কৌশিক মজুমদার
গতকাল সারাদিন, সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। তখনই মনে কু ডেকেছিল। দুপুরে খেয়েদেয়ে ক্লাইভ স্ট্রিটের অফিস যাব ভেবে বাইকের ইঞ্জিন স্টার্ট করতে গিয়েই বুঝে গেলাম আমার সন্দেহ অমূলক না। ব্যাটারি বসে গেছে। গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। অন্য গাড়ির ব্যাটারি বসা আর বুলেটের ব্যাটারি বসায় তফাত আছে। একে তো সব গ্যারাজে বুলেটের সার্ভিসিং হয় না, আর হলেও ব্যাটারি পাওয়া মুশকিল। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাঁর মধ্যেই সেই জগদ্দল গাড়িটাকে ঠেলে ঠেলে গ্যারাজে নিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় বেশ জল জমেছে। হাঁটু না হলেও গোড়ালি অবধি। ফলে কাজটা আরও কঠিন। এদিকে কোন এক বেয়াক্কেলে ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে। যাক গে যাক। আমি গ্যারাজে না পৌঁছে ফোন ধরছি না।
ভাগ্য অত্যাধিক ভাল, গ্যারাজ ফাঁকা, আর নতুন ব্যাটারিও আছে। তবু আধঘন্টা মত সময় লাগবে। পকেট থেকে ফোন বার করতে না করতে আবার কল এল। অচেনা নম্বর। ফোন ধরতেই বেশ গম্ভীর একটা গলা ভেসে এল।
–হ্যালো, আপনি কি তুর্বসু রায় বলছেন? প্রাইভেট ডিটেকটিভ?
–হ্যাঁ বলছি। বলুন…
–আমি জোড়াবাগান পুলিশ স্টেশনের ওসি কুণাল মজুমদার বলছি।
আবার কী হল? সেই চন্দননগরের ঘটনার পর থেকে পুলিশে ফোন করলেই ভিতর ভিতর একটা প্যানিক হয়। উত্তর দিলাম না। কী বলে দেখা যাক।
–আপনার কথা আমায় বললেন সুকল্যাণবাবু। সুকল্যাণ মিত্র। চেনেন তো?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো আলাপ। আইজি ছিলেন। এখন রিটায়ার্ড।
–হ্যাঁ, একদম। উনি আমার মেন্টর বলতে পারেন। এখানে একটা কেস নিয়ে একটু ঝামেলায় পড়েছি। ওঁকে ফোন করলাম। উনি অসুস্থ। প্রেশার খুব হাই। উনিই আপনার কথা বললেন। একটু আসতে পারবেন? আর্জেন্ট। একটা মার্ডার হয়েছে।
–কোথায়?
অফিসার যে ঠিকানাটা দিলেন সেখানে বাইকে যেতে ম্যাক্সিমাম দশ মিনিট লাগবে। কলকাতার এক নামকরা হাইরাইজ মাল্টিস্টোরি বিল্ডিং। ওই এক বিল্ডিং-এই অন্তত পঞ্চাশটা অফিস আছে। সেখানে দিনদুপুরে মার্ডার কীভাবে হল?
–আধঘন্টার মধ্যেই যাচ্ছি, বলে গ্যারাজের কর্মচারীকে তাগাদা লাগানো শুরু করলাম।
২.
বিল্ডিং-এর নিচে বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আর নিউজের ওবি ভ্যান। মিডিয়ার কাছেও খবর চলে এসেছে! আমি ঢুকতে যেতেই এক পুলিশ বাধা দিল। অফিসারের নাম বললাম। ভাগ্য ভালো অফিসার নিচেই ছিলেন। আমায় দেখে এগিয়ে এলেন। ফোনে বুঝতে পারিনি, সামনাসামনি দেখলাম ভদ্রলোকের বয়স বেশি নয়। আমার থেকে সামান্য বড় হবেন। মাস্কের ভিতর মুখ ঢাকা, ফলে মুখের হাসি দেখতে না পেলেও তাঁর চোখ যে হাসল, তা বোঝা গেল।
–আপনিই তুর্বসু? নমস্কার। উপরে যাব, তার আগে আপনাকে একটু ব্রিফ করে দিই। আমরা তো মশাই পুরো ঘেঁটে গেছি। সুকল্যাণস্যারকে তাই ফোন করেছিলাম। উনিই বললেন আপনার সঙ্গে একবার কনসাল্ট করে নিতে…
–কী হয়েছে?
–খুন। এই বিল্ডিং-এর একেবারে টপ ফ্লোরে একটা অফিস আছে। জেনিথ কনস্ট্রাকশনস। তার দুজন মালিক ছিল। পার্টনার। প্রবীর কুমার সাহা আর সোহম বসু। প্রবীরবাবু মাস তিনেক হল কোভিডে মারা গেছে। আজ সোহমবাবু খুন হয়েছে। নিজের অফিসে।
–কীভাবে?
–অফিস খোলে সকাল নটায়। সাড়ে নটার মধ্যে সবাই অফিসে চলে আসে। আজ বৃষ্টির দিন। তাই সবার লেট হচ্ছিল। সোহমবাবু নটায় নিজের চেম্বারে ঢুকে যায়। তার এক বুড়ি পিএ আছে। সে আসে নটা কুড়িতে। তার সঙ্গেই ঢোকে অফিসের হেডক্লার্ক শশাঙ্ক মাইতি। নটা চল্লিশ নাগাদ অফিসের দারোয়ান জানায় এক ভদ্রলোক সোহমবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। একে শশাঙ্কবাবু খুব ভালো চেনে। মৃত প্রবীরবাবুর শ্যালক। নাম অর্জুন। অর্জুন সরখেল। এই অর্জুন নাকি এককালে খুব বাউন্ডুলে ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পরে একটু শুধরেছে। প্রবীরবাবু মারা যাওয়ার পরে দুই-একবার অফিসে এসেছিল। প্রতিবার সোহম বসুর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া লেগেছে। অর্জুনের বক্তব্য সোহম নাকি জালিয়াতি করে পার্টনারশিপের গোটাটাই নিজের নামে লিখে নিয়েছে। ফলে তার দিদি প্রায় কিছুই পায়নি। সোহম তা মানতে নারাজ। এই নিয়ে এর আগেও অফিসে একাধিকবার গণ্ডগোল হয়েছে। শশাঙ্কবাবু অর্জুনকে দেখেই বোঝে এ আবার ঝগড়া করতে এসেছে। প্রথমে জানায়, সাহেব আসেনি। অর্জুন বলে সে সাহেবের গাড়ি নিচে পার্ক করা দেখেই ওপরে এসেছে। শেষবারের মত সোহমের সঙ্গে দেখা করতে চায়। শশাঙ্ক সোহমের ঘরের দরজায় উঁকি মেরে অর্জুনের কথা বলতে যাবে, তাকে প্রায় ঠেলা মেরেই অর্জুন ভিতরে ঢুকে পড়ে। সোহম তাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে যায়, বলে বেরিয়ে যেতে। অর্জুন খুব নম্রভাবে জানায় সে আজ ঝগড়া করতে না, ক্ষমা চাইতে আর কিছু কথা বলতে এসেছে। সোহম কথা বলতে রাজি হয়। শশাঙ্ককে বলে দরজা ভেজিয়ে চলে যেতে। শশাঙ্ক যায়। মিনিট পাঁচেক পর শশাঙ্ক চাপা একটা আওয়াজ শোনে অনেকটা পটকা ফাটার মতো। বুড়ি পিএ নাকি সেটাও শোনেনি। তার আবার কানের সমস্যা। সব কথা ঠিকঠাক শুনতে পায় না।
–তারপর?
–তারপরেই তো আসল খেলা। মিনিট তিন চার পর দরজা খুলে অর্জুন বেরিয়ে এসে সোজা শশাঙ্ককে বলে পুলিশে খবর দিতে। সোহমকে কেউ গুলি করে খুন করেছে!
–মানে? আর কে খুন করবে? বন্ধ ঘরে তো ছিল মাত্র দুইজন!
–একেবারেই তাই। কিন্তু অর্জুনের কথায় সোহম সিগারেট খেতে খেতে আচমকা বিস্ফোরণের মত একটা শব্দ শুনে জানলার কাছে যায়। জানলায় রড নেই। সে নিচে জানলা দিয়ে মাথা বাড়াতেই তার ঘাড়ে এসে গুলি লাগে। সে ঘরে লুটিয়ে পড়ে…
–আর অর্জুন?
–অর্জুন নাকি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি। হতভম্ব হয়ে ছিল। তারপর উঠে গিয়ে দেহের কাছে যায়। দেখে প্রাণ নেই। আচমকা এই দৃশ্য দেখে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। টেবিল থেকে জল নিয়ে জল খায়। মুখে ছেটায়। কী করবে ভেবে নিতে তার তিন-চার মিনিট সময় লাগে। তারপর সে বাইরে এসে খুনের খবর জানায়।
–অর্জুনের কথায় খুব গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আছে কি?
অদ্ভুত হাসলেন অফিসার।
–তাহলে আর আপনাকে ডাকছি কেন? অপরাধী ধরতে গেলে এই সব কেসে মোটিভ, সুযোগ ছাড়াও যেটা মাস্ট, সেটা হল মার্ডার ওয়েপন। ওই চেম্বারে কোনও অ্যাটাচড বাথরুম নেই। আমরা অর্জুন সহ গোটা অফিসের সবাইকে তন্নতন্ন করে সার্চ করেছি। গোটা অফিস প্রায় উলটেপালটে ফেলেছি। এমনকি বিল্ডিংয়ের আশেপাশে এক ইঞ্চিও খুঁজতে বাকি রাখিনি। মার্ডার ওয়েপন মানে বন্দুকটা কোত্থাও নেই। ভ্যানিস!
৩.
ছয়তলার অফিস। খুনের আগে যারা ভিতরে ছিল তারাই আছে। বাকি কর্মচারীদের পুলিশ আর ঢুকতে দেয়নি। ফলে খুব বেশি হলে ছজন মতো পুরুষ মহিলা বসে আছে। সবার চোখে একটা ভীরু ভীরু ভাব। শুধু এক কোণায় মাঝবয়সি একজন বসে সিগারেট টানছে। অফিসার চোখের ইশারায় আমাকে দেখালেন। বুঝলাম এ-ই অর্জুন।
–চলুন আগে বডিটা দেখবেন। তারপর ওটাকে পোস্টমর্টেমে পাঠাব, বললেন অফিসার।
চেম্বারে ভারী সেগুন কাঠের ডবল ডোর। এই দরজা ভেদ করে আওয়াজ না বেরোনোই স্বাভাবিক। জানলার ঠিক নিচে অদ্ভুত অ্যাঙ্গেলে সোহমবাবুর বডি পড়ে আছে। সাদা শার্টের কিছুটা রক্তে ভিজে লাল। সেই রক্তের কিছুটা কার্পেটকেও ভিজিয়েছে। জানলার দুটো পাল্লাই খোলা। আর যেমন শুনেছিলাম, কোনও রড নেই। সোহমবাবুর মাথাটা এমনভাবে বেঁকে আছে যে ঘাড়ের কাছে গুলির ফুটোটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট ফুটো। সেখানের রক্তও জমাট বেঁধে গেছে। আমি কোনওক্রমে পাশ কাটিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। পাশেই একটা বিল্ডিংয়ের কার্নিশ।
–স্যার এদিকে একটু আসুন…
–কী?
–পাশের বিল্ডিংটা দেখুন। খুব জোর আট ফুট দূরে আছে ওই কার্নিশটা। যদি এখান থেকে দাঁড়িয়ে কেউ গুলি করে… কিন্তু এই কার্নিশে দাঁড়াতে গেলে তাঁকে ওই বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে ভাড়া বেঁধে নামতে হবে, কিংবা সার্কাসের ট্রাপিজ খেলোয়াড় হতে হবে। এছাড়া সম্ভব না। তাও আপনি একবার পাশের বিল্ডিংয়ে গিয়ে খোঁজখবর নিন। সকাল থেকে ছাদে কাউকে উঠতে দেওয়া হয়েছিল কি না। কারণ এই বিল্ডিংগুলোর ছাদের দরজায় তালা মারা থাকে। উঠতে গেলে ওয়াচম্যানের থেকে চাবি নিতে হয়।
–ঠিক আছে আমি দেখছি। আর কিছু?
–নাহ আপনি বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিন। আমি একটু অর্জুনের সঙ্গে কথা বলব।
৪.
অর্জুন সরখেলের বয়স চল্লিশের কোঠায় হলেও চেহারা এখনও চাবুকের মতো। সিগারেট খাওয়া শেষ। এখন সে আবার মুখে মাস্ক পরে বসে আছে। চোখদুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল।
–নমস্কার। আমি তুর্বসু রায়। প্রাইভেট ডিটেকটিভ।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, নমস্কার। বলুন। কী জানতে চান। বসুন না। লোকটা এমন করে আমায় আপ্যায়ন করল যেন এটা ওর বাড়ির বৈঠকখানা।
–পুলিশকে যা বলেছেন শুনেছি। আর জিজ্ঞেস করে বিব্রত করব না। অন্য প্রশ্ন করি বরং। শুনলাম আগে নাকি একাধিকবার আপনি এই অফিসে এসেছেন, আর আপনার সঙ্গে সোহমবাবুর বেশ হট টক হয়েছে।
–হ্যাঁ, হয়েছে তো। মিথ্যে বলব না। ও আমার দিদি জামাইবাবুকে ঠকিয়ে ওঁদের সব সম্পত্তি হাতিয়েছে। দিদিকে প্রায় পথে বসিয়েছে। তাই ঝগড়া করতে এসেছিলাম। শেষবার তো আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েও দিয়েছিল দারোয়ান দিয়ে।
–এই হাতানো ব্যাপারটা এত সহজে হল কীভাবে? আপনার জামাইবাবু খেয়াল করেননি?
–উনিও তেমন। আসলে লাস্ট দুই বছর জামাইবাবু হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। অফিসে ইরেগুলার আসতেন। ওঁদের এক উকিল ছিল। শয়তানের বাসা। সেই তলায় তলায় এমনভাবে সব ব্যবস্থা করেছে, যে আইনি পথে কিছু করার উপায় নেই।
–তাই আপনি বেআইনি পথ নিলেন?
–আমি? আমি কিছুই করিনি। উপরে ভগবান আছে। গতমাসে সেই উকিল, দীপঙ্কর না কী নাম, কোভিডে মরেছে। এও আজ গেল। আমি কী করব?
–সেকী! শুনলাম আপনি নাকি ক্ষমা চাইতে এসেছিলেন?
–ক্ষমা না, এসেছিলাম ধান্দায়। আমি বুঝে গেছিলাম এই লোকের সঙ্গে লড়াই করে লাভ নেই। বরং তেল দিয়ে যদি এই কোম্পানিতে একটা চাকরি পাওয়া যায়। এমনিতেই লকডাউনে কাজকর্ম সব বন্ধ।
–কী কাজ করতেন?
–কী না করেছি এককালে? ছোটবেলা বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম তিনবার। পুলিশে খুঁজে নিয়ে এসেছিল। তারপর স্টেশনে কুলির কাজ, বাতের মলম, বিষহরি তেল বেচা, ট্রেনে পেন বিক্রি, সার্কাসে খেলা দেখানো…
–শেষ কী কাজ করতেন?
–বিএসএনএল-এর ক্যাজুয়ালে একটা কাজ পেয়েছিলাম। জামাইবাবুর চেনা ছিল। জুটিয়ে দিয়েছিল। এই লকডাউনে সেটাও গেছে। তাই চাকরির ধান্দায় এসেছিলাম।
–সোহমবাবু রাজি হয়েছিলেন?
–প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল। আমিই হাতেপায়ে ধরলাম। বলল ভেবে দেখব। তারপর রাস্তার দিক একে পটকা ফাটার মতো একটা শব্দ এল। ও উঠে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে গেল কিসের শব্দ। তারপর ছিটকে মাটিতে এসে পড়ল।
আমি অফিসারকে বললাম সবার কনটাক্ট নম্বর নিয়ে ছেড়ে দিতে। অটোপ্সি রিপোর্ট না পেলে কিছু বলা যাবে না।
৫.
তিনদিন বাদে অফিসে বসে আছি, কুণাল মজুমদারের ফোন এল।
–একটু থানায় আসুন তো।
গিয়ে দেখি অফিসার মুখ কালো করে বসে আছেন। সঙ্গে আর এক ভদ্রলোক। বয়স্ক। অফিসারই আলাপ করালেন।
–এই যে ইনি অনিমেষ মল্লিক। আমাদের ব্যালাস্টিক এক্সপার্ট, বলে ওঁকেই বললেন, ইনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ তুর্বসু রায়। এই কেসে সাহায্য করছেন। আপনাকে তো বলছিলাম…
অনিমেষবাবু হেসে নমস্কার করলেন।
–হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। গুলি করা হয়েছে ০.২২ ক্যালিবারের বন্দুক থেকে। গলার কাছে বারুদের দাগ নেই। মানে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করা হয়নি। হলে নিশ্চিত হতাম অর্জুনই করেছে। এখন বলা মুশকিল।
–কত দূর থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে?
–তিন থেকে আট ফুট। এর বেশি না। আসলে এত ছোট গুলির পাল্লা…
–এই ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?
–ক্যালিবার? ও হ্যাঁ। ক্যালিবার মানে গুলির ভিতরের ব্যাস। ০.২২ মানে গুলির ব্যাস ০.২২ ইঞ্চি, মানে মিলিমিটারে বললে ৫.৬ মিলিমিটার।
–এবাবা! একদম ছোট গুলি তো!
–একেবারেই তাই। আর যত ছোট আর হালকা গুলি হবে, তাকে তত কাছের থেকে মারতে হবে। নইলে টার্গেট থেকে সরে যাবে। এই গুলির পাল্লা বড়জোর আট ফুট।
–আট হলে তো মুশকিল। আচ্ছা অফিসার, সেই পাশের বিল্ডিংয়ে খবর নিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ। ওদের ওয়াচম্যানের কাছেই চাবি থাকে। আপনি সেটা বলেওছিলেন। ওয়াচম্যান জানিয়েছে এক সপ্তাহ আগে ট্যাঙ্ক পরিষ্কার করতে লোক উঠেছিল। তারপর থেকে আর কেউ ওঠেনি।
–চাবির ডুপ্লিকেট?
–অফিসে থাকে। ড্রয়ারে। সেটাও আছে যথাস্থানে।
–মানে সেই চাবি দিয়ে কেউ পাশের ছাদে উঠতে পারবে না?
–পারবে, কিন্তু তাকে তবে চাবি ড্রয়ার থেকে চুরি করতে হবে। সেই ঘরে সিসিটিভি ছিল, ফুটেজ দেখেছি। ড্রয়ারে কেউ হাত দেয়নি।
–ছাদে উঠে দেখেছিলেন?
–বলেন কী মশাই? আপনি বলার পর কার্নিশে লোক নামিয়েও দেখেছিলাম। কার্নিশে শেওলাভরা। ইনট্যাকট। কেউ দাঁড়ায়নি।
–তবে তো কার্নিশ থিওরি বাতিল। আচ্ছা সোহমবাবুদের বিল্ডিংয়ের ছাদ?
–সেটাও এক কেস। বন্ধ। আর ছাদের নিচেই বড় সানশেড। ওখান থেকে ঘাড়ে গুলি অসম্ভব।
–তাহলে তো একটাই অপশন। অর্জুন খুন করেছে। কিন্তু খুন করে ওয়েপনটা ফেলল কোথায়?
–সেটাই তো আমারও কথা। বন্দুক তো আর গ্যাস বেলুন না যে উড়ে যাবে। আর বন্দুক পেলই বা কোথায়?
এইখানে অনিমেষবাবু একটু গলা খাঁকারি দিলেন।
–একটা কথা বলার ছিল। মানে এই যে বন্দুক থেকে গুলিটা করা হয়েছে, সেটা কিন্তু বিরাট কোনও ব্যাপার না। সবচেয়ে বড় কথা কোনও ফ্যাক্টরিতে বানানোও না। আমি গুলি দেখেছি। গুলিতে কোনও রাইফ্লিং মার্ক নেই।
–সেটা আবার কী? আমার সরল প্রশ্ন।
অফিসার আর অনিমেষবাবু দুজনের মুখ দেখেই মনে হল পরিষ্কার ভাবছেন কাকে দিয়েছ রাজার পার্ট। শেষে অনিমেষবাবুই বললেন—
–বন্দুকের নলে ম্যানুফাকচারাররা স্প্রিং ঢুকিয়ে রাখেন। গুলি বেরোবার সময় ঘুরতে ঘুরতে বেরোয়। বেরিয়ে তার কৌণিক গতিবেগ রৈখিক গতিতে পরিণত হয়। এককথায় গুলির স্পিড বাড়ে। কিন্তু এই ঘুরতে ঘুরতে যাবার সময় গুলির গায়ে স্প্রিংয়ের দাগ লেগে যায়। এই গুলিতে তেমন দাগ নেই।
–এর মানে?
–এর মানে এই বন্দুক হাতে বানানো। একটা সরু পেনের মতো লোহার নল, ধরার মতো ছোট কাঠের টুকরো, ক্যাপ আর স্প্রিং দিয়ে এমন বন্দুক যে কেউ বানাতে পারে। বিহার, ইউপিতে এদের বলে কাট্টা। ম্যাজিশিয়ানদের বন্দুক দেখেছেন? তারাও প্রয়োজনমতো এইরকম বন্দুক বানিয়ে নকল টোটা দিয়ে খেলা দেখান।
–কিন্তু এখানে তো আসল টোটা ব্যবহার হয়েছে।
–কলকাতার চোরাবাজারে টোটা পাওয়া সমস্যা না। সমস্যা বন্দুক পাওয়া। এই ধরনের টোটার কোড নাম দানা। আপনি একটু খোঁজ করলেই পেয়ে যাবেন। সেই টোটা এই ধরনের হাতে বানানো বন্দুক বা জিপ গানে ভরে আপনি ওয়ান শটার একটা বানিয়ে নিতেই পারেন। কাজ হয়ে গেলে সেটা ভেঙে টুকরো করে ফেলে দিন।
আমি অফিসারের দিকে তাকালাম। অফিসার মাথা নাড়লেন।
–আমরা সব খুঁজেছি। একটা স্প্রিং, একটাও নল, এমনকি স্ক্রু অবধি পাইনি। ওই পথে গিয়ে লাভ নেই।
–আমি সে কথা বলিনি। আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। বোধহয় একটা আবছা ধারণা করতে পারছি কীভাবে খুনটা হয়েছে। অর্জুন আগে সার্কাসে খেলা দেখাত। ও নিজে বলেছে। আপনি খোঁজ নিন কোন সার্কাসে। তারপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। পারলে খবরের কাগজে সেই সার্কাসের বিজ্ঞাপন খুঁজুন।
–তাতে কী হবে?
–আহা! হয়তো কিছুই না। কিন্তু যোগাযোগ হলে জিজ্ঞাসা করবেন অর্জুন সার্কাসে কীসের খেলা দেখাত? আর সেই খেলার বিজ্ঞাপন থাকলে কুরিয়ারে পাঠাতে বলুন। যা ভাবছি যদি তা হয়, তবে আপনি খুব খুশি হবেন বলে মনে হয় না।
বেরিয়ে এলাম। বুলেটের ব্রেকটা আবার সমস্যা করছে। চাপলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ হচ্ছে। আবার গ্যারাজে যেতে হবে।
৬.
সাতদিন কোনও খবর নেই। আটদিনের দিন সকালে অফিসার ফোন করলেন। সার্কাসের নাম ডায়মন্ড সার্কাস। এখন বর্ষা আর কোভিডে খেলা বন্ধ। তাই খুঁজে পেতে এতদিন লাগল। সবাই অন্য অন্য কাজ করছে। জানা গেছে অর্জুন সেখানে ম্যাজিক দেখাত। কয়েকটা বিজ্ঞাপনও পাঠিয়েছে। অফিসার আমায় গিয়ে দেখে আসতে বললেন।
অফিসে যাওয়ামাত্র অফিসার একটা বাদামী খাম থেকে কয়েকটা রঙিন কাগজ আমায় ধরিয়ে বললেন—
–এই দেখুন, কী বুঝবেন বুঝুন।
হাতে নিতেই আমি যা বোঝার বুঝে গেলাম। যেমন সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই। ওপরে ট্রাপিজের দুটো মেয়ের ছবি, জোকার আর হাতির খেলার নিচে ইংরাজিতে লেখা SORKHEL’S SORCERY. নীচে বাংলায় ছোট ছোট অক্ষরে ছাপা, “জাদুকরের অদ্ভুত জাদু। উড়ন্ত তাস। অবলীলায় কাচ, লোহা, স্ক্রু, পেরেক, কাঠ ভক্ষণ। জীবন্ত শব। মন্ত্রবলে বুলেটের গতিরোধ” ইত্যাদি।
আমি অফিসারের দিকে তাকিয়ে বললাম—
–আমার কিচ্ছু করার নেই অফিসার। আপনারও না। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করেছে। যাকে বলে পারফেক্ট মার্ডার।
অফিসারের হাঁ মুখের দিকে চেয়েই বিজ্ঞাপনের ওই অংশটা দেখিয়ে বললাম—
–খুন করার পর ওই তিন মিনিটে অর্জুন বন্দুকটা টুকরো টুকরো করে জল দিয়ে গিলে খেয়ে ফেলেছিল।
লেখকের জবানী: প্রিয়া সাটিয়ার লেখা বিখ্যাত বই এম্পায়ার অফ গানস পড়তে গিয়ে বন্দুক বিষয়ে আগ্রহ জাগে। আর তখনই নানা রকম বন্দুক আর তাঁদের গঠন নিয়ে পড়াশুনো করা শুরু করি। সেখানেই প্রথমবার জিপ গানের নাম পাই। সার্কাসের খেলোয়াররা এককালে এই বন্দুক নিজেরা বানিয়ে খেলা দেখাতেন। এমন একজন ভদেভিল আর্টিস্টের কথাও জানতে পারি যিনি এমন খেলা দেখানো শেষে বন্দুকটা আবার খেয়েও ফেলতেন। ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগে।
কেমন হয়, এই লোকটা যদি খুন করে খুনের প্রমাণ লোপাট করে দেয়? আর এই ভাবনা থেকেই এই গল্পের জন্ম।