Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দিল্লি হাইকোর্টের রায় মোদি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে

শঙ্কর রায়

 




প্রাবন্ধিক, প্রবীণ সাংবাদিক

 

 

 

We find ourselves unpersuaded and unconvinced with this submission since we find it is not founded on any specific factual allegation and we are of the view that the mere use of alarming and hyperbolic verbiage in the subject charge-sheet will not convince us otherwise. In fact, upon closer scrutiny of the submissions made on behalf of the State, we find that the submissions are based upon inferences drawn by the prosecuting agency and not upon factual allegations.

কথাগুলি দিল্লি হাইকোর্টের দুই বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের গত ১৫ জুন প্রদত্ত রায় থেকে। গত বছর ২৩ মে উত্তর-দিল্লিতে গণতান্ত্রিক ও নিরস্ত্র প্রতিবাদ মঞ্চ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্র-ছাত্রী নাতাশা নারোয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা ও আসিফ ইকবাল তানহাকে ৫০,০০০ টাকা ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দেওয়া ব্যতিক্রমী রায় থেকে উৎকলিত। বিচারপতি সিদ্ধার্থ মৃদুল এবং জয়রাম ভাম্বানি। নাতাশা ও দেবাঙ্গনা জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ছাত্রী, আর আসিফ ইকবাল জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দিল্লি পুলিশ (যা দিল্লির রাজ্য সরকারের নয়, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে, অর্থাৎ অমিত শাহ-র অঙ্গুলিহেলনাধীন) টালবাহানা করেছিল। তিন অভিযুক্তের আইনজীবী দুই বিচারপতির নজরে আনলে তাঁদের ধাতানিতে ১৭ জুন জামিনে মুক্ত করে। দিল্লি পুলিশ এদের ৩৮৮ দিন কারারুদ্ধ করে রেখেছিল।

আদালতে পেশ করা চার্জশিটে দিল্লি পুলিশ বলেছিল, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ ২০২০) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ এবং গত বছর উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হিংসাত্মক এক ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে’ যুক্ত ছিলেন তিন অভিযুক্ত। সেই প্রসঙ্গেই ডিভিশন বেঞ্চের উপর্যুক্ত মন্তব্য, যা তাঁদের রায়ে উল্লেখিত।

গত বছর ২০ অক্টোবর ট্রায়াল কোর্ট তানহার জামিনের আবেদন খারিজ করে বলেছিল যে তিনি দাঙ্গা চালানোর পূর্বনির্ধারিত ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলেন ও সক্রিয় ভূমিকা ছিল, তা সত্য বলেই মনে হচ্ছে। তানহার আইনজীবীরা প্রমাণ দিয়ে বলতে চেষ্টা করেছিলেন যে সে সময় তিনি শহরেও ছিলেন না এবং দাঙ্গা-হিংসা ও হিংসা সংঘটিত হওয়ার মতো প্রতিবাদে ছিলেনই না। কিন্তু ট্রায়াল কোর্ট সে সব শুনতেই চায়নি। এই বছর জানুয়ারিতে ট্রায়াল কোর্ট নাতাশা ও দেবাঙ্গনার জামিনের আবেদনও খারিজ করে দিয়েছিল। ডিভিশন বেঞ্চ সখেদে বলেছে, “We are constrained to express, that it seems, that in its anxiety to suppress dissent, in the mind of the State, the line between the constitutionally guaranteed right to protest and terrorist activity seems to be getting somewhat blurred. If this mindset gains traction, it would be a sad day for democracy.” অর্থাৎ (মোটামুটি বাংলা বয়ান) “আমাদের বাধ্যত অভিমত এই যে ভিন্নমত দাবিয়ে দেওয়ার দুশ্চিন্তায় রাষ্ট্রের মানসে সংবিধান মোতাবেক প্রতিবাদের অধিকার এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মধ্যকার সীমারেখা কিছুটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। যদি এই মানসিকতা জঙ্গম হয়, তাহলে গণতন্ত্রের পক্ষে তা এক বিষণ্ণ অধ্যায়ের জন্ম দেবে।” তাঁরা আরও বলেছেন: Allegations relating to inflammatory speeches, organising of chakka jaam, instigating women to protest and to stock-pile various articles and other similar allegations, in our view, at worst, are evidence that the appellant participated in organising protests, but we can discern no specific or particularised allegation, much less any material to bear out the allegation that the appellant incited violence, what to talk of committing a terrorist act or a conspiracy or act preparatory to the commission of a terrorist act as understood in the UAPA”. (উত্তেজনাকর বক্তৃতা, চাক্কা জ্যাম সংগঠিত করা, নারীদের প্রতিবাদে উদ্বুদ্ধ করা, নানা প্রবন্ধ সংযোজন ও অন্যান্য অনুরূপ ঘটনা-সম্বলিত অভিযোগ আমাদের দৃষ্টিতে বড় জোর আবেদনকারীদের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশগ্রহণের প্রমাণ, কিন্তু আমরা নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে বা বিশেষায়িত করতে পারি না যে আবেদনকারীরা সহিংসতায় প্ররোচিত করেছিলেন। ইউএপিএ প্রয়োগ করা যায় এমন কোনও সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাস-প্রস্তুতিতে যে এঁরা লিপ্ত ছিলেন, তা তো বলাই যায় না।)

বিচারপতি সিদ্ধার্থ মৃদুল এবং জয়রাম ভাম্বানি ইউএপিএ আইন (ধারা ১৫ ও সংশ্লিষ্ট ধারা) সম্পর্কে বলেছেন ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাকে বলা যাবে তা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নয়। হিতেন্দ্র বিষ্ণু ঠাকুর বনাম মহারাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় উল্লেখ করে তাঁরা বলেছেন “অরাজকতা এবং সহিংস কার্যকলাপ বৃদ্ধির একটি রূপ হল সন্ত্রাসবাদ। … একটি ‘সন্ত্রাসবাদী’ কার্যকলাপ শুধু যে আইনের শাসন এবং শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হলেই জন্ম নেয়, এমনটা নয়। এই ধরনের একটি কাজকে অবশ্যই এমন হতে হবে যে সাধারণ আইনরক্ষাকারী সংস্থাগুলি দিয়ে বা সাধারণ অপরাধ-দমন আইন দিয়ে তাকে মোকাবিলা করা যাবে না।” শীর্ষ আদালত সেখানে এও বলেছিল “প্রতিটি ‘সন্ত্রাসবাদী’ই অপরাধী, কিন্তু প্রতিটি অপরাধীকেই কেবলমাত্র যাতে তাদের বিরুদ্ধে টাডা-র কঠোর ধারাগুলিকে প্রয়োগ করা যায় সেই অজুহাতে ‘সন্ত্রাসবাদী’ দাগিয়ে দেওয়া যায় না।” এখানেও দুই বিচারপতি তা উল্লেখ করেছেন।

জামিনে মুক্ত হয়েই এনডিটিভিকে নাতাশা ও দেবাঙ্গনা বলেছেন, “যারাই সরকারের বিরুদ্ধে বলবে, এ সরকার তাদেরই পিঞ্জরাবদ্ধ করতে চায়।” ইউএপিএ ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ছিল বলে অতিমারির সময়েও তাঁদের অন্তবর্তী জামিন দেওয়া হয়নি। কোভিডে নাতাশার বাবা মারা যাওয়ায় সৎকারের কাজের জন্য তাঁকে তিন সপ্তাহের অন্তবর্তী জামিন দিয়েছিল আদালত।

এঁদের সিএএ আইনের বিরোধিতা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরুখ আলম একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘The Citizenship Amendment Act, 2019 (CAA) and its attendant purposes can potentially reconfigure citizenship status. I believe that the prosecution’s case, emanating from the Delhi Police’s First Information Report (FIR) 59/2020 that describes the anti-CAA protests as a terrorist conspiracy to foment trouble, seeks to do much the same. It lays down permissible limits for participatory citizenship by naming certain political articulations as ‘propaganda’, or as being hostile to the elected government, and thus outside the purview of civic action.” নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য।

ইউএপিএ যে প্রধানত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও অসাংবিধানিকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং ভিন্নমতের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার পদদলিত করা হচ্ছে, দিল্লি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় মানবাধিকার সংগঠনগুলির দীর্ঘদিনের এই অভিযোগের যৌক্তিকতা ও বাস্তব সত্যতাকে মান্যতা দিচ্ছে। একথা ঠিক যে ‘গণতন্ত্র হত্যা’ নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ভয়াবহভাবে বেড়ে চলেছে। এর সূত্রপাত কিন্তু কংগ্রেস আমলেই। কিন্তু খোলাখুলিভাবে এত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়নি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) সঙ্গে যুক্ত এমন যারা তথ্য-প্রমাণসহ ইউএপিএ আইন মোতাবেক কারারুদ্ধ হয়েছে, তাদের ছেড়ে দেওয়া বা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুততার সঙ্গে তুলে নেওয়া হচ্ছে— এমন তথ্যও প্রকাশ্যে আসছে।

মোদি সরকারের কড়া সমালোচনা বা প্রতিবাদ জানালে ইউএপিএ ও ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ক ধারায় (সিডিশন) লাগামছাড়া দমননীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। অশীতিপর সমাজসেবী রেভারেন্ড স্ট্যান স্বামীকে গ্রেপ্তার তার নজির। বামপন্থী মানবাধিকার আন্দোলনের সামনের সারির কর্মী ও লেখক এবং ইউএপিএ আইনে বন্দি গৌতম নওলাখার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশ্যন এজেন্সির অভিযোগ তিনি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স)-এর সঙ্গে যুক্ত। এসব মনে করিয়ে দেয় ১৯৩০ দশকের নাৎসি জার্মানির কথা।

ইউএপিএ আইনের প্রয়োগের গণতন্ত্র নিধনকারী স্বরূপ ফুটে উঠেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যানে। ধারা বলে ২০১৬ থেকে ২০১৯-এ ৪২৩১ ব্যক্তির বিত্রুদ্ধে মামলা দায়ের ও ৫৯২২ জনকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র ১৩০৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। অর্থাৎ, ৭৮ শতাংশের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিটই দিতে পারেনি। আর মাত্র ৩০ শতাংশের বিরুদ্ধে অভি্যোগ নথিবদ্ধ হয়েছে।

রাজ্যসভায় এক প্রশ্নোত্তরে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জি কৃষ্ণান রেড্ডি জানিয়েছেন যে ইউএপিএ আইনে  ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র ২.২ শতাংশের সাজা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ আদালতের ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকের একটি সিদ্ধান্ত উল্লেখ্য। বলা হয়েছিল অবৈধ কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) সংক্রান্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইন অর্থাৎ ইউএপিএ-র সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলি নিয়ে পর্যালোচনা করতে হবে, দেখতে হবে কতটা পরিবর্তন আনা হয়েছে এই আইনে (মানে মোদি জমানায়। তা নিয়েই পর্যালোচনা করা হবে।) সংশোধিত আইনকে (anti-terror law) চ্যালেঞ্জ জানিয়ে করা আবেদনের ভিত্তিতে শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল যে, এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা যাচাই করবে তারা এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রকে নোটিসও দেবে। সমাজকর্মী সজল অবস্তির দায়ের করা আবেদনের পরেই সুপ্রিম কোর্ট এই ঘোষণা করে। শ্রী অবস্তির পেশ করা আবেদনে বলা হয়েছিল যে এই আইন মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং একজন ব্যক্তির অধিকারও লঙ্ঘন করে এটি।

কী হল সেই পর্যালোচনা? সুপিম কোর্ট তো অনন্তকাল ব্যাপী এই পর্যালোচনা করতে পারে না!

ডিভিশন বেঞ্চের রায় চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করে। ভেকেশন বেঞ্চের বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত ও ভি রামাসুব্রহ্মমানিয়াম জামিন খারিজ না করলেও বলেছেন যে এই রায়কে কোনও বিচারে প্রয়োগ করা যাবে না— নট টু বি ট্রিটেড অ্যাজ আ প্রিসিডেন্ট। এর ব্যাখ্যা কোথায়? দিল্লি হাইকোর্টের রায়ে তো সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উল্লেখ আছে। এই নির্দেশ কি সাংবিধানিক? এ প্রশ্ন উঠে আসছে।