Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বচপন বাঁচাও, ভবিষ্যৎ বাঁচাও…

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

আমাদের যুগটা নাকি সংখ্যাতত্ত্বের, পরিসংখ্যানের। তাই একটা সহজ, সাদামাটা সংখ্যা দিয়েই বরং শুরু করি। একটা সংখ্যা। খুব খাটো কলেবর অবশ্য নয়— ১৫২০০০০০০। বেশ বড়সড় সংখ্যা। পনেরো কোটি কুড়ি লক্ষ— সারা বিশ্বজুড়ে নথিবদ্ধ শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। সংখ্যাটির গাণিতিক পরিসরের মতো এই সমস্যার প্রেক্ষাপটটিও যে গহীন, গভীর তা বোধহয় আলাদা করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। প্রত্যাসন্ন শিশুশ্রমবিরোধী দিবস (১২ জুন)-এর কথা মাথায় রেখেই এই সমস্যার ওপর কিছুটা আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে এই নিবন্ধ।

 

শিশুশ্রম কী?

শব্দটিকে একটি বা দুটি কথায় সংজ্ঞায়িত করা সম্ভবত কঠিন কারণ বয়সের একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে বিষয়টিকে যাচাই করা হয় প্রায় সব দেশেই। তবে সেসব তাত্ত্বিক জটিলতাকে দূরে রেখে সহজ কথায় বলা যায়— কোনও অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালক বা নাবালিকা যখন কোনও জটিল উৎপাদনের কাজে নিজের কায়িক এবং মানসিক শক্তি বা শ্রমকে নিয়োজিত করে তখন তাকে শিশুশ্রম বলে। আর এমন সব কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত থাকে তারাই হল শিশু শ্রমিক।

পৃথিবীর সকল দেশেই সর্বতোমুখী অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সেই দেশের শ্রমশক্তির সক্রিয় ভূমিকা থাকে। এই শ্রমশক্তির জোগান আসে দেশের জনভাণ্ডার থেকে। তাই ইদানিং ‘জনসম্পদ’ কথাটির বহুল ব্যবহার আমরা প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু যে বয়সে মানুষ সবে পৃথিবীর পরিবর্তনশীল কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করছে, সেই বয়সের কচি কোমল প্রাণগুলিকে যদি আয়াসসাধ্য উৎপাদনকর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তাহলে বিষয়টিকে নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়ে বইকী!

 

পরিবার ও শিশু

সেই বহু আলোচিত শব্দবন্ধ থেকেই শুরু করি— ‘বন্যেরা বনে সুন্দর’ আর শিশুরা পরিবারে। পরিবার কাকে বলব? একটি সামাজিক সম্পর্ক যা রক্তসম্পর্কে সম্পর্কিত কিছু মানুষের পারস্পরিক সংযোগ, অধিকার ও মর্যাদার ওপর প্রতিষ্ঠিত। একটি শিশুর মধ্যেই নিহিত থাকে পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন— আগামীর দোলাচলের ইঙ্গিত। এই কারণে শিশুকে ঘিরেই পারিবারিক কর্মকাণ্ডগুলি আবর্তিত হয়, পরিমার্জিত হয়, পরিবর্ধিত হয়। পরিবার শিশুকে নিরাপত্তা দেয়, বিকাশের পথে নিয়োজিত রাখে। পারিবারিক পরিমণ্ডলে, একান্ত আপনজনদের সাহচর্যে, সান্নিধ্যে শিশু যতটা নিরাপদ বোধ করে, অন্যত্র তা কখনওই সে করে না। এমনই এক শিশুকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে অর্থনীতির জোয়ালে জুড়ে দেওয়া হলে তা শিশু তথা সমাজের বিকাশের সহায়ক হতে পারে না, এমনটা কোনও অবস্থাতেই কাম্য নয়।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে পরিবারের সামর্থ, স্বকীয়তা ও সক্রিয়তার বিষয়টি নিয়ে। পরিবার যেমন একটি সামাজিক একক, ঠিক তেমনই একটি পরিবার রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশভাক। রাষ্ট্রের তথাকথিত উন্নয়ন বা বিকাশমুখী কর্মকাণ্ডের প্রভাব একটি দেশের সমস্ত পরিবারে সমানভাবে না পৌঁছালে, রাষ্ট্র প্রস্তাবিত আর্থসামাজিক বিধিনিয়মগুলির সুবিধা সমস্ত পরিবার না পেলে এক ধরনের বৈষম্যের শিকার হতে হয় পরিবারগুলোকে। আর এই বৈষম্য থেকেই জন্ম নেয় অসামর্থ; পরিবার শিশুদের প্রতি তার দায়-দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে না পারায় একটি শিশু ক্রমে ক্রমে শ্রমিক হয়ে ওঠে। পরিবারের অপরিণত সদস্যদের শ্রম বিপণনে বাধ্য হওয়ার এটাই হয়ত করুণ আখ্যান।

পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক বনিয়াদ অনেক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অনেকদিন। ফলে শিশুশ্রমের সমস্যা সেইসব দেশে অনেক আগেই সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। পশ্চিমের পরিবারগুলির আকার তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ছোট, শিক্ষার হার বেশি, কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তে শিল্প আয়ের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বেশি। ফলে একটি শিশুকে কখনওই শ্রম, কায়িক শ্রম, বিক্রি করার কথা ভাবতে হয় না। পরিবারের আবহেই শিশুরা তাদের অধিকারগুলি সম্বন্ধে অনেক অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠতে পারে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এমন কাম্য ব্যবস্থাকে কায়েম করার বিষয়টি এখনও সুদূরপরাহত। ফলে এইসব দেশে এখনও বিপুল সংখ্যক শিশু নানান ঝুঁকিবহুল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলি তাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় সামাজিক সুরক্ষা দিতে অপারগ।

সারা বিশ্বে যে ১৫ কোটি ২০ লক্ষ অপ্রাপ্তবয়স্ক মানবশিশু শ্রম বিনিয়োগে নানা কারণে বাধ্য হচ্ছে তার সিংহভাগই হল ক্রান্তীয় আফ্রিকার (৭.২ কোটি)। বাকি ৬.২ কোটি শিশু শ্রমিকের জোগানদার হল এশিয়া ও ক্রান্তীয় আমেরিকার দেশগুলি। এ এক স্বপ্নহরণ পর্ব। জীবনের সম্ভাবনাপূর্ণ বিকাশ পর্বে একটি শিশু হারাচ্ছে তার আনন্দ-উল্লাস-নিরাপত্তা-শিক্ষা-স্বপ্ন— সব। কেবল শিশুটির নিজস্ব পরিবার নয়, বৃহত্তর সামাজিক তথা রাষ্ট্রীয় পরিবারও এক্ষেত্রে তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে যে ব্যর্থ হচ্ছে সে-কথা বলাই বাহুল্য।

 

শিশুশ্রম— কিছু বাধ্যবাধকতা

‘শিশুরা তাদের শ্রম বিনিয়োগে বাধ্য হচ্ছে’— এই নির্মম সত্যকে স্বীকার করে নিতে কোনও মহলেই আজ আর দ্বিধা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন শিশুরা শ্রম বিনিয়োগে বাধ্য হয়? একটা লেখা লিখেছিলাম বছর কয়েক আগে, প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের শিক্ষা নিয়ে। তিনটি নাবালক শিশু ছিল সেই আলোচনার প্রেক্ষাপটে— একরা, একটি আদিবাসী শিশু; ইরফান— একটি সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য এবং লাদেন— একটি বাস্তুচ্যুত বর্ণহিন্দু পরিবারের শিশু। এদের কথা এই কারণে উল্লেখ করলাম যে নামগুলো নিছকই প্রতীকী। এমনই সব শৈশবহীন শিশুরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে। ওরা কাজ করে— মাঠে-ঘাটে-চায়ের দোকানে-কারখানায়-রাস্তার ধারের গ্যারেজে-গৃহস্থের ঘরে-রেস্তোরাঁ-হোটেলে— না জানি আরও কত কত ক্ষেত্রে। বছর কয়েক আগে একটি পত্রিকার শারদ সংখ্যায় একটা চমৎকার গল্প পড়েছিলাম— ফুলছোঁয়া। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা রাতের অন্ধকার ঘুচে যাওয়ার আগেই চলে যায় চাষিদের ক্ষেতে। কী করে তারা? তাদের নরম, কচি আঙুল দিয়ে পরাগ সংযোগের কাজ করে তারা। পুরুষ ফুলের পরাগ নিয়ে সংযুক্ত করে স্ত্রী ফুলে। গাছ ফলবতী হয়। কৃষকের ক্ষেত পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে ফসলের পসরায়। তার মুখে ফোটে হাসি, পকেট ভরে ফসল বিক্রির লভ্যাংশে। বিনিময় ওই শিশুগুলি কী পায়? মজুরি বাবদ যে সামান্য কয়েকটি পয়সা মেলে তাই দিয়ে ‘লবণচুষ’ও চুষতে পারে না ওরা। অথচ সেই সামান্য পারিশ্রমিকের ভাগীদার গোটা পরিবার। নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া এই সমস্ত প্রান্তিক অর্থনৈতিক পরিবারের শিশুরা ‘জন্ম হইতেই শ্রমের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত’। এক এক ধরনের শোষণ। রাষ্ট্রীয় শোষণ। আর্থসামাজিক অসমতা, সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে নিদারুণ বৈষম্য, জাত-পাত-কৌম-গোষ্ঠীর রক্ষণশীলতা, বিপুল পরিমাণ লিঙ্গবৈষম্য— এ সবই সমস্যার আগুনে ঘৃতাহুতির সমান। তবে দারিদ্র ও অনুন্নয়নের ফলেই শিশুশ্রম বেলাগাম বেড়ে চলেছে, এমনটাও কি ঠিক?

নানান প্রয়াস সত্ত্বেও এ দেশে তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সার্বিক শিক্ষার প্রসার অত্যন্ত কম। ‘শিক্ষা’ শিশুর অধিকার, অথচ সাধারণ খেটেখাওয়া পরিবারের অভিভাবকেরা এই গুরুত্বপূর্ণ অধিকার সম্পর্কে মোটেই সচেতন নন। তাঁদের এই অসচেতনতার কারণে শিশুরা স্কুল-অভিমুখী না হয়ে কর্মস্থল-অভিমুখী হচ্ছে। অনেকেই কর্মস্থলে তাদের পিতা-মাতার সহযোগী। ইটভাটাগুলো এর বড় প্রমাণ। দিনান্তে যে সামান্য মজুরি মেলে তাতে শিশুটির কোনও ভাগ নেই, সবটাই পারিবারিক আয়ের অংশ হিসেবে গণ্য হয়। আসলে এর পেছনেও রয়েছে মুনাফাবাদী বাজার অর্থনীতির খেলা। উৎপাদনকারী প্রাথমিক লক্ষ্য হল মুনাফা বৃদ্ধির তাগিদে মজুরির হার কমানোর উদ্যোগ নেওয়া। শিশুদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগালে পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকের তুলনায় অনেক অনেক কম মজুরি দিয়েই কাজ হাসিল করা সম্ভব হয়। বিড়িশিল্প আতসবাজি তৈরি ইত্যাদি শিল্পে এভাবেই শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফার ঢালাও ব্যবস্থা করা হয়। এই বিধিনিয়মের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার সুযোগ পায় না হতভাগ্য শিশুরা। এক পাকচক্রে আবর্তিত হয় তাদের ভাগ্য। নিজেদের ভাগ্যকে নিজেদের মতো গড়েপিটে নেওয়ার সুযোগ না থাকায় উৎপাদন ব্যবস্থার চৌখুপিতে শিশুরা চিরকাল দাবা খেলার ঘুটিই থেকে যায়। নিজেদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর বিষয়ে ইদানিং আরও বেশি সংখ্যক অভিভাবক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এই প্রবণতাকে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই সমস্ত শিশুরা যথাযথ শিক্ষিত হয়ে উঠলে শিশুশ্রমের সমস্যাকে লাঘব করা অনেকটাই হয়তো সম্ভব হবে।

আর একটি বিষয়েও আমাদের নজর দিতে হবে। তা হল, রাষ্ট্রীয় পরিষেবা ব্যবস্থাকে সমাজের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা। অনেক ক্ষেত্রেই সুযোগসুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়টি উচ্চকিত সরকারি ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ‘সবার বিকাশ’— এই ভাবনাটিকে ইতিবাচক রূপ দিতে হবে কাজের মধ্য দিয়ে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে, দেশের অধিকাংশ মানুষই যদি দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন তাহলে শিশুশ্রম বাড়বে, কেননা সেরকম ক্ষেত্রে শিশুরা পরিবারের আয় বৃদ্ধির স্থূল যন্ত্রে পরিণত হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে এমনটাই ঘটছে বহু বছর ধরে। মানবোন্নয়ন বিষয়টি যদি অবহেলিত হয় তবে শিশুশ্রম বাড়বে।

বাধ্যবাধকতার জায়গাগুলোকে কাটিয়ে ওঠাটা খুব জরুরি। আমাদের সমস্যা হল বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করতে অনেক ক্ষেত্রেই আগ্রহের স্তরে বড় রকমের ঘাটতি রয়ে যায়। আমাদের সন্তানদের এই দুরবস্থার প্রতি একটু মানবিক, সহানুভূতিশীল কি আমরা হতে পারি না?

 

শ্রম বনাম শিক্ষা

এখানে আরেকটা বড় দ্বন্দ্ব রয়েছে, বিশেষ করে পৃথিবীর তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। মানুষের জীবনে শিখনের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দু পাতা পুথির বিদ্যা শিখে পেটের ভাত জোগাড় হবে এমন কথাও হলফ করে বলার মতো গলার জোর নেই। আমার পরিচিত এক মানুষের কথা বলি। পাড়ার ভেতরে একটা ছোট্ট মুদি দোকান চালান তিনি; চাল-ডাল-তেল-নুনের সঙ্গে সঙ্গে নানান টুকিটাকি মনিহারি জিনিস বিক্রি করেন। প্রায় সময় দোকানে ছোটখাটো ভিড় লেগেই থাকে। দোকানটি অবশ্য তিনি একা দেখাশোনা করেন এমনটা নয়— তার ছেলে, মেয়ে মায় স্ত্রী সবাই পালা করে ব্যবসা সামলান। সন্তানেরা স্কুলে যায় বটে তবে তা নিয়ে তাদের পিতার আগ্রহ খুব বেশি নয়। বরং এই বয়সেই তারা কাজকারবার বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছে দেখে তিনি ভারি খুশি। এমন চিত্র সর্বত্র। দোকানে একজন পেশাদার কর্মচারী রাখার খরচ বাঁচিয়ে পারিবারিক আয় বাড়াচ্ছেন বলে তিনি তৃপ্তি পাচ্ছেন বেশ। ‘শিক্ষার আয়োজন’ এক্ষেত্রে ‘শ্রমের প্রয়োজন’-এর কাছে অনেকটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

তবে এমনই এসব কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা শিশুদের ধরে বেঁধে স্কুলে পাঠালেই শিশুশ্রমের কালো মেঘ কেটে যাবে এমন মনে করার কারণ দেখি না। শিক্ষার অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পরেও আমাদের দেশে সমস্ত শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করে তোলা যায়নি। অথচ আইনকে কার্যকর করার আয়োজন নিয়ে বিস্তর প্রচার চলেছে। এর মাঝেই নতুন শিক্ষানীতি কার্যকর করার জন্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সমানে তাল ঠুকছেন। ‘মনকথা’ কইতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত নয়া শিক্ষানীতি কার্যকর করার কথা বলেছেন। নয়া শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনার পরিসর এটা নয়। তাই ওই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এইটুকুই বলব— অতিমারি পর্বে কার্যকর করা এই শিক্ষানীতি গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে বিভেদের প্রাচীর তুলবে, বাড়বে বৈষম্য, যার অনিবার্য প্রতিফলন ঘটবে শিশুশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে। এমনটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়। যে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা লড়াই করে বেঁচে থাকে তাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্টশিক্ষা নিছকই স্বপ্নমোহ বলে মনে হয়। রাষ্ট্র সকলকে শিক্ষা গ্রহণের উপদেশ দেয়, কিন্তু প্রচল শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর উপার্জনের উপায় সম্পর্কে কোনও দায়িত্ব নেয় না। ফলে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে চলে। আসলে শ্রমের বিরুদ্ধে শিক্ষাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে আমরা সকলেই দায়মুক্ত হতে চাইছি। এটা এক ধরনের পলায়নী মানসিকতার প্রতিফলন। শিক্ষার সঙ্গে শ্রমের কোনও বিরোধিতা থাকার তো কথা নয়। তাহলে?

এই বিষয়ে গভীর চিন্তার শরিক ছিলেন দুই যুগন্ধর ভারতীয়— রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধিজি। শ্রীনিকেতনের শিক্ষাসত্রের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন এক গভীর গ্রামশিক্ষার প্রচলন ঘটাতে। শিক্ষাকে পাঠক্রমের ভারমুক্ত করে সহজ কাজের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ‘আত্মপ্রকাশ এবং আনন্দময় জীবনচর্চা’র শরিক করে তুলতে চেয়েছিলেন। দৈনন্দিন বিদ্যালয়কেন্দ্রিক কার্যক্রমের মধ্যে যাতে শিক্ষার্থীরা ভাবী ‘পরিণত জীবনের আভাস’ পায়, তাই ছিল তাঁর শিক্ষাসত্রকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য। অন্যদিকে গান্ধিজি তাঁর বুনিয়াদি শিক্ষার তত্ত্বে হাতে-কলমে কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষা সঞ্চালনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শিক্ষা-পরিকল্পনায় শিক্ষা ও শ্রমকে সংযুক্ত করতে চেয়েছিলেন গ্রামীণ ভারতের বাস্তব সমস্যার কথা মাথায় রেখে। এটা আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে এই সময়ের শিক্ষা-ব্যবস্থাপনায় এই দুই মহান চিন্তকের ভাবনার কোনও প্রতিফলন নজরে পড়ে না। তাই স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা প্রত্যন্ত গ্রামীণ মানুষের কাছে স্বপ্ন ফেরি করেন তথাকথিত ডিজিটাল লার্নিং-এর, ডক্টর-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। শিক্ষার সঙ্গে বৃত্তিকে সংযুক্ত না করতে পারলে শিক্ষা নিছকই সময়ের অপচয় হয়ে দাঁড়ায় একরা, ইরফান, লাদেনদের কাছে। দুঃখজনকভাবে এমনটাই ঘটে চলেছে এতাবৎকাল। তাই গালভরা আশার বাণী না শুনিয়ে এখন সত্যি সত্যি শিক্ষা ও শ্রমের বাস্তবোচিত মেলবন্ধন ঘটাতেই হবে।

 

অতিমারি ও শিশুশ্রম

খুব সম্প্রতি আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রের গবেষণায় নিদারুণ বাস্তবতার এক ছবি উঠে এসেছে। সার্স-কোভ-টু অণুজীব সংক্রমণের দরুন যে ভয়ঙ্কর অতিমারি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে এতদিনকার জোড়াতাপ্পি মারা জীবনযাপনের অনেকটাই বেআব্রু হয়ে পড়েছে। দেশের মুষ্টিমেয় সংখ্যক উচ্চবিত্তের আর্থসামাজিক অবস্থানকে বাদ দিলে বাকি বিপুলাংশের মানুষের জীবনে হতাশার কালো মেঘ জমা হয়েছে। অতিমারির কারণে যে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পথে নামতে বাধ্য হলেন, তাঁদের পরিবারের শিশুদের শিক্ষার কী হবে? দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয়ে না যাওয়ার ফলে তাদের অভ্যস্ত বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে ছেদ পড়েছে শুধু নয়, এই সমস্ত কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের অদক্ষ শ্রমিক বিক্রিতে বাধ্য হয়েছে। সারা বিশ্বজুড়েই বিপুল সংখ্যক উপার্জনশীল মানুষ অতিমারি-জনিত অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রুজিহীন হয়ে পড়েছে। এদেশে আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীনতার শিকার। এই সমস্ত পরিবারের অভিভাবকেরা বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের সন্তানদের শ্রম-বিপণনে। ফলে বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। কর্মহীনতার সমস্যা যে কেবল প্রান্তিক পরিবারগুলোকেই গ্রাস করেছে তা নয়, অসংখ্য নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও এই ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন। সরকার এই সমস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি, ফলে সমস্যার প্রভাব যে গভীর ও সুদূরপ্রসারী তা বোধহয় বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। পাশাপাশি এ কথাটাও মাথায় রাখতে হবে যে পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ হ্রাস পাওয়া মানেই পরিবারের পুষ্টিমান হ্রাস পাওয়া। স্কুলছুট শিক্ষার্থীরা মিড ডে মিলের সুবিধা পায় না। এই অপুষ্টির দায় কে নেবে? প্রথাগত শিক্ষায় বঞ্চিত হয়ে এই সমস্ত শিশুরা অদক্ষ শ্রমজীবী হয়ে উঠছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় এমন শ্রমিকের বিপুল সংখ্যায় উপস্থিতি উৎপাদনব্যবস্থার আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি বেড়েছে গার্হস্থ্য হিংসাও। একটা কথা মনে রাখতে হবে, শিশুর শৈশবকে বাজি রেখে কোনও কাজ করা এক গর্হিত অপরাধ। মনে রাখতে হবে মানুষের জীবনে শৈশব আসে একবার। একে লালন করার দায়িত্বও যে একান্তভাবে আমাদেরই নিতে হবে। এ কথা যেন বিস্মৃত না হই।

 

বচপন বাঁচাও দেশ বাঁচাও

এসো, আজ সবাই মিলে এক নতুন লড়াই শুরু করি— ‘বচপন’ বাঁচানোর লড়াই, আমাদের আগামী প্রজন্মের শৈশব বাঁচানোর লড়াই। এই বছরটি সারা পৃথিবী জুড়ে শপথ নেওয়া হচ্ছে শিশুশ্রমমুক্ত এক পৃথিবী গড়ার। এও এক সংগ্রাম, লড়াই। এ লড়াই জিততে কামান, গোলা-গুলি, বন্দুক, বিদেশ থেকে আমদানি করা বহুমূল্য হাওয়াইযানের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন আমাদের সদিচ্ছার, মানসিক তৎপরতার। এ যুদ্ধ শুরু হোক আমাদের ঘর থেকে, আমাদের অত্যন্ত চেনা প্রতিদিনের চেনা পরিসর থেকে। সমস্যাটি গম্ভীর, বহুমাত্রিক; তাই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার এই লড়াইয়ে সামিল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের সঙ্গে দেশের সার্বিক বিকাশের প্রশ্নটি নিবিড়ভাবে জড়িত। শিশুর শৈশব আমাদের সম্পদ। একে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তাই আমাদের সকলের। আসুন, আমরা আমাদের হাত বাড়িয়ে দিই…।