Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সর্বনাশের সপ্তপদী — পঞ্চম বর্ষ, দ্বিতীয় যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

প্রচল বাংলায় একটি কথা অহরহ শুনা যায়— সেবা-শুশ্রূষা। ভাবিয়া দেখিলে, সমাসবদ্ধ এই পদটির দুই প্রকারের ব্যাসবাক্য রচনা সম্ভব— সেবা ও শুশ্রূষা, অর্থাৎ দ্বন্দ্ব সমাস; এবং যাহা সেবা তাহাই শুশ্রূষা, অর্থাৎ সাধারণ কর্মধারয়। এই দুই বিগ্রহবাক্যের মধ্যে কোনটি অধিক শাস্ত্রসম্মত, সে রায় বৈয়াকরণ হয়তো দিতে পারিবেন; কিন্তু আমাদিগের আগ্রহ আপাতত ব্যাকরণের প্রতি ততদূর নহে, যতদূর শব্দযৌগটির অন্তর্নিহিত ভাবনা ও তাৎপর্যের প্রতি। পাঠকের মনে থাকিবে, শুশ্রূষা শব্দটি প্রচলিত অর্থে সেবার ভাবকেই নির্দেশ করে, যদিচ শব্দটির মূল অর্থ আদিতে ছিল অন্যতর। শব্দটি ‘শ্রু’ ধাতু হইতে জাত— যাহার অর্থ শুনা— শ্রবণ করা। সেই বিচারে শুশ্রূষা শব্দটির অর্থ ‘শুনিবার ইচ্ছা’। ভাবিতে সাধ হয়, শব্দযৌগটি যখন গড়িয়া উঠিতেছিল তখন এই ‘শুনিবার ইচ্ছা’টি সেবার সহিত নিতান্ত অকারণেই জুড়িয়া যায় নাই— তাহার পশ্চাতে একটি অতি সংবেদনশীল জনমানসের পূর্ণত সচেতন আগ্রহ কাজ করিয়াছিল— যেন বা পরোক্ষে ইঙ্গিত করা হইয়াছিল যে, শুনিবার ইচ্ছাই প্রকৃত সেবা— শুনিতে অনিচ্ছুক, অসহিষ্ণু মানবের পক্ষে সেবাভাবে ভাবিত হওয়া কদাচ সম্ভব নহে। যেন বা নির্দেশ করা হইতেছিল, আর্তের সেবা করিতে চাও তো প্রথমে তাহার ক্রন্দন শ্রবণ করো— তাহাকে শুন।

সেবা বিষয়ে এত কথা মনে আসিল, তাহার কারণ— সম্প্রতি দেশের সরকার তাহার দ্বিতীয় দফায় দেশশাসনের দ্বিতীয় বর্ষ ও দুই দফা মিলাইয়া সপ্তম বর্ষ সমাপ্ত করিয়াছে— এবং উদ্‌যাপনের সেই মহামুহূর্তে সরকার জানাইয়াছে, দেশশাসক নহে, দেশসেবক হইয়া উঠাই তাহার মহাব্রত— গত সপ্তবর্ষব্যাপী সেই সেবাব্রতই সরকার পরমধন হিসাবে উদ্‌যাপন করিয়া আসিতেছে।

আপাত অর্থে এই বার্তায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নাই, বস্তুত তাহা অতিশয় স্বস্তিদায়ক। সরকার যদি শাসক হইতে সেবক হইয়া উঠিতে চায়, তাহার অপেক্ষা সুবিবেচনা-প্রসূত সিদ্ধান্ত দেশবাসীর পক্ষে আর কী বা হইতে পারে? জন স্টুয়ার্ট মিল হইতে আরম্ভ করিয়া কালে-কালে বহু মহাজ্ঞানী জনগণের সেবায় নিবেদিতচিত্ত সরকারকেই গণতন্ত্রের তুঙ্গতম অভীষ্ট বলিয়া কীর্তিত করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে যদি দিল্লীশ্বর আপনাকে দেশসেবক বলিয়াই অভিহিত করিতে চাহেন, দেশবাসী হিসেবে আমাদিগের তাহাতে আপত্তির তো কিছু নাইই, বরঞ্চ গর্বিত হইবার আছে— আপ্লুত বোধ করিবার আছে।

এই ক্ষণে একটি অবধারিত প্রশ্ন উঠে— স্বঘোষিত সেবক হইয়া উঠিলেও, সরকার শ্রবণশিক্ষা করিয়াছে কি? সে কি শুনিতে শিখিয়াছে? মানুষের জন্য কাজ করিতে হইলে তাহার কথা শুনিতে হয়, তাহার সমস্যাগুলি অনুধাবন করিতে জানিতে হয়, এবং সর্বোপরি, যাহারা সরকারের কাজের ভুলত্রুটিগুলি ধরাইয়া দিতে চায় তাহাদের বাক্য ও উদ্দেশ্যকে মর্যাদা দিতে হয়। এবং শুধু সেই মর্যাদাপ্রদর্শনেই সরকারের কার্য সিদ্ধ হয় না, তাহাদের প্রদর্শিত বিকল্প পথগুলি বিবেচনা করিবার সাহস ও সদিচ্ছাও তাহার থাকিতে হয় বই কী! মুশকিল হইয়াছে, এ-দেশে এক্ষণে কেহ সরকারের ভুল ধরাইয়া দিতে উদ্যত হইলেই সরকার তাহাকে দেশদ্রোহী ঠাওরাইয়া লয়, এবং সে যে দেশদ্রোহী সে-কথা সমাজে রীতিমত প্রতিষ্ঠা করিয়া তাহার ধোপা-নাপিত বন্ধ করিবার উদ্যোগ করে।

এই সেবক-শ্রবক যুগ্ম-পরিচয়ের যাথার্থ্য পর্যালোচনার অভিপ্রায় হইতেই আমাদিগের বাসনা হয়, গত সপ্তবর্ষে সরকারের সাফল্যপঞ্জী নিরীক্ষণ করিয়া তাহার মহামূল্যবান মাণিক্যগুলি চয়ন করিবার। বস্তুত সচেতন দেশবাসী হিসাবে আমরাই যদি সেই কাজ শুরু না-করি, তবে কে করিবে? বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদিগের কেহ-কেহ মদীয় প্রধানমন্ত্রীকে পরম বন্ধু বলিয়া কীর্তিত করিয়াছেন ঠিকই— কিন্তু সেই কার্য কি আমাদিগেরই শুরু করিবার কথা ছিল না? দেশের মানুষ কেনই বা এত আহাম্মক হইবেন যে, কারণে-অকারণে সরকারের নিন্দা না-করিয়া জলগ্রহণ করিবেন না?

সেই বিধায়, সমস্ত মে মাস জুড়িয়া আমরা সরকারের গত সপ্তবর্ষব্যাপী কৃতকর্মের এক সংক্ষিপ্তসার রচনায় মনোনিবেশ করিয়াছিলাম। অচিরাৎ বোধগম্য হইল, সে কীর্তিপুঞ্জ এত সুবিপুল যে, আমাদিগের ক্ষুদ্র প্রয়াসে তাহার কেশাগ্রভাগেরও পরিমাপ সম্ভব নহে— পত্রিকার ক্ষীণ পরিসরে তাহা আঁটিবে, তেমন সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত। অতঃপর আমরা অভীষ্ট হইতে সরিয়া আসিয়া তাহার শ্রেষ্ঠ কয়টি মাণিক্য চয়নে ব্রতী হইলাম। সাত একটি অতীব শুভ সংখ্যা— আমাদিগের পুরাণে ও কাব্যে সপ্তর্ষি, সপ্তসিন্ধু, সপ্তাশ্বরথ ও সপ্তপদী গমনের মহিমাবর্ণনেই তাহা সপ্রমাণ, সে কথা স্মরণ করাইয়া বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন, সরকারের অমিত সাফল্যরাজি হইতে আমরা শ্রেষ্ঠ সাতটি বাছিয়া লই না কেন? প্রস্তাব শিরোধার্য হইল, আমরা সাত বৎসরের সেরা সাত কার্যের সন্ধানে লাগিলাম। কিন্তু তাহাতেও দেখা গেল সমস্যা বিস্তর। সাতসহস্রের সিন্ধু হইতে সাতটি সর্বোচ্চ বিন্দুকে বাছিয়া লওয়া অতি দুরূহ কাজ, পরন্তু কোনগুলি কী কারণে সেরার তালিকায় স্থান পাইবে তাহা লইয়া সম্পাদকমণ্ডলীর গণতান্ত্রিক চুলাচুলি চূড়ান্ত পর্যায়ে পঁহুছিল।

এদিকে বেলা যায়, পত্রিকা প্রকাশের সময় ক্রমে আগাইয়া আসে। অবশেষে মাসের ৩১ তারিখ অধিক রাত্রে কোনওক্রমে আটটি বিষয় চূড়ান্ত করা সম্ভব হইল। কিন্তু সপ্তবর্ষের সাতটি মহাফল আমরা বাছিয়া লইব, এই চুক্তি হইতে সরিয়া আসি কী উপায়ে? বিস্তর বিতণ্ডার পর এক মহাভাগ চৌমাথার ফুচকা-বিক্রেতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া সুবুদ্ধি দিলেন, “সে যদি চারিটি খাইলে একটা ফাউ দিতে পারে, তবে আমরা নহি কেন?” এমন জটিল সমস্যার এমন আশ্চর্য সরল সমাধানে অবশেষে ধর্মসঙ্কটের সমূহ নিরসন হইল। সপ্তবর্ষ অতিক্রান্ত সরকারের সেরা সাতটি জনহিতকর কার্যের সহিত একটি ফাউ জুড়িয়া আমরা এক পরমাশ্চর্য অষ্টপদী রচনা করিলাম। রূপে অষ্টপদী, কিন্তু বিষয়শীর্ষে ‘সর্বনাশের সপ্তপদী’ শব্দবন্ধই রক্ষিত হইল— সাতটা কিনিলে একটা ফ্রি!

আলোচ্য প্রচ্ছদভাবনার বিষয়সমূহ সচরাচর আমরা সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করিয়া থাকি। কিন্তু এ-যাত্রায় সরকারকৃত কোন-কোন সর্বনাশগুলিকে আমরা কীর্তিত করিতে চাহিয়াছি, প্রচলিত প্রথার বাহিরে গিয়া তাহা অনুল্লেখিত রাখা হইল। সম্পাদকীয়তেই সেরার তালিকা প্রকাশিত হইয়া গেলে পাঠক বাকি রচনাগুলি পড়িবার ক্লেশস্বীকার না-ও করিতে পারেন, ইহাই আমাদিগের উদ্বেগ ও মন্ত্রগুপ্তির কারণ। কেবল উল্লেখ থাকুক, নিবন্ধগুলি রচনা করিয়া আমাদিগকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিলেন শান্ত মিত্র, অশোক মুখোপাধ্যায়, প্রতিভা সরকার, জয়ন্ত ভট্টাচার্য, সুমন কল্যাণ মৌলিক, সঞ্জীব দেবলস্কর, সৌমিত্র ঘোষ এবং সুশোভন ধর

এতদ্ব্যতীত, গত মাসে যে অনেকানেক বিশিষ্টজন আমাদিগকে ছাড়িয়া গিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে পরিবেশ আন্দোলনের এক মহান নাম সুন্দরলাল বহুগুণা, মানবাধিকার কর্মী ব্রজ রায়ডাঃ স্মরজিৎ জানা, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, অনুবাদক সলিল বিশ্বাস, সাহিত্যিক-সাংবাদিক শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-কে আমরা শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিলাম। গল্প, অণুগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, অন্যগদ্য, ফটোফিচার, ধারাবাহিক ও পুস্তকপরিচয়-আদি অন্যান্য সকল বিভাগ যথানিয়ম প্রকাশিত হইল। থাকিল স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, ডিসট্যান্ট সিগনাল, ভালো খবর-এর ন্যায় বিশেষ বিভাগগুলিও।

পরিশেষে একটি হাঁড়ির খবর জানাই। আপনারা লক্ষ করিয়া থাকিবেন, আমাদিগের কাগজের বিজ্ঞপ্তির নীচে সম্প্রতি একটি শব্দবন্ধের আবির্ভাব ঘটিয়াছে— ‘পাঁচে পা’। ঘটনা হইল, গত মাসে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পাঁচ বৎসরে পদার্পণ করিয়াছে। শিরোনামের নিম্নে এই ঘোষণা দেখিয়া কতিপয় বক্রমতি পাঠক সকৌতুক কটাক্ষ করিয়াছেন, একবার উল্লেখ করিলেই তো যথেষ্ট হইত— আপনার বয়স কোন আহাম্মক সারা বৎসর ধরিয়া সাড়ম্বরে জানাইতে থাকে? আমরা তাঁহাদিগকে সবিনয় জানাইতেছি, সারা বৎসর ব্যাপিয়াই এই ঘোষণা আমরা করিয়া চলিব।

কেন, তাহার কারণ একাধিক। প্রধানতমটি হইল, যে দেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র পত্রিকা ভূমিষ্ঠ হইবার প্রথম বর্ষ পূরণ না-হইতেই অকালমৃত্যু বরণ করে, সেই দেশে একটি সম্পূর্ণত অবাণিজ্যিক প্রকাশনা-উদ্যোগ পাঁচ বৎসর ধরিয়া নিরবচ্ছিন্ন চলিতে থাকিলে তাহা বারংবার ঘোষণা করিবার প্রয়োজন আছে বলিয়াই আমরা মনে করি। যে দেশের সাংস্কৃতিক পরিসর মুখে জগৎ মারিলেও কার্যক্ষেত্রে নবজাতকদের প্রতি এতদূর উদাসীন, ক্ষুদ্র যে কোনও প্রয়াসকণিকাকে বাঁচাইয়া রাখিবার প্রশ্নে এতদূর নিশ্চেষ্ট— সেই দেশে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কিঞ্চিন্মাত্র আনুকূল্য ব্যতিরেকে, কেবলমাত্র পাঠকের উৎসাহ ও সমর্থনকে পাথেয় করিয়া অগ্রসরমান একটি প্রকাশনার পাঁচ বৎসরের আয়ুঃপ্রাপ্তি স্পর্ধিত পুনরুক্তির দাবি রাখে বই কী! আমরা বিশ্বাস করি, এই বারংবার বয়ঃঘোষণা বস্তুত আপনাদের সোৎসাহ সমর্থনের প্রতি আমাদিগের বারংবার কুর্নিশেরই নামান্তর।

প্রণাম নিবেন। পার্শ্বে থাকিবেন…

ইতি—

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,

অভীক ভট্টাচার্য,
৪ জুন ২০২১