স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাই বাড়ানো জরুরি। সরকারি চাকরিতে আয়ুশ চিকিৎসকরা নিযুক্ত হচ্ছেনই, তাঁদের আরও দক্ষভাবে কাজে লাগানো যায়। আরেকদিকে হাতুড়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ চালানোর কথা ভাবা হচ্ছে, অথচ নার্সদের কথা এক্ষেত্রে ভাবা হচ্ছে না। হাতুড়েদের ক্ষেত্রে যুক্তি— তাঁরা এমনিতেই চিকিৎসা করে থাকেন, শিখিয়েপড়িয়ে নিলে ভালো কাজ চালাতে পারবেন। একটু ভেবে দেখুন, সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও, নার্সিং পাঠক্রমে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রায় পুরোটাই পড়ানো হয়। অর্থাৎ তাঁদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞানটুকু আছে— হাতেকলমে শিখিয়ে নিলে তাঁরাও চিকিৎসার অনেকটাই করতে পারেন। হাতুড়েদের হাতেকলমে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞান নেই। বিশেষত, চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে ন্যূনতম ধারণা নেই। কাকে শেখানো সহজ? বা কাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে চিকিৎসা করানো নিরাপদ? যিনি বিষয়টা জানেন, কিন্তু হাতেকলমে কাজের ট্রেনিং নেই, তাঁকে? নাকি যিনি অসীম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের ধারণা অনুসারে চিকিৎসা করে থাকেন, কিন্তু তার ভালোমন্দ নিয়ে সম্যক ওয়াকিবহাল নন, তাঁকে?
তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে প্রাথমিক শিক্ষকদের গুরুত্বের কথা আগেই বললাম। কাজেই এটুকুও জুড়ে দেওয়া যাক, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য কিন্তু ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ সর্বজনীন শিক্ষা ছাড়া সর্বজনীন স্বাস্থ্য আসা মুশকিল। এবং এ-ক্ষেত্রে নারীশিক্ষার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টিকে শিরোধার্য করেই সাক্ষরতা আন্দোলনের একটি স্লোগান ছিল, সাক্ষর মায়ের সন্তান কখনও নিরক্ষর হয় না। ঠিক তেমনই যে বাড়ির মা স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে অবহিত, সে পরিবারের বাকিদের মধ্যেও সেই ধারণাগুলো সঞ্চারিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বাড়ির মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে সচেতনতা ছড়ানো জরুরি। এই কাজটি পঞ্চায়েত এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের দিয়ে হওয়া সম্ভব, আশাকর্মীরা তো আছেনই। বিদ্যালয়শিক্ষার মধ্যেও একেবারে পাঠ্য বিষয় হিসেবেই স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন— যেখানে স্বাস্থ্যবিধি এবং পুষ্টির প্রাথমিক ধারণাগুলো পড়ানো হবে, রীতিমতো পাঠ্য বিষয় হিসেবেই। পাঠ্য বিষয় কথাটির উপর বারবার জোর দিচ্ছি, কেননা অভিজ্ঞতা বলে, বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে না এলে পড়ার ও পড়ানোর আগ্রহ কমে যায়। স্কুল হেলথ প্রোগ্রামে ইশকুলের ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদের স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে অবহিত করার কাজটাও শুরু করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষকরা ধারণাগুলো ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়াতে পারেন। পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা, সুপেয় জলের বন্দোবস্ত, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচালয়— এগুলো তো স্বাস্থ্যের প্রাথমিক ভিত্তি। চিকিৎসক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এসবেরও আগে দরকার পুষ্টি, পরিশুদ্ধ পানীয় জল, শৌচব্যবস্থা ইত্যাদি। পাবলিক হেলথ তো শুধু ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ নয়। দক্ষ পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কথাটা এতই স্বতঃসিদ্ধ, যে, সেসব নিয়ে আর আলাদা করে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করছি না।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মূল স্বাস্থ্যসমস্যাগুলোর চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকুক। প্রতি ব্লকে সুপার-স্পেশালিটি চিকিৎসার বন্দোবস্ত থাকাটা তেমন জরুরি নয়, যদি প্রতি গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেখানকার স্থানীয় অসুখ-বিসুখের উপযুক্ত চিকিৎসা মেলে। চিকিৎসাব্যবস্থা একটি পিরামিড৷ অধিকাংশ মানুষের অধিকাংশ অসুখেরই প্রতিরোধ সম্ভব — জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধান দিয়েই সে কাজ করা যায়। বাকি যে অসুখ, তাদেরও অনেকগুলোকেই সামলে নেওয়া যায় অসুখ বাড়তে না-দিলে বা প্রাথমিক অবস্থায় ধরে ফেলে চিকিৎসা শুরু করা গেলে। এই কাজও সহজ হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মজবুত করা গেলে — এবং জটিল অসুখ যখন প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তার চিকিৎসা মহকুমা বা জেলা হাসপাতালেই হওয়া সম্ভব। এগুলো ঠিকঠাক পরিকল্পনা মেনে করা গেলে তারপর শতাংশের হিসেবে সামান্য কিছু অসুখ-বিসুখই পড়ে থাক, যার চিকিৎসা জটিল এবং উন্নত পরিকাঠামো-নির্ভর — তার জন্য মেডিকেল কলেজ জাতীয় হাসপাতালগুলো তো রইলই। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল সমস্যা হল, পিরামিডের পরিবর্তে একখানা সরু লম্বা সিলিন্ডার জাতীয় স্বাস্থ্যমডেল খাড়া করার প্রয়াস। আর এটুকু তো অনুমান করা কঠিন নয়, একই আয়তনের দুটি ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক বস্তুর মধ্যে, সরু সিলিন্ডারের চাইতে পিরামিড অনেক বেশি স্থিতিশীল।
এই পরিকল্পনাহীনতার জন্যে অনেকাংশেই দায়ী তথ্যের অভাব। কী অসুখে বেশিরভাগ মানুষ ভোগেন, তার কারণ কী, অঞ্চলবিশেষে তার প্রকারভেদ— এ বিষয়ে সম্যক তথ্যের অভাব। একটু মোটা দাগের উদাহরণ দিই। কুড়িজন লোক দাদ চুলকাতে চুলকাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লেও আমাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু একজন লোকের পা-ভাঙাটা আমাদের চট করে নজরে পড়ে। সব দৌড়ঝাঁপ হইচই শুধু তাঁকে নিয়েই। এবং আমাদের প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়ায়, বাড়ির পাশেই তাঁর জটিলভাবে ভেঙে যাওয়া পায়ের হাইটেক অপারেশনটা হোক — ইদানীং সরকারের যাঁরা পরামর্শদাতা, তাঁরাও ওই পা-ভাঙার হাইফাই চিকিৎসা করেই অভ্যস্ত, বাকি বাস্তবতা তাঁদের জানা থাকে না, জানার চেষ্টাও থাকে না। জনগণের দিকভ্রান্ত চাহিদা এবং উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ — অতএব সরকারি প্রতিশ্রুতি আসে হাতের নাগালে হাইটেক চিকিৎসার বন্দোবস্তের। কিন্তু প্রথম বিশ্বেই তেমনটির আয়োজন সর্বত্র করা যায়নি, তৃতীয় বিশ্বে তো দূর। অতএব, কার্যক্ষেত্রে সে তো হয়ই না, এদিকে টার্শিয়ারি কেয়ার হাসপাতালে দাদে ভোগা মানুষজনের ভিড়ের চোটে পা-ভাঙা মানুষটিরও চিকিৎসার দেরি হয়ে যায়। আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত, ওই দাদের সমস্যায় ভোগা মানুষগুলোর খেয়াল রাখা, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা, দাদ কীভাবে ঠেকানো যায় তার খেয়াল রাখা। একমাত্র তাহলেই পা-ভাঙা মানুষটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নতমানের চিকিৎসা যথাসময়ে পাবেন। তার জন্যে বাড়ির পাশে সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল না-বানালেও চলবে।
আপনি চাইলে সরকারি সদিচ্ছার ওপরে ভরসা রাখতেই পারেন, সে আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, অনেক সন্তানের মধ্যে যে বাচ্চা কাঁদে না, তার বরাতে মাতৃদুগ্ধ জোটে না। কাজেই, ভরসা রাখুন বা না-রাখুন, সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্যের দাবি, মজবুত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার দাবিটুকু তুলুন, তুলতে থাকুন। আজকাল অবশ্য সকলে দাবিদাওয়াগুলোকে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে রাজনীতি-বিমুক্ত করতে চাইছেন। সে বেশ কথা। শুধু মনে করিয়ে দিই, স্বাস্থ্যের দাবিটা কিন্তু রাজনৈতিক। ডোনাল্ড লাইটের কথাগুলো মনে রাখুন—
Medical care and health services are acts of political philosophy.