সমীর ঘোষ
প্রাবন্ধিক, শিল্পী, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
‘শঙ্খ ঘোষ শ্রীচরণেষু’ শিরোনামে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন নবনীতা দেবসেন, ‘ভালোবাসার বারান্দা’য়। ৮ জানুয়ারি ২০১৭ সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকার ‘রোববার’-এ।
নবনীতা দেবসেনের এই লেখার উপলক্ষ শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্তি। নানা বিষয় অনুষঙ্গে ছড়ানো এই লেখা। শেষ করেছেন এইভাবে—
পুনশ্চ: ওঃ হো! মুদ্রাবন্দি হয়ে মধ্যবিত্ত মাথার কী অবস্থা! শঙ্খদার কথা ভাবতে বসে আর জ্ঞানই নেই, কেন লিখছি। আরে আসল কথাই তো লিখতে ভুলে গিয়েছি। এই যে উনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়ে বিশ সাল বাদ বাংলা সাহিত্যকে ভারতসভায় পৌঁছে দিয়েছেন, এজন্য আমরা প্রাণপণ গর্বিত।
নবনীতা দেবসেন মন্তব্য করেছেন—
তিনি পড়াতেন বাংলা সাহিত্য, কিন্তু তাঁর প্রবন্ধ পড়লেই ফুটে ওঠে ইউরোপের বিশ শতকের কবিদের রচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। শুধু কবিতা নয়, বিদেশি কবিদের লেখা গদ্য, সমালোচনা, প্রবন্ধ— সব কিছুর সঙ্গেই তাঁর চেনাশোনা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গে কবির নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধে সেই পরিচয় আমাদের পাঠকে আলোকিত করে।
এই পর্যন্ত বলার পর নবনীতা দেবসেনের অভিমত—
তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক তিনি ছিলেন না, কিন্তু পদে পদে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রাঙ্গণে নিয়ে যান তাঁর পাঠককে। বাংলা থেকে শুরু করে এক প্রকাণ্ড বিশ্বে তিনি পৌঁছে দেন আমাদের।
ক্রমে নানা বিষয় এসেছে লেখায়, ব্যক্তিগত অনুভব আর সাহিত্য প্রসঙ্গ। অতঃপর, ফিরে এসেছেন নবনীতা, তুলনামূলক সাহিত্যে—
তখন নিত্য নতুন বই বেরুচ্ছে শঙ্খদার, পদ্য গদ্য। এক-একটি বইকে ঘিরে আমাদের উত্তেজনার অন্ত নেই। আগেও বলেছি, আবার না বলেই পারছি না, শঙ্খদার পাণ্ডিত্যের বিস্তার বাংলা সাহিত্যের সীমানা ছাড়িয়ে সাত সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেয়। ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ ছাড়া আর কী? সেই কোন সবুজ বয়সে একদা দুই বন্ধুতে মিলে ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত’ পেরিয়েছিলেন লীলাচ্ছলে। সেই থেকেই তাঁদের প্রাণের কেন্দ্রে বিদ্যার, বোধের, সৃজন-কল্পনার বিস্তার দেশকাল পেরিয়ে মনুষ্যজীবনের এক নিহিত ছন্দের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। আজও দুই বন্ধুর সেই অন্তর্লীন যাত্রা ফুরোয়নি। শঙ্খদা আর অলোকদার এই অলোকসামান্য মৈত্রীর মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
২০১৭-র পর ২০২১। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত চলে গেছেন আগেই, তারপর শঙ্খ ঘোষ। আর দুই বন্ধুর সেই অন্তর্লীন যাত্রা ফুরোবার আগে, ত্রস্ত পায়ে ঝটিকা সফরে চলে গিয়েছিলেন সুদূরের পিয়াসী নবনীতা দেবসেন।
***
আমার উপরে যে আলোচনার ভার দেওয়া হইয়াছে ইংরেজিতে আপনারা তাহাকে কম্পারেটিভ লিটারেচার নাম দিয়াছেন। বাংলায় আমি তাহাকে বিশ্বসাহিত্য বলিব।
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বসাহিত্য। সাহিত্য। মাঘ ১৩১৩।
আজ তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে যতটুকু চর্চা, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের ভূমিকা যথেষ্ট। তবে বিশ শতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তুলনামূলক সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্য নামে চিহ্নিত করেছেন— বিষয়টি যথেষ্ট তাৎপর্যবহ।
আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
এইবার আমার আসল কথাটি বলিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে, সেটি এই, সাহিত্যকে দেশকালপাত্রে ছোট করিয়া দেখিলে ঠিকমত দেখাই হয় না। আমরা যদি এইটে বুঝি যে, সাহিত্যে বিশ্বমানবই আপনাকে প্রকাশ করিতেছে, তবে সাহিত্যের মধ্যে আমাদের যাহা দেখিবার তাহা দেখিতে পাইব।
–বিশ্বসাহিত্য: সাহিত্য
রবীন্দ্রনাথ ভাষণ শেষ করেছেন এইভাবে—
এই বিশ্বসাহিত্যে আমি আপনাদের পথপ্রদর্শক হইব এমন কথা মনেও করিবেন না। নিজের নিজের সাধ্য অনুসারে এ পথ আমাদের সকলকে কাটিয়া চলিতে হইবে। আমি কেবল এইটুকু বলিতে চাহিয়াছিলাম যে, পৃথিবী যেমন আমার ক্ষেত এবং তোমার ক্ষেত এবং তাহার ক্ষেত নহে, পৃথিবীকে তেমন করিয়া জানা অত্যন্ত গ্রাম্যভাবে জানা, তেমনি সাহিত্যও আমার রচনা, তোমার রচনা এবং তাহার রচনা নহে। আমরা সাধারণত সাহিত্যকে এমন করিয়া গ্রাম্যভাবেই দেখিয়া থাকি। সেই গ্রাম্য সংকীর্ণতা হইতে নিজেকে মুক্তি দিয়া বিশ্বসাহিত্যের মধ্যে বিশ্বমানবকে দেখিবার লক্ষ্য আমরা স্থির করিব, প্রত্যেক লেখকের রচনার মধ্যে একটি সমগ্রতাকে গ্রহণ করিব এবং সেই সমগ্রতার মধ্যে সমস্ত মানুষের প্রকাশচেষ্টার সম্বন্ধে দেখিব, এই সংকল্প স্থির করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে।
–বিশ্বসাহিত্য। সাহিত্য। মাঘ ১৩১৩
***
শঙ্খ ঘোষের ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রবন্ধ সঙ্কলনকে নবনীতা দেবসেন তুলনামূলক সাহিত্যের লক্ষণাক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু কেন, কী কারণে এই সঙ্কলন গ্রন্থ তুলনামূলক সাহিত্য হিসেবে গণ্য— তার বিশদ ব্যাখ্যায় যাননি। তবে তুলনামূলক সাহিত্যের আর এক কৃতী অধ্যাপক, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অমিয় দেব, ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ নিয়ে লিখেছিলেন অনুষ্টুপ, শঙ্খ ঘোষ বিশেষ সংখ্যা, ১৯৯৪-তে।
অমিয়বাবুর লেখা থেকে—
তাঁর ভারত-আততির এক প্রত্যক্ষ প্রমাণ ইকবাল-চর্চা। আমরা লিখতে বসলেই আমাদের পরিশ্রম ফুটে বেরোয়, শঙ্খ ঘোষ তাঁর পরিশ্রম প্রচ্ছন্ন রাখেন— এতটাই প্রচ্ছন্ন যে মনে হয় কোনও পরিশ্রমই করেননি, কেবল উপলব্ধি থেকে লিখে গেছেন। অথচ ইকবাল নিয়ে তিনি যে পড়াশুনো করেছেন তার সাক্ষী সিমলার ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি যেখানে তিনি ফেলো ছিলেন বছরখানেক। আর সেই শ্রমের ফল এই সঙ্কলনভুক্ত নিবন্ধ দুটিই নয়, ইকবাল থেকে তাঁর যে সম্প্রতি কিছু অনুবাদ বেরিয়েছে, তাও। হয়তো আরও অনুবাদ বেরোবে, হয়তো আরও লিখবেনও— ধরা যাক ইকবাল-রবীন্দ্রনাথ নিয়ে— তবু যেটুকু লেখা ও অনুবাদ পড়লাম তাতে মনে হল ইকবালকে বাদ দিয়ে আমাদের ভারত-ভাবনা অসম্পূর্ণ, বিশেষত এই মুহূর্তে যখন ধর্মের নামে কেউ-কেউ সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বেড়া তুলছেন। ইকবাল ওই সম্প্রদায়ের, অর্থাৎ ইকবাল এই সম্প্রদায়ের নন— এর চাইতে বিপজ্জনক কথা আর কী হতে পারে! ‘কেন ইকবাল’ নিবন্ধে ইকবালের ধর্মাদর্শের স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন শঙ্খ ঘোষ।
অমিয় দেব ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রসঙ্গে আরও একটি বিশেষ দিকের কথা উল্লেখ করেছেন।
…আমি বলছি তাঁর ভারত-আততির কথা। এবং সেই আততিতে যেমন একদিকে আছেন ইকবাল তেমনি অন্যদিকে আশানও। যিনি উল্লুর ও ভাল্লাথোলের মতোই বিশ শতকী মালায়ালাম কবিতার পথিকৃৎ। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে বছর বারো আগে শঙ্খ ঘোষ আশান পুরস্কার পান এবং আশানের জন্মস্থান কৈক্কর গ্রামে তাঁর থাকার সুযোগ ঘটেছিল সেই সূত্রে। আশান স্মৃতিমঞ্চের দ্বারপার্শ্বে যে তৈলচিত্রের উল্লেখ করে তাঁর ‘তিন চণ্ডালী’ নিবন্ধ তিনি শুরু করেছেন সেই চিত্রের উৎস দীর্ঘ কবিতা ‘চণ্ডাল ভিক্ষুকী’ যে আশানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা সে বিষয়ে কারওই সন্দেহ নেই। এবং ‘চণ্ডাল ভিক্ষুকী’ নিয়ে ভাবতে বসলে যে আমাদের ‘চণ্ডালিকা’র কথা মনে পড়বে তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ এক তৃতীয় চণ্ডালীর কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যার স্রষ্টা অকালমৃত সতীশচন্দ্র রায়কে আমরা ভুলতে বসেছিলাম। ঐতিহ্যের বিস্তার ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে এমন শিকড় আবিষ্কারেরও প্রয়াস খুব সুলভ নয় (সতীশচন্দ্রের দীর্ঘ কবিতাটির পাঠ উদ্ধার করে দিয়ে আমাদের বিশেষ কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন তিনি)।
অনুবাদ-ঐতিহ্যের বিস্তার এবং অনুবাদ-বিচার সেই বিস্তারেরই অঙ্গ। এই বিস্তারপর্বে শঙ্খ ঘোষের অবস্থান দ্বিবিধ, কারণ তিনি নিজেও অনুবাদক। আর তাঁর যে অনুবাদ আমাদের শিরোধার্য এবং যার দ্বারা আমাদের ঐতিহ্যের এক বিশেষ বিস্তার ঘটে গেছে তা ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ। ওকাম্পো-চর্চায় যে-উদ্যম আমরা এখন দেখাচ্ছি, এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে পটুত্বও, তার সূচনা শঙ্খ ঘোষেই।”
***
১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় বারোটি প্রবন্ধের সঙ্কলন, শঙ্খ ঘোষের ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’।
প্রথমেই নাম-প্রবন্ধ ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’। এরপর একে একে ‘তিন চণ্ডালী’, ‘কেন ইকবাল’, ‘ইকবাল: প্রতিভার অপচয়?’, ‘চণ্ডীদাস বা দান্তে’, ‘অন্তহীন সিঁড়ি: কাফকা’, ‘পিকাসো: তুলি থেকে কলম’, ‘কতটুকু এলিয়ট’, ‘সেও আমি নই: ওকাম্পো’, ‘লুকাচ আর ঘরেবাইরে’, ‘ধূর্জটিপ্রসাদের রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘পথের পাঁচালী’।
ভূমিকায় শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন—
অন্য দেশ বা অন্য প্রদেশের সাহিত্যচর্চা-জীবনচর্চা প্রসঙ্গে কখনও কখনও কৌতূহল হয় আমাদের। সেটা যে কেবল অন্যকে জানবার জন্যই তা নয়, তার মধ্য দিয়ে নিজেদেরও যেন খানিকটা নতুনভাবে দেখবার সুযোগ পাই। তাই দান্তে বা কাফকা, কুমারন আশান বা ইকবাল— এর যেকোনও লেখকের প্রসঙ্গে ভাবতে গেলে আমাদেরই ভাষার কোনও না কোনও লেখকের প্রতিতুলনার কথা এসে পড়ে, অন্তত পটভূমিতে একটা ছায়া থেকে যায় তার।
বিশ্বপট যতখানি, আমাদের সাহিত্যের সামনে ভারতীয় পট কি ততটা উন্মোচিত? না কি আমরা সঙ্কীর্ণ এক আত্মতৃপ্তির গণ্ডির মধ্যে নিজেদের বেঁধে রাখতে পেরেই খুশি?
এ-ভাবেই ভেবেছিলেন, প্রশ্ন তুলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, যেমন অনেককাল আগে ভাই বীর সিং-এর কবিতা নিয়ে লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী— “সবচেয়ে বড় দূরত্ব, আধুনিক নানা প্রদেশীয় প্রকর্ষ সম্বন্ধে আমাদের নিরুৎসুক মন।”
এর পাশাপাশি শঙ্খ ঘোষ মনে করিয়ে দিয়েছেন—
মৃত্যুর আগের বছরে লেখা ‘অসমাপ্ত আলোচনা’য় জীবনানন্দ ভাবছিলেন: ‘মারাঠি, গুজরাটি, তামিল বা হিন্দি কাব্য যদি এ বিষয়ে ফরাসি বা ইংরেজির স্থান নিতে পারত তাহলে জাতীয় সংস্কৃতির দিক দিয়ে জিনিসটা হয়তো ঠিক হত,’ যদিও তিনি বুঝেছিলেন যে ‘সে রকম কোনও সম্ভাবনা শিগগির আছে বলে মনে হয় না।
‘আমি দশদিকে চাই: ঐতিহ্যের বিস্তার’— শীর্ষক লেখার শেষ অংশে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শিশিরকুমার দাশ মন্তব্য করেছেন—
…ঐতিহ্যের কথা যখনই আমরা বলি তখনই বলি তার কালিক মাত্রার কথা, অতীত আর বর্তমানের সম্পর্কের কথা। কিন্তু ঐতিহ্যের যে বিস্তার তা শুধু কালিক নয়, স্থানিকও বটে। আর তার ফলে আমার নিজস্ব বাংলা থেকে বিস্তারিত হতে চাই বৃহত্তর ভারতবর্ষে, ভারতবর্ষ থেকে অব্যবহিত ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতির সীমান্ত পার হয়ে আরও বড় বিশ্বে। অবশ্যই এই বিস্তারের প্রেরণা সহজ-সরল-অনায়াস নয়, অনায়াস নয় এই বিস্তারের প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে জড়িত আছে আমাদের ‘অন্য’-এর প্রতি মনোভাব, ক্ষমতার চক্রান্ত, আধিপত্যের রাজনীতি। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই তো ক্রমাগত আবর্তিত হয়ে চলেছে মানুষের ইতিহাস, মানুষের কবিতার ইতিহাস এবং আধুনিকতার ইতিহাস। ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ শুধু সেই জন্যই এক স্মরণীয় রচনা: এক সংবেদনশীল কবির আত্মজিজ্ঞাসা।
–অনুষ্টুপ, শঙ্খ ঘোষ বিশেষ সংখ্যা, ১৯৯৪
***
১৯৫৬ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় নতুন বিষয়— ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ পাঠক্রম। এর সূচনা হয়েছিল কবি বুদ্ধদেব বসুর তৎপরতায়। শুরুর দিনের কথা শুনিয়েছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘বুদ্ধদেব বসু, তুলনামূলক সাহিত্য ও একজন পল্লবগ্রাহী’ শীর্ষক রচনায় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—
বুদ্ধদেব সেদিন এই নতুন বিষয় নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন। আর বলেছিলেন, বিষয়টা যখন এখানেই পড়ানো হচ্ছে, তখন অন্তত একটু বেশি জোর দেওয়া হবে ভারতীয় সাহিত্যের ওপরে— এপিক পড়ানো হবে— তবে শুধু হোমার ভার্জিল নয়, রামায়ণ, মহাভারতও, পড়ানো হবে গীতা, উপনিষদ, ধম্মপদ আর জাতকের গল্পও। পড়ানো হবে বাংলা সাহিত্য— মধ্যযুগ থেকে আধুনিক একেবারে সমকালীন কবিতা ও কথাসাহিত্য। পড়তে হবে দান্তে, আর ইতালির সাহিত্যের নিদর্শন। জার্মান থেকে গ্যয়টে, শুধু ফাউস্ট নয়, তরুণ হের্টেবের মৃত্যুও, আর তাঁর ডিভান পড়ার জন্যে লক্ষ রাখা হবে হাফিজের ওপরেও। রোমান্টিকতা থেকে প্রতীকীবাদ, কবিতার সাত-পাঁচ। পড়তে হবে পুশকিন, দস্তয়েভস্কি, তলস্তোয়। পড়তে হবে যেমন ভিক্টর উগো, তেমনই বোদলেয়ার, র্যাঁবোও। আধুনিক জার্মান সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে পড়তে হবে টোমাস মান বা হেরমেন হেসসেকেও। টোমাস মানের ‘মস্তক বিনিময়’ পড়বার সময় খেয়াল থাকবে বেতাল পঞ্চবিংশতি-র মূল কাহিনিটাকেও। ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কথা।
‘বিশ্বসাহিত্য’ শীর্ষক রচনায় রবীন্দ্রনাথ তুলনামূলক সাহিত্যের নামকরণ করেছিলেন— ‘বিশ্বসাহিত্য’। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখায় মন্তব্য করেন— “বস্তুত তুলনামূলক সাহিত্যের সূচনা যদি কোথাও ঘটে থাকে, তবে রবীন্দ্রনাথের ওই ভাষণেই।”
***
তুলনামূলক সাহিত্য পড়বার জন্য ছাত্রছাত্রীদের হাতে একটি নির্ভরযোগ্য বাংলা বই তুলে দেওয়ার কথা মনে রেখে শ্রী সুমন গুণ সম্পাদনা করেছেন ‘তুলনামূলক সাহিত্য/একটি তির্যক প্ররোচনা’ নামের সঙ্কলন। রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বসাহিত্য’ দিয়ে শুরু। আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শকুন্তলা মিরন্দা এবং দেসদিমোনা’। এই রচনা তুলনামূলক সাহিত্য পাঠক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন, যদিও বঙ্কিমচন্দ্রের সময়কালে তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়টির আবির্ভাব হয়নি বলেই মনে হয়। কেমন ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের সেই রচনার গঠন ও উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য? দেখা যাক।
প্রথম, শকুন্তলা ও মিরন্দা:
উভয়েই ঋষিকন্যা; প্রস্পেরো ও বিশ্বামিত্র উভয়েই রাজর্ষি। উভয়েই ঋষিকন্যা বলিয়া অমানুষিক সাহায্যপ্রাপ্ত। মিরন্দা এরিয়ল-রক্ষিতা, শকুন্তলা অপ্সরোরক্ষিতা।
উভয়েই ঋষি-পালিতা। দুইটিই বনলতা— দুইটিরই সৌন্দর্যে উদ্যানলতা পরাভূতা। শকুন্তলাকে দেখিয়া রাজাবরোধবাসিনীগণের ম্লানীভূত রূপলাবণ্য দুষ্মন্তের স্মরণপথে আসিল;
দ্বিতীয়, শকুন্তলা ও দেসদিমোনা:
শকুন্তলার সঙ্গে মিরন্দার তুলনা করা গেল— কিন্তু ইহাও দেখা গিয়াছে যে, শকুন্তলা ঠিক মিরন্দা নহে। কিন্তু মিরন্দার সঙ্গে তুলনা করিলে শকুন্তলা-চরিত্রের এক ভাগ বুঝা যায়। শকুন্তলা-চরিত্রের আর এক ভাগ বুঝিতে বাকি আছে। দেসদিমোনার সঙ্গে তুলনা করিয়া সে ভাগ বুঝাইব, ইচ্ছা আছে।
শকুন্তলা এবং দেসদিমোনা, দুইজনে পরস্পর তুলনীয়া, এবং অতুলনীয়া। তুলনীয়া— কেননা, উভয়েই গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। গৌতমী শকুন্তলা সম্বন্ধে দুষ্মন্তকে যাহা বলিয়াছেন, ওথেলোকে লক্ষ করিয়া দেসদিমোনা সম্বন্ধে তাহা বলা যাইতে পারে—
রচনার উপস্থাপনা ও গঠনরীতি দেখে বোঝা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র তিনটি চরিত্রকে মিল-অমিলের নিরিখে মূল্যায়ন করেছেন। দেশের বেড়া ভেঙে বিশ্বসাহিত্যের ব্যাপ্ত পরিসরে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। সাহিত্য-বিচারের এ-এক ভিন্নতর দিশা সন্ধান। শিশিরকুমার দাশের কথায়— “আমার নিজস্ব বাংলা থেকে বিস্তারিত হতে চাই বৃহত্তর ভারতবর্ষে, ভারতবর্ষ থেকে অব্যবহিত ইতিহাস-ভূগোল-রাজনীতির সীমান্ত পার হয়ে আরও বড় বিশ্বে।”
নবনীতা দেবসেন যদিও উল্লেখ করেছেন শঙ্খ ঘোষের ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ ছাড়া আর কী! অথচ সুমন গুণ সম্পাদিত ‘তুলনামূলক সাহিত্য/একটি তির্যক প্ররোচনা’ সঙ্কলনে গৃহীত হয়েছে শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধ ‘রেখানাট্যের নটী’। প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে ‘ইশারা অবিরত’ (১৯৯৯) গ্রন্থ থেকে। ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ থেকে নয়। তবে কি ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রবন্ধ সঙ্কলনের মত ‘ইশারা অবিরত’ প্রবন্ধ সঙ্কলনও তুলনামূলক সাহিত্য পাঠ হিসেবে গণ্য! অবশ্য শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধ ও গদ্য রচনা প্রসঙ্গে নবনীতা দেবসেন যে মন্তব্য করেছেন তা যথেষ্ট তাৎপর্যবহ। তাঁর মতে— “…তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক তিনি ছিলেন না, কিন্তু পদে পদে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রাঙ্গণে নিয়ে যান তাঁর পাঠককে। বাংলা থেকে শুরু করে এক প্রকাণ্ড বিশ্বে তিনি পৌঁছে দেন আমাদের।”
***
‘রেখানাট্যের নটী’ প্রবন্ধের শুরুতেই শঙ্খ ঘোষ উপস্থিত করেছেন ভিন্ন দুই শিল্পমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পর্ক, অন্বয়ের কথা—
বতিচেল্লির একটি ছবির সামনে দিনের পর দিন বসে থাকতেন ইসাডোরা ডানকান। তাঁর মনে হত সে ছবির ফুলগুলি যেন প্রাণ পেয়ে জেগে উঠছে, নৃত্যপর হয়ে উঠছে শরীর, যেন এক আনন্দের খবর বয়ে আনছে ছবিটি। মনে হল, একদিন এই ছবির রহস্য যদি ঠিকমতো তিনি বুঝতে পারেন, জীবনের ঐশ্বর্য আর মাধুর্য তবে তিনি ভরে দিতে পারবেন তাঁর নিজের নাচের মধ্যে।
তৈরি হয়েও উঠল সেই নাচ একদিন। তার নাম দিলেন ইসাডোরা: The Dance of the Future। বতিচেল্লির ‘প্রিমাভেরা’ ছবিটি থেকে জন্ম হল স্মরণীয় একটি নাচের।
কেন চিত্রশিল্পী বতিচেল্লি, কেনই বা নৃত্যশিল্পী ইসাডোরা ডানকান প্রসঙ্গ এল এই প্রবন্ধে? আসলে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি এবং নৃত্য বিষয়ে, তাদের পরস্পরের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে শঙ্খ ঘোষ কিছু কথা বলতে চান। তাঁর কথায়—
…এ তো আমরা ভুলিনি যে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই দুই শিল্পের সূচনা ছিল প্রায় একই কালে, তাঁর জীবনের শেষ দশটা বছর তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন একই সঙ্গে এই দুয়ের মধ্যে, একটির সূত্রে অনেক সময় তাঁর মনেও পড়ে যেত অন্যটির কথা।
শঙ্খ ঘোষ আরও একটি সূত্রের উল্লেখ করেছেন—
মনে পড়বে প্রতিমা দেবীর ‘নৃত্য’ বইটির প্রচ্ছদ— ছবিগুলি আঁকা হয়েছিল ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে, বোম্বাইতে, ‘তাসের দেশ’ অভিনয় হচ্ছিল তখন। ছবিগুলির মধ্যে একটিতে যে ‘তাসের দেশ’-এরই চিহ্ন লেগে আছে, সে কথা মনে করা অসঙ্গত নয়। কিংবা ভাবুন, শুধুমাত্র রেখার কয়েকটি টানে তৈরি করে তোলা কোনও নর্তনশীল রূপ, অন্যগুলির মত সম্পূর্ণ নাচটি নয়, সেই নাচের ছন্দময় সীমারেখাগুলি শুধু একটি যেমন অনেকদিন ধরে পরিচিত হয়ে আছে প্রবোধচন্দ্রের ‘ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ’ বইটির প্রচ্ছদ সূত্রে।
রূপের বেদনায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই রেখারই একটি দিক দেখা দেয় তাঁর ছবিতে, অন্য একটা দিক দেখা দেয় শারীরিক বিভঙ্গে, নাচে। ছবিকে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে ‘রেখানাট্যের নটী’, অন্য একদিকে সেই রেখানাট্যের সজীব নটীকেই আবার দেখতে পাওয়া যায় মঞ্চে, তার শরীরের প্রত্যক্ষ রেখায় রেখায় কথার ছন্দ তুলে আনে সে-নটী, আর সেইখান থেকে রবীন্দ্রনাথ গড়ে তোলেন তাঁর নাচ, তাঁর নৃত্যনাট্য। নাচ আর ছবিকে এইভাবে তিনি মিলিয়ে নেন এক ছন্দোময় রেখায়, বতিচেল্লির ছবি থেকে যেমন এক রেখার ছন্দকে শরীরে তুলে নিয়েছিলেন ইসাডোরা ডানকান।
***
‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রবন্ধ সঙ্কলনের প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৮৯। আর, ‘ইশারা অবিরত’ প্রবন্ধ সঙ্কলনের প্রথম প্রকাশ: ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, দশ বছরের ব্যবধানে। সঙ্কলনের ভূমিকায় শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন—
ছবি বা গান, ফিল্ম বা থিয়েটার, এসব বিষয়ে কখনও কখনও দু-একটি লেখা লিখতে হয়েছে। কবিতার সঙ্গে এদের সম্পর্ক, অথবা এদের পারস্পরিক কোনও সম্পর্ক, এ-প্রসঙ্গও কখনও বা এসে গেছে সে-লেখায়। বিভিন্ন শিল্পরূপ নিয়ে সেইসব অল্প কয়েকটি প্রবন্ধের এই সঙ্কলন। একজন সাধারণ দর্শক বা শ্রোতার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই প্রবন্ধগুলি তৈরি হয়েছিল, এখানে কোনও বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ নেই, সম্ভাব্য পাঠকেরা অনুগ্রহ করে একথা যেন মনে রাখেন।
ভূমিকার পরবর্তী অংশে শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন—
আমার নিজের লেখায় অন্য শিল্পের স্পর্শ কোথাও ছিল কিনা, এরকম একটা সরাসরি জিজ্ঞাসার উত্তরে লিখতে হয়েছিল সঙ্কলনের প্রথম প্রবন্ধটি। সেই কারণে এই বিশেষ লেখাটি যে একটু বেশিমাত্রায় আত্মকথনমূলক হয়ে উঠেছে, সসঙ্কোচে সে-কথাও জানিয়ে রাখি আগে।
কীভাবে ধরা পড়ে কবিতায়, বাইরের কোনও দৃশ্য, অনুভবের অভিঘাত! শঙ্খ ঘোষ, নিজেই উন্মোচন করেছেন তাঁর ‘ইশারা অবিরত’ নাম-প্রবন্ধে।
কোথায় যে কখন কোন ইশারা কাজ করে যায়, তার কোনও হিসেব থাকে না আগে। জলপাইগুড়ির ঐতিহাসিক বন্যায় অনেক দুর্যোগের মধ্যে একটা ছিল হাত-বাড়িয়ে-দেওয়া এক মুমূর্ষ মানুষের অসহায় ভেসে-যাওয়া, স্রোতের টানে রক্ষার্থীর আঙুল তাকে ছুঁয়েও ছুঁতে পারছে না, আর ওই দৃশ্যের সামনে একেবারে বিপ্রতীপভাবে— হয়তো অসঙ্গতভাবেও— চোখে ভেসে ওঠে সিস্টিন চ্যাপেলের ছবি ‘আদমের জন্ম’, প্রসারিত দুই বিপরীতমুখী হাতের মধ্যবর্তী ক্ষীণ ব্যবধানের অপরিমেয় বিস্তার যেন ভেসে ওঠে একবার, লেখা হয়ে যায় “আদমের জন্ম নয়”: ‘আমার দক্ষিণ হাতে ওর হাত মেলে না ঈশ্বর’। হয়তো এভাবেই গানের জগৎকে ছবির জগৎকে ভাস্কর্যের জগৎকে বা এমনকি চলচ্চিত্রের জগৎকে যখন দেখতে থাকেন কবি, তার থেকে নানারকম ইশারা তিনি তুলে নিতে পারেন অবিরত, তুলে নেনও, তাঁর নিজের সৃষ্টির কাজে।
অবিরত ইশারার সন্ধানে, মেরুপ্রমাণ দূরত্বের মধ্যেও আশ্চর্য সাদৃশ্যের সন্ধানে ব্রতী থাকেন শঙ্খ ঘোষ, তাঁর প্রবন্ধে, ব্যক্তিগত ভাবনার জার্নালে তার ছাপ স্পষ্ট।
***
১৯৭৮ সালে, এক বছরের শান্তিনিকেতন-বাসের সময়ে, প্রায় প্রতি রাতেই কিছু-না-কিছু লিখে রাখবার একটা অভ্যাস হয়েছিল। লিখবার সময়ে জানতাম সেগুলি নিভৃত এবং ব্যক্তিগত; তাই, যখন-যেমন-খুশি লিখতে কোনও বাধা ছিল না একেবারেই। বছর শেষ হল, খাতাও হল শেষ। ফিরে এলাম কলকাতায়।
২৫শে বৈশাখ ১৩৯২, প্রকাশিত হল ‘জার্নাল’, শঙ্খ ঘোষ যাকে বলছেন, ‘নিভৃত এবং ব্যক্তিগত’।
এই নিভৃত এবং ব্যক্তিগত জার্নালেও শঙ্খ ঘোষের ভাবনা, লিখন-ভঙ্গিমায় ছড়িয়ে আছে পরিচিত শৈলী। একের সঙ্গে অন্যের মিল-অমিলের তুল্যমূল্য বিচার। বা বলা যায় জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে রচনার বৈশিষ্ট্য সন্ধান। কেমন সেই সন্ধান, ‘জার্নাল’ থেকে তার দু-একটা নমুনা দেখা যাক।
‘কবিতার ভাষা’য় শঙ্খ ঘোষ লিখছেন—
একজন বন্ধু লিখেছেন সেদিন, জীবনানন্দের ভাষা তাঁর কাছে কোনও কিছুর বাহন নয়, না আবেগের না প্রজ্ঞার। ভাষাই নাকি তাঁর সেই চৈতন্য যাতে ‘নিখিল প্রপঞ্চের উদ্ভাস ঘটে’। আর তাঁর সমকালীন অন্য কবিদের ভাষা সামাজিক, বাচনিক, অর্থাৎ ভাষা দিয়ে তাঁরা কিছু একটা ব্যক্ত করেন।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন শঙ্খ ঘোষ, জীবনানন্দের কবিতায়। সঙ্গে এনেছেন শক্তি উৎপল— এঁদের কবিতা। আর এসেছে অনিবার্যভাবেই কবি মালার্মের প্রসঙ্গ। এসেছে গ্যয়টে-একারম্যান, রবীন্দ্রনাথ, পাবলো নেরুদা-লোরকা কিংবা গিন্সবার্গের প্রসঙ্গ। স্বল্প পরিসরে, যেমন খুশি লেখবার নির্ভার আয়োজনেও শঙ্খ ঘোষ এড়াতে পারেননি তাঁর স্বকীয় প্রকাশশৈলী। তাঁর লিখন ভঙ্গিমা।
আরও একটি উদাহরণ জার্নাল থেকে, নাম: বৃষ্টি।
আজ বিকেলের বৃষ্টিতে যখন ঘরে বন্দি, সঙ্গে ছিলেন দর্শনের দুই বন্ধু।” সময় কাটানোর কারণেই শঙ্খ ঘোষ কথা তুললেন— “এটা কেন হয় যে বৃষ্টিতেই স্মৃতির টান পড়ে বেশি?” জিজ্ঞাসার উত্তরে এক-একজন তাঁদের নিজের নিজের অনুভবের কথা বলেছিলেন। যেমন, “মানসীদির কথা হল, বৃষ্টির শব্দটাই আসল। সেই শব্দ আমাদের পুরনো এমন অনেক অভিজ্ঞতাকে টেনে নিয়ে আসে যেখানে অনুরূপ কোনও শব্দ হয়তো ছিল। আর, শব্দ নেই বলেই, তুষারপাতের সময় এ-রকম অনুভূতি হয় না, বিদেশে উনি লক্ষ করেছেন।
“তাই কি? তুষারপাতে আমাদের যা অভিজ্ঞতা হবে, ও-দেশের মানুষেরও কি তেমন? উনি অবশ্য বলতে চান তা-ই, সেইজন্যই নাকি সমারসেট মমকে গল্প লিখতে হয় ‘বৃষ্টি’, তুষার তো নয়।” এই উত্তর শঙ্খ ঘোষের মনে হয়েছে— “এ বোধহয় অতি-সরলীকরণের দৃষ্টান্ত।” আর জবাবে তিনি তুলে আনেন একের পর এক উদাহরণ—
ফেলিনির ‘আমারকড’ ছবিতে যে নিবিড় তুষার-আবহ ছিল, গোটা একটা শহরের সত্তা যেভাবে মথিত এক মদিরতায় ডুবে যাচ্ছিল সেখানে, তাতে তো মনেই হয় যে তুষারপাত ওখানে টান দিতে পারে সকলেরই মূল পর্যন্ত! আর, ছবির কথাই বা কেন! বিদেশের গল্পে বা কবিতায় প্রায়ই কি জড়িয়ে আসে না এই আবহ? ব্রিজেসের ‘লন্ডন স্নো’ কবিতায় সকলের মন কি বেরিয়ে আসছিল না প্রতিদিনকার গণ্ডি থেকে? কোনও কথা নেই সেখানে, যেখানে ‘দি ডেইলি থটস অব লেবার অ্যান্ড সরো স্লাম্বার’? এই-ই তো ধরন, যখন বৃষ্টির অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলবেন, ‘মিছে এ জীবনের কলরব’।
যখন-যেমন-খুশির আবহে, নিভৃত ব্যক্তিগত রচনার সঙ্গেও কবি শঙ্খ ঘোষ, জুড়ে দেন একের পর এক বৃষ্টি বা বিশেষ করে তুষারের আবহ, অনুষঙ্গ। নির্ভার এই ব্যক্তিগত জার্নালেও অনায়াস দক্ষতায় মিলিয়ে দেন পুশকিনের শীতসন্ধ্যার কবিতা, পাস্তেরনাক কিংবা কোন এক স্পেনীয় কবিতায়, কবরের সাদা ফলকের ওপর জমছে সাদা হিম, যেন নীরবতার ওপর নামছে এসে অন্য এক নীরবতা।
***
শঙ্খ ঘোষের প্রথম গদ্যগ্রন্থ ‘বিদ্যাসাগর’। কিশোরপাঠ্য জীবনীর প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৫৬।
কবির প্রথম কবিতার বই ‘দিনগুলি রাতগুলি’র প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯৫৬। এরপর এক ফর্মার কবিতার বই ‘এখন সময় নয়’। প্রকাশ: মে ১৯৬৭।
শঙ্খ ঘোষের প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’। প্রথম প্রকাশ: ২ অক্টোবর ১৯৬৯। প্রকাশক: সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। মূল্য: ৬ টাকা ৫০ পয়সা।
প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলনে কোনও ভূমিকার উল্লেখ না থাকলেও শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন—
রবীন্দ্রনাটক বিষয়ে সাম্প্রতিক একজন পাঠক বা দর্শকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ এই বই। প্রবন্ধগুলি বিচ্ছিন্ন, সাত-আট বছরের ছড়ানো সময়ে লেখা। ফলে এর মধ্যে কখনও কিছু-বা পুনরুক্তির অন্যায় দেখা যাবে। সে-জন্য মার্জনা চাই।
পুরনো লেখা নিজের কাছে সবসময়েই লজ্জার, কিন্তু ‘নাটকে গান’ রচনাটি তারও চেয়ে বেশি। এই প্রবন্ধের গোটা গড়নটাই আজ আমার পক্ষে অস্বস্তিজনক। তাহলেও, অল্পবিস্তর তথ্যের ব্যবহার ছিল বলে, একেবারে বর্জন না করে ওটিকে ‘পরিশিষ্ট’-এর অন্তর্গত করা হল। এ-লেখাটিতে প্রশ্রয় পেয়েছে সমস্যাটির অধ্রুব দিক, এর ধ্রুব দিকটিকে লক্ষ করবার চেষ্টা আছে ‘নাচ গান নাটক’ প্রবন্ধে।
সঙ্কলনের ১ চিহ্নিত অংশে আছে ছটি প্রবন্ধ: নাট্যমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৬, বহুরূপী নাট্যপত্রিকা), নাচ গান নাটক, নাট্যমুহূর্ত ও ভাষার সন্ধান, সঙ্গত প্রতিমা, পথ: প্রতীক ও পটভূমি, কালের মাত্রা।
২ চিহ্নিত অংশ আছে তিনটি রচনা— রাজা: রহস্য ও প্রকাশ্য (১৯৬৪, গন্ধর্ব নাট্য পত্রিকা), রক্তকরবী ক্রিসেন্থিমাম, অভিনয়ের মুক্তি।
পরিশিষ্ট অংশে দুটি রচনা: নাটকের গান, ঋতুমণ্ডল ও রক্তকরবী।
প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলনে শঙ্খ ঘোষ নিজেকে একজন নিবিষ্ট পাঠক বা দর্শক হিসেবে উপস্থিত করেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিবরণ বা ভাষ্য প্রকাশ— শুরু থেকেই শঙ্খ ঘোষ এই বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলেন যা পরবর্তীতেও সমান ক্রিয়াশীল। নিজের ভাবনা অনুভবকে যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি ব্যতিক্রমী মত-মন্তব্যকে জায়গা দিয়েছেন। যেন ব্যাপ্ত পরিসরে বিভিন্ন মত ও পথের বিতর্কের মধ্যে দিয়ে নিজের বক্তব্যকে যাচাই করে নেওয়া। একের পর এক প্রশ্ন, জিজ্ঞাসায় নিজেকেই শুধু নয়, পাঠককেও জড়িয়ে নিতে চান শঙ্খ, তাঁর গদ্যের প্রবাহে। চিন্তনের মুক্তধারা তৈরির জন্য। প্রথম থেকেই তাঁর প্রবন্ধের এই বিশিষ্ট ধারা নজর এড়ায় না। যেমন, ‘নাট্যমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে তাঁর মনের কথা এই—
এক দিক থেকে দেখলে তাই বলতে হবে যে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই জেনেছিলেন বাংলা নাটকের সম্পূর্ণ স্বকীয় নাট্যবিন্যাস, তার লোকজীবনের সঙ্গে ঘন সম্পর্কে যোজিত এক নাট্যরূপ। সঙ্গে সঙ্গে এ-ও ঠিক যে, এই ভঙ্গিই আবার স্পর্শ করে আছে প্রতীচ্যের আধুনিক পর্ব, এখনও পর্যন্ত তাঁকেই হয়তো বলা যায় আমাদের দেশের আধুনিকতম নাট্যকার।
প্রয়োজনে দেশজ রীতিশৈলীর পাশে আধুনিক পাশ্চাত্য ধরন-ধারণকেও সহজেই নিয়ে আসেন আলোচনায়। আরোপিত নয়, অনিবার্য করে তোলেন শঙ্খ ঘোষ, সেই তুলনা। রবীন্দ্র নাটকের আলোচনায়, মূল্যায়নে, ‘এক্সপ্রেশনিস্ট’ ধরনে, কিংবা ব্রেশটের ‘এপিক থিয়েটার’ প্রসঙ্গও উঠে আসে তাঁর প্রবন্ধে।
‘রক্তকরবী ক্রিসেন্থিমাম’ প্রবন্ধ পাঠে মনে পড়ে—
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ গানটির নেপথ্য উৎসারের সঙ্গে নন্দিনীর কিশোরসুলভ চঞ্চলতায় দ্রুত আসা-যাওয়া, পায়ে ঈষৎ নাচের আভাস, ঠোঁটে ঈষৎ গানের। অথবা পটভূমিতে বিশাল আকাশ হঠাৎ ভরে ওঠে নীলাভ আলোয়, পুরোবর্তী জাল প্রকীর্ণ মঞ্চসাজ আড়াল হয়ে যায়, বিশু-নন্দিনী তাদের মধ্যবর্তী ‘একখানা আকাশ’ নিয়ে দূরে মিলিয়ে যায় ‘ভালোবাসি ভালোবাসি’ গানে, যেন অল্পের জন্য আমরাও চিনে নিলাম প্রকারের বহির্গত আনন্দধারা।
আলোচনার এই আবহে, প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে তুলে আনেন এক ভিন্ন সূত্র—
সার্ত্রের একটি নাটকের অন্তিম দৃশ্যে নির্দেশ আছে: ঘর ভরে যাবে সবুজ আলোয়, এই আলো হয়ে উঠবে অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের মিলিত প্রতীক। ‘রক্তকরবী’র এই আলো তেমনি কেবল স্থানের জড়তাই সরিয়ে দেয় না, মুছে দেয় কালেরও ছিন্নতা, আমরা অব্যাহত লগ্ন হয়ে যাই এক প্রবহমানতার মধ্যে, তার অভ্যন্তর থেকে জেগে ওঠে দেশ।
শঙ্খ ঘোষ, তাঁর গদ্যে উপস্থিত করেন এমন কিছু কিছু চিহ্ন যা একান্ত ব্যক্তিক অনুভবে শুধু বিশিষ্টই নয়, সর্বৈব মৌলিক। যেমন ‘রক্তকরবী’ নাটকের কথা আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর মনে হয়—
তাই ‘রক্তকরবী’ যখন পড়ি তখন রাজা নন্দিনী কিশোর বিশু অধ্যাপক আর রঞ্জনের চারিত্রবিভা ভাবলেই মনে ভেসে আসে চিরাবর্তনময় ঋতুমণ্ডল, গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত আর বসন্তের খেলা। এর পটভূমিতে আছে শীত ঋতু, কিন্তু তার চারদিকে বেষ্টন করে ধরে যেন আরও এক সামগ্রিক সময়। ‘শারদোৎসবে’র কাল থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি-মানুষে সহজ চলাচলের যে রাস্তা ভাবছিলেন, এইখানে এসে যেন তার এক পরমার্থ অর্জিত হল। এইভাবে, নাটকের ভেতর দিকের সেই অদৃশ্য ঋতুমণ্ডলের পটের ওপর সাজিয়ে দেখলে, মানব-সংঘাতের এই কাহিনিটি খুব একটা স্বতন্ত্র মাত্রা পেয়ে যায়।
১৯৬৯-এ প্রকাশিত শঙ্খ ঘোষের প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’ থেকে শুরু। সময়ান্তরে আরও প্রবন্ধগ্রন্থের প্রকাশ, বিষয়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও সেখানে আছে ভাবনার সাযুজ্য। প্রতিটি বিষয়কে নানাভাবে, নানা ভাবনায় দেখার চেষ্টা। সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্য— উভয়ের মধ্য দিয়ে সত্তার উন্মোচন— তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন না শঙ্খ ঘোষ। কিন্তু তাঁর ভাব-প্রবণতা তুলনাত্মক সাহিত্যধর্মী। তাঁর গদ্য আমাদের পৌঁছে দেয় এক ব্যাপ্ত বিশ্বে, মুক্তচিন্তার বৃহৎ অঙ্গনে। শঙ্খ ঘোষের গদ্য, তাঁর প্রবন্ধ স্বাদু, রম্য এবং আশ্চর্য দ্যুতিসম্পন্ন। একই সঙ্গে গভীর দর্শনে জারিত।