দুর্জয় আশরাফুল ইসলাম
‘অনাহার, ফলাহার, স্নান, আমরা সব হাঁটছি/ আমাদের বিনাশ আমাদের পাশে-পাশে হাঁটছে’। একদিন এমন আসে, ঘুম ভাঙতেই চৈতন্যে আসে অনন্ত ঘুমের কথা। যেন ঘুমই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য, যেহেতু জেগে থাকা ক্ষণিকের মাত্র, ঘুমই চূড়ান্ত বিনাশ। কিংবা বিনাশের পথ। তবুও মায়া থেকে যায়। কার জন্য, আমি যারে দেখি নাই তবুও দেখেছি সমূহ শব্দের বসন্তবেলায়, অগাধ রাত্রির দেশে যে আমাকে শুনিয়েছে প্রকৃত বন্ধুর কথা।
চলে গেলে যদি মনে হয় ভেতরে কিছু চুরমার, তখন সত্যিই চেনা কেউ যায়, তখন শব্দেরা নিখোঁজ হয়, ব্রহ্মাণ্ডে বিস্তর নীরবতা, কান্না নয় তবুও কান্না মুহূর্ত, যেন কেউ অতি বিষণ্ণ এক ফ্রেম খুঁজেছে বলে থামিয়ে দিয়েছে ঘড়ির কাটা। এমনই হল, অন্তর্জালে যখন গৌতম বসুর প্রস্থানের কথা, প্রথমে অবিশ্বাস পরে অসহায় এক মুহূর্ত এল।
কতদিন হল, কবিতায় তাঁকে জানা, সম্ভবত এক দশক, সম্ভবত মহাবাহু, এবং তারও আগে প্রবাদপ্রতিম সে জলের অন্য সংজ্ঞায়ন, ‘এই জল প্রকৃত শ্মশানবন্ধু, এই জল রামপ্রসাদ দেন’। এরপর তার লেখা এবং না-লেখার শক্তির প্রতি অগাধ এক মুগ্ধতার এক দশক, মনে আছে তপন রায় যখন কবিতা নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চান তখন তাঁর উত্তর, ‘এই প্রশ্নের ফাঁদে আমি পা দিচ্ছি না। কিছু প্রসঙ্গ আছে যার আশেপাশে ঘোরা যায় কিন্তু ছুঁতে নেই। ছুঁলেই তাদের শুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায়।’ এত প্রখরতা একজন কবির, যিনি চাইলেই একটা মোড়ক দিতে পারেন কবিতার, এবং গানের প্রতি তার মুগ্ধতা, কেননা নিজেও ততদিনে সমস্ত অসহায়ত্বে জেনেছি সুর আশ্চর্য এক মহৌষধ। তারপর এদিক সেদিক থেকে খুঁজে নিয়ে অল্পপাঠ, এবং সমগ্রের সন্ধানে এ-শহর ও-শহর করে পাশের বিদেশে সংযোগ, অথচ হাতে এলে ভাবি এত অল্প, এবং তাতে কী পড়িনি! তার কবিতা যেরকম আশ্চর্য পরিমিত, সংখ্যায়ও তাই হতে হবে!
অথচ তিনি পথপ্রদর্শক, বাংলা কবিতার একটি দিশা। এই সত্য দিন যত যায় ততই স্পষ্ট হতে থাকে। সমস্ত আলোকের থেকে আড়ালে থেকে জ্ঞান অন্বেষণের দিকে তাঁর যে ঝোঁক, তার প্রতিভূ হয়ে যেসব কবিতা তাকে অস্বীকার করার সাহস কে রাখে! এত অল্পতে আর কে লিখতে পারে গঙ্গানারায়ণপুর, এমনকি রসাতল গ্রন্থে বিভাব হয়ে আবার যখন গঙ্গানারায়ণপুর আরও পরিসর পায় তখনও মনে হয় তৃষ্ণা মেটেনি, এত আঁটসাঁট বুনন তার। কবি মাত্রই ভ্রমণচারী হন, সে বাস্তবিক কিংবা অন্তর্দৃষ্টিতে, পরেরটি মানে স্মৃতিপ্রখরতা। বাংলা কবিতায় আরও কজন দিগ্গজ ছিলেন দ্যাখার অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, কিন্তু নিজের ব্যক্তিগত বোধকে মিলিয়ে দিয়ে তার যে দেখা, ‘তোমার পালকের, তোমার স্পর্শ না পাই, এ-জানালায় হাত রাখি/ একটি গহন স্বরের মৃত্যুর ও জন্মের দেখা যেন মেলে, মনে-মনে।’ তা পাঠকেরও হয়ে উঠছে এ অসামান্য তৈরি তার সৃষ্টিজুড়ে। পড়ার সময় এত সহজাত অথচ নির্মাণের এত অসাধারণত্ব খুব বেশি নেই বাংলা কবিতায়, আরেকটি কবিতা মনে পড়ল, ‘এমন সুখের অনুভব এমন যে ব্যথা/ এমন অশ্রুর বনে নেমে-আসা দৈব আলো/ অমল সে দুঃখরাতে তুমি আত্মহারা মেঘ/ এমন যে মরণকালের তরণী, রসুল।’ আমার বারান্দাজুড়ে বৃষ্টি নামল, বর্ষা এসে গেছে দিনপঞ্জি ধরে কদিন হল, তারপর নিয়ম করেই, এই পড়ন্ত জলধারা, আকাশ থেকে যে নেমে আসে, তারা জানে এই কবিতার কথা, আমার একাত্মতা। একাত্ম যে আরও কত আর হয়েছি তার পঙক্তির সাথে, যখন তিনি লিখেছেন ‘কথা ফুরাবার আগে নীরবতায় রূপান্তরিত হও’। আমি, আমরা পারিনি তবুও কথা কেন ফুরিয়ে যায় কিংবা জীবনধর্মে অন্তরীক্ষের যে ছিদ্র তার পাশে নিজের অবস্থানও তার কবিতা থেকেই নিয়েছি কতবার— ‘আমি আগুনের চেয়েও নিরুপায়, জ্বলি’।
এমন দুঃখের ঘনঘোর মুহূর্ত, একটা ক্রান্তি নিজের সম্মুখেও, অথচ কি যে অস্ফুট আমি, তবুও কেন যে নিজেকে বলি, যা কিছু সুন্দর ফুরিয়ে আসে ক্রমে…। অথবা অন্য কিছু এ দুঃখলগ্নে, তারই কথামতো, ‘শেষতম কথাগুলি এবার নিবেদন করি নিভৃতে’। বৃষ্টির শব্দ এখানে, বোধকরি অন্যবঙ্গেও, কেননা আমাদের যা কিছু হারায় তা ভেসে যায় বৃষ্টিজলে। অথবা কথা নেই কোনো, অনুভবশূন্য এক দৃশ্যাবতরণ, কুয়াশারূপ পরিচ্ছদে হাহাকার ধরায়। তারই মাঝে অকস্মাৎ কটি লাইন মনে আসে। গৌতম বসুর কলমে, গদ্যসংগ্রহের এক গদ্য এবং শেষপ্রচ্ছদে তারই উদ্ধৃতি অংশ, বোধকরি কবি নিজেই নির্বাচন করেছেন এটুকু, ‘ধীরে, মৃদুভঙ্গিসহিত অশ্বচালনা ক’রো, দম্ভভরে নয়, দ্রুতগতিতেও নয়; মনে রেখো,/ সহস্য প্রয়াত মানুষের দেহাবশেষ তোমার পায়ের তলে,/ মাটিতে সমাধিস্থ।‘ ঔরঙ্গজেব তাঁর পুত্রকে চিঠিতে লিখেছিলেন।
বুঝতে পারি একটা দিশা হয়ে অতিশয় নিরহঙ্কার তাঁর জ্ঞানলব্ধ, সারাজীবনব্যাপী তা লালন করে গেছেন নিজে। এইসব বলি, বলতে বলতে শামিল হই এক চিরন্তন যাত্রায়, যে যাত্রার বিবৃতি বলা আছে তারই কবিতায় ‘কিছু হরিধ্বনি, ভাড়া-করা বাজনদারদের পিছনে/ অবিরাম ছুটে চলেছি, সাক্ষী রইল পথের ভাঙন/ শোনো শূন্যস্থান, শোনো দিনান্ত ছায়া, ভৌতিক বৃক্ষরাজি।’ আমরা জানি চিত্রটুকু হুবহু এমন নয়, পেছনে যারা ছুটে চলেছে, আমি কিংবা আমারও অগ্রজ, আমাদের পাশে আরও ছায়ারূপ, একীভূত বেদনায়, একটা শূন্যতা নিয়ে, এমনকি বাংলা কবিতাও, কেননা বাংলা কবিতার জন্য এ শূন্যস্থান অনস্বীকার্য। এ অনস্বীকার্য মূল্যায়নটা ধরা আছে কবি অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের ভাষ্যে ‘…সেদিন যদি সত্য সত্যই আসে কোনোদিন, তবে সেই যুগান্তপারের হে পাঠক, হে পাঠিকা, আমরা নিশ্চিত জানি, যে, শ্রী গৌতম বসুর পদপ্রান্তে, তোমাদের সেদিন, কৃতজ্ঞচিত্তে, প্রণত হইতেই হইবে।’