রূপশ্রী সরকার
লেখক বামপন্থী গণআন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী
১৪ জুন ২০২১। বেলা এগারোটা।
শর্মিষ্ঠা, আজ তোমায় শেষবারের মতো বিদায় জানালাম।
তোমার সঙ্গে পরিচয় কবে হয়েছিল আজ আর মনে পড়ে না। সম্ভবত দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের সময়, এক রাতের অন্ধকারে সেই ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদ জানাতে আমরা যেদিন পথে নেমেছিলাম। কিংবা হয়ত তারও আগে। অনেকটা সময় বিভিন্ন লড়াই সংগ্রামের মধ্যে এক সঙ্গে থাকতে থাকতে রাজনৈতিক মতভিন্নতা সত্ত্বেও কখন যেন আমরা খুব কাছাকাছি চলে আসি। আমি তোমার দল (সিপিআই-এমএল রেড স্টার)-এর কেউ না হওয়া সত্ত্বেও আমরা একে অপরের উপর ভরসা করতে পারতাম। এই কাছে আসাটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বাইরের সবাই হয়ত বুঝতেও পারে না। কোথায় যেন তোমাকে ভরসা করি, শ্রেণিসংগ্রাম বা নারীমুক্তির প্রশ্নে, কখনও আবার পুলিশি আক্রমণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য। খুব মনে পড়ে, একটি ঘটনার কথা, যেখানে শাসকের পুলিশ এক সমাজকর্মীর বাড়িতে হানা দেয় নির্দিষ্ট কোনও কারণ না থাকলেও। তুমি এ কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে একটি দল তৈরি করে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে গিয়ে তীব্র প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিলে। এই যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তার বাস্তবায়ন, সেদিন আমার তা এক কথায় অসাধারণ লেগেছিল।
বা কেন্দ্র রাজ্যের যৌথ আধাসামরিক বাহিনির হাতে আদিবাসী নারীদের হেনস্থা হচ্ছে, খবর পেয়েই শর্মিষ্ঠা তুমি সঙ্গে সঙ্গে fact finding-এ যেতে প্রস্তুতি নিয়েছিলে। আমরা আটজন বেলপাহাড়ির বেহুলা গ্রামে গিয়ে ঘটনার অনুসন্ধান করে যৌথ বাহিনি দ্বারা আদিবাসী রমণীদের ধর্ষণের খবর জনসমক্ষে নিয়ে আসি, তাতেও তোমার ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। আমরা একই রাজনীতি না করলেও বন্দিমুক্তি আন্দোলন বা শাসকের যে কোনও আক্রমণের বিরুদ্ধে যৌথ গণআন্দোলনে যেতে তুমি কখনও দ্বিধা করোনি। কেন না, তুমি ছিলে সত্যিকারের অর্থে গণআন্দোলনের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী এবং নেত্রী। যে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে তুমি তৎক্ষণাৎ সময় দিয়েছ শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও।
মনে পড়ে যাচ্ছে, ভাঙরের পাওয়ার গ্রিড-বিরোধী আন্দোলনে তোমার নেতৃত্বে শাসক ভীত হয়ে তোমাকে ও অন্যান্যদের ইউএপিএ প্রয়োগ করে জামিন-অযোগ্য ধারাতে গ্রেপ্তার করে। রাজ্য সরকারের তরফে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এতটাই তীব্র ছিল যে তোমাদের আদালতে তোলার সময় “মুক্তি চাই” ধ্বনি দেওয়ার কারণে শাসক দলের গুন্ডাবাহিনী জনৈক মানবাধিকার কর্মীকে ঘিরে ধরে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। পরে আলিপুর মহিলা সংশোধনাগার থেকে জামিনে মুক্ত হবার পরে, বাইরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে তোমার সেই নির্মল, মুক্ত হওয়ার আনন্দ হাসি, আমার সারা জীবন মনে থাকবে। লুমটেকস জুট মিল শ্রমিক আন্দোলনেও তোমার ভূমিকা মনে থাকবে সকলের।
পাশাপাশি, শ্রেণিবিভক্ত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর সাম্য, নারীর স্বাধীনতা, নারীর অধীকার, নারীর সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে তোমার ভূমিকা তুলনাহীন। সমাজের যে কোনও স্তরের নারীর ওপর যে কোনও ধরনের অবমাননা বা হিংসার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠতে তুমি। এমনকি, যে কোনও সংগঠনের মধ্যে ঘটে যাওয়া অপ্রকাশ্য নারীনির্যাতন বা যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধেও তোমার কণ্ঠস্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হত। বঞ্চিত, নিপীড়িত নারী তাই আজ তার এক প্রকৃত বন্ধু, সহযোদ্ধাকে হারাল। তোমার মতো বলিষ্ঠ আর একজন নারী চরিত্র, আর একজন কমিউনিস্ট নেত্রীকে পেতে আমাদের বহু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
আজ তোমার নিথর দেহের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার চোখে জল আসছিল, আর তোমার ওপর রাগ করছিলাম (প্রথমবার), হ্যাঁ অভিমান, কেন তুমি নিজেকে অযত্ন করেছ? তোমার শরীর আস্তে আস্তে খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে, তুমি খেয়াল করোনি এবং গণমুক্তি আন্দোলনের কত শত কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গেলে। আমরা তো খুব অসহায় হলাম। তবে মনে রাখব তোমার দৃঢ় বক্তব্য, তোমার ধারালো চিন্তা, তোমার সংগঠিত করার ক্ষমতাকে, তোমার সাহসকে, হেলায় সুখের জীবন ত্যাগ করাকে। আজ তোমাকে যা দেখলাম, এ যন্ত্রণা হয়তো একদিন ভুলে যাব।
লাল সেলাম, কমরেড শর্মিষ্ঠা চৌধুরী।