গিয়োম আপলিনের
মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ: সৈয়দ কওসর জামাল
বিশ শতকের শুরুতে শুধু কবিতায় নয়, সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রেও গিয়োম আপলিনের (Guillaume Apollinaire, ১৮৮০-১৯১৮)-এর চিন্তাভাবনার নতুনত্ব একটা যুগের সূচনা করেছিল। কিউবিজম ও সুররিয়ালিজম-এর সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত। তাঁর মধ্যেই পুরোনো ধারার পাশাপাশি নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটেছে। তাঁর জন্ম রোমে, প্যারিসে আসেন বিশ বছর বয়সে। কবিতায় পরীক্ষাধর্মিতা তাঁর বৈশিষ্ট্য। সে সময়ের শিল্পী ও কবিদের সঙ্গে তাঁর তুমুল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯১৪-তে ফরাসি নাগরিক হওয়ামাত্র তাঁকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পাঠানো হয়। ১৯১৭ সালে মাথায় বোমার টুকরোর আঘাত পান। এই শারীরিক আঘাত আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সের জীবন। যুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রেমের কবিতাতেও তিনি সমানভাবে উজ্জ্বল। বেঁচে থাকাকালীন তাঁর প্রধান কাব্যগ্রন্থ— ‘আলকুল’ (১৯১৩), ‘কালিগ্রাম’ (১৯১৮)। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে ‘পোয়েম আ লু’ (১৯৪৭)। অনূদিত কবিতাগুলি কবির Alcools ‘আলকুল’ (সুরাসার) কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছে। আপোলিনের তাঁর কবিতায় কোনও ধরনের যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি।
অ্যানি
(Annie)
টেক্সাসের উপকূলে
মোবাইল আর গালভেস্টনের মধ্যে
আছে এক গোলাপবাগান
তার সঙ্গে আছে একটি বাড়ি
খুব বড় গোলাপবাগান
এক নারী প্রায়ই বাগানে আসেন হাঁটতে একা একা
এবং যখনই আমি ওই পথে লেবুগাছের পাশ দিয়ে যাই
একে অপরকে দেখি
মেনোনিট প্রোটেস্ট্যান্ট নারীটির
গোলাপ এবং পোশাকের মধ্যে কোনও
বোতাম থাকে না
আমার জ্যাকেটও দুজায়গায় বোতামবিহীন
ভদ্রমহিলা ও আমি একই আচার অনুসরণ করে চলি
এক বছর আগে লতার-এ গান গেয়েছিল ওবাদ
(Aubade chantée à Laetare un an passé)
পাকেত-এ বসন্ত এসে গেছে
মনোরম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটো
পাখিদের উঠোনের মধ্যে চিকচিক শব্দ উঠছে
আকাশে ভোরের বিভা কয়েকপ্রস্থ গোলাপি রঙের
ভালোবাসা হেঁটে যায় তোমার বিজয়ে
মঙ্গল ও শুক্রগ্রহ ফিরে আসে
পাগলের মতো তারা চুমু খায় খোলামেলা স্থানে
যেখানে গোলাপ পাতার নীচে
সুন্দর গোলাপি দেবতারা নগ্ন হয়ে নাচে
এসো আমার কোমলসত্তা উদ্ভাসিত কুসুমপ্রতিভূ
প্রকৃতি সুন্দর আর স্পর্শকাতর
জঙ্গলে গহ্বর থেকে উঠছে বাষ্পবিষ
গান গাইছে জলে ভেজা ব্যাং
গোধূলি
(Crepuscule)
কুমারী মারি লোরেনম্যাঁ-কে
মৃতদের ছায়া এসে
এখানে ঘুরেছে এই ঘাসে ওপর
যেখানে দিনের শেষ
ভাঁড় চরিত্রটি নগ্ন হয়েছে এখানে
পুকুরের জলে দ্যাখে নিজের শরীর
গোধূলির ভানকারী ভণ্ড এসে
স্তুতি করে সেইসব কলা যা যা প্রদর্শিত হবে
আকাশের গায়ে কোনো দাগের চিহ্ন নেই
দুধসাদা নক্ষত্রখচিত
মঞ্চ থেকে ম্রিয়মান ভাঁড়
প্রথমে অভিবাদন করে দর্শকের দিকে
বোহেমিয়া থেকে আসা কয়েকজন জাদুকর
কিছু পরি আর কিছু বিমোহিতকারী
কক্ষচ্যুত করে একটি তারা
দুহাত বাড়িয়ে ধরতে চায়
ওদিকে ফাঁসিতে চড়া মানুষটির পা
সময়মতো বীণায় আওয়াজ তোলে
অন্ধ লোকটি ফুটফুটে বাচ্চাটিকে দোলা দেয়
হরিণীটি তার আনন্দ প্রকাশ করে চলে যায়
বামন মানুষটি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে দ্যাখে
কেমন জাদুস্বভাবে বেড়ে উঠছে ভাঁড়
জিপসি
(La tzigane)
জিপসিটি আগেই জেনেছিল
আমাদের এ দুটি জীবন রাতে তারকাগ্রথিত
আমরা তাকে বলেছি বিদায়
তারপর গহীন কূপের থেকে আশার যাত্রা শুরু
ভালোবাসা নৃত্যরত প্রশস্ত ভালুক
নেচেছে সে যখনই চেয়েছি
নীলরঙা পাখি হারায় পালক
আর ভিখারিরা হারিয়েছে সব পথ
ভালো জানি হতভাগ্য আমরা
অথচ রাস্তায় ভালোবাসারূপী আশা
আমাদের হাতে হাত রেখে ভাবতে শিখিয়েছে
জিপসিটি কী ভবিষ্যৎ দেখেছিল সবার আগেই
শিকারি সিং
(Cors de chasse)
আমাদের এই গল্প যেমন মহান তেমনি বিয়োগান্তক
অত্যাচারীর মুখ ভেঙানোর মতো
কোনও নাটকের কিংবা জাদুর সুযোগবিহীন
বিশদে বলার কিছু নেই উদাসীন হওয়া ছাড়া
আমাদের প্রেম যা ছিল মহৎ অতি শোচনীয়
ভাবুন টমাস ডিকোয়েন্সিকে
আফিম খেলেন বিষকে মিষ্টি ভেবে
হতভাগ্য সে অ্যান দেখেছেন অনেক স্বপ্ন আর
আমরা এগোই এগিয়ে চলেছি
কেননা সবাই চলে যাবে যেতে হবে
আমি প্রায়শই ফিরব এখানে
স্মৃতিরা শিকারি শিংগুলো হায়
বায়ুর সঙ্গে তাদের লিখন একদিন মরে যায়
বিদায়
(Adieu)
সঞ্চয় করেছি আমি গুল্মের মঞ্জরি
তুমি মনে রেখো হেমন্তের কাল মৃত
কখনও হবে না দেখা আমাদের আর
সময়সুগন্ধি আর গুল্মের বল্লরী
মনে রেখো দিন যাবে চির অপেক্ষার