Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মিলখার চিঠি

মিলখা সিং | দৌড়বীর

দেবাশি সেনগুপ্ত

 



ক্রীড়াপ্রেমী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্ককর্মী

 

 

 

প্রিয় নিম্মি,

জানি না, শেষ অবধি এ চিঠি তোমার হাতে পড়বে কিনা! শরীরটা একদমই ভালো নেই আমার। আদৌ এ চিঠি শেষ করতে পারব কি? তাও জানি না। তবু, এই চিঠিটা লিখছি, তোমার জন্য। হাতে পড়লে পড়ে ফেলো এই চিঠিটা। আমার দেওয়া সেই প্রিয় নিম্মি নামেই ডাকছি তোমাকে।

নিম্মি তুমি ভালো আছ তো এখন? তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, কতদিন হয়ে গেল! তা প্রায় ২৬ দিন তো বটেই। গত মাসের ২০ তারিখে কোভিড পজিটিভ হয়ে চণ্ডীগড়ের পিজিআইএমইআর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দিন তোমাকে বলে এসেছিলাম, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে আসব, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। সেরে উঠলাম, কোভিড নেগেটিভ হয়ে ১০ দিন পরে ফিরেও এলাম বাড়িতে, কিন্তু তোমার সঙ্গে দেখা হল না।

জানো নিম্মি, ছেলেমেয়েরা কেউ আগে বলেনি আমাকে, আমার ৫ দিন পরে তুমিও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোহালিরই অন্য একটা হাসপাতালে ভর্তি আছ। এই ঘটনাটাই মনটা ভেঙে দিল আমার। আর মনের অসুখই তো শরীর খারাপের উৎস। তাই বাড়ি আসার পর আবার আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হল, কমে যাচ্ছিল শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা। ৩ জুন আবার আমাকে ওই পিজিআইএমইআর হাসপাতালেই ভর্তি করতে হয়। যদিও জ্বর আর আসেনি এবারে, কিন্তু খুব দুর্বল হয়ে গেছে শরীর। বয়সটাও তো কম হল না, ৯১ পার করে ফেলেছি। তাই, টেনশন তো একটু আছেই আমার এবারে। সঙ্গে আছে তোমার জন্য চিন্তা। জীব বা মেয়েরা না, অন্য কার কাছে যেন শুনেছিলাম যে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি তোমার নিউমোনিয়াও হয়েছে। জীব বা মেয়েরা হাসপাতালে এলে তোমার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিই। ওরা বলে, তুমি ভালো আছ। কিন্তু গত দু-তিন দিন ওরাও তো আসছে না। ভীষণ চিন্তা হচ্ছে এবার তোমার জন্য। তুমি ভালো থেকো কিন্তু। জীবরাও তো জেরবার হয়ে যাচ্ছে আমাদের দুজনের জন্য এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল করতে করতে।

তুমি জানো না নিম্মি, গত দু-তিন দিন ধরে খুব অতীতে ফিরে যাচ্ছে খারাপ থাকা মনটা। আমি শুধু দৌড়েই গেছি সারাজীবন। যে দৌড় একদিন শুরু হয়েছিল আমার ছোটবেলার আইডল বাবা সম্পূরণ সিংয়ের কথায়। ১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের মজফফরগড় জেলার গোবিন্দপুরায় আমার জন্ম, এখন যে জায়গাটা পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে। তেরোজন ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম আমাকে খুব ভালোবাসতেন আমার মা চাওয়ালি কৌর। আমার ১৮ বছর বয়সে, দেশভাগের সেই কঠিন সময়ের দাঙ্গায় চোখের সামনে দেখেছিলাম বাবা-মাকে জীবন্ত পুড়ে মরতে। সেই সময়েই পেয়েছিলাম তাঁর দেওয়া নির্দেশ ‘ভাগ, মিলখা ভাগ’। সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে ট্রেনের সিটের নিচে বসে ফিরোজপুর থেকে দিল্লিতে পালিয়ে এসেছিলাম। আমার পরবর্তী জীবনের ও দৌড়ের ট্র্যাকের হার না মানা লড়াইয়ের উৎস ছিল ছোটবেলায় চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া আর ওই ‘ভাগ, মিলখা ভাগ’। পনেরোটা দিন কেটে গিয়েছিল দিল্লির রেল স্টেশনে, খাবার জুটত না ঠিকঠাক। অভাবের তাড়নায় পেট চালাতে মালগাড়ি থেকে কয়লা, চাল চুরি করে বিক্রি করতে হত দিল্লির খোলাবাজারে। দিল্লি থেকে ট্রেনে যাতায়াতের সময়ে ছাতড়া স্টেশনে বিনা টিকিটে ধরা পড়েছিলাম। ভাগ্যের ফেরে রাত কাটাতে হয়েছিল তিহার জেলের অন্ধকার কুঠুরিতেও। সেখানে জায়গা হয়েছিল দাগী খুনি ডাকাতদের সঙ্গে। তখন জরিমানার ২৫ টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য ছিল না আমার। ভাবতাম, ওখানেই জীবন কেটে যাবে। পরে আমার এক দিদি নিজের গয়না বেচে আমার জামিন করিয়েছিলেন এসব তো তোমার জানা, কতবার বলেছি তোমাকে এসব।

তার চেয়ে এবার একটু সুখের স্মৃতিগুলোতে ঢুকে পড়ছি নিম্মি। পিছিয়ে যাচ্ছি ১৯৫৫-র কলম্বো শহরে আয়োজিত একটা টুর্নামেন্টে। আমি আর তুমি, দুজনেই ওই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে কলম্বো গিয়েছিলাম। তুমি ছিলে মহিলা ভলিবল টিমের অধিনায়ক আর আমি ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স টিমের সদস্য। কলম্বোয় এক ভারতীয় ব্যবসায়ী দুটো টিমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েই প্রথম দেখেছিলাম তোমাকে। আমার তখন ২৬, তোমার ১৭। তারপরেই “লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট”। আলাপ হল দুজনের আর তোমার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের স্ম্যাশে ঘায়েল হয়ে গেলাম আমি। আলাপ হল, হাতের সামনে কোনও কাগজ না থাকায় তোমার হাতে হোটেলের নম্বর লিখে দিয়েছিলাম, মনে আছে তোমার? তারপর সব চুপচাপ। এর তিন বছর পর ১৯৫৮ সালে একবার দেখেছিলাম তোমাকে, কটক জাতীয় গেমসে। সেই বছরই পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলে তুমি। তখন জেনেছিলাম, ১৯৩৮-এর ৮ অক্টোবর জন্ম হয়েছিল তোমার অবিভক্ত পাঞ্জাবের শেখপুরাতে।

মনে আছে নিম্মি, আমার এই কথাটা শুনে তুমি খুব হেসেছিলে যে বোধহয় প্রতিটি স্টেশনেই খেলোয়াড়দের জন্য একটি করে প্রেমকাহিনি অপেক্ষা করে থাকে (ভলিবল টিমের অধিনায়ক তুমি বলতে, ওগুলো মিথ, কই আমার তো হয়নি)। তাই তোমার আগেও আমার এক-আধটা প্রেম স্টার্টিং পয়েন্টেই ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। সে সবই ফারহান আখতার ফুটিয়ে তুলেছিল পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ ছায়াছবিতে আমার ভূমিকায় অভিনয় করে। আমার ব্যক্তিগত জীবনের ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার, সব ইনগ্রেডিয়েন্ট সহ অকপটে পর্দায় তুলে আনার অনুমতি দিয়েছিলাম আমি, বিনা পারিশ্রমিকে। আমাকে সম্মান জানাতে অভিনব উপহার দিয়েছিলেন পরিচালক, ১৯৫৮ সালে ছাপা একটি এক টাকার নোট। এ সম্মান অনেক বড় ছিল আমার কাছে। কারণ ওই ১৯৫৮-য় কার্ডিফে কমনওয়েলথ গেমসে ৪৪০ গজের দৌড়ে সোনা পেয়েছিলাম আমি, যেটি ছিল ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভারতের হয়ে জেতা প্রথম সোনার পদক। ১৯৫৮-র টোকিও এশিয়াডেও  ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড়ে ২টি সোনা পেয়েছিলাম আমি। পর্দায় আমার চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন জাভেদ আখতারের ছেলে। তারপরে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা যেখানেই গিয়েছি, সবাই বলেছেন ফারহান যেন আমার প্রতিচ্ছবি। ছবি তৈরির সময় ওঁর সঙ্গে দেখা করেছি। ১১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়তে দেখেছিলাম ওঁকে।

কিন্তু আমাদের স্মরণীয় প্রেমকাহিনি শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। তোমার মনে পড়ে নিম্মি, তা নিয়ে তখন চারিদিকে চর্চা! আমরা ঠিক করে নিলাম, দুজনে একসঙ্গে জীবনটা কাটাব। কিন্তু তোমাদের পরিবার আবার আমাকে পছন্দ করত না। কারণ তোমরা ছিলে পাঞ্জাবি ক্ষত্রী পরিবারের মেয়ে। সমস্যা সমাধানে আসরে নামতে হয় তখন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিং কায়রোঁকে। তাঁর হস্তক্ষেপে এবং দুই পরিবারের সঙ্গে কথা বলায় ১৯৬৩-র ৫ মে আমরা বিবাহসূত্রে বাঁধা পড়ি। তখন অনেককেই বলতে শুনতাম, প্রথম জীবনের সংগ্রাম, কেরিয়ারের উত্থানের মতো আমার প্রেমকাহিনিও সিনেমাকে হার মানায় ৷ গত মাসের ৫ তারিখে ৫৮ বছর পেরিয়ে ৫৯-এ পড়েছিল আমাদের দুজনের জীবনের ম্যারাথন রিলে রেস।

ছোটবেলার সেই লড়াই এবং হার না মানা মানসিকতা আমাকে ২৭ বছর বয়সেই পৌঁছে দিয়েছিল ১৯৫৬-র মেলবোর্ন অলিম্পিকে, ২০০ মিটার আর ৪০০ মিটার দৌড়ের ট্র্যাকে। সেবার হিটেই বিদায় নিতে হয়েছিল। তবে তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমাকে। ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিকের ফাইনালে ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড়েও (প্রথমে হাতে মাপা সময় ছিল ৪৫.৫৯ সেকেন্ড, পরে সবার মত আমার ক্ষেত্রেও ০.১৪ সেকেন্ড যোগ করা হয়) অল্পের জন্য (০.১৩ সেকেন্ড) ব্রোঞ্জপদক হাতছাড়া হয় আমার। ১৯৬২-র জাকার্তা এশিয়াডেও ২টি সোনা জিতেছিলাম আমি ৪০০ মিটার এবং ৪X৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে। ১৯৬৪-র টোকিও অলিম্পিকেও ৪X৪০০ মিটার রিলেতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলাম আমি। আর ১৯৫৮-র কথা তো আগেই লিখলাম। এশিয়াডে মোট ৪টে সোনার পদক আছে আমার। এছাড়া ১৯৫৮-র কটক ন্যাশনাল গেমসে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড়ে এবং ১৯৬৪-র কলকাতা ন্যাশনাল গেমসে ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক বিজেতাও ছিলাম আমি। তবু, ১৯৬০-এর রোম অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়ার আফশোস আজও গেল না আমার, আজও আক্ষেপ আছে আমার এজন্য। ওই অলিম্পিকের ফাইনালে ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে আমার ৪০০ মিটার দৌড় ৩৮ বছর ধরে ছিল ভারতের জাতীয় রেকর্ড। ১৯৯৮ সালে ওই রেকর্ড ভেঙেছিলেন পরম মিলখাভক্ত পরমজিত সিং, ৪৫.৭০ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড়ে। এতে ওই আক্ষেপ কিছুটা কমেছিল আমার। পক্ষান্তরে ১৯৫৮ সালে কার্ডিফে আমি যে রেকর্ড করেছিলাম, তা ২০১০-এর দিল্লি কমনওয়েলথ গেমস পর্যন্ত অক্ষত ছিল। দিল্লিতে সোনা জিতে আমার রেকর্ড স্পর্শ করেছিলেন ডিসকাস থ্রোয়ার কৃষ্ণা পুনিয়া।

নিম্মি তুমি তো জানোই, ভারতীয় সেনাবাহিনিতে ৩৯ টাকা ৮ আনা বেতনে টেকনিক্যাল কর্মী হিসাবে কাজ করতাম আমি। রানিং ট্র্যাকে আমার দুরন্ত পারফরমেন্স দেখে পাকিস্তানের জেনারেল আয়ুব খান  আমাকে ভারতের ‘উড়ন্ত শিখ’ নামে প্রথম ডাকেন, এই নামটা আমার সঙ্গে থেকে গেছে আজও, তোমার মতই। তুমি বাধা দাওনি, বরং খুশি হয়েছিলে যখন আমার সব জেতা পদক আমি ভারত সরকারকে দিয়ে দিয়েছি, এখন যা রাখা আছে পাতিয়ালার স্পোর্টস মিউজিয়ামে। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার আমাকে পদ্মশ্রী পুরস্কার দিয়েছিল। আর ১৯৫৮-য় কার্ডিফ কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিট হিসেবে প্রথম সোনা জেতার জন্য ৪৩ বছর পরে ২০০১ সালে আমি পেয়েছিলাম অর্জুন পুরস্কার। আমি বারবার বলতাম যে সাফল্য পেতে হলে দেশের খেলাধূলার ভার সেনাবাহিনির হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে, যা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বারবার।

তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি নিম্মি, আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতাতে বাংলার তদানীন্তন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী ‘শান্তির জন্য দৌড়’-এর আয়োজন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সরকারি অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম তুমি আর আমি। পার্ক স্ট্রিট থেকে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম পর্যন্ত দৌড় হয়েছিল। বহু মানুষকে দৌড়তে দেখে আমিও তাদের সঙ্গে দৌড়তে শুরু করেছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি ওখানে সরকারি অতিথি। তখন আমি ৫৭তম জন্মদিন পেরিয়ে গেছি। আসলে দৌড়ের সুযোগ পেলে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারতাম না তখন।

নিম্মি তোমাকে আমি বারবার বলতাম যে, সারা বিশ্বে ‘‌উড়ন্ত শিখ‌’ নামে খ্যাত আমি নিজে যা পাইনি, তা দেখতে চেয়েছিলাম কোনও ভারতীয় অ্যাথলিটের দখলে। সেই কবে, ১৯০০ সালে কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে নর্মান প্রিচার্ড দুটি রুপো জিতেছিলেন অলিম্পিকে। তারপর থেকে আজও অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্সে ভারত পদকহীন। তাই বোধহয় ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে আমি বলেছিলাম—

১৯৬০-এ রোম অলিম্পিকে পদক না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। তারপরে অর্ধশতাব্দীর বেশি পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও কোনও ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্সে পদক পেল না। অলিম্পিকে কোনও ভারতীয়কে পদক গলায় ঝুলিয়ে পোডিয়ামে দাঁড়াতে দেখব— এ-ই আমার শেষ ইচ্ছে।

তোমার তো এটা চোখে দেখা যে, আমাকে আর আমার সাফল্যকে দেখেই তখনও ব্রাত্য অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এসেছিলেন বহু ভারতীয় ক্রীড়াবিদ। এজন্যই ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে হয়ত ‘আইকন’ মানা হত আমাকে। যখন যে দৌড়ের ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছে, আমার জ্ঞানত কাউকে ফিরাইনি আমি। এই শিক্ষাটাও আমি তোমাকে দেখেই পেয়েছিলাম। আমার অলিম্পিকের একটা পদক যদি থাকত, তবে হয়ত অনেক বেশি উপকৃত হত ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড। তবুও, বাবার ‘ভাগ, মিলখা ভাগ’ মন্ত্রে দীক্ষিত, চিরদিন ‘সোজাপথে’ দৌড়ে যাওয়া আমি চাই, ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স ও খেলার দুনিয়া ‘উড়ন্ত শিখ’কে যেন কোনওদিন না ভোলে।

নিম্মি, আজ অকপটে এটা তোমাকে জানাতে চাই যে বিয়ের ৫৯ বছর পরেও তুমিই আজও আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। দশ ক্লাস পাশের পরে আর পড়া হয়নি আমার, শুধু দৌড়ের পিছনেই দৌড়ে গেছি চিরদিন। তাই আমাদের চার ছেলেমেয়ের পড়াশোনা সামলানো ও ছেলেমেয়েদের দেখভাল, সব তোমাকেই করতে হয়েছে একার হাতে, নিজের অফিস সামলানো ছাড়াও। তোমার চাকরিটাও খুব ছোটখাটো কিছু ছিল না, পাঞ্জাব রাজ্য সরকারের অধীনে ডিরেক্টর অফ স্পোর্টস ফর উওমেন ছিলে তুমি, ১৯৯৮ সালে অবসরের আগে পর্যন্ত। এভাবেই আমাদের তিন মেয়ে মোনা সিং, আলিজা গ্রোভার আর সোনিয়া সানওয়ালকার মধ্যে মোনা আজ চিকিৎসক৷ আর ছেলে জীব মিলখা সিং তো অন্যতম সেরা গল্ফারদের মধ্যে একজন। আমার জীবনে তোমার ভূমিকাকে কুর্নিশ জানিয়েছিলাম ২০১৩ সালে বেরোনো আমার আত্মজীবনীতে, যার নাম ছিল ‘দ্য রেস অফ মাই লাইফ’। পরে ১৯৯৯ সালে টাইগার হিলের যুদ্ধে নিহত হাবিলদার বিক্রম সিংয়ের সাত বছরের ছেলেকে দত্তক নেওয়ার পিছনে তোমার অবদানই বেশি ছিল।

আমাদের শহর সেরে উঠুক। তুমি, আমি সেরে উঠি। খুব তাড়াতাড়ি দেখা হোক আমাদের।

 

ইতি—

তোমার মিলখা
১৫ জুন ২০২১

(গন্তব্যে না পৌঁছনো ঠিক এমনই একটি চিঠি হয়ত পাওয়া যেতে পারত হাসপাতালে প্রয়াত মিলখা সিংয়ের বালিশের নিচে। চিঠিটি লেখার দু দিন আগেই মিলখা সিংয়ের স্ত্রী নির্মল কৌর সাইনি চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। আর চিঠিটি লেখার চার দিন পরে অনন্ত দৌড়ে দিগন্ত পেরিয়ে স্বয়ং ‘উড়ন্ত শিখ’ও পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর নিম্মির কাছে। সেখানে নিশ্চয়ই আবার দেখা হয়েছে তাঁদের। এতদিনে শুরু হয়ে গেছে তাঁদের যৌথ সফর। আবার…)