Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঈশ্বরের ঈশ্বর — প্রথম পর্ব

ঈশ্বরের ঈশ্বর: প্রথম পর্ব -- শিবাশীষ বসু

শিবাশীষ বসু

 


প্রাবন্ধিক, ইতিহাস-অন্বেষক

 

 

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের সবচেয়ে বড় বিতর্কিত অধ্যায় সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে তাঁর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটি। তাঁর ধর্মচিন্তা ও ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে যে বিতর্ক তাঁর জীবদ্দশাতেই আরম্ভ হয়েছিল, মৃত্যুর একশো ত্রিশ বছর পরেও তা মেটবার কোনও লক্ষণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও মতে তিনি ঠিক চিরাচরিত নিষ্ঠাবান হিন্দু না হলেও মোটের ওপর আস্তিক। কারও মতে তিনি পরিপূর্ণ নাস্তিক। আবার তৃতীয় একদল আছেন, যাঁরা মনে করেন তিনি ছিলেন অ্যাগনস্টিক বা সংশয়বাদী অথবা পজিটিভিস্ট বা প্রত্যক্ষবাদী। এই রহস্য এইজন্যেই আরও ঘনীভূত হয়েছে কারণ বিদ্যাসাগর নিজে এই বিশেষ বিষয়টি সম্বন্ধে ব্যক্তিগত পরিসরে ছুটকো-ছাটকা দুই-একটি মন্তব্য ছাড়া লিখিতভাবে কোনওদিনই তেমন কোনও বক্তব্য রাখেননি। আর আমাদের ট্র্যাজেডি হল বিবেকানন্দ অথবা রবীন্দ্রনাথের মতো বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার কোনও রেকর্ড কেউ রেখে যাননি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—

আমাদের কেবল আক্ষেপ এই যে, বিদ্যাসাগরের বসওয়েল কেহ ছিল না; তাঁহার মনের তীক্ষ্ণতা, সবলতা, গভীরতা ও সহৃদয়তা তাঁহার বাক্যালাপের মধ্যে প্রতিদিন অজস্র বিকীর্ণ হইয়া গিয়াছে, অদ্য সে আর উদ্ধার করিবার উপায় নাই।[1]

ফলশ্রুতিতে, বিদ্যাসাগরের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে আলোচিত রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিদ্যাসাগরের ঘরোয়া মনোভাব আমরা জানতে পারি না।

তবে এ-কথা নিয়ে বোধহয় কোনও বিতর্ক নেই যে, উনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে যত ব্যক্তি জন্মেছিলেন তাঁদের মধ্যে অক্ষয়কুমার দত্ত এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— এই দুজনই প্রত্যক্ষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন অনুভব করেননি, বরং ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ রেখে স্রেফ মানুষ এবং মানবতাবাদ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন। এই সেকুলার এবং মানবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যেই তাঁরা আধুনিক।

ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে বিদ্যাসাগর কী ছিলেন আর কী ছিলেন না, সে ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমরা একটু আলোচনা করে নেওয়ার চেষ্টা করি তাঁর মূল জীবনীকাররা এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর-গবেষকরা তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে ঠিক কী মূল্যায়ন করেছেন। এখানে একটা বিষয়ে পাঠকপাঠিকাগণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে প্রত্যেকের মতামতই ভয়ঙ্কর রকমের পরস্পরবিরোধী!

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাঁর ‘চরিতকথা’ প্রবন্ধগুচ্ছের অন্তর্গত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে লিখেছেন—

ঈশ্বর এবং পরকাল প্রভৃতি সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের কিরূপ বিশ্বাস ছিল, তাঁহার চরিত-লেখকেরা সে সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট কথা বলেন না। তবে সংসার হইতে দুঃখের অস্তিত্ব এক নিঃশ্বাসে উড়াইয়া দিয়া সুখের এবং মঙ্গলের রাজ্য কল্পনার বলে প্রতিষ্ঠা করা বোধ করি দয়ার সাগরের পক্ষে অসাধ্য ছিল। সমুদ্রতলে সার জন লরেন্স (এই নামে একখানা জাহাজ ৭০০ যাত্রী সহ কলিকাতা হইতে পুরী যাইবার সময় বাতাবৰ্ত্তে পড়িয়া সমুদ্রে মগ্ন হয়) ডুবাইয়া দিয়া দুনিয়ার মালিক কিরূপ করুণ প্রকাশ ও মঙ্গল সাধন করিলেন, এক নিঃশ্বাসে তিনি তাহা আবিষ্কার করিতে পারিতেন না। বস্তুতই দুঃখদাবানলের কেন্দ্রস্থলে উপবেশন করিয়া জগতের মঙ্গলময়ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা করা তাহার প্রকৃতির বিরূদ্ধ ছিল।[2]

ঘটনা এটাই, বিদ্যাসাগর সরাসরিভাবে কোনও বক্তব্য না রাখায় আমাদের পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং টুকরো-টাকরা কিছু কাহিনির মাধ্যমেই তাঁকে বুঝে নিতে হবে।

সম্ভবত বিদ্যাসাগর-গবেষকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত হলেন বিনয় ঘোষ। কিন্তু তিনিও বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আগাগোড়া বিভ্রান্ত। বিনয়বাবু লিখেছেন—

বিদ্যাসাগরচরিত্রের অত্যাশ্চর্য সঙ্গতি দেখা যায় তাঁর মূল জীবনদর্শনের মধ্যে। প্রচলিত ধর্ম (Religion) ও অধ্যাত্মবাদী ভারতীয় দর্শনের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের কোনও পরিবর্তন, তাঁর বার্ধক্য ও ব্যর্থতার জন্য, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত হয়নি। তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না এমন কথা বলা যায় না, তবে তিনি যে একেশ্বরবাদী ছিলেন এবং তাঁর ধর্মবিশ্বাস ও ঈশ্বরবিশ্বাস একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাঁর দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণের মধ্যেও তিনি কখনো এদিক দিয়ে কোনও অসঙ্গতির পরিচয় দেননি।[3]

নিজের বক্তব্যের সপক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে বিনয় ঘোষ হাজির করেন অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসুর স্মৃতিকথা, যাতে তিনি বলেছিলেন—

তাঁর ধর্ম্মজীবন-সম্বন্ধে এই বলা যায় যে তাঁর ধর্ম্মজীবন কর্ম্মগত ছিল। কাজই তাঁর কাছে ধর্ম্ম। তিনি একেশ্বরবাদী ছিলেন, বোধোদয়ে আমরা তার নিদর্শন পাই। … প্রতিমা পূজা তিনি লৌকিকভাবেই দেখতেন। কেন না বাড়িতে তো কোন পূজা হতে দেখিনি। মোটের উপর মনে হয় তিনি Agnostic সংশয়বাদী ছিলেন।[4]

কিন্তু পরক্ষণেই বিনয় ঘোষ পুনরায় মন্তব্য করেন—

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যয়ের দিক থেকে বিদ্যাসাগরকে বস্তুবাদী (Materialist) ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।[5]

বক্তব্যের স্ববিরোধিতাটি লক্ষ্যণীয়।

বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, বিদ্যাসাগর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও ঈশ্বরবিশ্বাস-বিহীন মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন হলে তাঁকে অশ্রদ্ধা করা হবে। তাই তিনি লিখেছেন—

কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হিন্দুভাব ও হিন্দুবুদ্ধির বিপর্যয় ঘটিয়াছিল। … হিন্দুভাব ও হিন্দুসংস্কারের রক্ষাকল্পে তিনি অপর কোন আস্থাবান হিন্দু অপেক্ষা ন্যূন ছিলেন না। কেহ কেহ দয়া করিয়া তাঁহাকে ভ্রান্ত হিন্দু বলিয়া পরম তৃপ্তি অনুভব করিয়া থাকেন, ইহা অপেক্ষা জাতীয় অপদার্থতা ও অধোগতির আর কি অধিক পরিচয় হইতে পারে? … তিনি আচারে ব্যবহারে চিরদিন সম্পূর্ণ হিন্দুভাব রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন; কখনও ভ্রমক্রমেও অখাদ্য ও অপেয় গ্রহণ করেন নাই।[6]

বিদ্যাসাগরের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, চণ্ডীচরণের শেষ লাইনটি নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের মতামত অনেকে জানবার এবং বোঝবার চেষ্টা করেছেন। গবেষক অমিয় সামন্ত জানিয়েছেন, বিদ্যাসাগরের বক্তব্য ছিল—

ধর্ম যে কী তা বর্তমান অবস্থায় মানুষের জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবার প্রয়োজন নাই।[7]

রামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থের লেখক মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত ওরফে শ্রীম মেট্রোপলিটান স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণ সকাশে বিভিন্ন সময়ে বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে একাধিক মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, ‘ধর্ম-বিষয়ে বিদ্যাসাগর কাহাকেও শিক্ষা দিতেন না।’ শ্রীম একদিন বিদ্যাসাগরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর হিন্দুদর্শন কীরূপ লাগে? বিদ্যাসাগর উত্তর দিয়েছিলেন—

আমার তো বোধ হয়, ওরা যা বুঝাতে গেছে, বুঝাতে পারে নাই।[8]

আরেকবার, ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৮২, বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রীম রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন যে, বিদ্যাসাগর অভিমান করে বলেন—

ঈশ্বরকে ডাকবার আর কি দরকার! দেখ চেঙ্গিস খাঁ যখন লুটপাট আরম্ভ করলে তখন অনেক লোককে বন্দী করলে; ক্রমে প্রায় এক লক্ষ বন্দী জমে গেল। তখন সেনাপতিরা এসে বললে মহাশয়, এদের খাওয়াবে কে? সঙ্গে এদের রাখলে আমাদের বিপদ। কি করা যায়? ছেড়ে দিলেও বিপদ। তখন চেঙ্গিস খাঁ বললেন, তাহলে কি করা যায়। ওদের সব বধ কর। তাই কচাকচ করে কাটবার হুকুম হয়ে গেল। এই হত্যাকাণ্ড তো ঈশ্বর দেখলেন? কই একটু নিবারণ তো করলেন না। তা তিনি থাকেন থাকুন, আমার দরকার বোধ হচ্ছে না। আমার তো কোন উপকার হল না![9]

বস্তুত, বিদ্যাসাগর এভাবেই একাধিকবার কথাপ্রসঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বে সংশয় প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত এই কারণেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে অ্যাগনস্টিক বলেছিলেন। বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিজেন্দ্রনাথের জবাব, “ঐ একরকমের নাস্তিক ছিলেন, যাকে বলে অজ্ঞেয়বাদী।”[10] একই কথা কিঞ্চিৎ ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও। ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং ধর্মতত্ত্বচর্চার উদ্দেশ্যে প্রকাশিত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত এবং গ্রন্থাধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগর মিলেমিশে ক্রমেই সে পত্রিকায় ধর্মতত্ত্বের পরিবর্তে  বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের লেখাপত্র ছাপাতে থাকেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় উত্তেজিত হয়ে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে রাজনারায়ণ বসুকে চিঠিতে লেখেন, “কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিস্কৃত না করিয়া দিলে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।”[11] স্পষ্টতই, দেবেন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার এবং বিদ্যাসাগরের প্রতিই ইঙ্গিত করেছিলেন। আবার সমস্ত জল্পনা-কল্পনা উড়িয়ে দিয়ে ‘কলিকাতায় বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে রাধারমণ মিত্র ঘোষণা করেন—

তিনি নিজে পজিটিভিস্টও ছিলেন না— অ্যাগনস্টিকও ছিলেন না। পুরাপুরি নাস্তিক ছিলেন।[12]

রাধারমণবাবু সাক্ষী মেনেছেন আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যকে।

কৃষ্ণকমল বালক বয়স থেকে বিদ্যাসাগরকে চিনতেন, যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতাও ছিল। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর প্রায় দুই দশক পরে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কৃষ্ণকমল বলেন—

বিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, একথা বোধ হয় তোমরা জান না; যাঁহারা জানিতেন, তাঁহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাঁহার সহিত কখনও বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না; কেবল রাজা রামমোহন রায়ের জ্যৈষ্ঠপুত্র রাধাপ্রসাদ রায়ের দৌহিত্র ললিত চাটুয্যের সহিত বিদ্যাসাগর পরলোকতত্ত্ব লইয়া হাস্যপরিহাস করিতেন।[13]

কৃষ্ণকমল বিদ্যাসাগরের নাস্তিকতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন সমসাময়িক সামাজিক অবস্থার মধ্যে। তাঁর মতে—

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আমাদের দেশে যখন ইংরাজি শিক্ষার প্রবর্ত্তন আরম্ভ হয়, তখন আমাদের সমাজের অনেকের ধর্মবিশ্বাস শিথিল হইয়া গিয়াছিল; যে সকল বিদেশীয় পণ্ডিত বাংলাদেশে শিক্ষকতা করিতে আরম্ভ করিলেন, তাঁহাদেরও অনেকের নিজ নিজ ধর্ম্মে বিশ্বাস ছিল না। ডেভিড হেয়ার নাস্তিক ছিলেন, এ কথা তিনি কখনও গোপন করেন নাই; ডিরোজিও ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবের সাম্যমৈত্রীস্বাধীনতার ভাব হৃদয়ে পোষণ করিয়া ভগবানকে সরাইয়া দিয়া Reason-এর পূজা করিতেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাব বন্যায় এদেশীয় ছাত্রদের ধর্মবিশ্বাস টলিল; চিরকাল পোষিত হিন্দুর ভগবান সেই বন্যায় ভাসিয়া গেলেন; বিদ্যাসাগর নাস্তিক হইলেন, তাহাতে আর বিচিত্র কি![14]

কৃষ্ণকমলের বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতা করে চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন—

অনেকের ধারণা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোন প্রকার ধর্ম্মবিশ্বাস ছিল না। কিন্তু আমরা তাঁহার সহিত এই বিষয়ে কথাবার্ত্তা কহিয়া যতদূর বুঝিতে পারিয়াছিলাম, এবং তাঁহার আচার আচরণ হইতে যতদূর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে এইরূপ বোধ হয় যে, তিনি ঈশ্বর-বিশ্বাসী লোক ছিলেন। তবে তাঁহার ধর্ম্মবিশ্বাস, সাধারণ লোকের অনুষ্ঠিত কোন এক পদ্ধতির অধীন ছিল না। সূক্ষ্মতর রূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে গেলে তাঁহার নিত্য জীবনের আচার ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপসম্পন্ন আস্থাবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না, অপরদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মের লক্ষণের পরিচয়ও কখনও পাওয়া যায় নাই।[15]

অমিয় সামন্ত যথার্থই বলেছেন—

সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে বিদ্যাসাগরকে নাস্তিক বলাও যেমন দুরূহ, তেমনি তাঁকে ঈশ্বরবিশ্বাসী বললে অবধারিতভাবে সত্যের অপলাপ হবে। তিনি অজ্ঞেয়বাদী বা সংশয়বাদী ছিলেন— এইটিই বোধহয় বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি। একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয় যে, বিদ্যাসাগরের মত বিখ্যাত ব্যক্তি পরম যত্নে সার্থকভাবে নিজের অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসের জগৎটিকে সাধারণ মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।[16]

পঞ্চপুস্প, আষাঢ় ১৩৩৬ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগর স্মৃতি’ প্রবন্ধে অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসু লিখেছেন—

অনেক দিন কেটেছে এমন যে বিকেল থেকে ঠায় ঘরে বসে গল্পগুজব হতে হতে রাত হয়ে গেছে, সেইখানেই খাবার-টাবার এল, সকলের সঙ্গে তিনিও খেলেন, সন্ধ্যা-আহ্নিক করতে তো দেখিনি।[17]

আমরা ক্ষুদিরামবাবুর এই বক্তব্যের সমর্থন পাই বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে। চণ্ডীচরণ লিখেছেন, বিদ্যাসাগর যখন সাহিত্য শ্রেণির ছাত্র তখন—

সন্ধ্যাদির নিত্যকর্ম্ম ভুলিয়া  গিয়াছিলেন, কিন্তু সন্ধ্যার ক্রমগুলি এরূপভাবে দেখাইতেন যেন সন্ধ্যা করিতেছেন, কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে তাঁহার সন্ধ্যা স্মরণ ছিল না এবং সন্ধ্যা করিতেন না।[18]

আর এক জীবনীকার গোঁড়া হিন্দু বিহারীলাল সরকার গভীর আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন—

বিদ্যাসাগরের যখন জন্ম হয়, সে সময় ব্রাহ্মণের ঘরে নিত্য সন্ধ্যা-আহ্নিক করিত না, এমন লোক প্রায় দেখা যাইত না; কিন্তু নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসাগর, উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্ব্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন।[19]

কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়, ধর্মের নামে কিছু ক্ষতিকর দেশাচারকেও বিদ্যাসাগর শ্রদ্ধা করতেন না, তাঁর বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে, এ আমরা বারবার দেখেছি। হিন্দু কলেজের কিছু ছাত্র সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘সর্ব্বশুভকরী’ নামে একটি পত্রিকা শুরু করেন। বিদ্যাসাগর নিজে এই পত্রিকায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখা ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার যেমন চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে লোকের জিহ্বা বিদ্ধ করা, চড়কে পিঠ ফোঁড়া, মৃত্যুর পূর্বে গঙ্গায় অন্তর্জলী করা— এইসব প্রথার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখবার জন্য তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের সুলেখক মাধবচন্দ্র তর্কসিদ্ধান্ত গোস্বামী এবং দীনবন্ধু ন্যয়রত্নকে ভার দিয়েছিলেন।

‘বিদ্যাসাগর চরিত’-এ রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে একটি কাহিনি শুনিয়েছেন—

বিদ্যাসাগর পিতৃদর্শনে কাশীতে গমন করিলে সেখানকার অর্থলোলুপ কতকগুলি ব্রাহ্মণ তাঁহাকে টাকার জন্য ধরিয়া পড়িয়াছিল। বিদ্যাসাগর তাহাদের অবস্থা ও স্বভাবদৃষ্টে তাহাদিগকে দয়া বা ভক্তির পাত্র বলিয়া জ্ঞান করেন নাই; সেইজন্য তৎক্ষণাৎ অকপটচিত্তে উত্তর দিলেন, ‘এখানে আছেন বলিয়া আপনাদিগকে যদি আমি ভক্তি শ্রদ্ধা করিয়া বিশ্বেশ্বর বলিয়া মান্য করি, তাহা হইলে আমার মতো নরাধম আর নাই।’ … ইহা শুনিয়া কাশীর ব্রাহ্মণেরা ক্রোধান্ধ হইয়া বলেন, ‘তবে আপনি কী মানেন?’ বিদ্যাসাগর উত্তর করিলেন, ‘আমার বিশ্বেশ্বর ও অন্নপূর্ণা উপস্থিত এই পিতৃদেব ও জননীদেবী বিরাজমান।’ যে বিদ্যাসাগর হীনতম শ্রেণীর লোকেরও দুঃখমোচনে অর্থব্যয় করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না, তিনি কৃত্রিম কপট ভক্তি দেখাইয়া কাশীর ব্রাহ্মণের প্রার্থনা পূর্ণ করিতে পারিলেন না। ইহাই বলিষ্ঠ সরলতা, ইহাই যথার্থ পৌরুষ।[20]

সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধে আরেকজন প্রখ্যাত বিদ্যাসাগর-গবেষক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বিদ্যাসাগরের ধর্ম না-বিশ্বাস নিয়ে আরেকটি কাহিনি শুনিয়েছেন। কাহিনিটি হল—

উনিশ শতকের শেষে বাঙলায় হিন্দু ধর্মকে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তার নেতা ছিলেন শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫২-১৯২৮)। তিনি থাকতেন কাশীতে; প্রচারের জন্যে তাঁকে কলকাতায় আনা হয়েছিল। তিনি একবার গেছিলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করতে৷ বিদ্যাসাগর তাঁকে বলেন, ‘আপনাকে হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্য যাঁরা এনেছেন তাঁরা যে কেমন দরের হিন্দু তা তো আমি বেশই জানি, তবে আপনি এসেছেন, বক্তৃতা করুন। লোকে বলবে, বেশ বলেন ভালো। এমন একটা প্রশংসালাভ করবেন এইমাত্র।’ এর পরে তিনি যোগ করেন, ‘আমার স্কুলের (মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন-এর) ছেলেরা যে মুরগির মাংস খায়, আপনার বক্তৃতায় তাঁরা যে সে মাংস ছাড়বে আমি তা একেবারেই বিশ্বাস করি না।’ কথাগুলি শশধরও লিখে যাননি, বিদ্যাসাগরও না। একজন তৃতীয় ব্যক্তি, শশিভূষণ বসু ঘটনাটি লিখেছেন।[21]

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বিষয়ে বিদ্যাসাগরের উদাসীনতার আরএক নিদর্শন রামকৃষ্ণ-বিদ্যাসাগর সাক্ষাৎকার। ৫ আগস্ট, ১৮৮২ সেই সময়কার অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে ছিলেন জীবনীকার শ্রীম। ঘন্টাখানেকের সেই সাক্ষাৎকারে রামকৃষ্ণই ছিলেন বক্তা, বিদ্যাসাগর ছিলেন মূলত শ্রোতা। ভক্তিরসে নিমজ্জমান ভাববাদী রামকৃষ্ণ পুরো সময়টা ধোঁয়াশাপূর্ণ কথা বলেছেন নানা বিষয়ে, গান গেয়েছেন, বস্তুবাদী বিদ্যাসাগর কোনও বিরক্তি প্রকাশ করেননি। রামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কথা বিদ্যাসাগরের মনে কোনও দাগ কাটেনি। তিনি শেষপর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে সরাসরিভাবে নিজের বিশ্বাসের কথাও জিজ্ঞাসা করেছেন। বিদ্যাসাগর স্বভাবতই রামকৃষ্ণের ব্যাখ্যার সঙ্গে সহমত হতে পারেননি, তাই প্রশ্নের সরাসরি জবাব এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, “আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব।”[22] ক্ষ্যণীয় যে, বিদ্যাসাগর কোনও তর্কের সৃষ্টি করেননি, নিঃসন্দেহে তা শিষ্টাচারবিরোধী হত; অল্প কথায় নিজের মনের ভাব বুঝিয়ে দিলেন। রামকৃষ্ণ বুঝেছিলেন তাঁর ভাববাদী কথা বিদ্যাসাগরের মনে দাগ কাটছে না, তাই বুদ্ধিমান রামকৃষ্ণ একবারও বিদ্যাসাগরকে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির দেখতে আসবার আমন্ত্রণ করলেন না, পরিবর্তে বললেন, “একবার বাগান দেখতে যাবেন, রাসমণির বাগান। ভারী চমৎকার জায়গা।”[23] যদিও বিদ্যাসাগর কোনওদিনও সে পথে পা বাড়াননি।

বাকচাতুর্য দ্বারা বিদ্যাসাগরকে বশ করতে না পারার জ্বালা ভুলতে পারেননি রামকৃষ্ণ পরবর্তীকালেও। তাই কথামৃতকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের সামনে বহুবার বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য নিয়ে খোঁটা দিয়েছেন রামকৃষ্ণ, বলেছেন, (১৫ জুন, ১৮৮৩)—

বিদ্যাসাগরের এক কথায় তাকে চিনেছি, কতদূর বুদ্ধির দৌড়! যখন বললুম শক্তিবিশেষ, তখন বিদ্যাসাগর বললে, মহাশয়, তবে কি তিনি কারুকে বেশি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন? আমি অমনি বললুম, তা দিয়েছেন বইকি। শক্তি কম বেশি না হলে তোমার নাম এত কম হবে কেন? তোমার বিদ্যা, তোমার দয়া— এই সব শুনে তো আমরা এসেছি। তোমার তো দুটো শিং বেরোয় নাই! বিদ্যাসাগরের এত বিদ্যা, এত নাম, কিন্তু এত কাঁচা কথা বলে ফেললে, ‘তিনি কি কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?’ কি জান, জালে প্রথম প্রথম বড় বড় মাছ পড়ে— রুই, কাতলা। তারপর জেলেরা পাঁকটা পা দিয়ে ঘেঁটে দেয়, তখন চুনোপুঁটি, পাঁকাল এই সব মাছ বেরোয়— একটু দেখতে দেখতে ধরা পড়ে। ঈশ্বরকে না জানলে ক্রমশঃ ভিতরের চুনোপুঁটি বেরিয়ে পড়ে। শুধু পণ্ডিত হলে কি হবে?[24]

কখনও বলেছেন, (২২ জুলাই, ১৮৮৩)—

বিদ্যাসাগরের পাণ্ডিত্য আছে, দয়া আছে, কিন্তু অর্ন্তদৃষ্টি নাই। অন্তরে সোনা চাপা আছে, যদি সেই সোনার সন্ধান পেত, এত বাহিরের কাজ যা কচ্ছে সে-সব কম পড়ে যেত; শেষে একেবারে ত্যাগ হয়ে যেত।[25]

ঈশ্বর তথা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্বন্ধে বিদ্যাসাগরের অনীহাটুকু বুদ্ধিমান রামকৃষ্ণের নজর এড়ায়নি।

রামকৃষ্ণের আমন্ত্রণের পরে বিদ্যাসাগর আরও নয় বছর জীবিত ছিলেন। এই কয় বছরে তিনি একাধিকবার কার্মাটার গেছেন, গেছেন চন্দননগর বা ফরাসডাঙা কিন্তু ঘরের কাছে রাসমণির বাগানে হিম্দু অভিজাত মহলে ক্রমেই বিখ্যাত হয়ে ওঠা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সাধনপীঠ দেখবার কোনও তাগিদই অনুভব করেননি। রামকৃষ্ণ ক্ষোভের সঙ্গে শ্রীমকে বলেন— “বিদ্যাসাগর সত্য কথা কয় না কেন? সত্যবচন, পরস্ত্রী মাতৃসমান। এই সে হরি না মিলে তুলসী ঝুটজবান। সত্যতে থাকলে তবে ভগবানকে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগর সেদিন বললে, এখানে আসবে, কিন্তু এল না।”[26] বস্তুত তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজের গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মহেন্দ্রলাল সরকার, শিবনাথ শাস্ত্রী, কেশবচন্দ্র সেন ইত্যাদি অসংখ্য ব্যক্তির উপর প্রভাব ফেলা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেননি— এই ব্যর্থতাই তাঁকে অকারণে কথোপকথনের সময় বারবার বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ টেনে এনে রূঢ় সমালোচনা করতে প্রবৃত্ত করেছে।

প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম অথবা ঈশ্বরের প্রতি বিদ্যাসাগরের এই ঔদাসীন্য মৃত্যু পর্যন্ত অম্লান ছিল। মৃত্যুর দুই-তিনমাস আগে তাঁর কন্যা বাড়িতে শান্তি-স্বস্ত্যায়নের ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘ কয়েকবছর রোগভোগের পর বিদ্যাসাগর মানসিক ও শারীরিকভাবে তখন জীর্ণ শীর্ণ। সচরাচর সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েন। নিজের বিশ্বাস না থাকলেও কন্যার অনুরোধে তাঁর মন রাখবার জন্য তিনি হোম-যজ্ঞের প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। এবার ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্রের লেখনী থেকে জানা যাক, “একতলার যে ঘরে হোম হয়েছিল, সেটি ছিল দোতলা থেকে নামার সিড়ির পাশে। কিন্তু সে ঘরে বিদ্যাসাগর প্রবেশ করেন নাই। কন্যার বিশেষ অনুরোধে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঈষৎ হেসে বললেন, মা এইখানেও ধোঁয়া আসছে, মনে দুঃখ করিস না।”[27] তিল তিল করে যন্ত্রণা পেয়ে মৃত্যুর সন্নিকটে থাকা বিদ্যাসাগর জীবনের অন্তিম পর্বেও ততটাই বস্তুবাদী ছিলেন।

এতক্ষণ আমরা বিদ্যাসাগরের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী মতামত পেলাম, এবার দেখব বিদ্যাসাগর-সমালোচকরা এই বিষয়ে তাঁর সমালোচনা করতে গিয়েও কেমন আস্তিকতা-নাস্তিকতার ফাঁদে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছেন।

 

দুই

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একজন বড় সমালোচক পরমেশ আচার্য লিখেছেন, ‘বোধোদয়’-এর প্রথম সংস্করণ শুরুই হয়েছিল ‘ঈশ্বর ও ঈশ্বরসৃষ্ট পদার্থ’ দিয়ে। তিনি নাকি অনেক খুঁজেপেতে ১৮৫১ সালে প্রকাশিত বোধোদয়ের প্রথম সংস্করণটি উদ্ধার করেছেন এবং লক্ষ করেছেন “বিদ্যাসাগর এদিকে যে বোধোদয়ের প্রথম সংস্করণেই ঈশ্বরকে জায়গা দিয়ে বসে আছেন।”[28] অতএব প্রমাণ হয়ে গেল, তিনি একেবারেই আস্তিক মানুষ। পরমেশবাবুর মতো করিৎকর্মা গবেষক না হলেও আমরাও খুঁজেপেতে ১৮৫২ সালে প্রকাশিত বোধোদয়ের দ্বিতীয় সংস্করণটি উদ্ধার করতে পেরেছি। এবং দেখা যাচ্ছে পরমেশবাবুর অভিযোগটি নিখাদ সত্যি। বোধোদয়ের প্রথম প্রকরণ হল— ঈশ্বর ও ঈশ্বরসৃষ্ট পদার্থ। প্রথম অনুচ্ছেদে পদার্থের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এসেছে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ:

ঈশ্বর সকল পদার্থেরই সৃষ্টিকর্ত্তা। তিনিই প্রথমে চেতন, অচেতন, উদ্ভিদ সমুদয় পদার্থ সৃষ্টি করিয়াছেন। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য্য, সমুদ্র, পর্ব্বত, তরু, লতা, মনুষ্য, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ প্রভৃতি সকলই তাঁহার সৃষ্টি। এই নিমিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্ত্তা কহে। ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যায় না, কিন্তু সর্ব্বদা সর্ব্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি তিনি তাহা দেখিতে পান; এবং যাহা মনে ভাবি তাহাও জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু। তিনি যাবতীয় জীব জন্তুকে আহার দেন ও রক্ষা করেন। অতএব ঈশ্বরকে ভক্তি, স্তব ও প্রণাম করা আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম।[29]

এই সূত্রে পরমেশবাবু বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছেন—

যাঁরা বিদ্যাসাগরকে শুধু ‘রিয়ালিস্ট’ নয় প্রায় ‘মেটেরিয়ালিস্ট’ বলতে বাকি রেখেছেন, তাঁরা এখন কী বলবেন জানি না।[30]

এখন মজার ব্যাপার হল, সে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবধারার সমালোচকই হন অথবা নিখাদ হিন্দুত্ববাদী সমালোচকই হন; বিদ্যাসাগরকে আর পাঁচজনের মত আস্তিক প্রমাণ করতে পারলে উভয়েই যেন অর্গাজমের আনন্দ পান। এ ব্যাপারে উভয়েই যেন মাসতুতো ভাই! অতএব ডঃ অচিন্ত্য বিশ্বাসের ‘বিদ্যাসাগর নির্মাণ: পরিকল্পিত মিথ্যাচার’ প্রবন্ধেও আমরা দেখি উত্তর-ঔপনিবেশিক বুদ্ধিজীবী পরমেশ আচার্যের প্রতিধ্বনি—

বোধোদয়ের প্রথম অনুচ্ছেদ ‘পদার্থ’। এ থেকে জড়বাদী মহান আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মেধাবীদের আনন্দের সীমা নেই। তাঁদের ধারণা ঈশ্বর-অনুচ্ছেদটি পরে রাখার মাধ্যমে তাঁরা মনোমত বস্তুবাদী-বিদ্যাসাগর নির্মাণের চেষ্টা করছেন। অথচ ‘বোধোদয়’র পরবর্তী অনুচ্ছেদ কি তাঁরা পড়ে দেখেছেন? চেতন পদার্থ অনুচ্ছেদে যখন তিনি লিখেছেন: ‘পুত্তলিকার চক্ষু আছে, দেখিতে পায় না, মুখ আছে খাইতে পারে না, … ইহার কারণ এই পুত্তলিকা জড় পদার্থ; উহার চেতনা নাই। ঈশ্বর কেবল প্রাণীদিগকে চেতনা দিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর কাহারও চেতনা দিবার ক্ষমতা নাই।’ অজ্ঞতা ভালো নয়। অজ্ঞের পাণ্ডিত্যাভিলাষ অত্যন্ত মন্দ।[31]

এঁরা কে যে কার হয়ে খেলছেন, বলা কঠিন।

যতদূর জানা যায়, ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত বোধোদয়ের পঞ্চম সংস্করণে ঈশ্বর-প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে দেন বিদ্যাসাগর। এখানে প্রশ্ন ওঠে কেনই বা বিদ্যাসাগর বোধোদয়ে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ এনেছিলেন আর কেনই বা তা বাদ দিলেন? কেন এনেছিলেন তা নিয়ে বিশেষ বিতর্ক নেই। কারণ সে সময়ে পাঠ্যপুস্তকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ সম্পূর্ণরূপে বর্জিত হলে শিক্ষাবিভাগের কাছে বইটি সম্ভবত গ্রাহ্য হত না। এর পর প্রশ্ন ওঠে তাহলে কোন সাহসে তিনি এটি মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই বর্জন করলেন? পরমেশবাবু এর কারণ সম্বন্ধে দাবী করেছেন—

১৮৫৪ সালের উডস ডেসপ্যাচ এবং ১৮৫৯ সালের স্ট্যানলি ডেসপ্যাচ খুললে দেখা যাবে, ব্রিটিশ সরকার শিক্ষা-ব্যাপারে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ থাকার কথা বলছে। শুধু বলছে না, উনিশ শতকের শিক্ষার ইতিহাস সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন ব্রিটিশ সরকার ওই সময়ে এ বিষয়ে কীরকম সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছে। মনে রাখতে হবে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সঙ্গে ধর্মীয় প্রশ্ন জুড়ে যাওয়ায় সরকার কোনওরকম ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না।[32]

নিজের বক্তব্যের সমর্থনে পরমেশবাবু তথ্যসূত্র হিসেবে এইচ এ স্টার্ক রচিত বইয়ের ৭৪ পৃষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। বইটা পরমেশ বাবু আদৌ পড়েছেন কি? কারণ দেখা যাচ্ছে, উডস ও স্ট্যানলি ডেসপ্যাচ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে স্টার্কসাহেব ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে একটিমাত্র লাইন লিখেছেন—

The system must be extended upwards by the establishment of Government schools as models, to be superseded gradually by schools started on the grant-in-aid principle. This principle is to be of perfect religious neutrality, …[33]

বেশ ভালো কথা। কিন্তু ঠিক এইখানেই যে কয়েকটা গোলমেলে প্রশ্ন এসে যায় পরমেশবাবু। প্রশ্নগুলি তুলেছেন ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক দেবাশিস ভট্টাচার্য, এই আন্তর্জাল পত্রিকাতেই প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে। দেবাশিসবাবুর যু্ক্তি হল—

প্রথমত, ১৮৫৯ সালের ‘স্ট্যানলি ডেসপ্যাচ’-এর প্রসঙ্গটিই এখানে সম্পূর্ণ অবান্তর, যেহেতু ১৮৫৯ সালের নির্দেশিকা কিছুতেই ১৮৫৬ সালের একটি বইয়ের বিষয়বস্তু-পরিবর্তনের কারণ হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ১৮৫৪ সালের ‘উড’স ডেসপ্যাচ’ যদি বা ১৮৫৬ সালের ‘বোধোদয়’ সংস্করণের বিষয়বস্তু-পরিবর্তনের কারণ হলেও হতে পারে, কিন্তু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের চাপে ১৮৫৪ সালের শিক্ষা-দলিল কিছুতেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি নিতে পারে না।[34]

সর্বোপরি, পরমেশবাবুর মতো “উনিশ শতকের শিক্ষার ইতিহাস সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন” যে, ব্রিটিশ সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি কোনওকালেই এমন কঠোর ছিল না যে শিশুপাঠ্য বইতে স্রেফ নিরপেক্ষভাবে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ থাকলেই, সে বই বাতিল করে দেওয়া হবে! স্পষ্টতই, পরমেশবাবু এখানে নিজস্ব কল্পনার ঘোড়াকে দৌড় করিয়ে সনতারিখ সব গুলিয়ে নিজস্ব ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

ঠিক কোন সংস্করণে ঈশ্বরের বর্জন ঘটল তা না হয় মোটামুটিভাবে জানা গেল কিন্তু পরবর্তী কোন সংস্করণে ঈশ্বরের পুনরাগমন ঘটেছিল তা আজ পর্যন্ত রহস্যাবৃত। একইরকমের রহস্যাবৃত রয়ে গেছে ঈশ্বর বর্জন ও পুনর্গ্রহণের কারণও। সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে গবেষক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন—

বিদ্যাসাগর বোধোদয়-এর প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে ‘ঈশ্বর ও ঈশ্বরসৃষ্ট পদার্থ’ অংশটি থাকলেও (সম্ভবত) পঞ্চম সংস্করণ থেকে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ বাদ দিলেন, আবার ১০৫তম সংস্করণে কেনই বা প্রথমে ‘পদার্থ’ ও তার পরে ‘ঈশ্বর’ নামে দুটি আলাদা অংশ আনলেন— সে রহস্যও ভেদ করা যায় না।[35]

রামকৃষ্ণবাবু বোধহয় সামান্য ভুল করেছেন কারণ ১২৯৩ বঙ্গাব্দে (১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে) প্রকাশিত বোধোদয়ের ৯৬তম সংস্করণে দেখা যাচ্ছে বইটি শুরু হয় ‘পদার্থ’ দিয়ে; দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসছে ‘ঈশ্বর’। এই শেষ নয়। এবার লেখা আছে, “ঈশ্বর, কি চেতন, কি অচেতন, কি উদ্ভিদ, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নিমিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে। ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ। তাঁহাকে কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান; আমরা যাহা মনে ভাবি, তিনি তাহা জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু; তিনি সমস্ত জীবের আহারদাতা ও রক্ষাকর্তা।”[36] স্পষ্টতই, প্রথম সংস্করণের শেষে যে বাক্যটি ছিল— ‘অতএব ঈশ্বরকে ভক্তি, স্তব ও প্রণাম করা আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম’— সেটিও পুরোপুরি বাদ চলে গেছে। আগেই বলেছি, ঠিক কবে কোন সংস্করণে ঈশ্বরের পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল তা আমরা জানতে পারিনি। সম্ভবত ঈশ্বরের পুনরাগমনের ঘটনাটি ঘটেছিল বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর অনুযোগের পর।

এই অনুযোগের ঘটনাটি অন্যতম জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থে বিবৃত করেছেন। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাতে এই বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন—

তিনি একবার বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত সাক্ষাত করিয়া বোধোদয় সম্বন্ধে বলেন, ‘মহাশয়, অনেকে আমার নিকট বলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় ছেলেদের জন্য এমন সুন্দর একখানি পাঠ্যপুস্তক রচনা করিলেন, বালকদের জানিবার সকল কথাই তাহাতে আছে, কেবল ঈশ্বর বিষয়ে কোন কথা নাই কেন?’ বিদ্যাসাগর মহাশয় একটু হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ‘যাঁহারা তোমার কাছে ঐরূপ বলেন, তাঁহাদিগকে বলিও, এইবার যে বোধোদয় ছাপা হইবে, তাহাতে ঈশ্বরের কথা থাকিবেক।’ ইহার পরবর্ত্তী সংস্করণ হইতেই ঈশ্বর সম্বন্ধে একটি পাঠ বোধোদয়ে সন্নিবিষ্ট হইল।[37]

বিদ্যাসাগরের আরেক জীবনীকার মনি বাগচির মতে, ‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’, বোধোদয়ের এই বিখ্যাত বাক্যটি আবার বিদ্যাসাগরের নিজস্ব নয়— ধার করা।

বোধোদয় বেরবার দশ বছর আগে, তত্ত্ববোধিনী সভার তৃতীয় বার্ষিক উৎসব সভায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বক্তৃতায় সর্বপ্রথম এই কথাটির উল্লেখ করেন। … কথাটি সম্ভবত বিদ্যাসাগরের মনে লেগে ছিল, তাই দশ বছর বাদে বোধোদয়ে ‘ঈশ্বর’ বিষয়ক প্রবন্ধে এটি সন্নিবেশিত করেন।[38]

স্পষ্টতই, বোধোদয় থেকে ঈশ্বরের বরখাস্তের পর রক্ষণশীল হিন্দুরা তো বটেই, এমনকি তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল ব্রাহ্মরাও গোঁসা করেছিলেন। ঈশ্বরের পুনরাবির্ভাবের পরে ব্রাহ্মরা খুশি হলেও রক্ষণশীল হিন্দুরা এর বাচনভঙ্গি নিয়ে যে বিশেষ খুশি ছিলেন না, তারও উদাহরণ আছে। ঈশ্বরকে ‘নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ’ বর্ণনা করায় স্বামী বিবেকানন্দ যথেষ্টই ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। বাল্যবন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ-র লেখা ‘স্বামীজির স্মৃতি’ থেকে জানা যায় একদিন বিবেকানন্দ শিশুদের উপযোগী কোনও পাঠ্যপুস্তক না থাকার জন্য আক্ষেপ করলে উপস্থিত একজন তাঁকে বিদ্যাসাগরের লেখা পুস্তকগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দেন৷ তিনি তখন উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন এবং বলেন—

…’ঈশ্বর নিরাকার, চৈতন্যস্বরূপ’, ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’— ওতে কোনও কাজ হবে না, ওতে মন্দ বই ভাল হবে না। রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ থেকে ছোট ছোট গল্প নিয়ে অতি সোজা ভাষায় কতকগুলি বাঙলাতে আর কতকগুলি ইংরেজীতে কেতাব করা চাই। সেইগুলি ছোটছেলেদের পড়াতে হবে।[39]

বিদ্যাসাগরের অপর জীবনীকার রক্ষণশীল বিহারীলাল সরকারও এই প্রসঙ্গ নিয়ে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তিনি মন্তব্য করেছেন—

বোধোদয় হিন্দু-সন্তানের সম্যক পাঠোপযোগী নহে। বোধোদয়ে বুদ্ধির অনেক স্থলে বিকৃতি ঘটিবারই সম্ভাবনা। ‘পদার্থ তিন প্রকার— চেতন, অচেতন ও উদ্ভিদ’; আর ‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ ইহা বালক ত বালক, কয়জন বিজ্ঞতম বৃদ্ধের বোধগম্য হয় বল দেখি?[40]

স্পষ্টতই যে বস্তুবাদী শিক্ষাধারার চর্চা বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন তা স্বভাবতই ওনাদের পছন্দ হয়নি।

বিদ্যাসাগর রচিত শিশুপাঠ্য ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থেও ধর্মীয় সুর খুঁজে পেয়েছেন পরমেশবাবু। তিনি লিখেছেন—

“উনিশ শতকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কান পাতলেই এই সময়ের ধর্মীয় আন্দোলনের সুর শোনা যায়। শিশুপাঠ্য বইতেও এই সুর শোনা যায়। ঈশ্বরচন্দ্রের ‘বর্ণপরিচয়’ বা ‘শিশু-সেবধি নীতি দর্শক’ এই সুরে লেখা পাঠ্যবইয়ের সেরা উদাহরণ।”[41]

এখন কথা হল, এখানে পরমেশবাবু সচেতনভাবে দুটি তথ্য লুকিয়েছেন। অবশ্য এই তথ্যবিকৃতি এবং তথ্যগোপনের অভ্যাসটি বিদ্যাসাগরের প্রায় সমস্ত সমালোচকদেরই আছে, এঁরা স্রেফ সেই তথ্যগুলিই প্রকাশ করেন যা তাঁদের ন্যারেটিভের সঙ্গে খাপ খায়। তথ্যদুটি হল, এক: বর্ণপরিচয়ের দুটি ভাগেই ঈশ্বর সম্বন্ধীয় একটিও শব্দ নেই, এবং  দুই: বিদ্যাসাগরের সমকালেই মার্ডক বিদ্যাসাগরকে কেবলমাত্র মেটেরিয়ালিজম নয়, বস্তুত র‍্যাঙ্ক মেটেরিয়ালিজমের দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মার্ডক স্পষ্টভাবে বিদ্যাসাগরকে সেকিউলারিস্ট, না-ধর্মী মনোভাবের লোক বলে অভিযুক্ত করেছিলেন। এর একটাই কারণ হতে পারে, তিনি বোধোদয়ের যে সংস্করণটি পড়ে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন তা ছিল নিঃসন্দেহে ঈশ্বরবর্জিত।

এইখানে রেভারেন্ড জন মার্ডক সম্বন্ধে একটুখানি আলোচনা আবশ্যক। তিনি বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক এক ইংরেজ পাদ্রি। লন্ডনের ক্রিশ্চান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। পঞ্চাশ বছরের উপর ভারতে কাজ করেন, লেখেন শতাধিক পুস্তক। মূলত দক্ষিণ ভারত তাঁর কার্যক্ষেত্র হলেও বঙ্গদেশ নিয়েও তাঁর আগ্রহের কমতি ছিল না। ১৮৫৮ সালের ডিসেম্বরে মার্ডক কলকাতায় এলে সোসাইটির বাংলা বিভাগের দায়িত্ব মার্ডকের উপর পড়ে। বাংলা হরফ নিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপও ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ) এবং ‘বোধোদয়’ বই দুটি নিয়ে তিনি রীতিমত জেহাদ আরম্ভ করেন বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে। ‘বিদ্যাসাগরের চুড়ান্ত বস্তুবাদ আর না-ধর্মীয় ভাব’ প্রবন্ধে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন—

বইদুটির বিষয়ে তাঁর প্রথম এবং প্রধান আপত্তি: এতে ‘চুড়ান্ত বস্তুবাদ’ (র‍্যাঙ্ক মেটেরিয়ালিজম) শেখানো হয়, আর এগুলির শিক্ষা শুধু না-ধর্মী (সেকিউলার) নয়, এগুলি একজন না-ধর্মী মতবাদী (সেকিউলারিস্ট)-এর লেখা।[42]

আসুন, মার্ডকের অভিযোগগুলি এক এক করে দেখা যাক।

১৮৭১ সালে মার্ডক বাংলা স্কুলগুলিতে প্রচলিত পাঠ্যপুস্তক সম্বন্ধে একটি পুস্তিকা লেখেন। এতে বর্ণপরিচয় ও বোধোদয় সম্পর্কে মার্ডক অভিযোগের বন্যা বইয়ে দেন। প্রথমটি বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ থেকে—

Nabin, yesterday you abused Bhuban when going home, you are young, you do not know that it is not good to abuse anyone. If you abuse any person, I will tell everybody, and no one will speak to you.[43]

এটি বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগের ১৭ পাঠে অনুবাদ, যাতে বিদ্যাসাগর লিখেছেন—

নবীন কাল তুমি, বাড়ি যাইবার সময়, পথে ভুবনকে গালি দিয়াছিলে। তুমি ছেলে মানুষ, জান না, কাহাকেও গালি দেওয়া ভাল নয়। আর যদি তুমি কাহাকেও গালি দাও, আমি সকলকে বলিয়া দিব, কেহ তোমার সহিত কথা কহিবে না।[44]

মার্ডকের পরবর্তী কোটেশন বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগ হতে—

1. Do not speak bad words to any one at any time. To speak bad words is a great fault. Whoever speaks bad words no one will wish to see him. 2. While you are young, learn your lessons with your whole mind. Everyone will like you if you learn to read and write. No one will like him who is negligent in learning to read and write. Never be negligent in learning to read and write. 3. Always speak the truth. Everyone likes him who speak the truth. Nobody likes him who tells lies. Every one dislikes him. Do not therefore tell a lie at any time. 4. Learn your lesson every day. Do not say, I will prepare it to-morrow. Whatever you postpone, you will not be able to learn. 5. Do not be disobedient to your father and mother at any time. Always do whatever they bid you; do not act otherwise. They will not love you unless you listen to them. 6. Boys without sense play all day long, and do not pay attention to reading and writing. On these accounts they are always a trouble. Whoever learns his lessons diligently will always be happy.[45]

এবার আমরা বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয়ভাগ থেকে দেখি বিদ্যাসাগর কী লিখেছিলেন—

(১) কখনও কাহাকেও কুবাক্য কহিও না। কুবাক্য কহা বড় দোষ। যে কুবাক্য কহে, কেহ তাহাকে দেখিতে পারে না। (২) বাল্যকালে মন দিয়া লেখাপড়া শিখিবে। লেখাপড়া শিখিলে, সকলে তোমায় ভালবাসিবে। যে লেখা পড়ায় আলস্য করে, কেহ তাহাকে ভালবাসে না। তুমি কখনও লেখা পড়ায় আলস্য করিও না। (৩) সদা সত্য কথা বলিবে। যে সত্য কথা কয়, সকলে তাহাকে ভাল বাসে। যে মিথ্যে কথা কয়, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না, সকলেই তাহাকে ঘৃণা করে। তুমি কখনও মিথ্যা কথা কহিও না। (৪) নিত্য যাহা পড়িবে, নিত্য তাহা অভ্যাস করিবে। কল্য অভ্যাস করিব বলিয়া, রাখিয়া দিবে না। যাহা রাখিয়া দিবে, আর তাহা অভ্যাস করিতে পারিবে না। (৫) কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইও না। তাঁহারা যখন যাহা বলিবেন, তাহা করিবে। কদাচ তাহার অন্যথা করিও না। পিতা মাতার কথা নস শুনিলে, তাঁহারা তোমায় ভালবাসিবেন না। (৬) অবোধ বালকেরা সারাদিন খেলিয়া বেড়ায়, লেখাপড়ায় মন দেয় না। এজন্য তাহারা চিরকাল দু্ংখ পায়। যাহারা মন দিয়া লেখাপড়া শিখে, তাহারা চিরকাল সুখে থাকে।[46]

‘বর্ণপরিচয়’ এবং বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মার্ডক সরাসরি অভিযোগ হেনেছেন—

In the 67 pages which they contain, there does not seem to be a single allusion of God or a future state. Some sentence, it is true, would seem to recognize what Lord Stanley called ‘the eternal principles of justice’, but the grand argument against telling lies and using bad words, is that a boy will be disliked by others if he does. What low miserable morality to be taught in a Christian school! … Missionaries, above all other men, are bound not to teach such a doctrine in their schools. … The phrase what ‘low miserable morality’ must be understood in the connection in which it occurs. Instead of being too strong, the reverse is the case. It may be characterised as an ATHEISTIC MORALITY. This is the most fitting epithet to be applied to moral teaching which ignores God and a future state.[47]

রামকৃষ্ণবাবুর বঙ্গানুবাদের ভাষায়—

ওই নৈতিকতাকে বরং নিরীশ্বরবাদী নৈতিকতা বলে চিহ্নিত করা যায়। ঈশ্বর ও পরকালকে যে নৈতিক শিক্ষা অগ্রাহ্য করে এ-ই তার সবচেয়ে উপযুক্ত অভিধা।[48]

রামকৃষ্ণবাবুর মতে, “মার্ডক এরপর একটি দামি কথা বলেন: ‘বলা হয়েছে যে কোনও লেখকের মতামত তাঁর মৌলিক রচনা থেকেই সবচেয়ে ভালো জানা যায়।”[49] “It has been stated that an author’s views can best be known from his original compositions.”[50] বর্ণপরিচয় বিদ্যাসাগরের মৌলিক রচনা এবং তাই এতে নিরীশ্বরবাদ এত প্রকট হয়ে উঠেছে।

চেম্বার্স প্রকাশনের ‘দ্য রুডিমেন্টস অফ নলেজ’ অবলম্বনে লিখিত বোধোদয় পুস্তকটি নিয়েও বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মার্ডক প্রায় একই ধরনের অভিযোগ এনেছিলেন।

Some indications are also afforded by the manner in which he omits passages in books which he translates.[51]

মার্ডক কয়েকটি উদাহরণও দিয়েছেন। এর মধ্যে একটির বঙ্গানুবাদ আগেই আমরা দেখেছি, “It is our duty to love God and pray to him and thank him for all his mercies.”[52] অর্থাৎ, “অতএব ঈশ্বরকে ভক্তি, স্তব ও প্রণাম করা আমাদিগের কর্ত্তব্য কর্ম্ম।”[53] সম্ভবত বোধোদয়ের পঞ্চম সংস্করণ থেকে এই বাক্যটি চিরতরে বর্জিত হয়। মার্ডকের পরবর্তী উদাহরণটি দেখবার আগে বোধোদয়ের ‘মানবজাতি’ শীর্ষক অধ্যায়ের নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি পড়া যাক—

জন্তু সকল মরিলে তাহাদের শরীরে প্রাণ ও চেতনা থাকে না। তখন উহারা আর পূর্ব্বের মত দেখিতে, শুনিতে, চলিতে, বলিতে কিছুই পারে না; কেবল অচেতন স্পন্দহীন জড় পদার্থ মাত্র পড়িয়া থাকে। মৃত শরীর বিশ্রী বিবর্ণ হইয়া যায়; দেখিলে অত্যন্ত অসন্তোষ জন্মে: এই জন্যে লোকে অবিলম্বে তাহা দাহ করে। কোন কোন জাতি দাহ করে না, মাটিতে পুতিয়া ফেলে।[54]

এবার ওই অংশটি রুডিমেন্টস অফ নলেজ গ্রন্থে কিভাবে আছে মার্ডক তা দেখিয়েছেন, আসুন আমরাও দেখি—

When a body is dead, all its life is gone. It cannot see or feel, or move; it is an inanimate object, and is so unpleasing to look upon, that it is buried in the ground, where it rots into dust, and is no more seen on earth. But although the bodies of mankind die and are buried, they have SOULS which live for ever, and which are given up to God who gave them.[55]

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগর রুডিমেন্টসের ভাববাদী অংশটুকু অর্থাৎ পরলোক বা আত্মা বর্জন করেছেন।

বিদ্যাসাগর দ্বারা এই জাতীয় ঈশ্বর-আত্মা-পরলোক বর্জনের গণ্ডাখানেক উদাহরণ মার্ডক দিয়েছেন। আর একটি উদাহরণ হল, রুডিমেন্টসে ‘ইন্দ্রিয়’ শীর্ষক অধ্যায়ের শেষের দিকে লেখা ছিল—

Mankind are called rational or reasoning beings, in consequence of having minds to reflect on what they see and do. They are also called responsible or accountable beings, because they have souls, which are accountable to God for actions done during life.[56]

মার্ডকের অভিযোগ, বিদ্যাসাগর ওই অনুচ্ছেদটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দিয়ে স্রেফ নিম্নলিখিত অংশটি রেখেছেন:

এই সকল ইন্দ্রিয় জ্ঞানের পথস্বরূপ। ইন্দ্রিয় পথ দ্বারা আমাদিগের মনে জ্ঞান সঞ্চার হয়। ইন্দ্রিয় বিহীন হইলে আমরা সকল বিষয়েই সম্পূর্ণ অজ্ঞান থাকিতাম। এই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের বিনিয়োগ দ্বারা অভিজ্ঞতা লাভ হয়। অভিজ্ঞতা লাভ হইলে, ভাল, মন্দ, হিত, অহিত বিবেচনার শক্তি জন্মে। অতএব ইন্দ্রিয় মনুষোর অশেষ উপকারক।[57]

রামকৃষ্ণবাবুর ভাষায়—

বিদ্যাসাগরের এই কথাগুলিই মার্ডক-কে অত উত্তেজিত করে তুলেছিল। ঈশ্বরের আদেশ বা ধর্মোপদেশ নয়, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানই নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভিত্তি— বিদ্যাসাগর প্রকারান্তরে এই কথাই বলতে চেয়েছিলেন। মার্ডক সেটি ধরতে ভুল করেননি।[58]

১৮৭২ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকায় মার্ডক আবার লিখলেন—

The above taken in connection with the passages previously omitted, seem to teach rank materialism. It has been asserted that it is ‘misleading’ to characterize such book as ‘Secularist’. The author is described as ‘the well-known Hindu reformer’. But this is no proof of the contrary. His reforms are purely social. So far as the writer is aware, he has kept himself entirely aloof from the Brahmo Somaj movement. … The writer described above books not simply as prepared by a Secularist, but as Secularist. He did so because, the author deliberately struck out the injunction to worship God; because his moral teaching has no reference to God’s will, but simply to what people around would think or do, because he omitted all passages teaching the immortality of the soul, the responsibility of man, and the difference between him and the brutes that perish. If it is ‘misleading’ to describe such books as ‘Secularist’, the writer confesses that he does not know the meaning of the term.[59]

পরমেশ আচার্য এবং অচিন্ত্য বিশ্বাস আদৌ কি পড়েছেন মার্ডকের এই বক্তব্য?

বিষয়টি এবার গুটিয়ে আনলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, মার্ডকের মতে বর্ণপরিচয় এবং বোধোদয় বইদুটি কেবলমাত্র সেকিউলার তাই শুধু নয়, লেখকও আদ্যোপান্ত সেকিউলারিস্ট। এছাড়াও—

(১) ঈশ্বরকে উপাসনার যে বিধান আছে (চেম্বারস্-এর দ্য রুডিমেন্টস অফ নলেজ-এ), বিদ্যাসাগর স্বেচ্ছায় সেগুলি কেটে দিয়েছেন, (২) তাঁর নৈতিক শিক্ষায় ভগবানের ইচ্ছার কোনও উল্লেখ নেই, শুধু আছে চারধারের লোক কী ভাববে ও করবে তার কথা, (৩) আত্মার অমরত্ব সংক্রান্ত সব অংশ তিনি বাদ দিয়েছেন, আর সেই সঙ্গে বাদ দিয়েছেন মানুষ ও পশুদের তফাত, যে পশুরা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বংস হয় (অর্থাৎ যাদের অমর আত্মা বলে কিছু নেই)। এরপর ক্ষুব্ধ চিত্তে মার্ডক বলেন, ‘এই ধরনের বইকে সেকিউলারিস্ট বলা যদি বিভ্রান্তিকর হয়, লেখক (মার্ডক) স্বীকার করছেন, তিনি জানেন না, শব্দটির অর্থ কী।’[60]

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


[1] পৃষ্ঠা ৬৭, বিদ্যাসাগর চরিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৯৩
[2] পৃষ্ঠা ১৯১-১৯২, রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গ্রন্থমেলা, ১৯৫৭
[3] পৃষ্ঠা ৪৪৪, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১
[4] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫৫
[5] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪৪
[6] পৃষ্ঠা ৩৪৫-৩৪৬, বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯০৯
[7] পৃষ্ঠা ১০০, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, অমিয় কুমার সামন্ত, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৬০
[8] পৃষ্ঠা ৪৮, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৩
[9] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২৭
[10] পৃষ্ঠা ২৯৩, পুরাতন প্রসঙ্গ, বিপিনবিহারী গুপ্ত, বিদ্যাভারতী, ১৯৫২
[11] পৃষ্ঠা ৬৭, উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গলার নবজাগরণ, সুশীলকুমার গুপ্ত, এ মুখার্জী এ্যান্ড কোং, ১৯৫৯
[12] পৃষ্ঠা ৭০, কলিকাতা দর্পণ দ্বিতীয় পর্ব, রাধারমণ মিত্র, সুবর্ণরেখা, ২০০৪
[13] পৃষ্ঠা ১৩১, পুরাতন প্রসঙ্গ, বিপিনবিহারী গুপ্ত, বিদ্যাভারতী, ১৯৫২
[14] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩১-১৩২
[15] পৃষ্ঠা ৫৩৯, বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯০৯
[16] পৃষ্ঠা ১০৪, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, অমিয় কুমার সামন্ত, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৬০
[17] পৃষ্ঠা ৫৫৫, বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ, বিনয় ঘোষ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান, ২০১১
[18] পৃষ্ঠা ৪৮, বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯০৯
[19] পৃষ্ঠা ৩৮২, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[20] পৃষ্ঠা ৪৮, বিদ্যাসাগর চরিত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, ১৯৯৩
[21] বিদ্যাসাগর: একালের নিরিখে, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, মার্চ, ২০২০
[22] পৃষ্ঠা ৫৩, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৩
[23] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৬
[24] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১৯
[25] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪২
[26] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৮
[27] পৃষ্ঠা ১০০, প্রসঙ্গ বিদ্যাসাগর, অমিয় কুমার সামন্ত, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৫৯
[28] পৃষ্ঠা ৯৭, বাঙালী প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[29] পৃষ্ঠা ২, বোধোদয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত যন্ত্র, ১৮৫২
[30] পৃষ্ঠা ৯৮, বাঙালী প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[31] পৃষ্ঠা ১১, স্বস্তিকা, ৭২ বর্ষ ২০ সংখ্যা, ২০শে জানুয়ারি, ২০২০
[32] পৃষ্ঠা ১০১, বাঙালী প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[33] পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪, ভার্নাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল ফ্রম ১৮১৩ টু ১৯১২, হারবার্ট অ্যালিক স্টার্ক, ক্যালকাটা জেনারেল পাবলিশিং কোম্পানি, ১৯১৬
[34] বিদ্যাসাগর, নাস্তিকতা ও মদীয় আচার্যদেবগণ প্রসঙ্গে শেষ কয়েকটি কথা, দেবাশিস ভট্টাচার্য, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, নভেম্বর ২০২০
[35] বিদ্যাসাগর: একালের নিরিখে, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম, মার্চ ২০২০
[36] পৃষ্ঠা ১৭৭, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ প্রথম খণ্ড, গোপাল হালদার সম্পাদিত, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২
[37] পৃষ্ঠা ৫৪০, বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান প্রেস, ১৯০৯
[38] পৃষ্ঠা ৩৩৬, বিদ্যাসাগর, মনি বাগচি, প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরি, ১৯৫৭
[39] পৃষ্ঠা ৪০৫, বাণী ও রচনা নবম খণ্ড, স্বামী বিবেকানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬০
[40] পৃষ্ঠা ১৫৫, বিদ্যাসাগর, বিহারীলাল সরকার, নবপত্র প্রকাশন, ১৯৬১
[41] পৃষ্ঠা ৬৩, বাঙালী প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ, ২০১৫
[42] পৃষ্ঠা ১৫, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক, ২০২০
[43] পৃষ্ঠা ৭৯৬, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[44] পৃষ্ঠা ২৭২, বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী প্রথম খণ্ড, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, রঞ্জন পাবলিশিং হাউস, ১৯৩৯
[45] পৃষ্ঠা ৭৯৬-৭৯৭, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[46] পৃষ্ঠা ২৮০, বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী প্রথম খণ্ড, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, রঞ্জন পাবলিশিং হাউস, ১৯৩৯
[47] পৃষ্ঠা ৭৯৭, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[48] পৃষ্ঠা ১৮, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক, ২০২০
[49] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ‍১৮
[50] পৃষ্ঠা ৭৯৭, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[51] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৯৭
[52] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৯৭
[53] পৃষ্ঠা ২, বোধোদয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত যন্ত্র, ১৮৫২
[54] পৃষ্ঠা ১৮২, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ প্রথম খণ্ড, গোপাল হালদার সম্পাদিত, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২
[55] পৃষ্ঠা ৭৯৮, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[56] প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৯৮
[57] পৃষ্ঠা ১৮৪, বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ প্রথম খণ্ড, গোপাল হালদার সম্পাদিত, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, ১৯৭২
[58] পৃষ্ঠা ১৯, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক, ২০২০
[59] পৃষ্ঠা ৭৯৮-৭৯৯, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৫৯
[60] পৃষ্ঠা ২১, জন্মদ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর, সৌরভ রঞ্জন ঘোষ সম্পাদিত, সংবর্তক, ২০২০