সুমন সেনগুপ্ত
রাজনৈতিক ভাষ্যকার, পেশায় বাস্তুকার
শিব ঠাকুরের আপন দেশে
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে পড়ে,
প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,
কাজির কাছে হয় বিচার—
একুশ টাকা দণ্ড তার।
এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থা অনেকটা এইরকম। গাজিয়াবাদে এক বয়স্ক বৃদ্ধ মানুষকে নিগ্রহ করা হল, আর সেখানকার পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেছে কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে কেন তাঁরা এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই কারণে। শুধু তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে পুলিশ সামাজিক মাধ্যম সংস্থা টুইটারের বিরুদ্ধেও এফআইআর করেছে যে কেন তাঁদের মাধ্যমকে তাঁরা ব্যবহার করতে দিয়েছেন এই খবর প্রচার করার জন্য। এখানেও বিষয়টি থেমে থাকেনি। সরকারের তরফ থেকে টুইটারের ইন্টারমিডিয়ারি স্ট্যাটাস অর্থাৎ টুইটারের কোনও দায় নেই এই ধরনের কথা কেউ লিখলে বা শেয়ার করলে, সেই অবস্থানেরও পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার সোজা অর্থ হল, এর পর থেকে যদি কোনও টুইটার ব্যবহারকারী এমন কোনও কথা লেখেন বা শেয়ার করেন যার ফলে দেশের যদি নাকি সার্বভৌমত্ব ‘আঘাতপ্রাপ্ত’ হয়, তাহলে সেই ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে শুধু নয়, টুইটারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? কোনও একজন মানুষকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বলা হবে, তারপর তাঁকে নিগ্রহ করা হবে, তারপর তাঁকে মারাও হবে, কিন্তু কোনও সাংবাদিক যদি এই ঘটনাটিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য টুইটারের মতো কোনও সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করেন তাহলে সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াতে কোনও অন্যায় নেই। একজন মানুষকে নিগ্রহ করলে তা দোষের নয়, কিন্তু তা খবর করলে সেটা দোষের।
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধরে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান সুরে,
নামতা শোনায় একশো উড়ে,
সামনে রেখে মুদির খাতা,
হিসেব কষায় একুশ পাতা।
ভারতবর্ষে এখন এই একুশে আইনই চলছে। বেশ কিছুদিন ধরেই শুরু হয়েছে। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আছে। ভারতবর্ষে তো অনেক সামাজিক মাধ্যম আছে, তাহলে শুধু টুইটারের বিরুদ্ধেই সরকারের এত রাগ কেন? দেখা গেছে ভারতে প্রায় ৫৩ কোটি মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৪১ কোটি, অথচ সেই তুলনায় টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র ১৭ কোটি। তাহলে কেন টুইটারের বিরুদ্ধেই এই সরকারের এত ক্ষোভ? আসলে সরকার বুঝতে পেরেছে যে টুইটার ব্যবহারকারীর একটি অংশ সরকারের হয়ে যাঁরা মিথ্যে প্রোপাগান্ডা করেন তাঁদের স্বরূপ উন্মোচন করে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে সরকারের সমর্থনকারী এক বিরাট অংশের মানুষের তরফ থেকে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয় তার বিরোধিতা করা হয় কিছু সংবাদ সংস্থার পক্ষ থেকে এবং সত্যি কথাকে সামনে নিয়ে আসা হয়, বেশ কিছু অপ্রিয় প্রশ্নকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় সরকারের দিকে, তাই তাঁরা সরকারের চক্ষুশূল। সরকারের বহু দিনের ইচ্ছে এই সংস্থা এবং কিছু বেয়াড়া সাংবাদিক যাঁরা সরকারের দিকে ক্রমাগত প্রশ্ন করছেন তাঁদের পায়ে বেড়ি পরানো। তাতে কী সুবিধে হবে সরকারের?
প্রথমত, সরকার বিরোধী যাঁরা, তাঁরা প্রশ্ন করার আগে দুবার ভাববেন। কিছুটা হলেও শঙ্কা কাজ করবে তাঁদের মনের ভিতরে। যদি অভিযোগ ভুল হয়, তাহলে তো সেই ব্যক্তি মানুষটি গ্রেপ্তার হতে পারেন। দ্বিতীয়ত, টুইটার যেহেতু আইটি আইনের ৭৯ নম্বর ধারায় আর সুরক্ষা পাবেন না, সুতরাং তাঁদেরও একটা দায় বর্তাবে কোনও ব্যবহারকারীর যেকোনও লেখা, ছবি বা ভিডিও যা ‘সরকার বিরোধী’ হবে সেইগুলো তাঁদের মাধ্যমে যাতে না স্থান পায় তা দেখা। তৃতীয়ত, এরপরে যদি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক কোনও পোস্ট কেউ করেন যা হয়তো সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াতে পারে তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে এতে তাঁদের দায় নেই, এবং এখন শুধু এটা টুইটারের দায়িত্ব। সুতরাং সবদিক দিয়েই টুইটারকে চাপে রাখার কৌশল ছাড়া কিছু নয় এটি।