Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গৌতম বসু — অন্তরীক্ষের যেটুকু অংশ

পার্থজিৎ চন্দ

 


কবি, গদ্যকার

 

 

 

১৮ জুন, ২০২১, শুক্রবার… বাংলার একটা বড় অংশ বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে; সকাল এসেছে একরাশ অন্ধকার নিয়ে। তরুণ কবিদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর চলে যাওয়ার কথা।

১৯৮১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যপুস্তিকা ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ প্রকাশিত হয়েছিল; তারপর ধীরে, অতি ধীরে প্রকাশিত হয়েছে আরও কিছু কাব্যপুস্তিকা। এবং (মুখ্যত) বাংলার তরুণ কবিরা তাঁকে পৃথক এক রাজ-সিংহাসনে বসিয়েছে। সে সিংহাসন গোপনে তরুণ কবিরা রেখে দেয় গুটিকয়েক কবির জন্য। শুধু তাই নয়, সাড়ে তিন-দশকের সময়কালে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার এক ভিন্নধারার প্রায়-‘কাল্ট’ ফিগার। ২০১৫ সালে তাঁর কবিতা-সংগ্রহ প্রকাশিত হয় ‘আদম’ থেকে; এমন গুরুত্বপূর্ণ একজন কবির কবিতা-সংগ্রহের আয়তন মাত্রই ১৬৩ পৃষ্ঠার। এটি নিছক এক তথ্য; কিন্তু এই তথ্য তাঁর ও তাঁর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সূচিত করে।

তিনি বহুপ্রসব করেননি, প্রতিষ্ঠানের ধাতব-আলো তাঁর ত্রি-সীমানায় পড়েনি কোনও দিন। কিন্তু তিনি পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছিলেন অপরিহার্য। পাঠককে তিনি আকর্ষণ করেছেন চুম্বকের মতো। যে সব প্রকাশনের আয়তন ‘ছোট’ সেখান থেকেই মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কাব্যপুস্তিকা এবং বাংলার তরুণ কবিরা প্রাচীন পুথির মতো… যেন অতি-পুণ্যে ও পরিশ্রমের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে সেই পুথি… সংগ্রহ করেছে পাগলের মতো। সমস্ত প্রক্রিয়াটির মধ্যেই ছেয়ে থাকত এক ‘অ-প্রকাশ্যের’ আনন্দ ও আভিজাত্য। আজ বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়, মূলত তরুণ কবিরাই তাঁর ঈশ্বরসম পাঠক। এবং কে না জানে যে তারুণ্য একটি প্রবণতা।

বাংলা কবিতার এক ঘাতক পরিসরে ঘুরতে ঘুরতে তরুণ কবিরাই আবিষ্কার করেছে তাঁর কবিতায় ছেয়ে থাকা শিল্পের সার্বলৌকিক উপাদানসমূহকে, জলের ভেতর খেলা করে যাওয়া জল-রং আলোকে।

অন্তর্গূঢ় স্বর, মৃদু অস্বস্তিকর অথচ দৃঢ়পিনব্ধ পংক্তিবিন্যাস, মননের মধুর সঙ্গে মিশে যাওয়া প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সুখ-দুঃখ তাঁকে এই বিশেষ পথের পথিক হিসাবে ডেস্টিনড করে তুলেছিল। স্তম্ভিত করে তোলার কোনও উপাদান তিনি ব্যবহার করেননি; তিনি আবিষ্ট করে রেখেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, এই আবিষ্ট করে রাখার উপায় হিসাবে তিনি ‘লিরিক্যাল-ট্র্যাপ’ সযত্নে পরিহার করেছিলেন। তাঁর কবিতার বুবিট্র্যাপ অন্যত্র লুকিয়ে ছিল, সে ক্ষেত্রটি একান্তই রহস্যের। শিল্পের ক্ষেত্রে স্তম্ভিত হয়ে থাকার আয়ু বড় কম; তিনি সেই গুটিকয়েক কবির মধ্যে পড়েন যাঁদের কবিতার কাছে বারবার ফিরে আসতে হয় রহস্যের সন্ধানে। জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি-ধ্বংসের মধ্যে খেলা করা পঞ্চ-অঙ্কের ‘নাটকের’ সামনে বসে থাকে পাঠক, শুধু তাই নয়— দ্বিতীয় তৃতীয়বার সে নাটকের কাছে ফিরে এসে আবিষ্কার করা যায় প্রতিটি সংলাপ মহা-ট্র্যাজেডির সঙ্গে যোগ করে চলেছে নতুন নতুন মাত্রা। এ রহস্য ফুরাবার নয়।

গৌতম বসুর সবচেয়ে বড় স্বকীয়তা— তিনি আমাদের দর্শনাশ্রয়ী নিরুদক প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে তাঁর প্রভা ও বিভূতি দেখাতে চাননি। তিনি যাত্রাপথের কল্প-বৈজয়িক ভাষ্যও রচনা করেননি। আসলে আমদের অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের সঙ্কট সম্ভবত এই দুটির কোনও একটির কাছেই নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে চায় না। তার খোঁজ আরও বড়, আরও গূঢ়। গৌতম আমাদের কাছে উন্মোচিত করে দিতে চেয়েছিলেন সেই দরজা, ফলে কোনও কোনও সময়ে তাঁকে মনে হয়েছে নন্দনতাত্ত্বিক বৈরাগ্যে আক্রান্ত; আবার কখনও মনে হয়েছে তিনি সেই রহস্যময় ময়ূর যিনি ঘোর বর্ষায় কলাপ অতি-কষ্টে গোপন রেখেছেন অতি-প্রকাশ্যের খড়্গ থেকে নিজেকে আড়ালে রাখবার জন্য। শুধু তাঁর কবিতার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে শোনা যেতে পারে সমুদ্রমন্থনকালে মন্দরের ধ্বনি। সেও অতিদূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ‘রহস্যময়’ শব্দ।

মানুষের প্রাত্যহিকতার দিকে চেয়েছিলেন গৌতম; তবে তা আমাদের মননে ঘনিয়ে ওঠা অনুচ্চ রাজনৈতিক দর্শন থেকে ‘মানুষের দিকে চেয়ে’ থাকা নয় কোনওমতেই। এই রোদসী, আর তার মাঝখানে যেন কিছুটা অনাথ কিছুটা দিশাহারা এক বালক কিংবা বালিকা… তাকে খুঁজে দেখতে চেয়েছিলেন গৌতম। এই হাসিকান্নার বিরাট চরাচরে দাঁড়িয়ে তিনি তাকিয়ে দেখেছিলেন উপরে, আবিষ্কার করেছিলেন মহা-চাঁদোয়ার নীচে ঘটে চলা আবহমানের নাটকটিকে—

মানুষের কান্নার চেয়েও অসহায় কান্না
কাঁদছে পদাহত কুকুর, পথে ঘুরে-ঘুরে,
কাঁটায় মোড়া সেই ঢেউ পার হতে জানি না
দাঁড়াই আর ভাবি, সমাপ্তি বুঝি এমনই;
ফুটপাথের একপাশে একা টিউবকল
পাতালের জল তুলে চলেছে আপনমনে
আর কাঁদছে, একটি অন্তিম সন্ধ্যার জন্য
শোক জ্ঞাপন করার মতো অন্য কেউ নেই,
আমি যাই, সংসারচিতা জ্বলছে ওইদিকে
দেখি শেষবার, হাসির অশ্রু, অশ্রুর হাসি।

(রাস্তার জন্য একটি)

কবিতা সংগ্রহে এই আশ্চর্য কবিতাটির পরেই রয়েছে ‘সুদর্শন’ নামে কবিতাটি। এই কবিতাটির দিকে ফেরা যাক একবার—

যদি সন্ধান করি প্রশ্নের, প্রশ্ন নিভে যায়,
মেঘেদের আকাশ আমায় সঙ্গ দেবে বলে
কত সহজ পথে পেয়েছে ধূলির আশিস,
ম্লান হেসে এগিয়ে এসেছে আমার বিনাশ।
পেলাম অতিদুরূহ গ্রন্থি, রৌদ্রের ঘর্ষণ
যতবার উঠে দাঁড়িয়েছি মুণ্ডিতমস্তক,
ততবার দুই চক্ষু ভরে দেখেছি অদূরে
ওই তোমার চক্র ঘুরছে, নয়নাভিরাম।

(সুদর্শন)

দর্শনের নিছক প্রস্থাপন তাঁর কবিতার মৌল-লক্ষণ নয়। অভিসন্ধিমূলক আধুনিকতার পরিসর ছিন্ন করে তিনি প্রশ্ন করে গেছেন অবিরাম। এই কবিতায় প্রথম লাইনের তিনটি শব্দের কাছে বহুবার ফিরে এসেও তার রহস্য মেটে না, ‘প্রশ্ন নিভে যায়’। তবে কি প্রশ্নের সন্ধান বৃথা! কিন্তু তার থেকেও আরও গূঢ় এক কূটাভাস রয়ে গেছে এখানে— সন্ধান তো ‘উত্তরের’। আবার প্রশ্নের সন্ধান ছাড়া উত্তরে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে কি তেমন কোনও মহা-উত্তর রয়ে গেছে কোথাও যা আদপে সচেতন নিরীক্ষা-নিরপেক্ষ?

বস্তু ও ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আমাদের অবিরাম জড়িয়ে পড়াই নিয়তি। এবং এই নিয়তির মুখচ্ছবি ছিন্ন করে মৃত্যুর সুদর্শনচক্র ঘুরে চলেছে, এগিয়ে আসছে— যা অনিবার্যাভাবে জীবনের অন্তিমপ্রকাশ।

শুধু এই দুটিই নয়, বালকবালিকার যৌনরোম প্রস্ফুটিত হওয়ার কারণে শিহরিত হওয়া বাংলা কবিতা আতুপুতু ‘অমর ভুবনের’ মাঝে রাখতে ইচ্ছা করে—

দুঃখহরণ, ওই বুঝি জেগে উঠেছে প্রথম কুজন
অতিমৃদুকম্পন নিদ্রালোকের অতল পুষ্করিণী মাঝে

কে তুমি অতিমৃদুকম্পন

যেন এক মহামৌন স্থাপত্যকলার পাঁজরে দাঁড়িয়ে আছি
গণিতশাস্ত্রের চেয়েও নীরব, সুন্দর, প্রেমার্ত

প্রণাম ভাসাই মধুসূদন, জ্বালাও, জ্বালাও
কবিতার রক্তমাখা কাঁথা।

(মৌন)

গণিতশাস্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সমাধানযোগ্য রহস্যকে ছাপিয়ে চলে যেতে হয় শিল্প ও কবিতার জরায়ুর ভেতর। গৌতম পৃথিবী ভাসানো লোরে ভাসতে দেখেছিলেন এক রক্তমাখা কাঁথা। এই রক্তমাখা কাঁথা সম্পুটে ধারণ করে থাকে প্রাত্যহিকতার প্রতিটি মুহূর্তকে, তবু তা প্রাত্যহিকতার স্রোতে মলিন নয়। ‘প্রথম কূজন’ সেই অক্ষর যার ‘ক্ষয়’ নেই।

এহেন গৌতমকেও আমরা অনেকে প্রথাগত ও সরল-মতে ফ্রেমে বন্দি করতে চেয়েছি, শস্য-ফলন-পূর্ণতা-রিক্ততা-জন্ম-মৃত্যু এই সেই ফ্রেম যার মধ্যে আমরা গৌতমকে ধরতে চেয়েছি। অনেকেই ফিরেও তাকাইনি তাঁর সে সব সৃষ্টির দিকে যেখানে তিনি অবিরাম সন্ধান করে চলেছেন সৃষ্টি ও সন্ত্রাসের মধ্যে শুয়ে থাকা অজগরের মতো সম্পর্কটিকে। অতি-প্রকাশ্য ও অতি-উচ্চকিত রাজনৈতিক উচ্চারণ ছাড়া আমরা ‘হিংসা’ ও সন্ত্রাসের উপস্থিতি বুঝে উঠতে পারি না।

এখানে গৌতম ও বাংলা কবিতার এক বড় অংশের পাঠক ‘অসহায়’; কারণ গৌতমের দ্বারা কাব্য-সন্ত্রাসের প্রকাশ হয়ে উঠবে এমন—

দুগগা পুজোর সকালে ছেলের দল লরীতে প্রতিমা চাপিয়ে
আকাশ-বাতাস মুখরিত করে জয়ঢাক বাজাতে-বাজাতে যাচ্ছে,
আপনি দোতলার জানালায় এসে দাঁড়ালেন, পিছনে আমি,
ম্লান হাসলেন, আঙুল দিয়ে আমায় সেই ছেলেটিকে দেখালেন
যে দেবীর সমস্ত নিস্ফল অস্ত্রশস্ত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছে,
ক্রমে ঢাকের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল, আমরাও জানালা থেকে সরে এলাম।
ওগো পাতা কুড়ানী, গান কুড়ানী, ভাষা কুড়ানী পাগল,

আজকাল, পাতলা টিনের পত্-পতে খড়্গ দিয়ে কবিতা লেখার কথা ভাবি।

(ঁকা্লী দাশগুপ্ত)

দেবীর নিস্ফল অস্ত্রশস্ত্র হয়ে নিয়ে যাওয়া ছেলেটির চারপাশ ঘিরে রাখা সন্ত্রাসকে আমরা চিহ্নিত করতে পারব না অনেকেই। সমস্ত উপেক্ষা সন্ত্রাস গুমখুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা পাতাকুড়ানি, গানকুড়ানি, ভাষাকুড়ানি পাগলদের উদ্দেশ্যে মেলোড্রামাটিক কাব্য রচনা করবেন না গৌতম, এটিই ভবিতব্য ছিল। সন্ত্রাসকে তিনি ম্যাক্রো ও মাইক্রো— এই দু স্তরেই পৃথক এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন সেটিও ভবিতব্য ছিল।

গৌতম বাংলাভাষার চিরকালের তরুণ কবির কিরীটখানি নিয়েই বিদায় নিলেন। কারণ যাওয়ার আগে তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন ‘জরাবর্গ’ ‘সুকুমারীকে না-বলা কথা’র মতো কাব্যপুস্তিকা। একটা পর্ব পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন অধিকাংশ লেখকই চেনা পথে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, যখন নিজের লেখার থেকে অবিরাম আহরণ করবার ফলে হয়ে ওঠেন এক অর্থে plagiarist, তখন গৌতম নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন ভিন্ন পথের সন্ধানে। ফলে তিনি আত্মাপহারক ছিলেন না, দুটি ক্ষীণকায় কাব্যপুস্তিকা তাঁর সন্ধানের তীব্রতাকে সূচিত করে রেখে গেল।

গৌতমের লেখার কাছে বসে মনে হচ্ছে বারবার আরোগ্যের কথাও তো ফিরে এসেছে! কী যেন এক ক্ষত ও যন্ত্রণার থেকে আরোগ্য খুঁজে চলেছিলেন তিনি। ভারহীন এক মৃত্যুই কি সেই আরোগ্য?

এতদিনে প্রবাদ হয়ে গেছে ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ সেন’… জীবন-মৃত্যুর মহা-আয়োজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খুঁজতে চেয়েছেন সার্বলৌকিক সত্য। অগ্নিবিদ্যার খুব কাছে দাঁড়িয়ে তিনি আভাস পেয়েছিলেন, ‘যে জানে শেষাংশ কীভাবে গীত হবে সেই জন সমাপ্তির রাজা।’

‘রসাতল’ (২০০১) কাব্যগ্রন্থের ‘ঝরাপাতা’ কবিতায় গৌতম লিখেছিলেন—

পথ থেকে একটি হলুদ পাতা কুড়িয়ে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘এটি কি জীবনের প্রতীক, না মৃত্যুর?’
‘জ্ঞানের, পরাজয়ের’।

‘জ্ঞান’ ও ‘পরাজয়’, শব্দ দুটির juxtaposition এক বিপুল বিস্ফারকে সূচিত করল। এই সহাবস্থান অকল্পনীয়, ঠিক যেমন অকল্পনীয়ভাবে জেগে উঠছে গৌতমের শান্ত সন্ত্রাসময় কবিতাগুলি।

‘যে-কোনও গৃহ থেকে শ্মশান খুব দূরের পথ নয়’, সে পথে বাংলার তরুণ কবিরা আবিষ্কার করবে, আরও বেশি আবিষ্কার করবে আপনাকে।

বৃষ্টির দিনে তবু এটুকু পথ পার হতে মাথা নুয়ে আসে অসহ্য বেদনায়।