প্রদীপ দত্ত
পরমাণুশক্তিবিরোধী সমাজকর্মী ও পরিবেশবিদ
অনেকদিন ধরে মনের মধ্যে সুদীপ্ত (সেন) যেন ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। মে মাসের ছয় তারিখে (২০২১) চলে গেল সে। দ্বিতীয় দফার করোনা ভাইরাস এরকম অনেকেরই প্রিয়জনকে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সুদীপ্তর কথা আলাদা, একমুখ দাড়ি, টকটকে রং, মুখ ভরা হাসি— এপিডিআর-এর এই পুরনো কর্মীকে ভোলা যায় না, যেন সাক্ষাৎ ‘বল-ভরসা’। ওর চলে যাওয়াতে কারও কারও কাছে পৃথিবী আরেকটু কঠিন হল, কেউ কেউ আরও অসহায় হলেন। বেলা থেকে রাত পর্যন্ত সংগঠনের নানা কাজে ছোটাছুটিতে অভ্যস্ত ছিল। আমি তার কোনও কাজে লাগি না, তবু ফাঁকা সময় পেলে চলে আসত। তারপর অনেক কথা হত, ওর কাজকর্ম, আন্দোলন ছাড়াও আনন্দ-বেদনার কথা।
এই তো সেদিন, গত ভোটের কিছুদিন আগে এসে বলল, ‘বিদু বলে একটা মেয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, আলিপুরদুয়ারে বাড়ি, সে বাড়ি গেছে। ৫ আগস্ট (২০২০) রামমন্দিরের শিলান্যাসের পর ও বিজেপি এবং রামমন্দির নিয়ে ফেসবুকে কিছু লিখেছে, গায়ের জ্বালার কথাই বলেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একশোর বেশি লোক জড়ো হয়ে বাড়ি ঘেরাও করেছে। গালিগালাজ শুরু হয়ে গেছে। এই করব, ওই করব নোংরামি করছে, গায়ে লাথি মেরেছে। পুলিশ এসে কোনওরকমে উদ্ধার করে তাকে থানায় বসিয়ে রেখেছে। এরপর এলাকায় বিচারসভা বসেছে। নিজের ও বাড়ির লোকের বিপদের কথা ভেবে সেখানে সে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছে। সে বলছে, এই হচ্ছে আমার অবস্থা, আমি অপমানিত, ক্লান্ত, আর পারছি না। এই হচ্ছে অবস্থা।
বললাম, ‘ঘটনাটা কাগজে পড়েছি। মত প্রকাশ থেকে প্রতিটি সেক্টর ধরে ধরে যদি দেখো একটাও জায়গা নেই যেখানে এদের থাবা বসছে না। ওদিকে দারিদ্র বাড়ছে, মানুষের কাজ, চাকরি-বাকরি দিন দিন কমছে। সিপিএম, তৃ্ণমূলও অত্যাচার করেছে, তবে ফেসবুকে কিছু লিখেছে বলে অত্যাচার করেছে শুনিনি। আমাদের হাঁটা চলা কথাবলার পরিসর কমে আসছে। এত তাড়াতাড়ি রাজ্যের কোথাও এই অবস্থা আমরা আশা করিনি, সবটা জানি না বলেই করিনি।’
সুদীপ্ত বলল, ‘আমরা কত ঘাড় কাত করব, কত নিচু হওয়া সম্ভব। কিছু একটা করা দরকার, অন্তত আমরা যে রাজ্যে রয়েছি সেখানে তাদের আটকানো, ক্ষমতায় না আসতে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ক্ষমতায় আসার সঙ্গে তার রিলেশন নেই বললে হবে না। যেই আসুক এই সিস্টেম থাকবে এটা ঠিক কথা। তার মানে বিজেপি ক্ষমতায় আছে, আর ক্ষমতায় নেই— এই দুই অবস্থার সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকারের, দেশের মানুষের ভালো থাকার কোনও রিলেশন বা ফারাক নেই তা কিন্তু নয়। কী পদ্ধতিতে তা হবে জানি না, কিন্তু যদি রেজিস্ট করা যায় তাহলে মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে। আর এদের রেজিস্ট করা যে সম্ভব— মানুষের মধ্যে এই কনফিডেন্স তৈরি হবে। সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে। আমাদের যেটুকু ক্ষমতা তাতে আমরা কী করতে পারি সেটা ভাবতে হবে। যেটা আদর্শ পরিস্থিতি তার কথা ভেবে লাভ নেই। ইলেকশন হয়ে গেল, তারা ক্ষমতায় চলে এল, তারপরে কিছু করা অত সোজা হবে না। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আর এখানে যদি বিজেপি আসতে পারে তাহলে জাতীয় স্তরেও তার একটা বিরাট প্রতিফলন ঘটবে। তাদের অধরা কিছু রইল না, বিরাট কনফিডেন্স তৈরি হবে। শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করে নয়, অন্যান্য যে ব্যপারগুলো রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। কেন মুসলিম সমাজ নিয়ে ঘেন্না ছড়াচ্ছে— এইটা দিয়ে সাধারণ মানুষকে পথে নামানো যাবে না। বলতে হবে, ও তোমাকে বাঁচতে দেবে না, তোমার সমস্ত কিছু গ্রাস করবে। এই জায়গাটা যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলেই কিছু করতে পারব।’
সুদীপ্ত একটানা বলে গেল, ‘সিঙ্গুরে একটা গণমত ছিল কিন্তু সেভাবে প্রতিরোধ করতে হয়নি। নন্দীগ্রামের প্রতিরোধটা কিন্তু রাষ্ট্র ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর মানুষ যে জনজোয়ার তৈরি করল তাতে রাষ্ট্র হেরে গেল। আজকে যদি আমরা একটা স্লোগানের ভিত্তিতে, একটা বক্তব্যের ভিত্তিতে নন্দীগ্রামের মতো কোনও মিছিল করতে পারি, ওইরকম একটা দুটো মিছিলই একটা সাম্রাজ্য পতনের পক্ষে যথেষ্ট। যদিও এরা ভীষণ অরগানাইজড, তবে কিছুটা অন্তত চমকে দেওয়া যায়। নন্দীগ্রামের ঘটনার সময় সিপিএম ক্ষয়িষ্ণু ছিল। এরা কিন্তু তা নয়। মাটিতে এদের পা আছে। আটকানো অত সহজ হবে না। আমরা যদি একটা বেশ বড় মিছিল করতে পারি তাহলে রেজিস্ট করার জন্য কিছুটা সময় অন্তত পাওয়া যাবে।’
‘২০১৯-এর নভেম্বরে কলকাতায় যে মিছিল হয়েছিল, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, মিছিলে হিন্দু, মুসলমান উপস্থিতি প্রায় ফিফটি-ফিফটি হয়েছিল। রামলীলা ময়দান থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। হাজার দশেক লোক হয়েছিল। এই যে একসঙ্গে হাঁটা, এটাই যদি আরও বাড়ে সোসাইটি অনেক বদলাতে থাকবে। নো এনআরসি-র বিপ্লবদারা মিছিলটা ডেকেছিল, কিন্তু এপিডিআর অ্যাক্টিভলি ছিল।’
‘আসলে মানুষের মধ্যে আমাদের পা নেই, আমরা অনেকটাই অন্তর্মুখী। সেটা যদি থাকত তাহলে আমাদের দশটা মুসলিম বন্ধু থাকে না কেন! কারওই থাকে না, কেন থাকে না বলো? এই মেলামেশাটা নেই। আমরা তো সোশ্যাল অর্গানাইজেশন করি, কিন্তু ঈদের সময় আমাদের দশ-পনেরোটা নেমন্তন্ন কেন থাকে না! এই যদি আমাদের অবস্থা হয় তাহলে আমরা একটা ভাবাদর্শকে, সে যত খারাপই হোক, আটকাব কী করে? ওরা যে সংস্কৃতি আনতে চাইছে তার একটা বিপরীত সংস্কৃতি স্থাপন করা দরকার। এটা শুধু বক্তৃতা দিয়ে হবে না।’
‘আজকাল আরেকটা ব্যাপার চলছে। সবাই কথা বলছে, রামও বলছি, শ্যামও বলছ। কেউ তো কিছু করছে না, শুধু ঘরের মধ্যে বসে কথা বলছে, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে বলছে। তাতে ধান্দাবাজি করাটা বেড়ে গেছে। যদি কেউ একটা স্রোত তৈরি করে তখন কিন্তু অন্যদের খুব অসুবিধে হবে। তখন সমাজেই একটা জিনিস তৈরি হবে— বেশি কথা বোলো না তো। সেটা আমরা কেউ করছি না বলে এই জায়গাগুলোয় জটিলতা তৈরি হচ্ছে।’
‘তবে জালটা ওরা বিরাট ছড়িয়েছে— চারিদিকে সত্যি-মিথ্যা গুলিয়ে দেওয়া, ধর্মান্ধ তৈরি করা হচ্ছে। ওদের মিথ্যে প্রচারগুলো মানুষের কাছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে, মানুষকে অন্ধ করে দিচ্ছে। হাজার হাজার কর্মী আছে যারা সেগুলোকে সমাজে ক্রমাগত ছড়িয়ে চলেছে। কত মিথ্যে প্রমাণ করবে। কত ফ্যাক্ট চেক করবে। গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষ তা করবে কী করে! কত মানুষ তো জানেই না যে দেশে এইরকম মিথ্যের কারবার চলছে।’
কথা ঘুরিয়ে আমি বললাম, ‘এখন তো সরকার বলছে কলকারখানা, রাস্তাঘাট কনস্ট্রাকশন, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে পরিবেশের উপর তার প্রভাব দেখতে হবে না, এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) করতে হবে না, কোনও দায়ই নিতে হবে না। দায় থাকার পর এই চেহারা, দায় না থাকলে কী চেহারা হবে! এখনই পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত কুড়িটা শহরের মধ্যে চোদ্দটাই আমাদের দেশের। দেড় লক্ষ স্কোয়ার মিটারের কলকারখানার জন্য কোনও স্যাংশন নিতে হবে না, ইআইএ করতে হবে না। কলকারখানা যদি পলিউশন করে তাহলে কিছু ফাইন দিলেই হবে, পলিউশন কমানোর দরকার নেই। সীমান্ত এলাকার একশো কিলোমিটারের মধ্যে কোনও প্রজেক্টের জন্য স্যাংশান নিতে হবে না। শেষ পর্যন্ত এক লাখ চিঠি গেল, তাতে তো জাভড়েকর বিরক্ত হয়ে উঠল। এটা একটা দপ্তরের কাজ নাকি! কিন্তু কিছু করার নেই। তুমি তো জনসাধারণের কাছে আলোচনার জন্য দিয়েছ। মানবে না হয়তো, কিন্তু এটা স্বীকার করেছে যে দপ্তর চিঠিতে ফ্লাড হয়ে গেছে।’
সে বলল, ‘আগে যেটা ছিল তার চেহারা আমরা দেখেছি, অনেকটাই লোকদেখানো। লোকদেখানো আইনেও যেটুকু সরব হওয়া যেত এখন সেটুকুও করা যাবে না। সেই সামান্য বাধাটুকুও এরা রাখবে না। আইনের শাসন বলে কিছু নেই তবুও আনুষ্ঠানিক যে শাসন ছিল সেইটুকুও তারা রাখবে না।’
আরেকদিন গাড়ি নিয়ে এসে গাড়িতে বসেই কথা হচ্ছিল। বলল, ‘আমি খুব অল্পই বেরোচ্ছি, যতটা না বেরিয়ে থাকা যায়। আজ তোমার কাছে আসাটা একেবারেই ব্যতিক্রম। আমাদের আত্মীয়স্বজনরা নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বাড়ির বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছি। মেজদির অনেকটা বয়স, গতবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল, একটা আতঙ্ক কাজ করছে। মা আর দিদি দুজনেই বিছানায়, আমার যদি হয় তাহলে বাড়িতে আল্লার নাম করা ছাড়া উপায় থাকবে না।’
‘এর মধ্যে আমার পরিচিত দু-চারজন রোগী সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। শুনলাম সেখানকার ব্যবস্থা খারাপ নয়। তবে যদি দশজনে মিলে একটা বাথরুম ব্যবহার করে, নানা ধরনের লোকজন, সবার অভ্যাস, দায়িত্ববোধ তো সমান নয়, বাথরুমের অবস্থা খারাপ হবেই, বাথরুমটা ব্যবহারযোগ্য থাকে না। সরকারি হাসপাতালের বাকি অ্যারেঞ্জমেন্ট কিন্তু ভালোই। খাওয়া-দাওয়ার কথা যা শুনলাম সে তো যথেষ্ট ভালো।’
বললাম, ‘ওসব কথা থাক, আমি কিন্তু রোজ এক ঘন্টা করে হাঁটছি, ব্যায়ামও করছি, তুমি কী করছ?’
‘আমিও ব্যায়াম করছি, মাঝখানে অনেকটা ওজন কমল। আমাকে যে দেখত সেই বলত, এর মধ্যে এতটা কমিয়ে ফেলেছ! এক একজনের এক একরকম হয়। আমার শরীরের একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে যে ব্যায়াম করলে এফেক্টটা খুব তাড়াতাড়ি পাই, ওজনটা তাড়াতাড়ি কমে। কিন্তু তারপরে কমাতে গেলে ব্যায়াম আরেকটু বাড়াতে হয়। সেটা আর হয়নি। ওই দুদিন করলাম একদিন গ্যাপ হয়ে গেল। লকডাউনটা বিরাট সুযোগ জানি, কাজে লাগাতে পারলে শরীরের অনেক উপকার হবে, দেখি কী হয়! আসলে মনটা যদি ভালো না থাকে তাহলে ও সব হয় না।’
সুদীপ্তর মনের ওপর চাপ কতটা জানি। সব কিছুই আমার সঙ্গে শেয়ার করে। সংগঠনের কাজের নানা চাপ ছাড়াও অনেক বছর ধরে রয়েছে বৈবাহিক সমস্যার চাপ।
সেদিন ব্যক্তিগত কথা বেশি হচ্ছিল। বলল, ‘বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কখনও কোনও চায়ের দোকানে গেলে বাবার কথা মনে পড়ে। আমি হয়তো দোকানদারকে বলি, আমিও কচুরি বিক্রি করি। আরও যদি কথা হয় তখন বলি, আমার বাবার আপনার মত এরকমই দোকান ছিল।’
বলল, ‘এটা কি জানো তো, একটা ফিলিংস। বাবা ভয়ঙ্কর কষ্ট করেছে, শুনলে হয়তো তোমার চোখে জল এসে যাবে। আলুর চপ, এটা-সেটা বিক্রি করত, তা থেকেই বাড়ির জন্য বাঁচিয়ে রাখত, সেগুলো ছিল রাতের খাবার। আমার মা-দিদিরা সেগুলোই খেত। একদিন বেচাকেনা হয়নি, বাবা বলছে, আমি বসে বসে কাঁদছি। কিছুই বিক্রি হয়নি, বাড়িতে কী নিয়ে যাব! তখন একজন সাধু দোকানে ঢুকে খাবারের অর্ডার দিয়েছে। খাবারটা আনতে গিয়ে ফিরে এসে বাবা দেখে সাধু নেই, আর ক্যাশবাক্সের উপরে একটা ফুল পড়ে রয়েছে। তারপর থেকে বাবার অবস্থা ফিরতে শুরু করল। ওই ঘটনাটাকে বাবা ঠাকুরের কৃপা বলে ভাবত।’
‘আসলে তখন তো ওখানে কিছুই নেই, শুধু আমাদের ওই দোকানটাই ছিল। ঊষা কোম্পানি যখন খুলল তখন থেকেই দোকান জোরদার চালু হল। বাবা খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল, কিন্তু পড়াশোনা করতে পারেনি। খুব সাহসী ছিল। সোনারপু্রে ভাগ্নার বিয়ে দিতে গেছে, সেখানে দেখে মাস্তান পেছনে লেগেছে। তখন বাবার সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কেনা হয়ে গেছে। ওই গাড়ির পেছনে বেঁধে সোনারপুর থেকে মাস্তানকে তুলে এনেছে আনোয়ার শা রোডে। আরেকবার— নবীনা সিনেমা হলের পেছনে বাবার সেলাই মেশিনের পার্টস তৈরির কারখানা ছিল। মাস্তানরা চাঁদা তুলতে এসেছে, বাবা বলে আর্মস না দেখালে তো আমি চাঁদা দেব না! এই লেভেলের সাহস! প্রচণ্ড ডেস্পারেট ছিল, হিরো ছিল।’
‘ওই অঞ্চলে বিয়ে হয়েছে অথচ বাবা একটা বড়সড় সাহায্য করেনি এমন হত না। নিজে যেহেতু দারিদ্র ভোগ করেছে তাই খাওয়া-দাওয়া ছাড়া আর কোনও বিলাসিতা ছিল না। খাওয়া-দাওয়া মানে শুধু নিজে খাওয়া না, খাওয়ানোও। আমাদের বাড়িতে বাবার সময় যে খাবার খেয়েছি এখন আমরা সে খাবার খাই না। বলত, টাকাগুলো রাখলে আমি আরেকটা বাড়ি বানাতে পারতাম। বাড়িতে দুরকম মাছ রান্না হত। একটা ঝাল, অন্যটা ঝোল হবে এবং বাজারের সেরা মাছ। আজকে চিংড়ি, কাল কই, পরশু গুলে। একা বাজার করতে পারত না। আমাদের বাড়ির মেম্বারই তখন সতেরোজন। ভাগনা, ভাগনার বউ, ভাগনার ছেলে, কাকা-কামিমা, ভাগনি, মামা, তারপর পিসিরা এসে থাকত। সতেরো-আঠেরোজনের রান্না হত। দুজন মিলে মাছ কাটতে বসত। দোকানেও তখন প্রায় সতেরো-আঠেরোজন। মানে চৌত্রিশজন লোকের বাজার।’
‘এখন তো ক্যাটারার হয়েছে, আমাদের বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে বাবা যা খাওয়াবে, এলাহি ব্যাপার। চিংড়িমাছের মালাইকারি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু হবে। বাড়িতে যে কত বিয়ে হয়েছে ভাবতে পারবে না। পিসিরা খুব গরিব ছিল। অসংখ্য ভাগনা-ভাগনি, তাদের কয়েকটা করে সন্তান আমাদের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। বাবা তাদের বিয়ে দিয়েছে। পরের দিকে পয়সাকড়ি হওয়াতে একটা বোকা বোকা কালচার এসে গেছিল। এগুলো আমি কিছুটা বুঝতে পারতাম।’
একটু থেমে ফের বলল, ‘এই যে আমাকে এক ধরনের লোকে হিংসে করে তার কারণ হচ্ছে আমার এত বড় গাড়ি। সুদীপ্ত একদিকে ওইসব করছে আবার কীরকম বড় গাড়ি নিয়ে চলে দেখেছ! বিচিত্র ব্যাপার! সে তো জানে না, আমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কী! জানলেও বিশ্বাস করত না। বলত ও অন্যভাবে নিশ্চয়ই কিছু করে রেখেছে, দেখায় গাড়ি ছাড়া কিছু নেই। তারা মনে করে আমরা চল্লিশ লাখ টাকার বাড়ি কিনি, সুদীপ্ত মনে করলে কালই দু কোটি টাকার বাড়ি কিনতে পারে। এইরকম বড় গাড়ি, সংগঠনের জন্য এভাবে খরচ করে! তাদের যদি বলা হয় চেনা-পরিচিতের মধ্যে বড়লোক কে আছে বল, বেশ কয়েকজন এ কথাও বলতে পারে যে, কেন সুদীপ্ত! আমি যদি বলি আমার উনিশ-কুড়ি লাখ টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য নেই, তাহলে বিশ্বাস তো করবেই না, ভাববে ঢপ মারছে, ওইটা কিছুই না, দেখা যাবে হয়তো ওর সাউথ সিটিতে ফ্ল্যাট রয়েছে। ‘যে মানুষ এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী, ওমুক-তসুক বিরোধী, সেই লোক ভেতরে ভেতরে এস্টাবলিশমেন্টকে কত শ্রদ্ধা করে! কিন্তু বুঝি ভেতর থেকেই এটা ফাইট করা দরকার।’
‘মানুষ আসলে বিচিত্র, কিন্তু আমরা চাই অর্ডার দেওয়া মানুষ। আমরা যেভাবে বলি বা ভাবি এই পৃথিবীর কোনও কিছুই ওরকম নয়। মানুষ আরও ডায়ালেক্টিকাল, আরও নিঃস্ব। আমরা যা ভাবি তার চেয়েও বেশি। যদি কেউ তার চিন্তা-চেতনাকে উলঙ্গ করে আত্মসমালোচনা করে তাহলেই দেখতে পাবে সে আসলে কী। কেউ হয়তো কাউকে নিয়ে ভাবে, এ তো পুরো ঢ্যামনা। তা কিন্তু নয়। সেই বিচারে সবাই ঢ্যামনা। নিজের বেলায় ভাবি ওই ভুল কাজটা আমি করেছি, আমি কিন্তু আসলে এইভাবে ভাবি। নিজের বেলায় ছাড় দিই, অন্যের বেলায় সেই ছাড় দিই না। লোকের যেখানে যেটুকু ক্ষমতা সেই ক্ষমতা দেখায়, আরও অনেক ত্রুটি থাকে। হয়তো তার নিজের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারও রয়েছে, আবার মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দরদও হয়তো রয়েছে।’
একটু থেমে বলল, ‘আমি দামি গাড়ি চাপি, সেটার কোনও মানে হয় না, সেটা চড়াও কমিয়ে দেব, বাদ দেব ভাবছি।’
আমি জানি সুদীপ্তর ওই গাড়ি চড়াটাই শখ। বহুদিন আগে ওর গাড়িতে করে দু রাতের জন্য বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। তখন তা চাক্ষুষ করেছি। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারে, সারা দিন ধরে পারে, গাড়ি চালাতে ওর ক্লান্তি নেই। এখনও সে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে একইরকম ক্লান্তিহীন। বলে, এটাই তার ভালোবাসা। গাড়ি চালানো ছেড়ে দেবে শুনে ভালো লাগল না। বললাম, ‘এপিডিআর-এর কাজে তোমার কমিটমেন্টের জবাব নেই। তোমার গাড়ি রয়েছে বলে সংগঠনের অনেক কাজ সহজে হয়। গাড়ি চালানো বাদ দেবে কেন?’
কথার উত্তর দিল না। ওর কথা বলেই চলেছে—
‘এমনিতেই আমাদের সংগঠনে নানারকম লোক। কেউ একটু বেশি কথা বলে, কেউ অন্য কিছু একটু বেশি করে। সব ধরনের লোককে নিয়ে চলাতেই আমাদের অভ্যস্ত হওয়া দরকার, সেরকমভাবেই চলি। পশ্চিমবঙ্গের কোথায় লকআপে খুন হবে, কোথায় কী ঝামেলা হবে আর সঙ্গে সঙ্গে লোকে দৌড়বে— এইরকম অর্গানাইজেশন কোথায়? আমাদের রাজ্যে আর কোনও শক্তি নেই যে প্রশাসন, পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করে। একটাই তো অর্গানাইজেশন, এ রাজ্যে এপিডিআর-টাই একটু রয়েছে। মানুষ এবং পুলিশের মনে তা এক বিরাট ব্যাপার। এটাও যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে খুব দুঃখের ব্যাপার।’
‘কেমন হয় জানো, তোমাকে একটা ঘটনা বলি। কিছুদিন আগে মেটিয়াবুরুজে একটা ছেলেকে থানায় মেরে ফেলেছে। আমাকে সেখানকার সংগঠন ডাকেনি, তাও আমি গেছি। পুলিশ কনস্টেবল করেছে কী, গেটের সামনে বন্দুকটাকে আড়াআড়িভাবে রেখে গেট আটকে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, দেখি ভাই একটু— ওটাকে টপকে আগে তো ভেতরে যাব তারপরে কথা। এই সময় আমার শরীরে অন্যরকম জোশ এসে যায়। যেই আমি বন্দুকটা পেরিয়ে গেছি সঙ্গে সঙ্গে সব বাধা ভেঙে গেল, সবাই থানায় ঢুকে পড়ল। বললাম, কোথায় ডিউটি অফিসার? দেখি, ওসি এদিকে আসছে। আমি তার সঙ্গে কেন কথা বলব! ডিউটি অফিসার কোথায়? ওসি বলছে, আসুন। কোথায় যাব? এখানেই কথা বলুন। তুমুল ঝাড়ছি, সে ঢোঁক গিলছে। মাঝেমধ্যেই আমাদের এসবে জড়াতে হয়।’
মানুষের অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁরা নিধিরাম সর্দার, যাঁদের ঢাল তরোয়াল নেই। মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর মনোবলই তাঁদের সম্বল। তার জোড়েই খালি হাতে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন, টক্করে যেতে পারেন। যখন কলকাতায় বা অন্য কোথাও যখন কোনও প্রতিবাদ, মিছিলের ডাক আসে— কৃষ্ণনগর, বনগাঁ, বারুইপুর, বজবজ থেকে প্রতিবাদী মানুষেরা চলে আসেন। দল বেঁধে নয়, বেশিরভাগই আসেন একা একা। এতটা পথ আসা-যাওয়ার সময় ও ক্লান্তি ভুলে। কারও পায়ের ভেতরে হয়তো স্টিলের প্লেট লাগানো, তারপরও টাল খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছেন। কেউ হয়তো ছোটখাটো দোকান চালান, মিছিলের জন্য দোকান বন্ধ করে চলে এসেছেন। পাড়ার বিনা পয়সার হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার, ডাক্তারি বন্ধ রেখে এসে গেছেন। কারও ক্ষীণ চেহারা, পাড়ার লোকে বেরোজগেরে বলেই জানে। অথচ ৩০-৪০ বছর ধরে এইরকম প্রতিবাদে নিয়মিত অংশ নেন। এঁরা আছেন বলেই এই হবু রাজার রাজ্যে এখনও কোনও কোনও রাষ্ট্রীয় অবিচারে পুলিশের শাস্তি হয়। লাগামছাড়া অন্যায় করতে ভয় পায়। অনেকে বিচার পায়, যে বিচার তাদের কাছে ছিল অকল্পনীয়।
সুদীপ্ত বলে চলেছে, ‘আমাদের সংগঠনে কয়েকজন খুব ভালো লোক আছে। একজন আছেন তাঁর শরীর এখন আর পারমিট করে না। তিনি আমাদের কাছে একটা উৎসাহ। তাঁর যেসব ধারণা তার সঙ্গে আমি একমত নই। তর্ক করি, কিন্তু তাঁকে প্রবলভাবে শ্রদ্ধা করি। তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমরা একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলাম। বলতাম গাড়িটা এখান থেকে যাচ্ছে, আপনাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দুদিন বাদে বললেন, না ট্রেনেই যাব। চোখে প্রায় দেখতেই পান না। যদি গাড়ি করে না গিয়ে ট্রেনে যাতায়াত করতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে মারা যান, তাহলে শহিদই বলতে হবে, জেনে বুঝে মরলেন। জানেন যে কোনও সময় বিপদ হতে পারে, কিন্তু তাও ওইভাবেই যাবেন। তাঁর হল খাঁটি ব্যাপার।’
‘যদি জানেন আমি দামি গাড়ি কিনেছি তাহলে সত্যি খুব গাল দেবেন। এইজন্যই তাঁকে শ্রদ্ধা করি, ভয়ে ভয়ে থাকি, একটু আড়াল করে ব্যবহারের চেষ্টা করি। চোখে কম দেখেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। ভাবেন, এরকম কালো রঙের গাড়িই তো ছিল। একবার মেদিনীপুরে যাচ্ছি, আমার পাশেই বসে ছিলেন। বলেন, সত্যি সুদীপ্ত, একটা গাড়িও তোমার আগে যেতে পারছে না। কীভাবে তুমি চালাচ্ছ! প্রতিটা গাড়ি কিন্তু তোমার পেছনে! জানেন না তো এটা এসইউভি, একটা গাড়িকে ধরে ফেলে সেটাকে ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছি। বুঝতে পারেননি ভালোই হয়েছে।’
‘তাঁর কালচারটা কী? বাড়িতে যাও, প্রথমে তোমাকে চপ-মুড়ি খাওয়াবেন, চা খাওয়াবেন, তারপরে সিঙ্গারা-মিষ্টি আসবে। যতক্ষন তুমি থাকবে খরচের শেষ নেই। আবার তুমি যদি বলো, দু হাজার টাকা দিন না আমাদের, সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবেন। কিন্তু বাইরে বেরোলে কখনও ট্যাক্সি চড়বেন না, অসুস্থ থাকলেও না।’
‘আমাদের সংগঠনের আরেকটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে বিপদে আপদে বন্ধুরা পাশে থাকি। এক দাদা বাঁচতই না, তাকে জোর করে নার্সিংহোমে দিলাম। প্রথম স্ট্রোক হওয়ার পর দ্বিতীয় স্ট্রোক হল— পুরো খরচাটা, বাড়ির খরচাও আমরা সাত-আটজন মিলে দিয়েছি। আমাদের মত সংগঠনে এসব ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করে থাকা যায় না।’
‘এই যে ছেলেটা গড়িয়ায় থাকত, তারা দুই ভাই পলিটিক্যাল প্রিজনার হয়েছিল। আমরা কয়েক বছর তাদের ফ্যামিলিটাকে টেনেছিলাম। ওদের মা-বাবাকে কাকারা আলাদা করে দিল, সেই মা-বাবাকে আমরা টেনেছিলাম। আমরা দিতাম, তার সঙ্গে ওই দাদা আমাদের দুই হাজার টাকা করে দিতেন। এই যে ধরো, যার সঙ্গে আমার কোনও পরিচয় নেই কিন্তু আমি তার অভাবটা জানি, তাই সাহায্য করে যাচ্ছি টানা, আমার এখন খেয়াল নেই কত বছর। এইটা কিন্তু আমরা করি।’
‘আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকে সংগঠন করছি, শেখার মধ্যে একমাত্র সংগঠন করাটাই শিখেছি। বিভিন্ন বিষয়ে স্ট্রাগলের ব্যাপারে আমার একটা ভূমিকা ছিল, থাকবে। আমি চাইলেও সেসব ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ করতে পারি না। কাল যদি একটা খুব লোভনীয় প্রপোজাল পেয়ে যাই, তারপরও সেটা অস্বীকার করা আমার পক্ষে খুব কঠিন। কারণ সংগঠনটা শেষ হয়ে যাবে। ঠিক করেছি পুরোটা মন দেব সংগঠনের কাজে। আর কোনও ব্যক্তিগত বা সাংসারিক ঝামেলায় যাব না।’
জানি, সুদীপ্ত আরও সক্রিয় হবে মানে এপিডিআর আরও কার্যকরী হয়ে উঠবে। সে তো আনন্দের কথা, তবু কেমন যেন থম মেরে গেলাম। ও যে পড়ালেখাতেও সময় দেবে বলেছিল! লিখত তো ভালো, তাও কি বন্ধ করে দেবে?
কিছুক্ষণ হল সন্ধ্যা হয়েছে। তখনও বাতাসে শীতের আমেজ ছিল। ওর মুখে সেই হাসি নেই, অন্যমনস্ক হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রয়েছে। দরজা খুলে আমি গাড়ি থেকে রাস্তায় নামলাম। ভাবলাম, এখন নয়, কথা বলব পরে কোনওদিন। সে-ই আমাদের শেষ কথাবার্তা।