অংশুমান দাশ
পরিবেশবিদ ও খাদ্যসুরক্ষা বিশেষজ্ঞ। কবি ও প্রাবন্ধিক
কোনও ফেসবুক পোস্ট নেই, টুইট নেই, ইউটিউব লাইভ নেই— তবুও হাঁটছেন সুন্দরলাল বহুগুণা। কাশ্মির থেকে কোহিমা। ৪৮৭০ কিলোমিটার। কাঁধে পিঠঠু ব্যাগ, তাতে লিফলেট বইপত্র— আর এক মান্ধাতা আমলের স্লাইড প্রোজেক্টর। সে হল ১৯৮১ সাল। তার আগেও হেঁটেছেন, পরেও। মার্ক এলিয়ট জুকেরবার্গ জন্মাচ্ছেন আরও পরে— ১৯৮৪ সালের মে মাসে। ততদিনে, ১৯৮১ সালে পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দিয়েছেন বহুগুণা। সে তো কই ফেসবুক ভাইরাল হয়নি! এইবারে আপনি চটে যাচ্ছেন— বিরক্ত হয়ে বলে উঠছেন, আরে মশাই জুকেরবার্গই নেই, তো ফেসবুক! আমিও তো তাই বলছি— ঠিক কিসের তাড়নায় বহুগুণার এই দৌড়ঝাঁপ? সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার না করে তো কেউ আজকাল ডালে পাঁচফোড়নও দেন না! আচ্ছা আর একটা ধাঁধা বলে রাখা যাক। সুন্দরলাল বহুগুণার মত একজন— যাকে বলে লিভিং লিজেন্ড— বেঁচে ছিলেন, তা তিনি চলে যাওয়ার আগেই বা কতজন জানতেন? তিনি অসুস্থ হওয়ার আগে, ঠিক কতগুলি আলোচনা আপনার নজরে এসেছে— যার উপজীব্য সুন্দরলাল বহুগুণা?
আসেনি। টেক্সট বইয়ে গাছ জড়িয়ে ধরে থাকা কিছু মহিলার ছবিতেই সুন্দরলাল বহুগুণাকে বেঁধে ফেলেছি আমরা। হালে, ২০১৯-২০ সালে ৩৮৫০০ হেক্টর জঙ্গল হারিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি আমরা ভারতে। গাছের আচ্ছাদন কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ[1]। তার আগেই, তার আরও অনেক আগেই সুন্দরলাল বহুগুণাকে আমরা খুন করেছি— যখন সামাজিক বনায়নের নাম করে অ্যাকাশিয়া আর ইউক্যালিপটাস লাগিয়েছি, জঙ্গল কেটে জমি তুলে দিয়েছি কারখানার হাতে, নানা অজুহাতে কুড়ুল চালাতে পিছিয়ে থাকিনি। শুধু নিজের দেশে নয়— অন্য দেশেও। ভারত এখন কাঠ আমদানিতে পৃথিবীর মধ্যে এক নম্বর[2]। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে এই আমদানি বেড়েছে ১৬ গুণ। মালয়েশিয়া থেকে পামতেল আনার ব্যাপারেও আমরা সবার আগে— ওরাংওটাংদের ঘরবাড়ি জঙ্গল কেটে পামগাছ লাগানোর অন্যায়ে আমাদের খাবারেও কালো দাগ।
উত্তরাখণ্ডের গ্রামে গ্রামে ফিসফিসিয়ে ঘুরে বেড়ানো গাছ আর জঙ্গলের উপকথাকে স্লোগান করে তুলেছিলেন তিনি। স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে, জাতভেদপ্রথা বিরোধী একগুঁয়ে আন্দোলন, শিক্ষাবিস্তার— এইসব নিয়ে পাহাড়েই বাসা বাঁধেন বহুগুণা। আর চলতে থাকে পরিক্রমা, পথচলা— মানুষের সঙ্গে, গাছের সঙ্গে, পাহাড়ের সঙ্গে। দেখছেন পাহাড় কেটে রাস্তা, গাছ কেটে শহর— উন্নয়ন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। দেখছেন পুরনো গাছপালার বদলে সোজাসাপটা পাইনের বন কারণ হয়ে উঠছে পাহাড়ে ভূমিক্ষয়ের, ঝরণা শুকিয়ে যাওয়ার, জল ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার। ঘুরে ঘুরে হাজার বারুদ জড়ো করছিলেন বহুগুণা— যে বারুদ ছড়িয়ে ছিল বাড়িতে, উঠোনে, পাহাড়ি মেয়েদের ধারালো কাস্তের আগায়। সেই বারুদ ছড়িয়ে দিলেন আরও, ঘুরে ঘুরে। তাই ১৯৭৩ সালের একদিন, এক কোম্পানির জমি দখলের মুখোমুখি, বুকে বারুদ নিয়ে চোখে চোখ রাখল মেয়েরা, বৃদ্ধ বনস্পতিরা যেন ডালপালা মেলে জড়িয়ে ধরল তাদেরই। বহুগুণার জোর মানুষের এই স্বতঃস্ফুর্ততায়। মানুষ ছাড়া কোথায় সুন্দরলাল— আবার সুন্দরলাল ছাড়া কোথায় মানুষের বুকে রাখা বারুদের সাহস? ১৯৮৩ সালে আইন হল হিমালয়ের বিশেষ বিশেষ জায়গায় গাছ কাটা যাবে না। জুকেরবার্গ তখনও জন্মাননি।
এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা হলে রচনা আসবেই— সুন্দরলাল বহুগুণা। তখন গুগল করে নেওয়া যাবে। কথা বলার আগে, প্রবন্ধ লেখার আগে নেট ঘেঁটে নেওয়া যাবে। নেটে যা নেই— তা এই রোগাপাতলা স্বল্পভাষী সদাহাস্যময় সাদা ফেট্টি বাঁধা মানুষটি এতটা বারুদ ঠিক কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন।
যে বহুগুণার পায়ের কোনও চিহ্নই আমরা আমাদের উঠোনে পড়তে দিইনি— তিনি কোন তাড়নায় এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় ডিঙিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন, গাছ বাঁচানোর জন্য অনশন করেছেন দিনের পর দিন— তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের এখনও হয়নি। আত্মপ্রচারের নারসিসিজম ছাড়াও যে গাছ বাঁচানো যেতে পারে— এই রহস্যটুকু ভেদ করার চেষ্টাই বরং ২০২১ মানুষরা করে যাক।
ততক্ষণ হাঁটতে থাকুন সুন্দরলাল বহুগুণা।
[1] https://www.business-standard.com/article/current-affairs/india-lost-14-tree-cover-amid-covid-rainforest-destruction-up-12-in-2020-121040200371_1.html
[2] https://www.globalforestwatch.org/blog/data-and-research/whats-happening-in-india-forests/