Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লিলিৎ

লিলিৎ -- অভি বিশ্বাস

অভি বিশ্বাস

 

প্রথমবার যখন তাকে দেখি, একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল, স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল। বড় গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখায় আমি মগ্ন, হঠাৎ কী জানি কেন ওইদিকে আমার দৃষ্টি চলে যায়।

সেটা সেপ্টেম্বর মাস। ২০০১ সাল। আমার বয়স তখন চব্বিশ।

কলকাতা শহরে এসেছি বছর দেড়েক হয়েছে। আলিপুর জাজেস কোর্টের উল্টোদিকে একটা ছোট ম্যারেজ হলে ম্যানেজারের কাজ করি। আমার স্টাফ খুবই দক্ষ আর করিৎকর্মা। মালিক মাড়ওয়ারি হলেও মাইনে বা টাকাপয়সা নিয়ে কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। মাইনে সামান্যই, তবে একলা মানুষের দিব্যি চলে যায়। আমার বিশেষ কোনও শখ-আহ্লাদ বা নেশা-টেশা নেই। থাকার মধ্যে যেটা, সেটা হল ফুটবল খেলার প্রতি একটা ঝোঁক। খানিকটা সেই জন্যেই মাইনে কম জেনেও কলকাতায় এই চাকরিটা নিয়েছিলাম। কলেজে রাইট ব্যাক খেলতাম, আর কলকাতা মানেই যে ফুটবলের শহর এ কথা আর কে না জানে। সল্টলেকে, ময়দানে প্রায়ই খেলা দেখতে যাই।

থাকার জায়গা পেতে অসুবিধে হয়নি, বাবার পুরনো অফিসের সহকর্মী সুবিমল আঙ্কেল ঠিক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওখান থেকে কালীঘাটের গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ খুব একটা দূর হবে না। রবিবার করে আমার চার্চে যাওয়ার অভ্যাস আছে, উনি জানতেন।

আমার কাজের জায়গা আর থাকার জায়গা দুটো খুবই কাছাকাছি, যাকে বলে পাথরছোঁড়া দূরত্ব। মঙ্গলম ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে জাজেস কোর্ট রোড ধরে বাঁদিকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই ডান হাতে আলিপুর গার্লস স্কুলে যাওয়ার যে রাস্তাটা ঢুকে যায়, সেটা ধরে একটু এগোলেই হেস্টিংস হাউসের পেছন দিকে একটা ছোট, দোতলা বাড়ি। বাড়ির মালিক বয়স্ক ক্রিশ্চান দম্পতি এক তলায় থাকেন, আর দোতলায় একটা ঘর আর বাথরুম নিয়ে আমি।

অমায়িক দুটি মানুষ, কতদিন দেরি করে বাড়ি ফেরায় ওনাদের সঙ্গে ডিনার করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমাকে ওঁরা নিজের ছেলের মতই দেখতেন। আমার বাবা নেই শুনে যেন আরও বেশি করে।

আমি আসার বছর খানেক পর, কি আরেকটু বেশি হবে, ওনাদের মেয়ে জানায় যে সে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে ওখানকার এক বাসিন্দাকে বিয়ে করেছে। মা-বাবাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে চায়। মাস ছয়েকের মধ্যে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি আর বাড়ির ভার আমাকে দিয়ে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস প্যাট্রিক ঘোষ লন্ডন পাড়ি দেন। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাদ দিয়ে মাসে মাসে ভাড়ার টাকাটা আমি ওনাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে পাশের সাইবার কাফে থেকে একটা ই-মেল করে দিই।

অফিস থেকে বেরিয়ে রোজ এক রাস্তায় বাড়ি যেতে ভালো লাগত না। কখনও কখনও, যেদিন কোনও বুকিং থাকত না, একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আলিপুর বার অ্যাসোসিয়েশানের পাশ দিয়ে গিয়ে সন্তোষের দোকানে বসতাম। এলাকার শ্রেষ্ঠ চা কার হাতের, সেটা প্রতিটা কালো কোট পরা লোক থেকে সাধারণ আদমি সবাই জানত। চা আর ডিমের অমলেট খেয়ে খেলার মাঠ ঘুরে বাড়ি ফিরতাম।

সেই সেপ্টেম্বরে, দিন দুয়েক পরে, একদিন সন্তোষের দোকান ঘুরে সন্ধে নাগাদ মাঠের পাশ দিয়ে আসছি, দেখি গাছটা থেকে একটু দূরে একটা বেঞ্চের ওপর সে বসে আছে। সামনের দিকে তাকিয়ে।

মাঠে তখন খেলা ভেঙে গেছে, দু-চারজন লোক এদিক ওদিক ছড়িয়ে। কিন্তু মেয়েটা যেন সেসব পার করে দূরে, বহু দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বেঞ্চটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আঠারো কি উনিশ বছরের একটা মেয়ে। পরনের কাপড়জামা ভালোই, তবে জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। পায়ে জুতো নেই। মনে হয় বাড়ি থেকে পালিয়েছে।

যথাসম্ভব কৌতূহল চেপে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, বসতে পারি?

আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, নিশ্চয়ই… আপনি সবসময় এখানে বসতে পারেন।

কাঁধ অবধি রুক্ষ, এলমেলো চুল। গায়ের রং ময়লা। চোখ দুটো ঈষৎ টানা-টানা, আর ঠোঁটের ঠিক ওপরটায় একটা লালচে আঁচিল। হাত দুটো লম্বা লম্বা। দৃষ্টি অসম্ভব স্থির, গভীর। দেখে মনে হয় যেন বহুযুগ আগের আঁকা কোনও ছবি থেকে উঠে এসেছে।

এ যুগের আঠারো বছর বয়সী মেয়েদের মত নয়।

পাশাপাশি চুপচাপ বসে আছি। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ বলে উঠল, জানেন, এই জায়গাটা, এই পুরো জায়গাটা কার ছিল?

–জানি না।
–বাংলার গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের। প্রায় দুশো বিঘা জমি নিয়ে সাহেবের বাগানবাড়ি ছিল। আপনি যে বাড়িটায় থাকেন, সেই বাড়িটাও ওই সম্পত্তির অংশ ছিল।

চমকে উঠলাম! আমি কোথায় থাকি তাও জানে…

–টলি-নালার এদিকটায় পুরো জমিটাই সাহেবের সম্পত্তি ছিল। এখন যে বাড়িটাকে হেস্টিংসের বাড়ি বলে সবাই, সেটা আসলে পরে বানানো। যদিও সাহেবের আসল বাড়িও ওইখানেই ছিল। পশ্চিম দিকে বিরাট মাঠ পেরিয়ে জঙ্গল, মাঠের শেষ প্রান্তে ছিল একটা প্যাডক। সেখানে সাহেবের ঘোড়াদের হাঁটানো হত। বিশাল আস্তাবলে চোদ্দটা ঘোড়া আর চারটে ঘোড়ার গাড়ি ছিল। প্যাডকের দক্ষিণ দিকে ছিল বিরাট একটা ফোয়ারা। নীল পাথরের তৈরি। ওই জায়গাটায় গাড়ি ঘোরানো হত। মূলত ঘোড়াগুলোর জন্য পানীয় জলের জায়গা।… সকল তৃষ্ণার্তদের জায়গা।

কথাগুলো বলছিল সেই দিগন্তভেদী দৃষ্টি নিয়ে, সামনের দিকে তাকিয়ে। যা বলছে, সব যেন দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে।

–ফোয়ারাটা এখনও আছে, ওইখানেই… ঘোড়া আর নেই। চারপাশে এখন চওড়া রাস্তা, বাড়িঘর…
–মরূদ্যানের মত!? আমি বললাম।

আবার সেই মুখ টিপে হেসে মাথা নাড়ল মেয়েটি।

–কখনও কখনও মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই একটা মরুভূমি। খুব কমই জায়গা আছে যেখানে কেউ নিশ্চিন্তে পান করতে পারে… ঘোড়াদেরও আর জল পানের অনুমতি নেই…

এসব কথা সে আমাকে কেন বলছে বুঝিনি। সত্যি বলতে আমি কলকাতায় আর কতদিনই বা থেকেছি যে এতসব খুঁটিনাটি জানব… আর তাছাড়া আমি সেরকম লোক নই যার ইতিহাস বা কার্টোগ্রাফি নিয়ে বিরাট উৎসাহ। তবুও, একটা বিস্ময় মেশানো ঘোরের মত ওর কথা শুনে গেছিলাম।

–তোমার ঘোড়া পছন্দ?

এ কথায় সে কিছু বলল না। চোখের পলক ফেলে আমার দিকে তাকাল।

ওর পোশাকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আমার মনে হল, দামী কিন্তু খুব পুরনো। বাদামি রঙের মিহি সুতোর তৈরি গাউন, এখানে ওখানে ছিঁড়ে গেছে। তার ওপর সাদা ওড়না, মসলিনের তৈরি। আমার মনে হল কিছু একটা বলা উচিত… নীচুস্বরে বললাম, একজোড়া জুতো এনে দেব? পরবে?

বলল, না… খালি পায়ে সে নাকি মুক্ত… জুতো পরলে দম আটকে আসে।

সে রাত্রে কিছুতেই ঘুম এল না। সারা রাত বিছানায় ছটফট করে ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে গেছিল। দেখলাম, মাঠের সেই গাছটা। গাছের নীচে ফুলকাটা সাদা জামা, সাদা প্যান্ট আর বকলস দেওয়া চকচকে কালো জুতো পরে টাকমাথা এক সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে কারুকার্য করা লাঠি। চারপাশ অনেক পাল্টে গেছে… মাঠটা দিগন্ত-বিস্তৃত, দূরে একটা সাদা দোতলা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়ির পাশে ঘোড়ায় টানা গাড়ি। আরও দূরে জঙ্গল।

সাহেবের পাশে তার থেকেও লম্বা এক মহিলা দাঁড়িয়ে। হলুদ রঙের গাউন পরে। মাথার চুল লাল। সাহেব সেই মহিলাকে কী একটা অনুরোধ করছে, আর মহিলা তাকে প্রত্যাখ্যান করছে। মহিলার বাঁ দিকে, হাতে সাদা রঙের একটা বড় টুপি হাতে… ওটা কে দাঁড়িয়ে??

সেই মেয়েটা… শুধু তার চুলগুলো পরিপাটি করে বাঁধা, আর বয়স যেন আরও বেড়ে গেছে। চমকে উঠে ঘুম ভেঙে সোজা হয়ে উঠে বসলাম…

এটা কি দেখলাম আমি?

 

২.

পর পর অনেকগুলো বিয়ে আর অনুষ্ঠানের বুকিং থাকায় অক্টোবর মাসটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। নভেম্বর আসতেই শীত পড়ে গেল কলকাতায়। অনেক বছর বাদে নভেম্বরে শীত এসেছে বলে কলকাতাবাসীদের খুব আনন্দ। সোয়েটার, মাফলার আর মাঙ্কি টুপিতে এলাকা ছেয়ে গেল।

আমার নিজের শীত খুব ভালো লাগে। আর তাছাড়া মফস্বলের ছেলে আমি, এইটুকু শীতে একটা পুরোহাতা জামা ছাড়া কিছুই লাগে না। কলকাতার লোকজনের এই শীত উৎসব দেখে ভারী মজা লাগত।

কাজের ব্যস্ততায় ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবার সময় পাইনি, তবে সেই রাতের স্বপ্নটা আমি ভুলতে পারিনি। এর মধ্যে মাঠের পাশে, ওই গাছটার ধারে দু-চারবার গেছিও, কিন্তু তার আর দেখা পাইনি।

নভেম্বেরের শেষ নাগাদ একবার রাতের দিকে সাইবার কাফে থেকে বেরোচ্ছি, দূরে মনে হল যেন গাছটায় হেলান দিয়ে কে একটা দাঁড়িয়ে।

কাছে গিয়ে বসলাম বেঞ্চটায়।

ধীরে ধীরে বললাম আমার স্বপ্নের কথাটা। শুনে অনেকক্ষণ কিছু বলল না সে।

তারপর হেঁটে এসে বেঞ্চের অন্য পাশটায় বসে বলল, …উনি আমার মা। হলুদ গাউন পরা মহিলা লেডি মেরি, সাহেবের বউ। আর যে সাহেবকে দেখেছেন, উনিই বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস।… আমার মা লেডি মেরির প্রধান পরিচারিকা ছিলেন।

সেই সময়ে সাহেব কলকাতায় সেন্ট জন’স চার্চ স্থাপন করেছিলেন। প্রতি রবিবার মেরি ঘোড়ায় টানা ক্যারেজ চড়ে চার্চে যেতেন। পাঁচ মাইল রাস্তা, এতই খারাপ ছিল যে প্রত্যেকবার ফিরে এসে মেরি সাহেবের কাছে নালিশ জানাতেন। সাহেব ছিলেন সহানুভূতিশীল। বাধ্য হয়ে তিনি তাঁর বাড়ির কাছে একটি ছোট প্যারিশ চার্চ তৈরি করান…। বলে মাঠের অন্য প্রান্তে একটা জায়গার দিকে আঙুল তুলে দেখাল সে।

–ওই… ওইখানে… যেখানে এখন বাস্কেটবল কোর্ট আছে…

আমার ইতিহাসের জ্ঞান কম, কিন্তু কোথায় যেন খুব বড় একটা ভুল হচ্ছে…

–এসব… কতদিন আগের কথা? জিজ্ঞাসা করলাম।
–দুশো বছরেরও বেশি। ওইখানে, ঠিক ওই জায়গাটায় সাদা পাথরের তৈরি ছোট্ট একটা চার্চ ছিল। লম্বা হলঘরটার মাথায় তিনকোনা পাথরের ছাদ, আর সামনের দিকটায় ছিল একটা টাওয়ার। তার মাথায় জলনিকাশী গার্গয়েল। চার্চটাকে ঘিরে ঘাসের লন, তার মাঝখান দিয়ে পাথরের বাঁধাই করা রাস্তা। রাস্তার পাশে, ঘাসের ওপরে, অনেকগুলো সমাধিপাথর। ওরই একটার নীচে শুয়ে আমার মা।…
–মানে আমি যে স্বপ্নটা দেখেছি, সেটা ইতিহাসের অংশ? কিন্তু… এ তো অসম্ভব… তার মানে…

এই প্রথম আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে সে হাসল। মুখ টেপা হাসি নয়। খোলামেলা হাসি।

তার দিকে তাকিয়ে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। তাকিয়ে দেখলাম আশে পাশে আর কোনও লোক নেই… শীতের রাত, রাস্তাঘাট শুনশান।

সে আবার অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

ভয়ে, উত্তেজনায় ঠান্ডার মধ্যেও আমার জামা ঘামে ভিজে গেছে… অনেক চেষ্টাতেও তার ওই সরু, ধারালো দাঁতের থেকে আমি মন সরাতে পারছিলাম না।

প্রায় ফিসফিস করে বললাম, তুমি… তুমি ভ্যাম্পায়ার?

–ছিঃ! কি বিশ্রী একটা নাম… চাপা স্বরে গর্জন করে উঠল সে। আমি লিলিৎ। দুশো বছর ধরে আমি এইখানেই আছি।

আমি পাথর হয়ে গেছি। হঠাৎ মনে হল তার মুখটা যেন আস্তে আস্তে আমার কানের দিকে এগিয়ে আসছে। ঠোঁটের ওপরের সেই লাল আঁচিল এখন আগুনের মত উজ্জ্বল। একটা বরফ-ঠান্ডা নিঃস্বাস পড়ল আমার ঘাড়ের কাছটায়। আমার হাত পা চলছে না… আমি যেন একরকম সঁপেই দিয়েছি নিজেকে, তার কাছে।

খট করে একটা শব্দ হল, আর ঝটকা দিয়ে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। দেখি খোলা জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে আমার মুখে।

কী বিদঘুটে একটা স্বপ্ন রে বাবা!

ঘাড়ের কাছে জ্বালা-জ্বালা করায় হাত দিয়েই হাত সরিয়ে নিতে হল। ব্লেড দিয়ে চিরে যাওয়ার মত পাশাপাশি দুটো ক্ষত।… আমি জিসাসে বিশ্বাসী, কোনওমতেই রাতের স্বপ্ন বাস্তব হতে পারে না।

ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম তার জন্য।

কিন্তু তবুও… সারাদিন মনটা জুড়ে উথাল-পাথাল হয়েই চলল।

সন্ধে হতে না হতেই গিয়ে হাজির হলাম গাছটার কাছে। সাহস করে বসলাম গিয়ে বেঞ্চটায়।

ভয় ছাপিয়ে এক অদম্য কৌতূহল আর দুর্নিবার আকর্ষণ যেন আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে তার কাছে। কেন জানি না, আমার মন বলছিল সে আমার ক্ষতি চায় না।

ওর গায়ে ঝরা পাতার গন্ধ। শুকনো, অথচ হালকা ঝাঁঝালো। আর পুরনো কাপড়ের।

আমার রক্ত নেওয়ার সময় ফিসফিস করে স্নিগ্ধ স্বরে কী একটা বলেছিল আমার কানের কাছে। সে ভাষা আমি জানি না।

–সকালে ভালো হয়ে যাবে…। হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলেছিল সে।
–বাড়ি ফিরে জল দিয়ে ধুয়ে নিও।

সেই থেকে প্রতিবার সে আমার থেকে যৎসামান্য নেয়, আর তার বদলে আমায় দেয় অদ্ভুত, অপার্থিব সব অভিজ্ঞতা। সেসব সত্যি, না স্বপ্ন, আমি আজও ভালো করে জানি না।

কখনও দেখি দাঁড়িয়ে আছি মাটির নীচে, অনেক নীচে, এক নিকষ কালো হ্রদের সামনে। নিথর, মসৃণ কালো জল। এ জল কোনওদিন সূর্যের আলো দেখেনি, তাতে পড়ে না কোনও ছায়া। যেন আবলুশ কাঁচের এক আয়না। মাথার ওপর দুর্ভেদ্য পাথরের দেওয়াল।

সে আমাকে আহ্বান করেছে, জলে নামার…

–এ জলে স্নান করলে আর রোগ হবে না তোমার কোনওদিনও…

আমি সাঁতার জানি না, তবুও মন্ত্রমুগ্ধের মত নেমে যাই… সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, আমি চেষ্টা করছি সে হাত ধরার, কিন্তু পারছি না… হঠাৎ দেখি ডুবে যাচ্ছি আমি… সেই ভয়ঙ্কর হ্রদের গভীরতা আমার চারপাশকে গ্রাস করে এক বিষাক্ত কালো কোবরার মত আমাকে গিলে নিতে চাইছে… একের পর এক ভারী পাথর আমার বুকের ওপর চেপে বসে ফুসফুস দুটোকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে…

আমি চিৎকার করার জন্য মুখ খুলেছি…

হঠাৎ মনে হল জল থেকে শূন্যে উঠে গেছি… দেখি আমাকে জড়িয়ে সে তার ডানা দুটো মেলে উড়ে যাচ্ছে ওপরে… অনেক, অনেক ওপরে…

কখনও দেখি অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই সাদা পাথরের চার্চের মাথায় গার্গয়েলের ওপর দুজনে বসে আছি…

পূর্ণিমার রাতে উড়ে উড়ে আমরা এক প্রাচীন, অপরিচিত কলকাতা শহর দেখছি। ভাগিরথী নদী সুবিশাল চওড়া। নদীর পাড় থেকে ভেতরের দিক অবধি বেশিরভাগটাই ঘন জঙ্গল। মাঝে মাঝে এক একটা করে ছোট খাঁড়ি পুব দিকে ঢুকে এসে বৃহৎ জলাশয়ে গিয়ে মিশেছে। খাঁড়িগুলোর মাঝে মাঝে মানুষের বসবাস। অনুমান চৌরঙ্গীর কাছটায় অল্প কিছু পাকা বাড়ি, তার দু পাশেই জঙ্গল।

নৈঃশব্দ ভেঙে সে বলে উঠল, এত বন-জঙ্গল থাকার ফলে সে সময় শহরে একধরনের জ্বর হত, যাকে বলত পাক্কা-জ্বর। পরে যার নাম হয় ম্যালেরিয়া।… ওই জ্বরই নিয়েছিল আমার মাকে।

–আর… তোমাকে?

হেসে উঠল সে। চাঁদের আলোয় তার ধারালো দাঁতগুলো চকচক করে উঠল।

 

৩.

প্রথম প্রথম সপ্তাহে একবার কি বড়জোর দুবার দেখা হত। আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে থাকল। কোনও কোনও সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের দেখা হয়েছে।

সময়ের অত চুলচেরা হিসেব আর রাখি না। এক সুদীর্ঘ অস্পষ্টতা।

দিনগুলো সব কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। কখন ঘুম থেকে উঠি, কী খাই, কখন কাজে যাই, কিছুই মনে থাকে না।

অপেক্ষা করে থাকি কখন রাত হয়।

জেগে না ঘুমিয়ে, তাও জানি না সবসময়।

কতদিন নিজের খাটে শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়েছি… দেখেছি সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আবার আমরা বেরিয়েছি, রাতের অভিসারে।

নাগাল পেয়েছি কত অজানা, অদেখা, অশ্রুত আখ্যানের।

আমাকে সে একটা উপহার দিয়েছিল।

একটা পাথরের বাটি। বাটিটার ভেতরে, ঠিক মাঝামাঝি, খোদাই করে আঁকা একটি নারীমূর্তি। পা দুটো পাখির পায়ের মত, বাঁকানো নখযুক্ত। ডানা দুটো মেলা… তার বিস্তার বাটির কানা পর্যন্ত। বাটি থেকে পান করার সময় একটা দৃষ্টিভ্রম হয়, মনে হয় সেই নারীমূর্তি যেন উড়ছে।

–এটা হারিও না। নিজের কাছে রেখো। এটা থাকলে কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। সে বলেছিল।

কতদিন এইভাবে চলেছিল খেয়াল নেই, হুঁশ এল একদিন বাড়িতে লোক দেখে। আমি নাকি কাজে যাইনি দু সপ্তাহ, তাই ওখান থেকে দেখতে এসেছে আমার শরীর খারাপ কি না।

হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে এল। মনে পড়ল মায়ের কথা, সমস্ত দায়িত্বের কথা।

প্রথমে গেলাম ডাক্তারের কাছে। ঘাড়ের ক্ষতটা দেখে বললেন কোনও বিষাক্ত পোকা জাতীয় কিছুর লালা থেকে ওরকম হয়ে থাকতে পারে। একটা মলম দিলেন।

ওনাকে কিছু বলতে পারলাম না।

কিন্তু মনের ভেতরে সেই উথালপাথাল শুরু হয়েছে, কাউকে একটা খুলে বলতেই হবে সবকিছু। তবে যে কেউ নয়, এমন একজন যে বুঝবে। হঠাৎ মনে এল, পরদিন রবিবার। ঠিক করলাম চার্চে যাব।

কনফেশান বক্সে বসে ভেতরে যা জমে ছিল, সবকিছু ঢেলে দিলাম ফাদারের কাছে। ফাদার শুনে অনেকক্ষণ কিছু বললেন না। তারপর বললেন, তোমাকে যখন ও বন্ধু হিসেবে স্বীকার করেছে, তোমাকেই ওর মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

–কী করতে হবে আমায়?
–ও তোমাকে যা যা বলেছে, তার সব তুমি বুঝেছ?
–তার মানে?
–ও কি কখনও তোমাকে এমন কিছু বলেছে যার ভাষা তুমি বোঝোনি?

মনে পড়ে গেল সেই দ্বিতীয়বারের অভিজ্ঞতার কথা। বললাম, বলেছে…

–তুমি কি তার ধ্বনিরূপ মনে করে বলতে পারবে?

যতদূর মনে ছিল আওয়াজ করে শোনালাম। ফাদার আমাকে বসে থাকতে বলে কনফেশান বক্স থেকে উঠে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় মিনিট দশেক পর।

পর্দার ফাঁক দিয়ে কিছু একটা বাড়িয়ে ধরলেন। হাতে নিয়ে দেখলাম একটা ক্রস। কাঠের তৈরি।

–ও পান করতে চাইলে বাধা দিও না, তাতে সন্দেহ হবে। তবে এবার থেকে যখনই বেরোও, এটা জামার নীচে লুকিয়ে রাখবে। আবার কখনও যদি কোনও চার্চ বা গোরস্থানে যাও, আমি যে মন্ত্র বলছি সেটা উচ্চারণ করবে ক্রসটাকে সামনে হাতে ধরে… আর মন্ত্র বলার সময় ওর চোখের দিকে তাকাবে না।

বলে আমাকে সেই মন্ত্র দিলেন। আবারও আমি কিছু বুঝলাম না, ভাষাটা আমার অজানা। মনে হল, যে ভাষাতে আমার কানে ও কথাগুলো বলেছিল, সেই ভাষাতেই মন্ত্রটা।

সে রাতে আমার স্বপ্নে সে এল না। তার পরের দু রাতও নয়।

তিনদিন পর একদিন রাতে নিজের বিছানায় বসে বাটি থেকে জল পান করছি, বারান্দায় যেন খস্‌খস্‌ পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। আজ অবধি সে আমার ঘরে কখনও ঢোকেনি, ভাবলাম আজ ঢুকবে নাকি।

পায়ের শব্দ কিন্তু অস্থিরভাবে বারান্দাতেই ঘোরাফেরা করতে থাকল। ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। ক্রসটা আমার জামার তলায়।

দেখা মাত্র আমাকে নিয়ে উড়ে গেল সে।

আমি হাঁফ নিয়ে চোখ খুললাম, কখন বন্ধ করেছি মনে নেই। দেখলাম বিরাট একটা হলঘরের মেঝেতে শুয়ে আছি। দেওয়ালগুলো বিরাট বিরাট লাল পাথরের ব্লক দিয়ে গাঁথা… আলো-বাতাস ঢোকে না। … থেকে থেকে মশাল জ্বলছে … ভেজা বাতাস তীব্র, ঝাঁঝালো এক ধূপের গন্ধে ভারী।

–এটা আমার গোপন জায়গা। আমার সব দিয়ে রক্ষা করি। এইখানে আমার প্রিয়জনদের এনে রেখেছি।

লক্ষ করে দেখলাম পাথরের খাঁজে খাঁজে কাঠের কফিন। নিজের অজান্তেই কখন এক পা পিছিয়ে গেছি। মনে হল, আর না… আর জানতে চাই না … ক্রসটার কথা মাথায় এল…

কিন্তু না, ওকে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।

–ভয় পেয়েছ? সে জিজ্ঞেস করল আমাকে…

মনে মনে ঠিক করলাম ছলচাতুরি না করে সোজাসুজি প্রশ্ন করব…

তাকে বললাম সবকিছু। ফাদারের কথা, ক্রসটার কথা। বলে প্রশ্ন করলাম, মুক্তি চাও?

সে এক পা এগিয়ে এল… হেসে বলল, … মুক্তি বোধহয় তুমি চাও…

তারপর অদ্ভুত উঁচু এক স্বরে বলল, লিলিৎ নিরবধি। লিলিৎ বহু। লিলিৎ ব্যাপ্ত। যে মানুষ একবার লিলিতের সঙ্গ পেয়েছে, সে আবার পাবে… পাবেই…। বলে আমার জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ক্রসটা চেপে ধরল।

চরম উত্তেজনায় ফাদারের দেওয়া মন্ত্র এক নিঃশ্বাসে আউড়ে দিলাম।

এক মুঠো ঝরা পাতা ধুলো হয়ে আমার জামা থেকে ঝরে পড়ল।

 

৪.

কলকাতা ছেড়ে চলে এসেছি বহুদিন। মা-ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে বহুদিন।

আমি এখন নিউ ইয়র্কের স্টেটেন আইল্যান্ডে থাকি। রোজ সকালে ফেরি ধরে ম্যানহ্যাটান যাই চাকরি করতে। সন্ধের ফেরি ধরে ফিরে আসি।

গত আঠারো বছরে একদিনের জন্যেও আমার শরীর খারাপ হয়নি। জীবনে আমার সঙ্গে যা যা হয়েছে, সব ভালোই হয়েছে।

এখন বুঝি, যৌবনের অদ্ভুত ভীরু ন্যায়নিষ্ঠতার ঝোঁকে কী করেছি।

আমার কথা কাকে জানাতাম?

প্রথমে ভেবেছিলাম, কোনওদিনও লিখব না… তারপর লিখলাম… ভাবলাম লিখেই পুড়িয়ে দেব।

তারপর ভাবলাম স্টেটেন আইল্যান্ড ফেরি চড়ে যখন লেডি লিবার্টির পাশ দিয়ে যাই, একদিন একটা বোতলে কাগজগুলো ভরে অ্যাটলান্টিকের জলে ফেলে দেব…

শেষ পর্যন্ত প্যাড থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির কোনও এক বইয়ের পাতার ফাঁকে গুঁজে রেখে এসেছি। কী বই, আমিও দেখিনি।

বাটিটা এখনও আমার কাছে আছে।

প্রতিবার ওটা থেকে পান করার সময় তাকে দেখি, ডানা মেলে উড়ছে। নাকের কাছটা লাল।

তার শেষ কথাগুলোর প্রতিটা শব্দ আজও আমার কানে বাজে।

আমি অপেক্ষায় রয়েছি।