সৌনক দাশগুপ্ত
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের তরফে কথা বললেন সৌনক দাশগুপ্ত।
সৌনক দাশগুপ্ত: নমস্কার দেবাশীষদা। সরাসরি আমাদের আলোচনার বিষয়ে আসা যাক। জাভেদ হাবিব, একটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড, তাঁদের একটি বিজ্ঞাপন সাম্প্রতিককালে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। মা দুর্গা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেলুনে বসে চুল কাটছেন। এই ছিল বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু। কিন্ত এই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে বাঙালি আরও বড় মাপে বলতে গেলে ভারতবাসীর মধ্যে আলোড়ন বা হইচই পড়ে গেছে। এরকম অদ্ভুত অসহিষ্ণুতা আমাদের মধ্যে আগে দেখা যায়নি। শিল্পের ক্ষেত্রে তো নয়ই। আমরা দেখেছি বিভিন্ন বাংলা পত্রিকাতে মা দুর্গার কার্টুন। সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যাই তৈরি হয়নি। আজ জাভেদ হাবিব মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি বলেই কি এত অসহিষ্ণুতা? আপনার কী মনে হয়?
দেবাশীষ দেব: আপনি যেটা বলছেন সেটা ঠিক। আগে এই অসহিষ্ণুতা ছিল না। সেদিক থেকে বিচার করতে গেলে আগে অনেক কিছুই ছিল না, এখন হচ্ছে। আপনি যদি সেভাবে বিশ্লেষণ করেন দেখবেন অনেক কিছুই নতুন নতুন হচ্ছে। আমাদের মকবুল ফিদা হুসেন যখন সরস্বতীকে ন্যুড এঁকেছিলেন তখনও কিন্তু প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আজকের দিনে হিন্দু সমাজের আবেগ এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে; যে আমাদের দেবদেবীকে নিয়ে করেছ, তোমাদেরটা নিয়েও করো না! এটা একদম মূল বিষয়, যারা দুর্গাকে নিয়ে বা কার্তিককে নিয়ে কার্টুন করায় আপত্তি করছে তারাই কিন্তু হুসেনকে বলেছিল যে মহম্মদকে নিয়ে করো না! বেসিক ব্যাপারটা, আবেগের জায়গাটা বুঝতে হবে। যারা দুর্গাকে নিয়ে মজা করার প্রতিবাদটা করছে তারা কিন্তু এটা দুর্গাকে নিয়ে মজা করেছে বলে প্রতিবাদটা করছে না, তাদের মূল বক্তব্য হল আজ দুর্গা, কার্তিক, গণেশের পাশাপাশি অন্য ধর্মাবলম্বীদের যে ঈশ্বর আছেন, তাঁদেরকে নিয়েও কেন এইরকম হচ্ছে না!
সৌনক দাশগুপ্ত: আপনি বলছেন একজন মুসলিম শিল্পী কেন হিন্দুদের দেব দেবীকে নিয়ে মজা করে কার্টুন আঁকছে প্রতিবাদটা সেখানেই। কিন্তু আমরা দেখেছি রাজা রবি বর্মা হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে যে অন্যরকম ভাবনাচিন্তার ছবি এঁকেছিলেন, সেখানে তিনি হিন্দু হওয়া স্বত্বেও তাঁকে চরম বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়।
দেবাশীষ দেব: রবি বর্মার ক্ষেত্রে আমি আপনাকে বলি, রবি বর্মার এই দেবদেবী সিরিজের ছবিগুলো সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ছিল। উনি সীতাকে পাতলা বস্ত্র পড়িয়েছেন, ভিজে জামা পড়িয়েছেন দেবীদের, এগুলো কিন্তু উনি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক কারণে করেছেন, যাতে ওনার আঁকা পেন্টিংগুলো বিক্রি হয়। এই ধরনের ছবি বরাবরই বাজারগত দিক থেকে উচ্চ চাহিদার। রবি বর্মার সেদিকেই নজর ছিল। অথচ এই রবি বর্মাই যখন কোনও রাজা মহারাজার সুপারিশে ছবি এঁকেছেন, সেই ছবিতে কিন্তু তিনি শালীনতার সীমা বজায় রেখেছেন, তাঁর ছবির চরিত্রকে রেখেঢেকেই জামাকাপড় পড়িয়েছেন। তো এই পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করছে কোন পরিস্থিতিতে কী মানসিকতা নিয়ে শিল্পী আঁকছেন অথবা যাঁর সুপারিশে শিল্পী আঁকছেন তাঁর মানসিকতা কীরকম।
সৌনক দাশগুপ্ত: আচ্ছা। তো সমকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বলি, আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দুর্গা বা অন্যান্য দেবদেবীর কার্টুন দেখেছি। সেখানে শিল্পর বহিঃপ্রকাশটাই আমাদের বেশি টেনেছে। তো এই ক্ষেত্রেও এটাকে নিছক কার্টুন বা শিল্পের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবতে পারতাম না?
দেবাশীষ দেব: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি যখন প্রথম বিজ্ঞাপনটা দেখি তখন তো আমার এটাকে নিছক বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি। তারপর যখন প্রতিবাদ শুরু হয় তখন বিষয়টা তলিয়ে ভাবতে বাধ্য হই। আমার মনে আছে প্রায় ৭-৮ বছর আগে আমি একটি হোর্ডিং ডিজাইন করেছিলাম, দুর্গা তার পরিবার নিয়ে বাসে চেপে পুজো পরিক্রমাতে বেরিয়েছেন। সেই হোর্ডিংটার ছবি মনে হয় আমার কাছে এখনও আছে। আনন্দমেলা তো কিছুই না, টেলিগ্রাফের পাতায় বিভিন্ন সময় নানারকম মজার কার্টুন উঠে এসেছে দেবদেবীদের নিয়ে। যেমন ধরুন, গণেশকে ব্যবসায়ী হিসেবে দেখানো হয়েছে, অমুক দেবী র্যাম্পে হাঁটছেন। এগুলো যদি একটু তলিয়ে ভাবেন আদতে কোনও গুরুতর ব্যাপারই নয়। দুর্গা বলুন শিব বলুন লক্ষ্মী স্বরস্বতী বলুন, এরা কিন্তু দেবদেবী সত্তা পার করে অনেক বেশি আমাদের ঘরের লোক, পরিবারের সদস্য হয়ে গেছেন। এই যে প্রতি বছর দুর্গাপুজো হয় এত জাঁকজমক করে, তাতে কিন্তু ধার্মিক বা আধ্যাত্মিক মননশীলতার থেকে পুজোর ক’দিন সব ভুলে আনন্দে মেতে ওঠা, এই আবেগটারই প্রাধান্য বেশি। বছর ঘুরে মেয়ে বাপের বাড়িতে ফিরলে আমরা যেরকম আনন্দ করি, দুর্গাপুজোতেও ঠিক তাই হয়। তাই এসবের মধ্যে আদতেও ধর্ম ব্যাপারটা কতটা গুরুত্ব পায় সেটাই প্রশ্নের বিষয়।
সৌনক দাশগুপ্ত: একদমই, সেরকমভাবে দেখতে গেলে কলকাতায় ১০০টা পুজো হলে তার মধ্যে ৮০টা পুজোই হয়তো নিখুঁত নিয়ম আচার মেনে হয় না। এবার আপনার কথাতেই আসি। দুর্গাপুজোর আধুনিকীকরণ ঘটছে। কলকাতার প্রায় সব বারোয়ারি পুজোতেই থিম-এর ছোঁয়া। বিভিন্ন পুজো কমিটির পোস্টারে দেখা গেছে অন্য ধর্মের কোনও অভিনেত্রী হয়ত দুর্গার রূপে। সেখানে কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু জাভেদ হাবিবের যে পোস্টার, যেটায় বিজ্ঞাপন এবং বাণিজ্যই ছিল মূল উদ্দেশ্য, সেখানে জাভেদ হাবিব কি মুসলিম বলেই তাকে এই প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হল? এটা কে কি আমরা নিছক বিজ্ঞাপন বা একজন কার্টুনিস্টের শিল্প নিদর্শন হিসেবে দেখতে পারি না?
দেবাশীষ দেব: নিশ্চয়ই দেখতে পারেন, আরও স্পষ্ট করে বললে বিষয়টাকে এভাবেই দেখা উচিত। বিষয়বস্তুকে স্বচ্ছ রাখা উচিত। কিন্তু এই বিষয় বস্তুটাকে আরও বৃহৎ পরিসরে ভাবতে হবে। আমি শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মকে নিয়েই মজা করব নাকি আমি অন্য ধর্মের আরাধ্যদের নিয়েও মজা করার সাহস দেখাতে পারব। আমি আজ হিন্দু হয়ে আমার ধর্মের দেবদেবীকে নিয়ে মজা করত পারি, কিন্তু আমি হিন্দু হয়ে একজন বোরখা পরা মহিলাকে নিয়ে কি মজা করতে পারি? পারি না। আমায় নিজেকেও ইলাস্ট্রেশন করতে গিয়ে এরকম ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমি একটি প্রচ্ছদের জন্য ছবি এঁকেছি কিন্তু শুনতে হয়েছে– না দাদা, এই ইস্যুগুলো বাংলাদেশেও সার্কুলেট হয়, এটার জন্য এরকম ইলাস্ট্রেশন না হলেই ভালো। শিল্পী হিসেবে আমায় একটা সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অথচ যখন পশ্চিমবঙ্গে চলা কোনও ম্যাগাজিনের জন্য দুর্গাকে নিয়ে কার্টুন করছি, তখন কেউ কিছুই বলেনি। এই সূক্ষ্ম তারতম্যের বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে।
সৌনক দাশগুপ্ত: তাহলে আপনার কথা অনুযায়ী জাভেদ হাবিব যেহেতু ধর্মে মুসলিম, তাই তার ভাবা উচিত ছিল যে এই হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে সে কার্টুন গোছের বিজ্ঞাপন করলে ভারতের হিন্দু কমিউনিটি ব্যাপারটা আদৌ নিতে পারবে কিনা।
দেবাশীষ দেব: আসলে কি জানেন; হিন্দুরা, বাঙালি হিন্দুরা তো বটেই, আমরা নিজেরাই জানি না আমরা কতটা উদার। এই যে আপনি প্রশ্নটা তুলেছেন, বাঙালি হিন্দুদের কাছে এটা একটা সামান্য ঘটনা মাত্র। আমরা বাঙালিরা এসব নিয়ে কিছুই ভাবি না, কিছুই মানি না। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে বাঙালি হিন্দুরা উদারতম জাতি। হলফ করে বলা যায় ৯৯% বাঙালি জাভেদ হাবিবের ঘটনাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামায়নি। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর লোকেদের মধ্যে হয়ত এই ঘটনা দাগ কেটেছে, আর তারাই হইচই করছে। এই যে আপনি বললেন এরকম ঘটনা আজকের দিনে কেন হচ্ছে। আসলে অনেক বছর ধরে আস্তে আস্তে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বিচার বিবেচনা বুদ্ধির পরিবর্তন আমরা দেখছি। এবং এইসব সমীকরণ আগামী দিনে আরও পাল্টাবে, আমরা দেখতে পাব।
সৌনক দাশগুপ্ত: তাহলে সেক্ষেত্রে আমি যদি একজন শিল্পী হই, হতে পারি আমি হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিস্টান, আমাকে তো পাঁচবার ভাবতে হবে কিছু করতে গেলে!!
দেবাশীষ দেব: অবশ্যই ভাবতে হবে। ভাবতে হবে কারণ ভাবার মত পরিস্থিতি হচ্ছে। কিছুই করার নেই। এটা তো একতরফা হচ্ছে না। এই যে আপনি বলছেন অস্থিরতা, এই অস্থিরতা তো আদতে কাম্য নয় আমাদের এই সুস্থ সমাজে। কিন্তু এই অস্থিরতার যে পরিবেশ আস্তে আস্তে লালিত হয়েছে, সেটা কে তো আমরা আটকাতে পারিনি। অসহিষ্ণুতা, এটা তো একতরফা কিছু নয়। আজকে মীর তাঁর বাবাকে বলছেন, ‘বাবা আমার আল্লাহ’, তাঁকে তো কেউ ছেড়ে কথা বলেনি, তীব্র আক্রমণে তাঁর চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। আর আমরা এই ঘটনা দেখে তো আর নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছি না, এই ঘটনার পাল্টা প্রতিক্রিয়া তো হতেই পারে। এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর প্রকাশ একদিনে হয়নি, এরকম ঘটনাক্রম দেখতে দেখতে বা বলা ভালো জমতে জমতে এরা আজ এই জায়গায়। আজকে জাভেদ হাবিব হয়েছে, কিন্তু এরকম ঘটনা তো আজ থেকে পঞ্চাশ বছর, চল্লিশ বছর, কুড়ি বছর আগে চট করে হত না। এখানে আমাদের নিউটনের তৃতীয় সূত্র মনে করতে হবে, ‘For every action, there is an equal and opposite reaction’। এই action গুলো যখন হয় তখন আমরা ভাবি না, পাত্তা দিই না, কিন্তু reaction হলেই আমরা নড়ে চড়ে বসি।
সৌনক দাশগুপ্ত: আপনি action বলতে কি বোঝাতে চাইছেন যদি একটু বলেন।
দেবাশীষ দেব: আসলে এটাই বলতে চাইছি, যে ঘটনাগুলো এখন ঘটছে, তা শুরু হয়েছে কিন্তু অনেক আগে। ভিতরে ভিতরে বীজগুলো পোঁতা হচ্ছিল। এই ঘটনার বীজগুলো আসলে মাটিচাপা ছিল। এই বীজগুলোকে যদি উপড়ে ফেলতে হয়, আমাদের সবাইকে একসাথে সচেষ্ট হতে হবে। এটা আপনার আমার ব্যক্তিগত সমস্যা নয়। এটা একটা সার্বিক সমস্যা। এটার জন্যে একসাথে ভাবতে হবে। আজকে আপনি বালিগঞ্জে বসে একরকম ভাবলেন আমি রাজাবাজারে বসে একরকম ভাবলাম আর একজন রিপন স্ট্রিটে বসে ভাবল আরেকরকম, তাহলে তো হবে না। আমি ভাবলাম জল, আপনি ভাবলেন তেল, তাহলে মিশ কী করে খাবে বলুন। এই সমীকরণগুলো একদমই আলাদা। অঙ্কের হিসেব এখানে চলবে না। এর জন্যে সবাইকে এক ছাতার তলায় আসতে হবে, বসতে হবে, ভাবতে হবে।
সৌনক দাশগুপ্ত: তাহলে একথা বলাই যায়, যা পরিস্থিতি আসছে তাতে শিল্পী তথা শিল্প জগতের জন্য এক সমূহ বিপদ ঘনিয়ে আসছে।
দেবাশীষ দেব: অবশ্যই ঘনিয়ে আসছে। পরিষ্কার করে বলতে গেলে শিল্পী সমাজের স্বাধীন সত্তা আজ বিপদের মুখে। কিন্তু এটাকে প্রতিরোধ করতে হবে। যে কোনও মূল্যেই। তার জন্য সবার আগে দরকার, সবাইকে মুক্তকণ্ঠে বলতে হবে। খোলাখুলিভাবে কথা বলতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা আদতে ভণ্ড। আমরা যা ভাবি তা বলি না। শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে এই অসুখটা বহুদিন ঢুকে গেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা আছে যে তাঁরা লেখার সময় একরকম লিখছে, বাড়িতে শৈততাপ-নিয়ন্ত্রিত ঘরে স্কচ-হুইস্কি সহযোগে গল্প করার সময় আরেকরকম বলছে। আমি দিনের পর দিন দেখেছি, বিশেষ করে যাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালি। তো আপনি কী পাবেন তাঁদের থেকে? কী আশা করেন? এরা এরকমই স্বভাবের যে কফি হাউসে বসে আনন্দবাজারকে গালাগাল দেবে, আবার গল্প ছাপার জন্যে আনন্দবাজারের অফিসেই ঘুর ঘুর করবে। আমার দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে এসব ঘটনা দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিশেষ করে বাম মানসিকতার আঁতেল শ্রেণীর বাঙালি, কিন্ত এখন যাদের দেখতে হচ্ছে তাঁরাও যে খুব একটা এর ব্যতিক্রম তা একদমই নয়। একটা বিষয়ের অভাব ভীষণ প্রকট, তা হল স্পষ্ট কথা। স্পষ্ট কথা বলা দরকার।
সৌনক দাশগুপ্ত: তাহলে সামগ্রিক ভাবে বলতে গেলে আপনি কী বলবেন?
দেবাশীষ দেব: সামগ্রিক ভাবে আমার মনে হয়, এই ঘটনায় জাভেদ হাবিবের ক্ষমা চাওয়ার কোনও দরকার ছিল না। তাঁর এই ঘটনায় কোনও দোষ নেই। কিন্তু ভাবতে হবে আবেগের প্রশ্নটা নিয়ে। কেন আমরা একজন হিন্দুকে মাপ করে দিচ্ছি, কেন একজন মুসলিমকে মাপ করতে পারছিনা, এটাই তো সমস্যা। এখান থেকেই তো প্রশ্নটা এসেছে। এই প্রশ্নটাই আমাদের ভাবাচ্ছে। শুধুমাত্র জাভেদ হাবিব বলেই কি আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে? কেন এই উগ্র প্রতিবাদের জন্ম হলো? কোন বিপরীত প্রতিক্রিয়া এর উৎস, সেটা ভাবতে হবে। আমাদের উচিত ছিল অনেক আগেই এই উৎস খুঁজে বের করে তার প্রতিরোধ করা। কিন্তু আমরা করিনি। দিনের পর দিন ভণ্ডামো করে গেছি। সেই জন্যই আজ এই পরিস্থিতি। নয়ত আমরা বেশ মিলেমিশে থাকতাম। এই সব ঘটনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনও রকম আঁচ ফেলার সুযোগ পেত না।
সৌনক দাশগুপ্ত: হ্যাঁ, আমরা দেখেছি মহম্মদ আলী পার্ক, খিদিরপুর বা মধ্য কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম যুবকরাই দুর্গা পুজোর মন্ডপ সামলান, তারাই থাকেন উপস্থাপনায়। আমরা তো এই সহাবস্থানেই পরিচিত।
দেবাশীষ দেব: হ্যাঁ অবশ্যই। আমাদের হিন্দি সিনেমার কথাই ভাবুন না, শাকিল বদাউনি কি অসম্ভব সুন্দর ভজন লিখেছেন, নওশাদ সুর করেছেন , মহম্মদ রফি গেয়েছেন সে সব গান বৈজু বাউরা সিনেমাতে। অমন অসাধারণ উৎকৃষ্ট ভজন ক’জন লিখতে পারে বা ক’জনই বা গাইতে পারে বলুন তো। আমরা তো কেউ প্রতিবাদ করিনি যে ও কেন লিখছে বা ও কেন গাইছে! আমরা এগুলো সানন্দে গ্রহণ করেছি, আমাদের তো কোনও অসুবিধাই হয়নি। সমকালে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে সেগুলো কখনও ছিলই না, আমরা এগুলো ভাবিনি কখনও। কিন্তু দিনের পর দিন নানা ঘটনাপ্রবাহ, সে রাজনৈতিক হোক সামাজিক হোক, পরিস্থিতিকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে, এই সামাজিক ভেদাভেদের সৃষ্টি করেছে।
সৌনক দাশগুপ্ত: আপনার কি মনে হয় আমাদের দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তা কি অনেকাংশে দায়ী এটার জন্যে।
দেবাশীষ দেব: না না, এসব ঘটনা এক-আধ দিনের বহিঃপ্রকাশ নয়। একটা রাজনৈতিক দল তিন বছর কি পাঁচ বছর এসেই একটা গোটা দেশের অভিমুখ এরকমভাবে পরিবর্তিত করতে পারে না। এর সূত্রপাত দীর্ঘদিন আগেই হয়ে গেছিল। এতদিন মাটিচাপা পড়ে ছিল, এখন বেরিয়ে আসছে। আমি আমার যত হিন্দু বা মুসলিম পরিচিতদের দেখেছি তাঁরা যে অত্যন্ত উদার, তার অধিকাংশটাই উপরে উপরে। খুঁড়ে ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে এদের সবার ভিতরেই এই ভেদাভেদের বীজ বহু আগেই পোঁতা হয়ে গেছে।
সৌনক দাশগুপ্ত: তাহলে বলা যেতে পারে আগুন অনেক আগে থেকেই জ্বলছিল, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুধু মাত্র অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র।
দেবাশীষ দেব: একদমই তাই। এটা সব জায়গাতেই হচ্ছে। যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু সেখানে হিন্দুদের কার্যকলাপ চোখে পড়ছে, যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু সেখানে তাদের কার্যকলাপ চোখে পড়ছে। এটা ভীষণ জটিল সমীকরণ। একটু একটু করে বারুদ জমতে জমতে আজ বিস্ফোরণ ঘটছে। এর জন্যে আমরা প্রত্যেকে দায়ী। আমি দায়ী, আপনি দায়ী, আমাদের নেতারা দায়ী, আমাদের ভণ্ডামি দায়ী, আমাদের প্রত্যেকের মুখোশের আড়ালের মুখগুলো দায়ী। কেউ বাদ যায় না।
সৌনক দাশগুপ্ত: পরিশেষে আপনার কী মনে হয়, কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে আমরা ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আটকাতে পারব, বা এই অস্থিরতাকে প্রতিরোধ করতে পারব? শিল্পী সমাজের দিক থেকে কি কোনও বিশেষ পদক্ষেপ দরকার এই সময়ে দাঁড়িয়ে?
দেবাশীষ দেব: ভারতবাসী হিসেবে আমাদের আশু এবং প্রাথমিক কর্তব্য হল সমস্ত জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সহিষ্ণুতা পোষণ করা। আর শিল্পী সমাজের দিক থেকে সব থেকে বড় পদক্ষেপ যেটা নিতে হবে তা হলো ভণ্ডামি বন্ধ করতে হবে। যা বলবে সত্যি কথাটা বলো। শিল্পী হিসেবে নিজের সত্তাকে বিকিয়ে দিও না। কায়দা করে, ফিকির করে একটা ছবি বিক্রি করা, এরকম চললে হবে না। একথা সত্যি যে প্রত্যেকেই বাণিজ্যিক দিকটা দেখে। পেটের দায় বড় দায় আমরা জানি। কিন্তু তার পাশাপাশি এটা মাথায় রাখতে হবে শিল্পী মানে কিন্তু আপোষ করা নয়। আমার শিল্পী সত্তার প্রভাবে আমার যা আঁকতে ইচ্ছে করবে আমি তাই আঁকব, তাই গাইব, তাই লিখব। কেন আমি কিছু সস্তা চটকদারী আর জনপ্রিয়তার জন্যে শিল্পের সাথে আপোষ করব। আমার যদি মনে হয় আমার তিন ছেলের মধ্যে তিনজনই আমার কাছে সমান তাহলে আমি বড়ছেলে অন্যায় করলেও তার শাস্তি দেব, মেজছেলে করলেও তাই, ছোটছেলে করলেও তাই করব। কারোর ক্ষেত্রে কোনও তারতম্য হবে না। এইখানে যদি একই অপরাধে শাস্তির তারতম্য ঘটে তাহলে ছেলেরা কী শিখবে! আজ নাগরিক সমাজ আমাদের শিল্পী সমাজের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাই আমাদের কোনও ভুল পদক্ষেপ তাদের কাছেও ভুল বার্তা নিয়ে যাবে। আমাদের অনেক বেশি ব্যালান্সড হতে হবে। আমাদের এই আনব্যালান্সড মানসিকতাই আমাদের বিপদে ফেলছে। আজ আমরা অফিসে একরকম বলছি, কাল পাড়ায় গিয়ে একরকম বলছি, বাড়ি এসে একরকম বলছি, ক্লাবে একরকম বলছি, বন্ধুদের সামনে একরকম বলছি, আবার ছেলেমেয়েদের সামনে অন্যরকম বলছি। ফেসবুকে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে কে কতটা উদার, কে কতটা socially active, কে কতটা ধর্মনিরপেক্ষ সেসব মেকি জিনিস না প্রচার করে, বাহবা কুড়োবার প্রতিযোগিতা না করে বাস্তবের মাটিতে নামতে হবে। সত্যি কথাটা সত্যি ভাবে বলতে হবে। সমস্যাটা ঠিক উলঙ্গ রাজার মত; সবাই জানে রাজা উলঙ্গ, কিন্তু কেউ আগে এগিয়ে এসে বলবে না।
সৌনক দাশগুপ্ত: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দেবাশীষদা ৪ নং প্ল্যাটফর্মের সাথে এ বিষয়ে আলোচনা কর৯বার জন্য। ভালো থাকবেন।
দেবাশীষ দেব: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সাফল্য কামনা করি।
সাক্ষাতকারের ভেতরে গণেশের কার্টুন দেবাশীষ দেবের আঁকা। ‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত।