Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পরিচয়পত্র

পরিচয়পত্র -- বর্ণালী ঘোষদস্তিদার

বর্ণালী ঘোষদস্তিদার

 

ঝড়ের পূর্বাভাস সপ্তাহখানেক আগে থাকতেই ছিল। সেই ঝড় এসেছে। সেই সঙ্গে চলছে লকডাউন। শুধু দিনের বেলায় ঘন্টা চারেক দোকানপাট খোলা। তারপরই তল্লাট  শুনশান। শুধু পুলিশের টহলদারি। করুনা নাকি বেড়েছে বেজায়। এখন এর শিকলভাঙা দরকার। কিন্তু রসিক ভাবছিল কদিন আগেও কি করুনা ছিল না, যখন পাল্লা দিয়ে মিটিং-মিছিল করছিল রাজনৈতিক দলগুলো? দিল্লি-গুজরাট থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে আসছেল নেতারা? আসলে করুনা বা তেমন যা-ই হোক, আসে বা যায় নেতা-মন্ত্রীদের মর্জিমাফিক। এখন দোরে দোরে ঘুরে ভোটভিক্ষে শেষ। এখন মানুষকে ঘরের কোণায় ঢুকিয়ে তালা-চাবি দিয়ে দিলেই হল। তবে পেট লকডাউন মানতে চায় না। খিদে শিকল ভেঙে চাগাড় দিয়ে ওঠে।

হপ্তাভর প্রিন্ট মিডিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় টেলিভিশনে উপকূলবর্তী মানুষকে নিরাপদ আস্তানায় নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। টিভিতে দেখা যাচ্ছে গরিব মানুষদের নিয়ে চলেছে পুলিশ, সামরিক বাহিনির লোক। পোঁটলা-পুঁটলি ভুখা-নাঙ্গা ছেলেপুলে নিয়ে হেঁটো ধুতি-কাপড় পরা লোকগুলো চলেছে সার বেঁধে। লাইন দিয়ে। মুখে অবশ্য প্রায় সবারই “মাক্স” বাঁধা আছে নাম কে ওয়াস্তে। সোশ্যাল-ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সের কথা বলছে প্রশাসন, কোথাও কোথাও এসব বিধিব্যবস্থা নিয়ে কড়া নজরদারি চলছে।

একরোখা এক দম্পতিকে দেখা গেল, খুব তেড়িয়া হয়ে বলতে গিয়েছিল— পরব নি মাক্স… খাব নি তোদের খাবার… ভয় পাই না তোদের লাঠিকে… মার না কত মারবি… যেথায় নিয়ে গিয়ে তুলবি আমাদের সেখানে ডিসটেন থাকবে? একটা ছুটো জায়গায় তো আমাদের ঠিস্যে রেখে দিবি… তো ত্যাখন করুনা হবে না? গতবারেও তো ঘর ভেঙেছেল আমাদের… সে ঘর সারেনি আজও। সরকার বরাদ্দ করেছেল বিশ হাজার তো পেলুম পাঁচ হাজার… আমাদের আঁধারকাট যদি জলের তলায় তলিয়ে যায়… পাব না সেটুকুনিও…

খুব বেশিক্ষণ গায়ের ঝাল ঝাড়তে পারল না প্রতিবাদী দম্পতি।

–কথা থামাও। গাড়িতে ওঠো— উর্দিপরা পুলিশ একটা মস্ত ফুলপাঞ্জাব ট্রাকে গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে এলাকার  মানুষগুলোকে বোঝাই করে নিয়ে চলে যায়।

শরণার্থী শিবিরে ঢালাও চিঁড়ে-গুড়-খিচুড়ির বন্দোবস্ত। এক একটা তাঁবুতে  পিলপিল করছে লোক। হাড়হাভাতে ভিখিরির দল। যাদের প্রশাসনের কাজে লাগে শুধু ভোটের সময়। সব রাজনৈতিক দলেরই মাথাপিছু ভোট-গুনতিতে এদের নাম থাকে। তখন পাকাবাড়ির প্রতিশ্রুতি থাকে। ইস্কুল-হাসপাতাল-শিক্ষিত পাশকরা ছেলেমেয়েদের চাকরি-কাজ… তারপর ভোট মিটে যেতেই ফের যে কে সেই…।

ভুঁয়ে থৈ থৈ করছে জল আর জল… ছলাৎ ছল ঢেউ খেলছে সমুদ্দুরের মতো। মাটির বাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। গাছেরা জলে ডুবে গেছে। শুধু কোনওক্রমে জেগে আছে কখানা নারকেল গাছের মাথা। ভাঙা ঘরবাড়ির হাড়জিরজিরে কঙ্কালসার কাঠামো আগলে একগলা দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য অসহায় মানুষ।

দুর্যোগের দিনে মাথার অস্থায়ী ছাউনিটুকু দিয়েছে সরকার। কিন্তু বাচ্চাকাচ্চা লোটাকম্বল নিয়ে মানুষ যায় কোথায়? তাছাড়া এ তো আর একবছরের ঘটনা নয়, সেই কোন যুগ যুগ ধরে ফি বচ্ছর এই দুর্যোগ ঘটেই চলেছে। নদীর পাড় ধরে ডাঙা রাস্তার মাথায়  ব্রিজ হয়েছে কোথাও কোথাও। শহুরে বাবুদের গাড়ি ছুটিয়ে আসার জন্য শহর বরাবর পাকা মেটাল রোড হয়েছে। হোমস্টে-রিসর্ট গজিয়েছে ব্যাঙের ছাতার মতো। কিন্তু নেই হাসপাতাল, নেই ইস্কুল-কলেজ। হাসপাতাল বলতে সাকুল্যে একটি  প্রাইমারি হেলথ সেন্টার। তাতে না আছে ওষুধ না কোনও আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা। রুরাল সার্ভিসেস এর জোয়ান ডাক্তাররা আসেন কখনও কখনও। কিন্তু ওষুধ? সেই সাধারণ জ্বরজারির জন্য প্যারাসিটামল আর পেটখারাপের জন্য ইলেকট্রাল-ওআরএস… বড় জোর মেট্রোজিলের মতো সস্তা সহজ ওষুধ-বিষুধ। নেই অস্ত্রোপচারের পরিকাঠামো। গর্ভবতী-প্রসূতিদের নিয়ে যেতে হয় নদী পেরিয়ে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে। বর্ষার দিনে নদীতে যখন জোয়ার আসে, পূর্ণিমায় ভরা কোটালে ফুলে-ফেঁপে ওঠে নদী, তখন সমস্যা  আরও তীব্র। প্রসববেদনা তীব্র হয়ে ভেসেল বা শালতি নৌকার মধ্যেই শিশুর জন্মদানের ঘটনাও বিরল নয়।

মোটামুটি এপ্রিল মানে চৈত্র মাস থেকে শুরু করে ভাদ্র-আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই বাদা অঞ্চলের এই চিরচেনা বিপর্যয়ের ছবি। শীত-বসন্তে দিনের আকাশ ফাটিয়ে রোদ্দুর, ছলছল নদীর অপার বিস্তার, পৌষের মিঠে রোদ আর সোনালি বালুবেলার উজ্জ্বল ঝিকিমিকি, তারপর  সূর্যাস্ত হতে না হতেই মাতলা, বিদ্যে, ইছামতী, গোমর, রায়মঙ্গলের সমস্ত প্রদীপ নিভে গিয়ে অনন্ত কালো ঘন রহস্যের জলরেখা। ধারে ধারে দুর্ভেদ্য সুন্দরী-গরান-হেঁতাল-ম্যানগ্রোভের বন্য ভয়াবহতায় ওঁৎ পেতে থাকা হিংস্র শ্বাপদের শিকারের অপেক্ষায় হিসহিস শব্দ।

এখানেই প্রাণ হাতে করে যুগযুগ বসতি রতন করাল, লক্ষ্মণ পরামানিক, মৈনুদ্দিন মোল্লা, হামিদ শেখদের।

বৃষ্টিধরা মিষ্টি জল জমিয়ে রেখে ছোট্ট একচিলতে জমিতে চাষবাস করছিল রসিক নস্কর। সামান্য ধান কলাই তরমুজ, ঢ্যাঁড়স-পটল-কুমড়ো-ঝিঙে-লালশাক ফলাচ্ছিল। সেখানেও সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সর্বস্ব। এখন বুড়ো বাপ-মা-বৌ-ছেলেপুলে নিয়ে কীভাবে টিঁকবে জীবন রসিক ভাবছিল।

করুনা রোগটাকে এতকাল চিনত না এই বাদাবনের গাঁয়ের মানুষ। সুন্দরবন কেন? কোথাকার কেউ কি চিনত? হাঁচি-কাশি-জ্বর ও তো সবারই হয়। কিন্তু না, এ রোগ নাকি তেমন সাধারণ নয়। ছোট্ট একরত্তি বেজানু শরীরের ভেতর সেঁধিয়ে হিৎপিন্ডে-ফুসফুসে-লিভারে-পাকস্থলিতে পাকাপোক্ত বাসা বেঁধে বসে মানুষকে ঘায়েল করে। আর মানুষে-মানুষে ছোঁয়ায় নাকি খুব চটপট ছড়ায়ও এ রোগ। সেজন্যই মাক্স পরতে বলছে ডাক্তার। প্রশাসন। ডিসটেন রাখতে বলছে। ভীড়-জমায়েতও নিষেধ।

সুন্দরবনে মা শীতলা-মনসা-দক্ষিণরায়ের পুজো চলে ঢের। সম্বৎসর মীন ধরার পর নৌকা নিয়ে বড় গাঙে গিয়ে নদীর গভ্ভ খুঁড়ে মাছ আনতে যেতে হয় বৈকি। আর তাতে ঝুঁকিও খুব থাকে। তখনও তো কখনও করুনার কথা শোনেনি রসিক। কিন্তু এখন শুনছে। টিভি-রেডিওতে দিনরাতই বলছে করুনা করুনা। মাক্স পরো, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া লাগাও, সেনিটেজার মাখো… জ্বর-হাঁচি-কাশি হলে ডাক্তার দেখাও আর পরস্পর অনেক দূরে দূরে থাকো। অসুখটা হলে নাকি একটা ঘরে একজনাকে ঢুকে লুক্যে থাকতে হবে। তা নাহলে বাড়ির সব্বাকার হবে ওই রোগ। রসিকের খুব হাসি পায়। ছোট্ট এক টুকরো দরমার ঘরে ছজন মনিষ্যি বাস করে তারা। একজনা যদি গোটা ঘরখানার দখল নেয় তো বাকিরা ওই নৌকার ছইয়ের নীচে বসে থাকবে উবু হয়ে? নাকি গলুই ধরে ডেঁইরে থাকবে দুঠ্যাঙে…?

এখন বহুদিন কাজকম্মের কোনও সুরাহা নেই। রসিকের ছেলে-মেয়ের ইশকুল সেই যে গতবছরটায় বন্ধ হয়েছে খোলার নাম নেই। মিড-ডে মিলেও লকডাউন। ফিরি রেশনের চাল মিলছে। কিন্তু তাতে কুলোয় না। ঘরে একটু সব্জি… বেগুন, পটল, ঝিঙে, কুমড়ো, লাউ… মিষ্টি জলের ধার ঘেঁষে কমলি-লালতে শাক… অবরে-সবরে দুটো চারা মাছ, ঘরে পোষা মুরগির ডিম, ছাগলের দুধ… চলে যাচ্ছিল কোনওমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। যদিও তেমন খুশি নয় রসিক। ও চায় ছেলে-মেয়ে দুটো লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াক।

এ গাঁয়ের দু-একজন গরিবির মধ্যে থেকেও কষ্ট করে পড়ালেখা শিখে মানুষ হয়েছে। তাদের সংসারের ছিরিও ফিরেছে খানিক। কেউ কেউ চাটিবাটি আবাস গুটিয়ে শহরেই চলে গেছে। সেখানেই আস্তানা গেড়েছে। বাদাবনের নিত্য ঝড়-জল-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। রসিকও এমন সোনালি ভবিষ্যতের একটা স্বপ্ন মনে মনে দেখে। কিন্তু শিকড়ের টান সেও তো বড় টান।

নদীর পাড়ের বসতবাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ইশকুলবাড়ির ছাদে তিরপল টাঙানো আশ্রয়ে বসে রসিক আর তার বৌ হামিদা বাঁশের ফাঁক দিয়ে দেখছিল আকাশ। ঝড় কমেনি এখনও। থোকা থোকা কালো মেঘ মুখ গোমড়া করে আকাশটাকে ভারি করে রেখেছে। মাঝেমাঝে ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে তেরপলের কোণও উড়ে যায়।

নৌকা করে রিলিফ দিতে এসেছে অনেক পাটি, এনজিও টিম। প্যাকেট ভরে শুকনো চিঁড়ে-গুড়-বাতাসা-মুড়ির প্যাকেট বিলোচ্ছে। সবাই হাত বাড়িয়ে কাড়াকাড়ি করে নিচ্ছে। নিজের ন্যায্য পাওনাটা নিচ্ছে  নিয়ে নিমেষে লুকিয়ে ফেলছে। তারপর অন্যেরটাও নিচ্ছে। রসিকের খারাপ লাগে খুব। এরকম ভিখিরির মতো পরমুখাপেক্ষী জীবন তো সে চায়নি। কিন্তু এ কী অদৃষ্টের ললাটলিখন? এখন রসিক বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশের যুবক। গরিবের ঘরে জন্ম নিয়ে ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হল যখন ফি-বছর একই ছবি। বর্ষার তোড়ে দু কূল ছাপিয়ে আসে বন্যা। মাটি কেটে, বয়ে, ফেলে পিটে বাঁধগুলো সারাবছর ধরে গড়ে তোলে, মেরামত করে গ্রামের মানুষ। আর প্রতিবছরই ঝড়ের শাসানিতে রাগে ফুঁসে ওঠা জলের ধাক্কায় ভেঙে চুরমার হয়ে সর্বস্বান্ত হয় মানুষগুলো।

এই বাদাবনের এলাকার নফর, বিমল, যাদব, আবুল, রফিক কর্মসূত্রে এখন শহরের বাসিন্দা। প্রতিবছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধাক্কা আর কাবু করতে পারে না তাদের। রসিকও কি পেতে পারত না এমন জীবন? না, পায়নি। মালকোঁচা মেরে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে মাটি কেটে বয়ে বাঁধ মেরামতিতে সে হাত লাগাত যখন, তখন ওই ওপরের নামের মানুষগুলো থাকত না তার আশেপাশে। যখন যে পার্টি ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসেছে এই বাদা অঞ্চলের কিছু মানুষ সেসব হোমরাচোমরাদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করেছে। ওঠাবসা করেছে। তাতেই কি তাদের কারও কারও কেল্লাফতে হয়েছে?

কদিন আগেই দিল্লি থেকে গেরুয়াদলের চাঁই নেতারা এসে বাদাবনের পেটের ভেতর ঢুকে পাত পেড়ে ভুঁড়ি ঠেসে খেয়ে গেল। ইশকুলের বন্ধু নসিবকে তখন দেখেছিল রসিক চাঁইগুলোর সামনে হাত কচলাচ্ছিল আর গলে গলে গায়ে পড়ছিল। অনেকে বলছিল নসিবই নাকি জোগাড়-যন্ত্র করে এদের এখানে নিয়ে এসেছে। রসিককেও বলেছিল নসিব— তোদের বাড়িতে অনেকগুলো ভোট। দেখিস রসকে, যেন সবকটা গেরুয়ায় পড়ে।

নসিব চলে যেতে ফের পরপর এসেছিল সবুজ-লাল। তাদের সঙ্গেও রসিকের বন্ধুবান্ধবদের কেউ কেউ আছে। সবাই জমা হচ্ছে। মিটিং-মিছিল চলছে। মঞ্চ বাঁধা। মাইক আঁটা। কোনও ডিসটেনের বালাই নেই। অনেকের মাস্কও নেই। কিন্তু প্রশাসন তাদের বলছে না কিছু। পুলিশ দাঁড়িয়ে  আছে কাঠপুতলির মতো। মিটিঙে বলছে সবাই— আমাদের ভোট দিন। সুন্দরবনের মানুষের এই প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে নিয়ত সংগ্রামের দিন শেষ হবে। স্বাধীনতার পর থেকে আপনাদের সমস্যা নিয়ে ভাবেনি কোনও সরকার। ক্ষমতায় এলে মানুষের মতো বাঁচবার পথ করে দেব আমরাই।

ভোটপর্ব মিটে গেছে। ফলও বেরিয়ে গেছে। মাঝে কটা দিন খুব মারদাঙ্গা হল। এখন সব শান্তি-কল্যাণ। ঢের কিছু দেবে বলেছেল সরকার। প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসা রসিকদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। এটা দেব। ওটা দেব। সেটা দেব।

কিন্তু রসিকদের মতো অনেকেই এই দানসামগ্রী চায়নি। চেয়েছিল লেখাপড়া শিখে গতর আর মগজ খাটিয়ে সৎভাবে উপার্জন করতে। তারপর সাধ্যমতো নিজেদের বাসভূমি-মাতৃভূমিটার উন্নতি করতে। এই জল-জঙ্গল-জমিন আর  হাজার বছর ধরে লড়াই করে টিঁকে থাকা এখানকার  মানুষজন… রসিকরা এই শিকড় ছেড়ে একলা ভালো থাকতে চায়নি। সবাইকে নিয়ে সবার মধ্যে একটু নিশ্চিন্তে নিরাপদে সুখে-শান্তিতে থাকতে চেয়েছিল…

যতদূর চোখ যায় ঢেউখেলানো থৈ থৈ জল। নারকোলগাছের মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে জলের স্রোত। রাগী ঢেউয়ের আঘাতে  সড়ক ভেঙে-কেটে দুটুকরো ফালি হয়ে গেছে। সেই হাঁ হয়ে যাওয়া রাস্তার ধারেই কাতারে কাতারে মানুষ জানমাল সম্বল করে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে। কিছু কিছু উঁচু পাকা বাড়ির মাথায় গরিবগুর্বো সবখোয়ানো মানুষগুলোকে গরু-ছাগলের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারি-পুলিশ। সেখানে আশ্রয় নেওয়া হতদরিদ্র মানুষগুলোর মুখে করুনা আটকানোর মাস্ক থাকবে? থাকবে ডিসটেন?

রসিক ভাবে কোন শত্তুরের মার থেকে রেহাই পাবে এই চেনাজানা মানুষগুলো? কখনও করুনা তো কখনও বন্যা-ঝড়-প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কখনও  গরিবি তো কখনও রাজনৈতিক অত্যাচার। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া পাঁজরের গভীরে ঢুকে বুক জুড়ে গভীর শূন্যতা নিয়ে আসে। এত মানুষ থেকেও এ কোন স্তব্ধ শ্মশান?

আকাশে টহলদারি করছে প্রশাসনের হেলিকপ্টার। ওরা আকাশচারী। সমতলে নামেন না। নীচে কাতার দিয়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের মিছিল। হামিদা চিঁড়ে-মুড়ি সঞ্চয় করে রেখেছে। বন্যার জলের অতর্কিত ক্ষিপ্র বেগ থেকে কোনওমতে কয়েকটা জরুরি জিনিস বাঁচিয়েছে। ত্রাণশিবিরে খিচুড়ির গামলার পাশে বসে আধার কার্ডগুলো টিঁকে আছে কি না দেখছিল হামিদা। ভুললে চলবে না রসিক হামিদা এক স্বাধীন দেশের নাগরিক। জীবন বাজি রেখেও এই পরিচয়পত্রটি আগলে রাখতে হবে শেষ নিঃশ্বাস পড়া পর্যন্ত।