সৌমিত্র দস্তিদার
প্রাবন্ধিক, তথ্যচিত্রনির্মাতা
ওই ওই যে সেই লোকটা। প্রায় আর্তনাদ করে উঠল অনন্ত। অন্যমনস্ক হয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখতেই দেখি সত্যি বেঁটেখাটো লোকটা কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে খোলাখুলি শাসিয়ে যাচ্ছে বিরোধীদের। সোজাসাপটা হুমকি দিচ্ছে— আমরা তৃণমূল পার্টি করি। আমাদের যারা ভোট দেয়নি তাদের একশো দিনের কাজ কেন, কিস্যু করতে দেব না। ভাঙরের ওই পঞ্চায়েত প্রধানের পাশে বসে চুপচাপ গোটা বিষয়টিতে সায় দিচ্ছেন ভাঙরের আর এক বিতর্কিত তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আরাবুল ইসলাম।
অনন্ত টিভি দেখছে। আর আমি আড়চোখে গরিব ঘরের চাষি পরিবারের ছেলে অনন্তর ফ্যাকাশে মুখটা দেখছি। সেই মুখে তখন একই সঙ্গে ভয়, ঘৃণা ও একরাশ উদ্বেগ। টিভি-ফতোয়ার ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগেই ওই মাস্তানটিকে অনন্ত দেখেছে ভাঙরে, কাঠালবেড়িয়ায়। এক নামকরা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘শিস’-এর সাহায্যে আমরা কয়েকজন মিলে যে করোনা সেফ হোম করেছিলাম এই মাস্তান ও তার দলবল বিনা প্ররোচনায় তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল।
ভাঙরের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এবার জেতেনি। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ তৃণমূলের অভিজাত ডাক্তার প্রার্থী, রাজনীতিক রেজাউল করিমকে আঠাশ হাজার ভোটে হারিয়ে দিয়ে জিতেছেন নতুন দল আইএসএফ-এর তরুণ প্রার্থী নওশাদ সিদ্দিকী। ঘটনাচক্রে, সংযুক্ত মোর্চার শরিক নওশাদ একমাত্র যে মোর্চার হয়ে বিধানসভায় যেতে পেরেছেন। কিন্তু নিজের পরাজয় মেনে নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের ধাতে নেই। বস্তুত বিরোধী স্বর সহ্য করা বা মানা এ দুটি মহৎ গুণ তৃণমূল কংগ্রেসের আছে এটা তার কোনও পরম বন্ধুও মানতে পারবে না।
ফলে নির্বাচনের পরে পরেই শাসক দল যেভাবে দুয়ারে হিংসা নামিয়ে এনেছে তা ভয়ঙ্কর। ভেবেছিলাম তাও এসব নিয়ে কিছু লিখব না। কারণ পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এখন এমন যে চোখের সামনে কাউকে খুন হতে দেখলেও বলা যাবে না। বললেই আপনাকে চিহ্নিত করা হবে আপনি বিজেপির লোক বলে। বলা হবে সবই নাকি বিজেপির আইটি সেলের প্রচার। পাশাপাশি এও শুনতে হবে যে চৌত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সময় এর চেয়ে কিছু কম অত্যাচার হয়নি। ধরে নেওয়া হবে যে আপনি সিপিএম এবং আপনি কখনও কোথাও কোনও অন্যায়ের কোনও প্রতিবাদ করেননি। আর যেহেতু সিপিআইএম একসময় করেছে, তাই তৃণমূল যে কোনওদিন যে কারও বাড়িতে আগুন লাগাতে পারবে। নির্বাচনে জয় যেন তাদের সে অধিকার দিয়েছে। এখন স্ত্রীর সামনেই স্বামীকে টেনে এনে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা যেতেই পারে। যাবতীয় নোংরামি গুণ্ডামি করার নৈতিক অধিকার ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার কারণে শাসক দলের আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক প্রগতিশীল বিপ্লবীরাও খোলাখুলি এই হিংস্র আক্রমণ সমর্থন করে বিবৃতি দিচ্ছেন যে এতবছর মার দিলে আজ পাল্টা তো খেতেই হবে।
অথচ এই গজদন্ত মিনারে বসে থাকা আপাদমস্তক ভণ্ডরা জানেই না দুই ক্ষেত্রেই মার খায় নিতান্তই গরিবস্য গরিবেরা। আর যারা মারে তারা সবসময়ই শাসক-ঘনিষ্ঠ। ক্ষমতার পালাবদল হলেই তারা দল বদলে শাসকদের দলে ভিড়ে গিয়ে অত্যাচার চালায়। এই বাহুবলী মাস্তানদের নির্দিষ্ট কোনও দল নেই। শাসকদের ভাড়াটে গুণ্ডা হয়ে প্রশাসনের মদতে এরা অবাধে সন্ত্রাস চালিয়ে যায় বছরের পর বছর ধরে, রাজনীতির মঞ্চে পালাবদল হলেও এদের শাসন অক্ষুণ্ণ থাকে।
সত্যি কথা বলতে কী, আমি নিজেও এর আগে কখনও এসব ‘ছোটখাটো’ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কোথায় কোন গ্রামে মানুষ মার খাচ্ছে, কে-ই বা শহরে বসে সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়। তার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে ফেবুতে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করা বা দূরে বসে ঠাট্টাইয়ার্কি করে অমুক খারাপ তমুক সাম্প্রদায়িক বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া ঢের ভালো কাজ। এই ধরনের লোকই তো বাঙালি ভদ্রলোক সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমি নিজেও জন্ম-ইস্তক বড় হয়েছি ওই বাবু ভদ্দরলোকের সমাজে। ফলে এতদিন বেশ চলছিল গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে।
কী দরকার আমার, কবে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে ভাঙর কিংবা হাড়োয়ার অজ গ্রাম থেকে টেনেহিঁচড়ে মানুষ খুন করা নিয়ে এই এতদিন পরে অর্থাৎ নির্বাচনের রেজাল্ট বের হওয়ার দেড় মাস বাদে এসব ‘তুচ্ছ বিষয়’ নিয়ে নতুন করে কাটাছেঁড়া করার। যখন জানি এসব নিয়ে বেশি লেখালেখি করলে গণতান্ত্রিক সরকার আমার মতো সামান্য কলমচি, তথ্যচিত্র পরিচালককেও জেলে পুরে দিতে পারে। ভেবেছিলাম, সত্যিই ভেবেছিলাম কিস্যু লিখব না। আমার অধিকাংশ প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধবদের মতই নীরবে ঠান্ডা ঘরে বসে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সংজ্ঞা নিয়ে চর্চা করব। পারলাম না তিনচারজন তরুণদের জন্য। যারা ইলেকশনের দিন থেকে আজ অবধি খেয়ে না-খেয়ে কন্ট্রোল রুম খুলে বিস্তীর্ণ এলাকায় কোথায় কী ঘটছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা নিয়মিত লিখে রাখছেন। শুধু লিখেই রাখছেন না, একের পর এক এফআইআর নথিবদ্ধ করে চলেছেন রীতিমতো কাঠখড় পুড়িয়ে। শুনে রাখুন, এই পশ্চিমবঙ্গে আজ এই মুহূর্তে পাঁচ হাজারের ওপরে মানুষ ঘরছাড়া শুধু গত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি এই ‘অপরাধে’। হাড়োয়া, ভাঙর, দেগঙ্গা, আমডাঙা, মধ্যমগ্রাম, অশোকনগর— পার্শ্ববর্তী গ্রামের পর গ্রামে একই অত্যাচারের ঘটনা। অনেক জায়গায় আমি নিজে গেছি। গভীর রাতে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে অজানা গলা। ফোন তুলতেই অসহায় আর্ত চিৎকার, দাদা বাঁচান আমাদের। প্রাণে মেরে ফেলছে। জনে জনে কথা বলেছি। সেই আর্তনাদ হাহাকার।
যে পাঁচ হাজার ঘরছাড়াদের কথা লিখছি তারা সবাই দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগনার বাসিন্দা। সারা রাজ্যে তাহলে সংখ্যাটা কত হতে পারে তা কল্পনা করতেও ভয় হচ্ছে। ভোট শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেগঙ্গার কদম্বগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের উলা গ্রামের দরিদ্র ক্ষেতমজুর হাসানুর জামানকে স্ত্রীর সামনে যে নৃশংসতায় খুন করা হল তা শুনলে সভ্যজগত শিউরে উঠবে। তারপর যা হয়। পুলিশ তদন্ত করে। নাম কা ওয়াস্তে দু-একজনকে ধরা হয়। টিভিতে কাগজে মাননীয় আধিকারিক বা নেতামন্ত্রীরা জানিয়ে দেন, আইন আইনের পথে চলবে। কয়েকদিন পরে খুন হওয়া পরিবারের লোকজন অবাক হয়ে দেখেন ‘অপরাধী’রা জামিন পেয়ে নিশ্চিন্তে পাড়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাড়াছাড়া, বাড়ি-ভেঙে-দেওয়া লোকজনের তালিকায় একবার চোখ দিতে পারেন। মমিনুল হক, মনিরুল ইসলাম, আলামিন মোল্লা, সিরাজুল ইসলাম, আজাহারউদ্দিন, আলাউদ্দিন মল্লিক এরকম অজস্র নাম। বলা বাহুল্য যে নির্যাতিতরা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। অবাক হবার কিছু নেই। কমবেশি সব জায়গায় ছবিটা এক। যারা মারছে তারাও মুসলিম। মার খাচ্ছে যারা, তারাও মুসলিম। সংখ্যালঘু বলা মাত্র ধরে নেবেন না ধর্মের তাস খেলছি। আসলে আমাদের রাজ্যের সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামোই এমন, যেখানে হতদরিদ্র মানুষের অধিকাংশই আজও সংখ্যালঘু মুসলমান ও নীচু তলার হিন্দু। এই গরিব মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দুদের রক্তের বিনিময়েই আমরা বাবু ভদ্দরলোকেরা ক্ষমতা ভোগ করছি। এই ভদ্রলোক সমাজের রাজনীতির মুরুব্বিরাই জন্ম দেয় ক্রিমিনালদের। ভদ্রলোক গডফাদারদের জোরেই তারা দিনের আলোয় সেফ হোম ভাঙতে পারে। কেউ নিজেদের জন্য পাকা বাড়ি তুলতে গেলেও তাকে টাকা দিতে বাধ্য করে। রাস্তা বানাতে গেলে ঠিকাদারের কাছে বাইক চায়। এমনকি তাদের দলকে সমর্থন না করলে অন্য কাউকে একশো দিনের কাজ করতে না দেবার ফতোয়া দেন।
ভাঙড়কে তো ষাটের দশকের চম্বল বলে মনে হয়। দুটি ব্লকের ১৫টি অঞ্চলের ১৪৪টি গ্রামই এখন সমাজবিরোধীদের আখড়া। ভোটে আইএসএফ জেতার পরে গ্রামে গ্রামে অত্যাচার শুরু করেছে শাসক দলের দুর্বৃত্তরা। বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে আইএসএফ সমর্থক পরিবারের কিশোরীর কন্যাশ্রীতে পাওয়া সাইকেলও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে বিরোধী সমর্থকদের। খোদ এমএলএ-কে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না ভাঙড়ে। এভাবেই তথাকথিত গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘন্টা বাজছে। আর গণতন্ত্রই যদি না বাঁচে তাহলে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নির্মূল করাটা কথার কথা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
কেউ এসব নিয়ে একটিও কথা বলে না। তাদের কথা বলার সময় কোথায়! প্রশ্ন ওঠে না কেন এই প্রান্তিক মানুষগুলো শাসক দলের বিরুদ্ধে গিয়ে ভোটে অন্য ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা করছিল। শহুরে বাবু ভদ্রলোকেরা তখন ব্যস্ত আব্বাস সিদ্দিকী কতটা সাম্প্রদায়িক তাই নিয়ে আলোচনায় বা জোট কেন চরম বিপর্যস্ত সে নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে। পোলেরহাট, কোচপুকুর বা হাড়োয়ার গরিব কৃষিজীবীদের একটাই ‘অপরাধ’— সাম্প্রদায়িক আব্বাস সিদ্দিকীকে সমর্থন করা। আমার অনেক বন্ধুকে বলতে চেয়েছি সঙ্কটের কথা। তারা হেসে আব্বাসকে নিয়ে করা নানারকমের মিম পাঠিয়েছেন। এই হচ্ছে আমার, আমাদের সহনাগরিকেরা। হতে পারে যারা মার খাচ্ছে তারা তথাকথিত সুশীল সমাজে ব্রাত্য। হতে পারে তারা জানে না ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে আটকাতে স্রেফ তৃণমূলকেই ভোট দেওয়া উচিত ছিল। না বুঝে তারা দলে দলে আইএসএফ-কে সমর্থন করেছিল। এখন তাই প্রাণ দিয়ে তাদের সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার নিদান দিচ্ছেন সহনাগরিকদের বড় অংশ। এটাই সবচেয়ে বিস্মিত করছে আজ, এই মুহূর্তে।